অপেক্ষা ১ম_পর্ব

0
2719

অপেক্ষা ১ম_পর্ব
গল্প

নিপাকে হঠাৎ করেই জানানো হলো আজ সন্ধ্যায় পাত্রপক্ষ নাকি ওকে দেখতে আসবে। যত দ্রুত সম্ভব বাসে উঠে সে যেন রওনা দেয় দেশের বাড়ির উদ্দেশ্য। বড় ভাই এর এমনতর কথা শোনার পর নিপা কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। এদিকে সেই ছোটবেলা থেকেই যমের মত ভয় পায় সে তার বড় ভাইকে। আর তাই ভয়ে ভাইকে জিজ্ঞেস করতেও পারেনি পাত্র কে বা কী করে, কোথায় থেকেই বা আসবে তারা। শান্ত স্বভাবের মেয়ে নিপা এমনই।

দুপুর তিনটা নাগাদ দেশেরবাড়ি পৌঁছালো নিপা। বাড়ি পৌঁছেই বেশ খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে মাকে বললো,
-কে আসবে আম্মা, আমাকে দেখতে? কোথাকার মানুষ তারা?কই আগে তো কিছুই বলেননি আমাকে।
নিপার মা’ও মেয়ের মতই শান্ত আর চুপচাপ স্বভাবের মানুষ। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন,
-এসব কী আমি জানি রে’ নিপা! তোর ভাই আর তোর আব্বা জানে। আমাকে কোনদিন তোর আব্বা কোন কিছু জানতে দেয় নাকি দিয়েছি কখনো, বলতো ? আমাকে তো সে মানুষই মনে করে না কখনো। মারে, তুই যতটুকু শুনেছিস, আমিও ততটুকুই জানি। নারে মা, আমি অবশ্য আর একটু বেশি শুনেছি কারণ তোর ভাই সকালেই আমাকে বলেছে, “আম্মা, রাতে পোলাও মাংস রান্না করবেন। নিপাকে দেখতে লোক আসবে। মোটামুটি বিশ পঁচিশ জনের রান্না হয় যেন। খাওয়া দাওয়ার ঘাটতি কমতি হোক তা আমি চাই না”।

নিপা জানে আম্মার কাছে এর থেকে বেশি কিছু জানা যাবে না। কারণ আম্মা জানেই যে অতটুকু !

নিপাকে দেখে বড় ভাই নজরুল আর ওদের আব্বা বেশ খুশি হয়েছে।নজরুল বললো,
-পথে কোন সমস্যা হয়নি তো?
নিপা মাথা নাড়িয়ে বললো,
-সমস্যা হয়নি ভাইয়া। তবে হুট করে আসতে বললেন তো, হুড়াহুড়ি করে বাস ধরবো বলে বাড়িওয়ালি আন্টিকে বলে আসতে পারিনি। উনি আবার কী মনে করবেন!
-বাড়িওয়ালি ! মানে যে মহিলা মেসে থাকিস, সেই বাড়ির মালিকের কথা বলছিস? তো এত টেনশনের কী আছে, উনাকে ফোনে বল বাড়ি এসেছিস জরুরী কাজে। ফিরতে কদিন দেরি হতে পারে।
ভাইয়ের কথায় নিপা চমকে উঠলো।মনে মনেই বললো, “কদিন থাকতে হতে পারে”!
-ভাইয়া আমি কাল সকালেই চলে যাবো। আপনি কদিন থাকার কথা বলছেন কেন? দু’মাস পর আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা।
নজরুল বোনের মাথায় হাত দিয়ে বললো,
-পড়াশোনা তো করবি কিন্তু বিয়ে শাদীও করতে হবে তো! কতদিন বাপ ভাইয়ের বোঝা হয়ে থাকবি ?

নিপা জানে ওর ভাইয়ের সাথে কথা বললে শুধু মন মেজাজই খারাপ হবে। কখনো কেনদিন ভালো কথা ওর ভাইয়ের মুখ থেকে বের হয় না। এমন এমন কথা বলে যে, শেষে বড় ধরণের ঝগড়া বিবাদ লেগে যায়।অশান্তি হয়। আর ওদের আব্বা পুরো সাপোর্ট দেয় প্রিয় ছেলেকে। দুই মেয়ে আর বউয়ের কথার কোন দাম নেই যেন এই বাড়িতে।

নিপার ছোট বোন নিরু। ক্লাস টেনে পড়ে বকুলপুর গার্লস হাই স্কুলে। আজ বোনকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে, এই খুশিতে সে পুরো বাড়িময় ছুটোছুটি করে কাজকর্মে মাকে সাহায্য করছে। ঘরদোর গোছাচ্ছে। এসব কাজে নিরু আবার ভীষণ পটু। অবাক চোখে চেয়ে নিপা ছোট বোনের কান্ড কারখানা দেখছে।কিছুক্ষণ পর মুচকি হেসে বোনকে বলল,
-নিরু পড়ালেখাটা যদি এত মন দিয়ে করতি, তাহলে কত ভালো রেজাল্ট হতো তোর ! এসএসসিতে ভালো ফল করতে হবে, সে মোতাবেক পড়াশোনা কর, বুঝলি?
নিরু বড় বোনের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
-ওসব মেলা মেলা পড়ালেখা আপনি করেন আপা।পড়াশোনা আমার ভালো লাগে না। ইশ আজকে আপনার বিয়ে না হয়ে যদি আমার বিয়ে হতো, তাহলে দারুণই হতো!
বুকের মধ্যে ছ্যাত করে ওঠলো নিপার।
-আমার বিয়ে মানে? আমাকে তো দেখতে আসবে, বিয়ে কেন হবে?
নিরু এক গাল হেসে বললো,
-আপা আপনি এত সুন্দর দেখতে, তার উপর পড়েন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তো পাত্রপক্ষ কোন দিক দিয়ে আপনাকে অপছন্দ করবে, বলেন তো? আমি কিন্তু আপনাকে সাজাবো আজ। যান তো গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নেন। শিক্ষিত মেয়েদের এই এক জ্বালা, রাজ্যের কথা শোনায় পড়া পড়া করে। ধ্যাততেরিকা পড়ালেখার কিছু বলেছি !

নিরু বোনকে সাজাতে বসেছে। এদিকে থেকে থেকেই নজরুল এসে তাড়া দিচ্ছে।
-কিরে হলো নিপাকে সাজানো?
-এই তো ভাইয়া, হওয়ার পথেই। আর একটু থামেন।
নিরু উত্তর দেয় আর মুচকি মুচকি হাসে।

মাগরিবের নামাজের আধা ঘন্টা পরই পাত্রপক্ষের লোকজন এলো নিপাদের বাড়িতে। নিপার আব্বা আর ভাই ব্যস্ত হয়ে গেলো মেহমানদারী করাতে। জনা বিশেক লোক এসেছে ও বাড়ি থেকে।চা নাস্তা খাবার পর পরই পাত্রের বড় চাচা কথা শুরু করলেন।
-মেয়েকে তো আমরা দেখেছি ছবিতে। যথেষ্ট খোঁজ খবরও নিয়েছি মেয়ের ব্যাপারে। এক বাক্যে সবাই বলেছে মেয়ে ভালো।বড় শহরে একা থেকে পড়ালেখা করছে।তবুও কোন খারাপ রিপোর্ট নেই।ওহ! আজকাল যা দিনকাল পড়েছে !
নিপার আব্বা স্বস্তির সাথে বললেন,
-আমার ছেলে মেয়েরা সবাই ভালো আলহামদুলিল্লাহ..।

কথা বলাবলির এক পর্যায়ে নজরুল ভেতরের ঘরে গেলো বোনকে আনতে। নিপা বেগুনী রংয়ের একটা জামদানী শাড়ি পরে বসে আছে।
-নিপা চল আমার সাথে, আয় আয়..।
নিপা, ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালো।কী যেন বলতে চেয়েও বলতে পারলো না বড় ভাইকে।
-কী হলো অমন করে তাকিয়ে আছিস কেন?চল চল,ওনারা তোকে এখনই দেখতে চান, চল ওঠ।

একদম হুট করে,নিজেদের আত্মীয়-স্বজন কাউকে না জানিয়েই, রাত দশটায় কাজি সাহেবকে ডেকে এনে বিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হলো নিপা আর রেজার। অবশ্য রেজার বাড়ির প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিলো। রেজা বরের নাম। ছেলেটি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনের চাকরী করে ঢাকায়। একদম অচেনা আর অজানা লোকের সাথে এভাবেই বাবা আর ভাই মিলে বিয়ে দিয়ে দিলো নিপার। অদ্ভূত ব্যাপার বিয়ে পড়ানোর সময় ডাকা হলো পাশের গাঁ থেকে শুধু মাত্র নিপার ছোট মামা আর মামীকে। এদিকে নিপার বিয়ের কথা শুনে তারাও ছুটে এলেন।

বিয়ের রাতেই নিপাকে শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে। এমনটাই দাবি করে বসলেন ওর শাশুড়ি। নতুন বেয়ানের এমনতর কথা শুনে নিপার আম্মার মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো।মেয়েটা বাড়িতে এলো আজ, আবার শ্বশুরবাড়িও যাবে আজ! এ কেমন কথা ! তারপরও স্বামী আর ছেলের ভয়ে নিপার আম্মা, মুখ বন্ধ করে রেখেছে। সারাজীবন এই মহিলা শুধু ভয়ই পেয়ে গেলো স্বামী, ছেলেকে। একবার কিছুটা সাহস করে ছেলেকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকলো। নজরুল যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে মায়ের দিকে এগিয়ে গেলো।
-কী হলো আম্মা ডাকছেন কেন ? জলদি বলেন কী বলবেন।
নিপার আম্মা খুব নীচু স্বরে বললো,
-আজ নতুন জামাই থাকুক আমাদের বাড়ি। কাল না হয় ওরা এসে নিয়ে যাবে। তুই একটু বলে দেখ বাপ।
নজরুল, মায়ের কথা শুনে দাঁত পিষে পিষে বললো,
-চুপ করেন আম্মা। মেয়ে মানুষের যত সব আজাইরা বুদ্ধি ! শোনেন, নিপা আজই যাবে শ্বশুরবাড়ি। ওকেও সেটা বুঝিয়ে বলেন।

রাত বারোটার কিছুক্ষণ পর নিপা, বরের হাত ধরে শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ করলো। বিয়ে, বর, শ্বশুরবাড়ি কোন কিছুই যেন ওর মাথায় ঢুকছে না এখনো। মস্ত বড় একটা ঘোরের মধ্যে আছে সে। এমন তো নয় যে, কোন ছেলের সাথে নিপার প্রেমের সম্পর্ক ছিলো বা এখনো আছে। সেই ছেলের থেকে সরানোর জন্যই যোগ্য পাত্র পেয়ে ওর বাবা ভাই মিলে লুকিয়ে দ্রুত বিয়ের কাজটা সারলো। বিষয়টা তেমনও নয়। বাবা আর ভাইয়ের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া এই বিয়েটা নিপার কাছে কেমন যেন গোলমেলে লাগছে। বিয়ের ক্ষেত্রে একটা মেয়ের মতামত জানাটাও খুব জরুরী। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা ওর বাবা আর ভাই আমলেই নিলো না। অর্থাত আমাদের ধর্মকেও মানলো না তারা। নিপার মনের মধ্যে এক প্রকার তোলপাড় চলছে।এদিকে গাড়িতে বরের পাশে বসে আসলো সে। কই বর তো একটি বারের জন্যও নিপার সাথে কথা বললো না।অথচ দু’বার তার ফোন আসলো, তখন ঠিকই হেসে হেসে অপর প্রান্তের মানুষটির সাথে কথা বললো। এই বিষয়টাও নিপাকে বেশ ভাবাচ্ছে।

রাত একটার পর নিপাকে, ওর ছোট ননদ ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেলো। রেজা তখনও ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। ঘরে যে নতুন বউ সেদিকে ওর নজরই নেই। নিপা শিক্ষিত মেয়ে। রেজার এমন অসভ্য আচরণে বড্ড কষ্ট পাচ্ছে সে। আধা ঘন্টা চুপচাপ বিছানায় বসে থাকার পর নিজেই ওয়াশরুমে গেলো। পোষাক বদলে ঘরে আসতেই রেজা বললো,
-আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। যা বলবো মন দিয়ে শোনেন।
নিপা এবার একটু স্বস্তি পেলো। যাক অন্তত বর কথা বলেছে।
-জি বলেন কী বলতে চান।
-বসেন, আপনি বিছানায় বসেন আগে।
নিপা বিছানার এক কোণে গিয়ে বসলো। রেজা ওর সামনে একটা চেয়ারে বসলো। তারপর শুরু করলো কথা।
-বলছিলাম আমি আপনাকে বউ হিসেবে মেনে নিতে পারবো না। আমার সম্পর্ক আছে একটি মেয়ের সাথে। মেয়েটির সাথে আমার পাঁচ বছরের সম্পর্ক। ওকেই বিয়ে করবো। শুধু মা-বাবার জেদের সাথে পেরে উঠলাম না বলেই এক প্রকার বাধ্য হয়ে আপনাকে বিয়ে করতে হলো। জানেন নিপা, ওই মেয়েটিকে খুব ভালোবাসি আমি। ময়মনসিংহে লেখাপড়া করতে গিয়ে ওর সাথে পরিচয় হয় আমার।
নিপা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এসব কী শুনছে সে ! চোখ মুখ শক্ত করে নিপা বললো,
-কী বলছেন এসব ? বিয়ের পর এমন কথা কিভাবে বলেন আপনি ? আমার কী হবে এখন ? আপনার বিয়ে আজ, আপনি তো জানতেন। আর আমি আজই রাজশাহী থেকে বাড়ি এসেছি।আমি একটুও জানতাম না, আমার জন্য কঠিন নরক যন্ত্রণা অপেক্ষা করছে। ও আল্লাহ আমার কী হবে এখন!
রেজা হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো নিপাকে।
-থামেন আপনি, এত রাগারাগি কান্নাকাটি করবেন না। কারণ আপনার কোন কথাতেই আমার কিচ্ছু হবে না। বুঝবার চেষ্টা করেন আমি একটি মেয়েকে ভালোবাসি।
রেজার এমনতর কথায়, নিপার দু’চোখের জল উপচে পড়ছে।নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে ওর। ঘেন্না ধরে যাচ্ছে ছেলে জাতির উপর। আস্তে আস্তে কথা বলার শক্তিও যেন হারাচ্ছে সে। নিজেকে কোনরকমে সামলে নিয়ে নিপা বললো,
-আপনি কাওকে ভালোবাসেন, বুঝলাম আমি। কিন্তু আমাকে যে বিয়ে করলেন ধর্ম মেনে, তাহলে আমি কে আপনার? কী হলো বলেন !

রেজা কোন কথার উত্তর না দিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেলো। ঘর লাগোয়া সুন্দর একটা বারান্দা আছে এই ঘরটার সাথে। যাবার সময় রেজা বলে গেলো, “আপনি ঘুমিয়ে পড়েন।আমি বারান্দায় শোবো। ওর সাথে কথা বলতে হবে। বড্ড অভিমান করে আছে সে, আমার উপর। বোঝেনই তো”!
জুবাইদা পারভীন লিপি
৪-৩-২০২১
#২য়_পর্বের_লিংক
https://m.facebook.com/groups/pencilglobal/permalink/2946076622347669/?comment_id=2946083539013644&notif_t=group_comment&notif_id=1614871935490019&ref=m_notif

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here