অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-২০,২১

0
530

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-২০,২১
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-২০:

||
পিয়াসার মুখোমুখি বসে আছে স্পর্শ। স্পর্শের মুখটা একদম মলিন হয়ে গেছে।

কাঁপা কন্ঠে স্পর্শ বললো,
“সুচিস্মিতা আ..আমি……..”

পিয়াসা হাতের ইশারায় স্পর্শকে থামিয়ে দিলো। স্পর্শ পিয়াসার শীতল দৃষ্টি দেখে মনে মনে কিছুটা ভড়কে গেলো।

স্পর্শ বিড়বিড় করে বললো,
“যত্তসব! অপরাধীর সামনেই নিজেকে অপরাধী সাজতে হচ্ছে।”

পিয়াসা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি বললেন?”

স্পর্শ পিয়াসার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
“হুহ, ভাগ্যটাকে বকছি। আমার দোষেই আজ আমি তোমার কাছে অপরাধী।”

স্পর্শ পিয়াসার হাতে হাত রেখে করুণ গলায় বললো,
“কিন্তু আমি যে তোমায় ভালোবাসি। আমাকে তুমি ক্ষমা না করলে হয়তো আমি আর কখনোই ভালো থাকতে পারবো না। এই বোঝা নিয়ে সারা জীবন কিভাবে কাটাবো আমি?”

পিয়াসা স্পর্শের হাত সরিয়ে দিয়ে টেবিলের উপর নিজের হাত দুটি গুটিয়ে নিয়ে নড়েচড়ে বসলো। তারপর শান্ত দৃষ্টিতে স্পর্শের দিকে তাকালো।

এরপর বললো,
“আমার কিছু প্রশ্ন আছে।”

স্পর্শ বললো,
“কি প্রশ্ন?”

“আপনি কেন আমাকে সুচিস্মিতা বলে ডাকেন? কেন কখনোই আমার নাম জানতে চান নি? কেন আমায় বলেছেন কখনো আমার নাম যাতে আপনাকে না বলি? আমার সম্পর্কে আপনি কিছুই জানতে চান নি, অথচ আমার বাবা-মার পরিচয় ঠিকই নিয়েছিলেন৷ আমার বাড়ি কোথায়, আমার পরিবারে কে আছে, কে নেই, আমার বান্ধবী কয়জন, সবকিছু জেনে নিয়েছেন। শুধু আমার নামটাই জানতে চান নি! ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই উদ্ভট লেগেছে। মনে হচ্ছে আমি যার সাথে সম্পর্কে আছি সে একজন সাইকো।”

স্পর্শ আহত কন্ঠে বললো,
“আমি সাইকো? তুমি আমাকে সাইকো বললে?”

“আপনার কাজগুলো আমাকে বাধ্য করছে এমন ভাবতে।”

“ওকে ফাইন। আমি বলবো। কিন্তু একটা শর্ত আছে।”

“কি শর্ত?”

“আমাকে দুইটা দিন সময় দেবে? আমি তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই।”

“দুইদিন মানে? রাতেও?”

“হ্যাঁ, দুইদিনের জন্য তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবো। তুমি চাইলে আমাকে বিশ্বাস নাও করতে পারো। সমস্যা নেই। তবে তুমি আমার সাথে সেই জায়গাটিতে গেলে বুঝবে কিছুক্ষণ আগে তুমি আমাকে যা বলেছো তা আসলে বাস্তবে কেমন হয় দেখতে। জানতে পারবে আমার উদ্ভট ব্যবহারগুলোর কারণ।”

“আমি আপনাকে এতোটাও বিশ্বাস করি না, স্পর্শ।”

স্পর্শ মনে মনে বললো,
“তুমি নিজেকে এতোটা ইনোসেন্ট প্রমাণ করছো কেন? তুমি হয়তো জানো না তোমার সব কুকর্মের তথ্য আমার কাছে আছে। আমি এটাও জানি তুমি রকিকে খুনি হিসেবে প্রমাণ করতে পারবে। আর তাই তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন। এতো সহজে তুমি আমার ফাঁদে পা দেবে না, আমি জানি। তাই তোমাকে ভালোবাসার জালে আটকে পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবো। একবার আমায় বিশ্বাস করে দেখো। এরপর দেখবে কিভাবে আমি তোমার বিশ্বাসটা ছিন্নভিন্ন করে তোমার সামনে রাখি, যেভাবে তুমি আমার, আর আমার মতো অনেক ছেলের সাথেই প্রতারণা করেছিলে।”

পিয়াসা স্পর্শের মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে বললো,
“কি ভাবছেন?”

স্পর্শ মাথা নিচু করে টেবিলের উপর দৃষ্টি স্থির করে বলতে লাগলো,
“সুচিস্মিতা নামটি আমি আমার ভালোবাসা থেকেই রেখেছিলাম। সুচিস্মিতা অর্থ যেই মেয়ের হাসি খুব সুন্দর। প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম তোমার স্কুলের সামনে। তুমি ফুচকা খাওয়ায় ব্যস্ত ছিলে। আর আমি তোমাকে দেখতে ব্যস্ত ছিলাম। তোমার ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ছিলো, আর চোখে ছিলো পানি। মানুষ একসাথে হাসতে ও কাঁদতে পারে তা আমি সেদিন প্রথম দেখেছিলাম। তারপর তোমার মায়া ছাড়তে পারি নি। হঠাৎ একদিন আগের বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোমায় দেখে ফেলি। এরপর তোমাকে হারানোর ভয়টা চলে যায়। তোমাকে মাঝে মাঝে ফলো করতাম। তবে তুমি কখনো আমাকে খেয়াল করো নি। আমার শার্টের হাত আঁকড়ে ধরে রাস্তা পার হয়েছিলে, সেদিনও আমায় চিনলে না। বৃষ্টিভেজা এক দুপুরে আমার খুব কাছে এসেও আমায় চিনলে না। সেই চিঠি আর তোমাকে দেওয়া সেই চারাটি লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার বাসার সামনে রেখে এসেছিলাম, তবুও আমায় দেখলে না। সারা দিন-রাত তোমার বারান্দায় আমার চোখ দুটি ব্যস্ত ছিলো, তবুও আমার ভালোবাসা তুমি বুঝলে না। হঠাৎ তোমার সাড়া পেয়ে আমি নিজের মাঝেই আর ছিলাম না। তবে বেশি দিন আর খুশিটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে। কতো অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য। কিন্তু তোমার দেখা আর পাই নি। আর একদিন হঠাৎ বাবার মৃত্যুর পর আমার জীবনটাই একদম এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। আমার দুইটা ছোট বোন, যাদের বয়স তখন মাত্র দুই বছর ছিলো, তারা অনাথ হয়ে যায়। যদিও বাবার সাথে আমার সম্পর্কটা তেমন ভালো ছিলো না। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর বুঝেছি এই সম্পর্কের শিথিলতার কারণটা আসলে কি ছিলো। শুধু আমাদের ভবিষ্যতের জন্য তিনি বাইরে রাত-দিন কাটিয়েছেন। আমাদের সময় কম দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে ব্যস্ত ছিলেন। মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম আমার দাদা অনেক কষ্ট করেছিলেন তার জীবনে, কারণ আমার দাদার বাবা কিছুই রেখে যান নি সন্তানদের জন্য, আর দাদাও কিছু করতে পারেন নি। তাই বাবা মনে করতো দাদার মতো আমিও কিছুই করতে পারবো না। জানো, আমি আমার বাবার কাছে বসে কখনো জিজ্ঞেস করতে পারি নি, কেমন আছো বাবা? কখনো প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলি নি। আর এখন চাইলেও কি সম্ভব?”

স্পর্শের চোখের কোণা ভিজে গেলো। পিয়াসা স্পর্শের হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
“নিজেকে শক্ত রাখুন। আংকেল যেখানেই আছে ভালো আছে।”

স্পর্শ পিয়াসার কথাটি শুনে রাগী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। তারপর সাথে সাথেই এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলো। পিয়াসা খানিকটা অবাক হলো। তবুও কিছু বললো না। স্পর্শ পানির বোতল থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি শেষ করলো।

স্পর্শ মনে মনে বললো,
“আমার বাবার খুনিকে সাহায্য করে আমাকেই সান্ত্বনা দিচ্ছো তুমি? তুমি একটা বেইমান। আই হেইট ইউ।”

পিয়াসা বললো,
“আপনি ঠিক আছেন তো?”

স্পর্শ স্বাভাবিক হয়ে বললো,
“হ্যাঁ, ঠিক আছি।”

স্পর্শ আবার বলতে লাগলো,
“বাবা বিজনেস করতো, তাই কিছু লাভ হলেই টাকা আসতো আমাদের হাতে। তবে বিজনেসটা অন্য একজন চালাচ্ছিলো বাবার অবর্তমানে। তাই সে আমাদের কি পরিমাণ ঠকাচ্ছিলো তা বুঝতে পারি নি। মাসে দশ হাজার টাকা দিতো। কখনো কখনো দুই মাস পর পর পনেরো হাজার বা এর চেয়েও কম টাকা আসতো আমাদের হাতে। যা সঞ্চয় ছিলো তা আমার পড়াশুনায় শেষ হয়ে যায়। আর বাড়ি ভাড়া, খাবার-দাবার সবকিছু মিলিয়ে শহরে থাকাটা অনেক ব্যয়বহুল মনে হচ্ছিলো। তার উপর আমার মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। মা, আমার বোন দুইটাকে দেখলেই তাড়িয়ে দিতো, ওদের মারধর করতো, যেখানে মা ছাড়া ওদের ঘুমই আসতো না। আমি শুধু পরীক্ষাটাই দেওয়ার জন্য শহরে এসেছিলাম, বাকী সময়টা বোনদের নিয়েই কাটিয়ে দিতাম। শেষে ভার্সিটি থেকে আমাকে আলাদা ভাবে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেয় ভিসি স্যার। পাশাপাশি আমার বন্ধুরা অনেক করেছে আমার জন্য। বোন দুইটাকে মামার বাসায় রেখে এসেছি। আর বাকী আমার খাওয়া-দাওয়া আর থাকার খরচ, পাশাপাশি মায়ের ওষুধপত্র সবকিছুই বাবার সেই বিজনেসের টাকা থেকেই আসছে। এতোকিছুর মাঝেও আমি তোমাকে চেয়েছিলাম, এখনো চাই। কিন্তু তুমি আমার সাথেই ছিলে না। তোমাকে খোঁজার চেষ্টা করি নি, কারণ আমার অবস্থায় ভালো ছিলো না। তবে আমার স্মৃতিতে তুমি সুচিস্মিতা হয়েই বেঁচে ছিলে। আমি সুচিস্মিতাকেই ভালোবেসেছি। তাই তোমার নাম জানতে চাই নি। তোমার আসল নামটা আমার কাছে রহস্যের মতো। আর আমি সেই রহস্য এতো তাড়াতাড়ি ভেদ করতে চাই না। আমি ধীরে ধীরে তোমাকে কাছে পেতে চাই। হিমু কি বলেছে জানো?”

“কি বলেছে?”

“যে সম্পর্ক যত আড়ম্বরে গভীর হয়, তার শেষটা একটু তাড়াতাড়ি হয়।”

পিয়াসা মুচকি হাসলো।

স্পর্শ বললো,
“আমি কি তাড়াতাড়ি শেষ হতো দেবো তোমার আমার এই প্রিয় মুহূর্তগুলো?”

“উহুম, আমি চাই না তা কখনো শেষ হোক।”

স্পর্শ দীর্ঘশ্বাস ফেললো আর মনে মনে বললো,
“তুমি আবার ধরা পড়েছো সুচিস্মিতা। হ্যাঁ, তবে আমার অনুভূতিগুলো মিথ্যে না। একটা বিশ্রী অনুভূতি জন্ম নিচ্ছে সুন্দর অনুভূতির মাঝে। একপক্ষ বলছে ভালোবাসতে, আরেক পক্ষ চায় তোমার ধ্বংস।”
||

চলবে–

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-২১: (রহস্যের উন্মোচন)

||
স্পর্শের কথা শুনে পিয়াসার মনে তার প্রতি মায়া জন্ম নিয়েছে। অনেকক্ষণ দু’জন কথাবার্তা বলার পর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। রাস্তায় রিক্সার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলো পিয়াসা। হঠাৎ রাস্তার অপর পাশে চোখ পড়তেই তার চোখ দুটি স্থির হয়ে গেলো। তুবা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা ছেলের হাত ধরে কথা বলছে। ছেলেটা কোনো বাঁধা ছাড়াই তুবার কপালে আসা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিচ্ছে।

পিয়াসা মনে মনে বললো,
“ছেলেটাকে দেখে তো রাতুলের মতো একদমই মনে হচ্ছে না। তাহলে তুবা আবার আরেকটা সম্পর্কে জড়িয়েছে?”

বাসায় এসে তুবাকে নিয়েই ভাবছে পিয়াসা। কারণ এতোদিন সে ভেবেছিলো তুবার আগের সম্পর্কগুলো ভাঙ্গার কারণ তাদের সাথে তুবার মনের মিল না হওয়া। কিন্তু আজ পিয়াসার মনে হচ্ছে তুবা ইচ্ছে করেই সম্পর্কগুলো নষ্ট করেছে শুধু নিজের বিলাসিতার জন্য। তুবা আদৌ কোনো সম্পর্কে কখনোই সিরিয়াস ছিলো না।

এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটা অপরিচিত নম্বর থেকে পিয়াসার ফোনে কল এলো। কিছু একটা ভেবে কলটা রিসিভ করলো সে। অপর পাশ থেকে রাতুলের কন্ঠ শুনে পিয়াসা অবাক হলো।

রাতুল বললো,
“পিয়াসা, বলছো? তোমার সাথে কিছু কথা আছে।”

“হ্যাঁ, বলুন।”

“আমার সাথে কি দেখা করতে পারবে?”

“কোথায় দেখা করবো?”

রাতুল আগামীকাল পিয়াসাকে একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বললো। পিয়াসাও রাজী হয়ে গেলো। তবে গতদিন তুবার ফোন রিসিভ করে রাতুলের কথাগুলো যে শুনে ফেলেছিলো তা আর জানালো না। ভাবলো দেখা হলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। হয়তো এই বিষয়েই কথা বলবে রাতুল। আর পিয়াসা এমনিতেই মনে মনে রাতুলের সাথে যোগাযোগ করবে ভাবছিলো, আর রাতুল এখন নিজেই ফোন দিয়ে দিলো।

পরের দিন-

রাতুলের কথামতো রেস্টুরেন্টে এসে তার অপেক্ষা করছে পিয়াসা। দশমিনিট পর রাতুল একটা ছেলেকে সাথে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। রাতুলের পাশে ছেলেটিকে দেখে পিয়াসা আরো বেশি অবাক হলো। কারণ এই ছেলেটিকেই সে গতকাল রাস্তায় তুবার পাশে দেখেছিলো।

রাতুল পিয়াসাকে দেখে তার বন্ধু আরিফের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।

রাতুল বললো,
“কেমন আছো, পিয়াসা?”

“হ্যাঁ, ভালো আছি।”

আরিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তাহলে তুমিই পিয়াসা? তোমার সাথে তুবার কি সম্পর্ক?”

পিয়াসা খানিকটা অবাক হলো আরিফের কথা বলার ধরণ দেখে। খুব উদ্ভট ভাবেই সে প্রশ্নটি করেছে পিয়াসাকে। তাই পিয়াসা একটু অবাক হয়ে বললো,
“আমি তুবার কাজিন। তুবা আমার খালার মেয়ে। কিন্তু আপনি কে?”

আরিফ একটু শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমি তুবার বয়ফ্রেন্ড। আর রাতুল আমার স্কুল ফ্রেন্ড। আপনি রাতুলকে কিভাবে চেনেন?”

পিয়াসা রাতুলের দিকে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। রাতুল করুণ কন্ঠে বললো,
“পিয়াসা, তুমি যা জানো, সব সত্য কথায় বলো। আমি কে? তুমি আমাকে কিভাবে চেনো সব বলো। আর এই ছেলে আমাকে একটুও বিশ্বাস করছে না। তার কাছে ছোটবেলার বন্ধুর চেয়ে সেই তুবার কথায় সত্য মনে হচ্ছে।”

পিয়াসা কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললো,
“আমি আসলে বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে এসব।”

এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো পিয়াসা। তারপর আরিফের দিকে তাকিয়ে পিয়াসা বললো,
“আমি গতকাল আপনাকে তুবার সাথে রাস্তায় দেখেছিলাম। অনেক অবাক লেগেছিলো আমার। কারণ আপনার কথা তুবা আমাকে জানায় নি। আর আমি যতোটুকু জানি তুবা আমার কাছে কিছুই লুকিয়ে রাখে না। রাতুল ভাইয়ার সাথে তুবার অনেকদিনের সম্পর্ক ছিলো। আর আমি তো ভেবেছি, এখনো তার সাথেই সম্পর্ক আছে। কিন্তু আপনি এখন বলছেন, তুবার সাথে আপনার সম্পর্ক। বিষয়টা আসলেই আমি বুঝতে পারছি না।”

রাতুল বললো,
“পিয়াসা, বুঝতে না পারার কিছুই নেই। তোমার বোন একটা খারাপ মেয়ে। ও সব ছেলের সাথেই সম্পর্ক রাখে। ওর যেখানে সুবিধা ও সেখানেই থাকে।”

তুবার সম্পর্কে পিয়াসা এমন কথা শুনে একটু কষ্ট পেলো। তখন আরিফ মলিন মুখে বললো,
“আমি তুবাকে ভালোবাসি। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তুবা আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে। সে আমাকে বলেছিলো রাতুল তাকে বিরক্ত করতো। অনেকবার প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে, আর সে রাজী না হওয়ায় এখন তার নামে মিথ্যে কথা রটাচ্ছে।”

পিয়াসা কিছুক্ষণ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখলো। এমন পরিস্থিতিতে সে আগে কখনোই পড়ে নি। তার হাত দুটো ঠান্ডা হয়ে গেছে। নিজের কাজিনের নামেই এতোকিছু সে শুনছে আর বলছে, সে-ই কাজিন যাকে নিজের আপন বোনের মতোই সে ভালোবাসে।

পিয়াসা গলা ঝেড়ে আরিফকে বললো,
“আমি আপনাকে একটা কথায় বলবো, তুবার আগেও দুটো সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু ছেলেগুলোর চরিত্র ভালো না, তাই সেই সম্পর্কগুলো শেষ করে দেয় তুবা। আর রাতুল ভাইয়ার সাথেও তুবার অনেকবার ঝগড়া হয়েছে, কারণ ভাইয়া একটু পজেজিভ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তুবা আমাকেও মিথ্যে বলেছে। ভাইয়া, আপনাদের কাছে একটা অনুরোধ। তুবাকে কিছু বলবেন না। ওর সম্পর্কে কাউকে কিছুই জানাবেন না, প্লিজ। আমাদের পরিবারের একটা মান-সম্মান আছে।”

পিয়াসা আরিফকে আলাদা ভাবে বললো,
“আপনি তুবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেই ভালো হবে।”

আরিফ মাথা নেড়ে বললো,
“ওর মতো মেয়ের সাথে যোগাযোগ রাখা কখনোই সম্ভব না। আমি এখন যাই।”

কথাটি বলে আরিফ উঠে চলে গেলো। রাতুল পিয়াসাকে বললো,
“তোমার অনেক চিন্তা পরিবারের সম্মান নিয়ে, তাই না?”

“অবশ্যই। আমার পরিবার, আমি চিন্তা করবো না?”

“পিয়াসা তোমাকে আরেকটা কথা বলার আছে।”

“হ্যাঁ, বলুন।”

“তোমার বোন তোমাকেও ছাড়ে নি। যাকে তুমি নিজের বোনের মতো ভালোবাসো, সে তোমার ছবি ব্যবহার করে অনেক ছেলের সাথে সম্পর্ক রেখেছে। অতিন্দ্রিয়া নামের একটা ফেইক আইডি আছে তার। যদিও প্রফাইল লক করা, কিন্তু ছবিটা তোমার, তা ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। তুবা কিন্তু যথেষ্ট সুন্দরী, কিন্তু কেন তোমার ছবি ব্যবহার করে এসব করছে তা আসলেই বুঝতে পারছি না আমি। তাই তোমাকে জানিয়ে দিলাম।”

কথাটি বলে রাতুল চলে গেলো। আর পিয়াসার কানটা গরম হয়ে গেলো। কারণ এই নামটা সে কোথায় যেন শুনেছে! কিন্তু কোথায়?

পিয়াসার গলা আর ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। চোখের কোণে পানি জমেছে। কারণ তার মনে পড়ে গেছে এই নাম সে কোথায় শুনেছে। দুই বছর আগেই, এই নামটি তার কানের সামনে গুঞ্জন করে উঠেছিলো কয়েকবার।

পিয়াসা ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো। এখন বাসায় যেতে হবে। কারণ বিশ্বাসঘাতকটা যে বাসায় আছে।

এদিকে স্পর্শ ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করছিলো। তখনই তার সামনে চলে এলো কিছু মেসেজিংয়ের স্ক্রিনশট। চোখগুলো লাল হয়ে গেলো সে নোংরা মেসেজগুলো দেখে। ফোনটা এক ঝটকায় হাত থেকে ফেলে দিলো স্পর্শ। তারপর বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“সুচিস্মিতা, তোমাকে আমি যতোটা ভালোবাসেছি, তার চেয়েও বেশি অতিন্দ্রিয়া নামের সেই তোমাকেই ঘৃণা করেছি। এই নামটা আমার কানে বাজলে শরীর ঘিনঘিন করে উঠে। তাই আমি তোমার মুখ থেকে সেই ঘৃণিত নামটি শুনতে চাই নি। আর এইটাই একমাত্র কারণ তোমাকে সুচিস্মিতা নামে আমার জীবনে প্রবেশ করানোর। কারণ তোমার নামটি শুনলে আমার তোমাকে সহ্য হয় না, মনে পড়ে যায় সেই নোংরা কথোপকথন, আমার বাবার মৃত্যুর কারণ।”

এদিকে-
পিয়াসা শক্ত মুখে তুবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর তুবা ভীত চোখে পিয়াসার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মাথা নিচু করলো।

পিয়াসা শক্ত কন্ঠে বললো,
“অতিন্দ্রিয়া! বাহ বেশ ভালোই তো অভিনয় করতে পারিস তুই। তোর এমন নোংরা খেলায় আমাকে কেন যোগ করেছিস? আমি তোর কি এমন ক্ষতি করেছিলাম তুবা?”

তুবা বললো,
“সরি পিয়ু। ভুল হয়ে গেছে৷ তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস।”

“ক্ষমা? তোর কাছে আমার প্রশ্নের কি কোনো উত্তর নেই?”

“আছে।”

“তাহলে বল। কেন আমাকেই তোর নোংরামিতে ব্যবহার করেছিস? কেন অতিন্দ্রিয়া সেজে এতোগুলো ছেলের সাথে প্রেমের অভিনয় করেছিস?”

“পিয়ু, আমি যা করেছি বা করছি তাতে তোর চোখে হয়তো আমি অপরাধী। কিন্তু আমি ভেবেছি এতেই আমি সুখী হবো। আমি তোকে অনেক ভালোবাসি বোন। কিন্তু তোর কারণেই আমি আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষটিকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি জানি এখানে তোর কোনো দোষ নেই। তবুও আমি তোর ছবি ব্যবহার করে ওই সুখটা খুঁজে নিয়েছি, যেই সুখটা আমার খুব প্রয়োজন ছিলো।”

“কি বলতে চাইছিস তুই? আমি তোর সুখ কবে কেঁড়ে নিয়েছি?”

তুবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
“রিয়াদের কথা মনে আছে?”

পিয়াসা ভ্রূ কুঁচকে তুবার দিকে তাকালো।

“রিয়াদ! কোন রিয়াদ?”

“রুদিতা আপুর বিয়েতে এসেছিলো, রুদিতা আপুর খালাতো ভাই! মনে নেই?”

“হ্যাঁ, কিন্তু হঠাৎ রিয়াদের কথা বলছিস কেন?”

“পিয়ু, আমি রিয়াদকে সত্যিই খুব ভালোবাসতাম। এখন হয়তো ভালোবাসার মূল্য আমার কাছে খেলনার মতো, যা নষ্ট হয়ে গেলে আরেকটা কিনে নিয়ে আসি। কিন্তু রিয়াদের প্রতি আমার ভালোবাসা খেলনা ছিলো না। আমি ওকে সত্যিই ভালোবাসতাম।”
||

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here