#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-২২,২৩
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-২২:
||
তুবা অতীতের মাঝে ডুবে গেলো, যেই অতীতে রিয়াদই ছিলো তার অস্তিত্ব জুড়ে। তুবা আর পিয়াসা সবে মাত্র নবম শ্রেণিতে উঠেছিলো। এই বয়সে প্রেম-ভালোবাসার কোনো ভিত্তি নেই। আর এই বয়সে মনে যেই অনুভূতির সৃষ্টি হয় তা শুধুই আকর্ষণ বা আবেগ। সেই আবেগটাই যেন তুবার ঘাড়ে চেপে বসেছিলো। তুবা আর পিয়াসা দু’জনই সুন্দরী। তাদের চেহারার আলাদা কোনো বিশেষত্ব না থাকলেও, সাধারণের ভীড়ে তারা মায়াবী। আর দুটি সুন্দরী ললনার ভীড়ে যদি যেকোনো একজনকে আলাদা করতে বলা হয়, তাহলে তা শুধুমাত্র গুণ ও ব্যবহারের দ্বারাই সম্ভব। আর সেই দিকে পিয়াসা এগিয়ে ছিলো, কারণ সে অসম্ভব শান্ত আর ছেলেদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস তার নেই। অন্য কোনো ছেলের দৃষ্টিতে পিয়াসার এই দুটি স্বভাব দোষ বা ন্যাকামি মনে হলেও রিয়াদের কাছে ছিলো অসাধারণ। তাই রিয়াদের মনোযোগ পিয়াসাতেই নিবদ্ধ ছিলো।
রুদিতা, পিয়াসা আর তুবার মামাতো বোন, যার বিয়ের আয়োজন শহর থেকে অনেক দূরেই করা হয়। সেই সূত্রে মোটামুটি তিন সপ্তাহ সকল অতিথি একই স্থানেই ছিলো, শুধু দূর সম্পর্কের অতিথিরা বিশেষ অনুষ্ঠানের দিনগুলোতেই নিমন্ত্রণ পেয়েছিলো। আর রিয়াদ যেহেতু রুদিতার খালাতো ভাই ছিলো, তাই সে পুরো তিন সপ্তাহ সময় পেয়েছিলো পিয়াসার মাঝেই ডুবে থাকার আর পিয়াসা সম্পর্কে ভালোভাবে জানার।
রিয়াদ দেখতে মোটেও সুদর্শন নয়, তবে স্মার্টনেস তার মধ্যে যথেষ্ট ছিলো, যা একজন ভার্সিটি পড়ুয়া তরুণের মধ্যে থাকে। আর তার কথা বলার মাঝে আলাদা শক্তি আছে, যা মেয়েদের কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রভাবিত করে ফেলে। আর তার এই শক্তিটাই তুবাকে পাগল করে দিয়েছিলো। তুবা সারাদিন রিয়াদের পেছন পেছন ঘুরঘুর করতো শুধু তার সাথে কথা বলার জন্য আর তার কথাগুলো শুনার জন্য। পুরো তিন সপ্তাহে তুবা তার মনের জায়গায় রিয়াদকে বসিয়েছিলো। কিন্তু তিন সপ্তাহ পর রুদিতার বিদায় শেষে যে যার ঠিকানায় চলে গেলেও তুবা রিয়াদের ফোন নম্বরটি জোগাড় করেই এসেছিলো। তবে সাহসের অভাবে ফোন দিতে পারে নি।
কয়েক সপ্তাহ পর রুদিতা বাবার বাড়ি বেড়াতে আসার পর তার সব কাজিনরাই তাকে দেখতে যায়। যেখানে রিয়াদও ছিলো। কিন্তু পিয়াসা হয়তো কোনো এক কারণে সেখানে যেতে পারে নি। আর সেদিন রিয়াদের চোখে শুধু অস্থিরতাই দেখা গিয়েছিলো। আর ওইদিনই রিয়াদ রুদিতাকে জানায় তার পিয়াসাকে ভালো লাগে। আর বোন যদি তার দয়া করে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে, তাহলে সে খুব খুশি হতো। রুদিতা রিয়াদের কান টেনে বলেছিলো,
“আচ্ছা, তাহলে আমার ভাইয়ের তার নিঝুমকে চাই?”
পিয়াসার চুপচাপ স্বভাবের কারণে রিয়াদ তার নাম রেখেছিলো নিঝুম।
রিয়াদ কান ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
“রুদি আপু, উপকারটা করলে ভীষণ খুশি হতাম।”
“আরেহ পাগলা, মেয়েটা এখনো বাচ্চা। এই বয়সে এসব অনুভূতির কথা বলে তার সময় নষ্ট করিস না। বরং তুই অপেক্ষায় থাক, আর পিয়ুকে বড় হতে দে।”
“যদি হারিয়ে ফেলি?”
“তাহলে ভেবে নিস ও তোর ভাগ্যেই ছিলো না।”
“আপু, মেয়েটা যে আমার প্রিয় মুহূর্তের প্রিয় সঙ্গী, ওকে ছাড়া কিভাবে এতোদিন দূরে থাকবো?”
“আচ্ছা, ভাই একটা সাহায্য তাহলে করেই দেই।”
“কি সাহায্য?”
“আমি মাকে জানায়। মা না হয় ফুপিকে বলে রাখবে।আর তুই তো ভালো জায়গায় পড়াশুনা করছিস। এখন চাকরিটায় ভালো জুটিয়ে ফেল। তারপর নিঝুম হবে রিয়াদের।”
“ইনশাআল্লাহ।”
রুদিতা তার মা আর ফুপিকে এই বিষয়ে জানানোর পর তাদের কোনো আপত্তি ছিলো না। আবার পিয়াসার মা এই বিষয়ে অতি আগ্রহও দেখান নি। কারণ তার মেয়ের জন্য যদি এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব আসে ভবিষ্যতে?
ঘটনা বিদ্যুৎ গতিতে কাজিন মহলে ছড়িয়ে পড়লো। নবম শ্রেণিতেই পিয়াসার বিয়ের প্রস্তাব রিয়াদের পক্ষ থেকে, এই কথা শুনে মুহূর্তেই তুবার বুকটা ধক করে উঠলো। মনের এক কোণে যেখানে রিয়াদের ছবি বসিয়েছিলো, সেটি হুট করেই ভেঙে গেলো। তারপর থেকেই তুবার মনে পিয়াসার মতো হওয়ার ভূত চেপে বসে। অনেক চেষ্টা করেও সে পিয়াসার স্বভাব নিজের মধ্যে স্থাপন করতে পারে নি। আর পারবেও বা কিভাবে? মানুষ নিজস্ব স্বকীয়তা সহজে ছাড়তে পারে না। বরং অন্য কারো বৈশিষ্ট্য অনুকরণ করতে যাওয়াটাই তার বোকামি। যেই বোকামিটা তুবা করছিলো। কিন্তু পরিশেষে ফলাফল শূন্য। আর এরপর থেকেই তুবা পিয়াসা হতে না পেরে পিয়াসার ছবি ব্যবহার করেই অনেক ছেলের সাথে প্রেম করা শুরু করে দেয়। তুবা যা করেছিলো তা আসলেই জঘন্য অপরাধ, তবে তার মাথায় আসে নি, এর পরিণাম ভয়াবহও হতে পারে। সে কখনো চায় নি তার জন্য পিয়াসার ক্ষতি হোক। কিন্তু অল্প বয়সে মানুষের বিবেচনা করার ক্ষমতাটা এতোটা প্রখর হয় না৷ তার ভুল সিদ্ধান্তগুলোই তার কাছে সঠিক মনে হয়। তাই তুবা বিভিন্ন ছেলেদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে নিজের মনকে শান্ত করার জন্য। আর এর মধ্যে একজন ছিলো রকি। রকি পিয়াসার পেছন পেছন ঘুরঘুর করতো। আর তুবার অপরিপক্ব মন চেয়েছিলো তার পেছনেও এভাবেই একদল বখাটে ঘুরঘুর করবে। তাই সে অতিন্দ্রিয়া সেজেই পিয়াসার ছবি ব্যবহার করে রকির সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। যার কারণেই পুরো এলাকায় পিয়াসা একটা খারাপ মেয়ে হিসেবেই পরিচিতি পায়।
পিয়াসা এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। তারপর তুবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“রিয়াদ ভাইয়াকে আমি ওই নজরে কখনোই দেখি নি। আমি ভালোবাসার অর্থ বোঝার পর শুধু স্পর্শকেই ভালোবেসেছি। আর আমার কাছে ভালোবাসা মানে মন বদলানো না। যদি স্পর্শকে আমি না পাই, কখনোই আমি তোর মতো বহু ছেলের পেছনে ঘুরে মনকে শান্ত করবো না। কারণ আজ আমি যদি এমন খারাপ কাজ করি, আগামীতে আমার চরিত্রেই দাগ লাগবে। তখন ভবিষ্যতটা শুধরানোর সময় আর পাবো না।”
“আমি ভুল করে ফেলেছি পিয়ু।”
“আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে লাভ নেই। আমি জানি তুই কখনো নিজেকে পরিবর্তন করতে পারবি না। কারণ তুই এসবেই অভ্যস্ত হয়ে গেছিস। তবে আজ থেকে একটা সম্পর্কে ফাটল তো ধরলো। আর তা হলো তোর আর আমার সম্পর্কটা আজ এখানেই হয়তো শেষ। আমি আর আগের মতো তোকে বিশ্বাস করতে পারবো না। হয়তো কথা বলতেও বাধা আসবে। তুই বরং চলে যা।”
তুবা কিছু না বলে ব্যাগপত্র গুছিয়ে পিয়াসার বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। আর পিয়াসা ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো।
এদিকে-
কলেজের পিকনিকে যাওয়ার বাহানা দিয়ে, দুইদিন সময় হাতে নিয়ে স্পর্শের সাথে তার বাড়িতে ঘুরতে গেলো পিয়াসা।
স্পর্শের বাড়ি সীতাকুন্ড পার হয়েই যেতে হয়। তাই পিয়াসা স্পর্শের জন্য পাহাড়তলী অপেক্ষা করছিলো। বিশ মিনিট পর স্পর্শ পাহাড়াতলী এসে পিয়াসাকে সাথে নিয়ে রওনা দিলো।
এদিকে পিয়াসার রিম-ঝিমের সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু স্পর্শ কোনোভাবেই তার বোনদের সাথে পিয়াসার দেখা করাতে চাইছে না। পিয়াসা রাগ দেখিয়ে বললো,
“আপনি নিয়ে আসেন নি কেন রিম-ঝিমকে?”
স্পর্শ বিরক্ত হয়ে বললো,
“বললাম তো ওরা ঝামেলা করবে।”
“কিসের ঝামেলা? আমি সামলাবো ওদের।”
স্পর্শ নরম সুরে বললো,
“সুচিস্মিতা, তোমার সাথে একটু সময় কাটাবো ভাবছিলাম। আর তুমি রিম-ঝিমের মাঝেই আটকে আছো!”
“ওদের সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে।”
স্পর্শ দাঁতে দাঁত চেপে হাঁটতে লাগলো। পিয়াসা স্পর্শের হাত শক্ত করে ধরে বললো,
“আমি একা রাস্তা পার হতে পারি না।”
কথাটি শুনে স্পর্শ পিয়াসার হাত শক্ত করে ধরে হাঁটতে লাগলো।
সীতাকুন্ড পার করে একটু ভেতরেই স্পর্শদের বাড়ি। মোটামুটি তিন ঘন্টা লাগলো তাদের বাড়ি পৌঁছাতে। বাড়ি পৌঁছে পিয়াসাকে তাদের নতুন বাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে স্পর্শ বললো,
“তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি একটু আসছি।”
পিয়াসা স্পর্শের হাত চেপে ধরে বললো,
“না, আমার ভয় লাগছে। আপনিও থাকেন।”
স্পর্শ পিয়াসাকে একটা রুমে নিয়ে গিয়ে বললো,
“এই রুমটা আমার বাবা-মার রুম। তুমি আজ রাতে এই ঘরেই থাকবে।”
“আপনি কোথায় থাকবেন?”
“আমি পুরোনো বাড়িতে দাদীর ঘরেই থাকি।”
পিয়াসা ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“পুরোনা বাড়ি কোনটা?”
স্পর্শ বিরক্ত হয়ে বললো,
“তোমার এতো কিছু জানতে হবে না৷ যাও, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো। খাওয়া-দাওয়া করবে না?”
পিয়াসা স্পর্শের বিরক্ত ভাব দেখে মলিন মুখে বললো,
“আচ্ছা, যাচ্ছি।”
পিয়াসা ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো স্পর্শ বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। পিয়াসা স্পর্শের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
“ছি, স্পর্শ! আপনি সিগারেট খান?”
স্পর্শ সিগারেট নিভিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো,
“হুম, খায়। কোনো সমস্যা?”
পিয়াসা স্পর্শের মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো,
“আপনি আজকে আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন কেন?”
স্পর্শ চেঁচিয়ে বললো,
“আমি আবার কিভাবে কথা বললাম? এতো ন্যাকামো করছো কেন, হ্যাঁ?”
পিয়াসা অবাক হয়ে তাকালো স্পর্শের দিকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি সিগারেট খাওয়া মানুষ পছন্দ করি না।”
স্পর্শ চোখ ছোট করে বললো,
“তোমার পছন্দ মতো চলা আমার পক্ষে সম্ভব না। তুমি চাইলে আমাকে অপছন্দ করতে পারো।”
পিয়াসা স্থির হয়ে গেলো স্পর্শের কথা শুনে। আর স্পর্শ হন হন করে চলে গেলো।
পিয়াসা মনে মনে ভাবছে,
“হঠাৎ স্পর্শ এভাবে কথা বলছে কেন? আমি তো তাকে বিশ্বাস করেই এখানে এসেছি। আমি ভুল করি নি তো এখানে এসে?”
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর স্পর্শ পিয়াসার জন্য খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলো। পিয়াসা তখন চুপচাপ সোফায় বসে ছিলো। স্পর্শকে দেখে সে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
স্পর্শ খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো,
“খেয়ে নাও।”
পিয়াসা স্পর্শের হাত ধরে বললো,
“আপনি আমায় কেন নিয়ে এসেছেন এখানে? আমার পাশে দু’টো মিনিট বসছেনও না।”
“আমি একটু ব্যস্ত আছি।”
“খাবেন না?”
“খেয়ে এসেছি।”
“আমাকে ফেলে খেয়ে নিয়েছেন?”
স্পর্শ কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেলো। পিয়াসা একা একা বসেই খাওয়া-দাওয়া সারলো। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগলো। হঠাৎ একজন মহিলা পিয়াসাকে দেখে তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনে কে? আপনারে তো চিনলাম না।”
“জি, আমি স্পর্শের সাথে এসেছি।”
স্পর্শ হঠাৎ কোথা থেকে এসে পিয়াসাকে সরিয়ে দিয়ে বললো,
“চাচী, আপনি এখানে কি করছেন? মাকে খাইয়ে দিয়েছেন?”
“হ্যাঁ, বাবা খাওয়াইয়া দিসি। এহন ঘুম পাড়াইয়া দিয়া আইছি। তুমি এহন যাইতে পারবা ও ঘরে৷ কাছের থেইকা দেখতে পারবা।”
“আচ্ছা, চাচী। আপনি এখন যান।”
মহিলাটি চলে গেলে স্পর্শ পিয়াসার হাত চেপে ধরে বললো,
“কি কথা বলছিলে তুমি চাচীর সাথে?”
“স্পর্শ, আপনি এভাবে রেগে যাচ্ছেন কেন? উনি আমাকে জিজ্ঞেস করছিলো, আমি কে? আমি তখন বললাম আপনার সাথে এসেছি।”
স্পর্শ নরম সুরে বললো,
“বাড়িতে এলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। কিছু মনে করো না, সুচিস্মিতা।”
পিয়াসা স্পর্শের হাত ধরে বললো,
“চলুন আন্টিকে দেখে আসি।”
স্পর্শ মুচকি হেসে বললো,
“চলো।”
দু’জনই স্পর্শের মাকে যেই ঘরে রাখা হয়েছে সেখানে গেলো। স্পর্শের মা মাটিতে শুয়ে আছেন। তার হাত-পায়ের বাঁধন খোলা। স্পর্শ আর পিয়াসা তার পাশে গিয়ে বসলো।
স্পর্শ মায়ের কপালে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো। আর পিয়াসা স্পর্শের কাঁধে হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো।
স্পর্শের চোখ থেকে টপ করে এক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। স্পর্শ ধরা কন্ঠে বললো,
“আমার মা আর কখনোই স্বাভাবিক হবে না। মা সারাজীবন এমনি থাকবে। আমার মাকে এই অবস্থায় দেখে অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছি না। বাবা বেঁচে থাকলে আমাদের পরিবারটা হয়তো সম্পূর্ণ থাকতো। এখন এভাবে বেঁচে থাকতে বড্ড কষ্ট হয় আমার।”
পিয়াসা নরম কন্ঠে বললো,
“তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে হবে? রিম-ঝিমকে বড় করার দায়িত্ব তোমার। আমার বিশ্বাস আন্টি একদিন সুস্থ হয়ে যাবে।”
স্পর্শ অগ্নিদৃষ্টিতে বাসার দিকে তাকালো।
পিয়াসা স্পর্শের অগ্নিদৃষ্টি দেখে মাথা নিচু করে বললো,
“সরি।”
স্পর্শ শক্ত হয়ে বলল,
“আমি জেনে গেছি আমার বাবাকে কে হত্যা করেছে। এখন শুধু খুনিকে প্রমানসহ ধরা বাকি। একবার যদি আমি প্রমান পেয়ে যায়। তাদের একজনও শান্তিতে বাঁচতে পারবে না।”
“কি করবেন আপনি?”
স্পর্শ বাঁকা হেসে বললো,
“কেন ভয় লাগছে?”
“আমি কেন ভয় পাবো?”
স্পর্শ রহস্যময় হাসি দিলো। স্পর্শের হাবভাব দেখে পিয়াসা আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না।
||
চলবে–
#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-২৩: (নতুন মোড়-নতুন অতিথি)
||
সন্ধ্যায় স্পর্শ মায়ের ঘরে একবার উঁকি দিতে গেলো। আর সেখানেই পিয়াসাকে মায়ের পাশে শান্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে সে অবাক হয়ে গেলো। স্পর্শের মা, জাবেদা রহমান পিয়াসাকে কি যেন বলছেন। স্পর্শ জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করছিলো। হঠাৎ পিয়াসার চোখ পড়লো জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা স্পর্শের উপর। সে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
এরপর জাবেদা রহমানের হাত ধরে স্পর্শের দিকে ইশারা করে বললো,
“মা, আপনি কি ওকে চিনতে পারছেন?”
জাবেদা রহমান ছেলের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু কিছুই বললেন না। স্পর্শ সাহস করে ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকতে লাগলো৷ জাবেদা স্পর্শকে কাছে আসতে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন।
পিয়াসা এক ঝটকায় জাবেদাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“মা, উনাকে ভয় পাবেন না। উনি অনেক ভালো। আপনার অনেক খেয়াল রাখেন। আপনার জন্য এই মজার মজার খাবারগুলো তিনিই আনিয়েছেন।”
জাবেদা ছেলের দিকে কিছুক্ষণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এক গাল হাসলেন। তারপর স্পর্শের দিকে হাত এগিয়ে দিলেন। স্পর্শ কাঁপা হাতে মায়ের হাতটি ধরে তার পাশে বসলো।
জাবেদা রহমান বললেন,
“তুমি না অনেক ভালো। অনেক মজার খাবার এনেছো। জানো? আমার চৌধুরী সাহেবও আমার জন্য নিয়ে আসতো মাঝে মাঝে।”
মায়ের কথা শুনে স্পর্শের চোখে অশ্রু টলমল করে উঠলো। মুচকি হেসে বললো,
“মা, আমি খাইয়ে দেবো তোমাকে?”
জাবেদা রহমান পিয়াসার দিকে তাকালো। পিয়াসা হ্যাঁ সূচক ইশারা করার পর তিনি মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলেন।
আজ দুই বছর পর মায়ের কাছে এসেছে স্পর্শ। যেই কাজটি এই দুই বছরে হয় নি, আজ পিয়াসা একদিনেই সেই কাজটি করে ফেলেছে। স্পর্শ পিয়াসার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। মাকে ঘুম পাড়িয়ে স্পর্শ আর পিয়াসা ঘর থেকে বের হলো।
স্পর্শ বললো,
“তুমি কিভাবে পারলে মায়ের কাছে আসতে?”
“আন্টি হয়তো আংকেলের মৃত্যুতে অনেক আঘাত পেয়েছে, তাই তার মানসিক অবস্থা ভালো না। তার মানে এই না যে আন্টি কখনো সুস্থ হবে না। স্পর্শ, আপনি তাকে ভালো ডাক্তার দেখাতে পারেন। তাঁর মস্তিষ্ক এখন চার-পাঁচ বছরের বাচ্চাদের মতো, তাই তিনি এমন আচরণ করছেন। বাচ্চারা যেমন আদর পেলে কাছে আসতে চাই, ঠিক তেমনি আন্টির মনে জায়গা পাওয়ার জন্য আপনার তাকে খুশি করার চেষ্টা করতে হবে। আপনি ছোট বয়সে যা করেছিলেন, এখন সেই সময়টা তার চলছে। আপনি এভাবে ভেঙে পরবেন না, স্পর্শ।”
স্পর্শের গলা ভারী হয়ে আসছে। সে হুট করেই পিয়াসাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। পিয়াসা স্পর্শের ছোঁয়ায় একদম স্থির হয়ে গেলো। স্পর্শ পিয়াসার চোখে চোখ রেখে বললো,
“ধন্যবাদ। আজ তোমার কারণে মা আমার কাছে এসেছে। এতোবছর মা যখন ঘুমিয়ে থাকতো, তখনই আমি তার কাছে যেতে পারতাম। আর আজ! সত্যিই আমার অনেক ভালো লাগছে সুচিস্মিতা।”
পিয়াসা স্পর্শের গালে হাত রেখে বললো,
“আপনার খুশির জন্য আমি সব করতে রাজি। আর এটা তো খুবই সহজ কাজ ছিলো।”
স্পর্শ পিয়াসাকে দেখতে দেখতেই ঘোরের মাঝে চলে গেলো।
রাত দেড়টা। পিয়াসা পুরো বাড়িতে একা। আর স্পর্শ তাদের পুরোনো বাড়িতে ঘুমাচ্ছে। গ্রামের বাড়িতে ভূত আছে এসব কথাবার্তা শুনেই বড় হয়েছে সে। তাই এই বাড়িতে একটা রাত একা কাটাতে হবে ভেবে ভয়ে তার আত্মা বের হয়ে যাচ্ছে। লাইটগুলো সব জ্বালিয়ে সে চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ দরজায় করাঘাত পেয়ে পিয়াসা জড়সড় হয়ে গেলো৷
কাঁপা কন্ঠে বললো,
“ক…কে?”
স্পর্শ উষ্ণ গলায় বললো,
“সুচিস্মিতা, আমি এসেছি।”
পিয়াসা দরজা খুলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
স্পর্শ চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললো,
“কি ব্যাপার ঘুমাচ্ছো না?”
“কিভাবে ঘুমাবো? ভয় লাগছে আমার।”
“কেন ভয় লাগছে?”
“শুনেছি গ্রামে নাকি ভূত আছে।”
পিয়াসার কথা শুনে স্পর্শ শব্দ করে হাসলো। পিয়াসা ভড়কে গেলো স্পর্শের হাসি দেখে৷
ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
“আপনি হাসছেন?”
স্পর্শ পিয়াসার কাছাকাছি এসে বললো,
“আমার কি তোমাকে সঙ্গ দেওয়া উচিত?”
পিয়াসা কোনো উত্তর দিলো না। স্পর্শ পিয়াসার আরো কাছাকাছি আসতে যাচ্ছিলো, কিন্তু পিয়াসা হাত দিয়ে বাঁধা দিয়ে বললো,
“এতোটা কাছে এসে সঙ্গ দিতে হবে না। আমি রাত জাগবো। আপনি আমার পাশে বসে গল্প করবেন। আর সকাল হলে আমি ঘুমাতে যাবো।”
স্পর্শ মুচকি হেসে বললো,
“তোমাকে এখানে এনেছি আমার মায়ের সাথে দেখা করানোর জন্য। আগামীকাল আবার রওনা দেবো আমরা।”
পিয়াসা বললো,
“আমি আপনার ভরসায় এসেছি। আমাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর দায়িত্বও আপনার।”
স্পর্শ মাথা নেড়ে বললো,
“তোমার কোনো ক্ষতি হতে দেবো না আমি।”
পিয়াসা মুচকি হেসে স্পর্শের কাঁধে মাথা রাখলো। আর স্পর্শ মনে মনে বললো,
“আজ তোমার মনে যেই বিশ্বাস অর্জন করেছি, তা আমার প্রতিশোধের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আর একদিন এই বিশ্বাস তোমার জীবনকে কলঙ্কিত করবে। আজ না হয় তুমি বিশুদ্ধ থেকো। আগামীতে তোমাকে অশুদ্ধ করার দায়িত্ব আমার।”
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর স্পর্শ আর পিয়াসা রওনা দিলো শহরের উদ্দেশ্যে। মাঝপথে পিয়াসাকে নিয়ে বাঁশবাড়িয়া নামলো স্পর্শ।
পিয়াসা স্পর্শের হাত ধরে মাঝ সমুদ্রে হাঁটতে লাগলো। সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন আর হাওয়ার তালে পিয়াসা খোলা চোখে স্পর্শকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগলো।
পিয়াসা স্পর্শের হাত শক্ত করে ধরে বললো,
“আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি, স্পর্শ।”
স্পর্শ পিয়াসার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। কিন্তু কোনো জবাব দিলো না।
পিয়াসা ইতস্ততভাবে বললো,
“কিছু বলবেন না?”
“কিছু কথা বারবার বললে সুন্দর দেখায় না। কম বলা ভালো।”
পিয়াসা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো।
কয়েক সপ্তাহ পর-
আজ স্পর্শদের ভার্সিটিতে একটা প্রোগ্রাম আছে। আর অনেক রাজি করিয়ে স্পর্শ সেই প্রোগ্রামে পিয়াসাকে নিয়ে এলো। এর আগের বার রেস্টুরেন্টে যা হয়েছে তারপর পিয়াসার সাহস ছিলো না স্পর্শের বন্ধুদের মুখোমুখি হওয়ার। কিন্তু স্পর্শ যেন জেদ ধরেই ছিলো, পিয়াসা না এলে সে যাবে না প্রোগ্রামে।
শেষমেশ বেগুনি রঙের একটা শাড়ি পড়ে সে স্পর্শদের ক্যাম্পাসে গেলো। ক্যাম্পাসে ঢুকেই স্পর্শ বন্ধুদের সাথেই ব্যস্ত হয়ে গেলো। কিন্তু পিয়াসা আগে থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করে এসেছিলো। তাই সে স্পর্শকে স্পেইস দিয়ে তাদের ক্যাম্পাস একা একাই ঘুরে দেখছিলো।
হঠাৎ পিয়াসা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। তার চোখ আটকে গেলো তার কাছ থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দিকে। সেই মানুষটিও পিয়াসার দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
বেগুনি শাড়ি, হাতে বেগুনি আর সাদা চুড়ি, চুলে সাদা গাজরা, আর পিয়াসার মায়াবী চোখে ভীতি। ছেলেটি তার দৃষ্টি সরাতে পারছে না। তার ঠোঁটের ফাঁকে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে।
পিয়াসা ছেলেটিকে দেখে মাথা নিচু করে নিলো, আর নিজেকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো।
কিন্তু যেই চোখে একবার নেশা ধরে যায়,
সেই চোখের নেশা কাটানো দায়।
এদিকে-
ধীর পায়ে পিয়াসার দিকে এগিয়ে এলো ছেলেটি। পিয়াসা ধরা পড়া চোরের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, আর হাত দুটি বারবার ঘষছে।
ছেলেটি পিয়াসাকে ভালোভাবে দেখে মুচকি হেসে বললো,
“নিঝুম!”
ছেলেটির মুখে নিঝুম নামটি শুনে পিয়াসা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো,
“তিনি হয়তো আমাকে চিনতে পারেন নি!”
ছেলেটি আবার বললো,
“আমি রিয়াদ। চিনেছো পিয়াসা?”
পিয়াসা আমতা-আমতা করে বললো,
“হ…হ্যাঁ, জি চিনেছি।”
পিয়াসা নিজের নাম শুনে বুঝতে পারলো রিয়াদ তাকে চিনে ফেলেছে। আর সাথে সাথেই তার মনে পড়ে গেলো রুদিতা আপু বলেছিলো, রিয়াদ তাকে নিঝুম নামটি দিয়েছিলো। কারণ সে খুব চুপচাপ থাকতো।
রিয়াদ নরম গলায় বললো,
“পিয়াসা, তুমি এখানে কি করছো?”
পিয়াসা এবার কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। রিয়াদ যদি জানতে পারে সে স্পর্শের সাথে এসেছে তাহলে রুদিতা আপুকে জানিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর সে না জানালেও তার সামনে পিয়াসা নিজেকে স্পর্শের প্রেমিকা হিসেবে প্রমাণ করতে চায় না।
যদিও বিয়ের আগে প্রেম-ভালোবাসা বর্তমান সমাজে একটা সাধারণ ঘটনা। কিন্তু আত্মীয়-স্বজনদের কাছে বিষয়টা খুব কম মানুষই খোলাসা করে, আর পিয়াসা তো মাত্র কলেজ পড়ুয়া। এতোটা সাহস এখনো তার হয় নি, যে স্পর্শকে এখনই কোনো আত্মীয় বা কাজিনদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে।
পিয়াসা কিছু একটা ভেবে বললো,
“একটা আপুর সাথে এসেছি। তিনি আমাদের প্রতিবেশী হন। আজকে তার ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম, তাই এলাম। কিন্তু আপনি?”
“এইখানে তো রাদিত পড়ে। ওর সাথে এসেছি।”
“ওহ, রাদিত! আপনার ছোট ভাই, তাই না?”
“হ্যাঁ।”
রিয়াদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
“তোমাকে আমি এর আগেও একটা জায়গায় দেখেছিলাম।”
পিয়াসা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায়?”
“আনোয়ারার আশেপাশে একটা জায়গায়।”
কথাটা শুনে পিয়াসার বুকটা ধক করে উঠলো। মনে মনে বললো,
“হায় আল্লাহ! আমি তো স্পর্শের সাথেই সেখানে গিয়েছিলাম।”
রিয়াদ নিচু স্বরে বললো,
“তোমাকে আমিই বাঁচিয়েছিলাম সেদিন। কিন্তু একটা ছেলে অনেকটা জোরপূর্বক তোমাকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। আমি আমার পরিচয় দেওয়ার সুযোগও পাই নি। ছেলেটা কে ছিলো?”
রিয়াদের চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে আন্দাজ করতে পেরেছে ছেলেটা পিয়াসার কি হতে পারে। কিন্তু তবুও কেন জিজ্ঞেস করছে তা পিয়াসা বুঝতে পারছে না।
পিয়াসাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিয়াদ মুচকি হেসে বললো,
“চলো। একা একা কেন হাঁটছো? এতো বিশাল ক্যাম্পাস! তুমি যদি হারিয়ে যাও?”
রিয়াদ আর পিয়াসা হাঁটতে হাঁটতে স্পর্শ ও তার বন্ধুরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো তার কাছাকাছি চলে এলো। পিয়াসার পাশে একটা ছেলেকে দেখে স্পর্শ খানিকটা অবাক হলো।
||
চলবে-