#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-২৪,২৫
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-২৪:
||
পিয়াসা স্পর্শের দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে রইলো। আর তখনই রিয়াদ হাত নাড়িয়ে রাদিতকে ডাক দিলো।
রাদিত পিয়াসাকে দেখে অবাক হয়ে বললো,
“নিঝুম, ওহ সরি, পিয়াসা কেমন আছো তুমি? আর এখানে কি করছো?”
“ভালো আছি। আসলে একটু ঘুরতে এসেছিলাম।”
পিয়াসা রাদিতের সাথে কথা বলতে বলতে স্পর্শকে মেসেজে পুরো ঘটনা সংক্ষিপ্তভাবে খুলে বললো। স্পর্শ মেসেজটি দেখে সূচিকে বললো পিয়াসাকে সাহায্য করার জন্য। যদিও সূচি জানতো পিয়াসা আর স্পর্শ কাজিন। তাই একটু অবাক হয়ে বললো,
“তুমি আর সুচিস্মিতা তো কাজিন। তাহলে ভয় কিসের?”
স্পর্শ আমতা-আমতা করে বললো,
“সূচি, ও আমার গার্লফ্রেন্ড। ওইদিন আমি প্রস্তুত ছিলাম না তোমাদের সত্যটা জানানোর ব্যাপারে।”
সূচি স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ স্পর্শের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
“আচ্ছা, আমি সাহায্য করবো তোমাদের।”
সূচি পিয়াসা, রাদিত ও রিয়াদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পিয়াসাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“তুমি এখানে? আর আমি তোমায় এতোক্ষণ খুঁজছিলাম।”
পিয়াসা সূচির কথা শুনে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা স্পর্শের দিকে তাকালো। স্পর্শ ইশারায় বোঝালো চিন্তামুক্ত থাকতে।
পিয়াসা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি একটু ঘুরছিলাম আপু।”
পিয়াসা রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“উনিই আমার প্রতিবেশি আপু। উনার সাথেই এসেছি আমি।”
রিয়াদ মুচকি হেসে বললো,
“হ্যালো প্রতিবেশি আপু।”
রাদিত রিয়াদকে গুঁতো দিয়ে বললো,
“ভাই, ও আমাদের জুনিয়র।”
রিয়াদ পিয়াসার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ছোট-বড় সবাইকে আপু বলে সম্বোধন করা যায়।”
পিয়াসা রিয়াদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তার মনে পড়ে গেলো রুদিতা আপুর বিয়ের সময়ের একটি ঘটনা।
ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে খোলা মাঠে কানামাছি খেলছিলো পিয়াসা। আর রিয়াদ দূর থেকে পিয়াসাকে দেখে অবাক হচ্ছিলো। কারণ পিয়াসার মতো বাচ্চাদের একটু বেশি এটেনশন দিতে সে খুব কম মেয়েদের দেখেছে। পিয়াসার বয়সী মেয়েরা তাদের সমবয়সী কারো সাথে গল্প করে বা মোবাইলে ব্যস্ত থেকে সময় কাটায়। কিন্তু পিয়াসা সম্পূর্ণ বিপরীত। সে বাচ্চাদের সাথে হেসে খেলে সময় কাটাতে ভালোবাসে। আর ছোট ছোট বাচ্চাগুলোও পিয়াসাকে পিয়ু আপু বলে ডাকে। রিয়াদের কাছে খুব সুন্দর লেগেছিলো বিষয়টা। সে পিয়াসার কাছে এসে দাঁড়ালো।
পিয়াসা রিয়াদকে দেখে লজ্জা পেয়ে একটু সরে দাঁড়ালো। তারপর একটু উঁচু গলায় একটা বাচ্চাকে বললো,
“ভাইয়া, তুমি আস্তে দৌঁড়াও, নয়তো ব্যথা পাবে।”
পিয়াসার মুখে ভাইয়া ডাকটি শুনে রিয়াদ বললো,
“ভাইয়া…..খুব সুন্দর করে ডাকলে তো! তুমি ছোটদেরও কি এভাবেই মিষ্টি করে ডাকো?”
পিয়াসা মুচকি হেসে বললো,
“হ্যাঁ, ছোট-বড় সবাইকে ভাইয়া বলে সম্বোধন করা যায়। এর ফলে তারা নিজেদের গুরুত্ব দিতে শিখবে।”
রিয়াদ হাসলো। বয়সে ছোট হলেও অনেক কিছুই বুঝে পিয়াসা। কাউকে ভালো লাগার পর তার কোনো গুণ সম্পর্কে জানতে পারলে ভালো লাগা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। রিয়াদের মনেও পিয়াসার প্রতি ভালো লাগা বেড়ে যেতে লাগলো।
পিয়াসা ও রিয়াদ স্পর্শের কন্ঠ শুনে ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এলো।
স্পর্শ বললো,
“আমাদের সাথেও পরিচয় করিয়ে দাও।”
পিয়াসা স্পর্শের কথা শুনে স্পর্শ ও তার বন্ধুদের দেখে ঘাবড়ে গেলো। সূচি হেসে রিয়াদকে বললো,
“ওরা আমার ক্লাসমেট।”
পিয়াসা হালকা হেসে বললো,
“ইনি হলেন রিয়াদ ভাইয়া আর উনি রাদিত ভাইয়া, আমার মামাতো বোন রুদিতা আপুর খালাতো ভাই।”
রিয়াদ স্পর্শকে দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর সবার সাথে পরিচিত হওয়ার পর পিয়াসার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমরা যেহেতু বহিরাগত, তাহলে আমাদের ওইদিকটাই বসা উচিত। চলো।”
পিয়াসা স্পর্শের দিকে এক নজর তাকিয়ে রিয়াদের সাথে আলাদা সীটে বসে পড়লো। স্পর্শও পিয়াসাকে আটকাতে পারলো না। কি বলেই বা আটকাবে? যেহেতু এই মুহূর্তে সে সূচির ক্লাসমেট মাত্র, পিয়াসার তো কিছুই না।
রিয়াদ পিয়াসার সাথে অনেক কথা বললো, সবকিছুই পিয়াসার মা-বাবা, তার পড়াশুনার অবস্থা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এসব নিয়েই। আর পিয়াসা শুধু উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। রিয়াদকে কোনো প্রশ্ন করছে না।
রিয়াদ এবার পিয়াসার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“সব প্রশ্ন কি আমিই করবো? তোমার কি কিছুই জানার নেই?”
পিয়াসা রিয়াদের চোখের দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। তার হঠাৎ তুবার কথা মনে পড়ে গেলো। কারণ এই ছেলেটার প্রতি দুর্বল হয়েই তুবা অনেকগুলো ভুল করে ফেলেছে, এমনকি তার জীবনেও সেই ভুলের ছাপ রেখে গেছে।
রিয়াদ এবার গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
“কোথায় হারিয়ে গেলে নিঝুম?”
পিয়াসা একটু শক্ত কন্ঠে বললো,
“আমি নিঝুম না। আমার নাম পিয়াসা।”
রিয়াদ হেসে বললো,
“আমি তো জানি তোমার নাম পিয়াসা আজীজ। আর পিয়াসা অর্থ কি জানো?”
পিয়াসা রিয়াদের দিকে তাকালো।
রিয়াদ বললো,
“পিয়াসা অর্থ তৃষ্ণা। কি চমৎকার নাম রেখেছে তোমার বাবা-মা! তারা ভেবেছে হয়তো তুমিই কারো জীবনকে একেবারে সম্পূর্ণ করে দিতে পারবে। পানির অপর নাম যেমন জীবন, আর এই পানি যেভাবে মানুষের তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম। ঠিক তেমনি তুমিও হয়তো কারো জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়াবে। আর তুমি কাছে থাকলেই তার সব তৃষ্ণা মুহূর্তেই মিটে যাবে। আর আমি তোমাকে নিঝুম নামটি দিয়েছি, কারণ তুমি অনেক চুপচাপ স্বভাবের। মনে হয় ঘন আঁধারের নিস্তব্ধতার মাঝেও একটা চাঁদ বসে আছে। যার কোনো সাড়া নেই, তবে সে খুব সুন্দর করেই আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে৷ যার ভাষা নেই, তবুও সে মুখের ভঙ্গিতে তার অনুভূতি প্রকাশ করে যায়।”
“মুখের ভঙ্গিতে অনুভূতি প্রকাশ করে বলতে? বুঝলাম না আপনার কথা!”
“তোমার চোখে চোখ না রাখতে পারার ব্যর্থতা, প্রকাশ করে তুমি কিছু লুকাতে চাইছো। তোমার দাঁত চেপে কথা বলা, প্রকাশ করে তুমি কিছু বলতে ইতস্তত করছো। তোমার মাথা নিচু করে মুচকি হাসি দেওয়া প্রকাশ করে, তুমি অনেক লজ্জা পেয়েছো। তোমার স্থির দৃষ্টি প্রকাশ করে, তুমি কোনো কথায় অবাক হয়েছো বা আঘাত পেয়েছো।”
পিয়াসা হেসে বললো,
“এগুলো সবার ক্ষেত্রেই একই। তাই আমার নাম দিয়ে চালিয়ে দিতে হবে না।”
রিয়াদ হেসে বললো,
“এই প্রথম তুমি আমার সাথে একটু বেশি কথা বললে। তুমি কি এখন কথা বলা শিখে গেছো নাকি? আগের পিয়াসা হলে আমার কথার উত্তরে মাথা নিচু করে শুধুই মুচকি হাসতে।”
পিয়াসা এবার মাথা নিচু করে হাসলো। কিন্তু পিয়াসা আর রিয়াদকে একসাথে দেখে স্পর্শের অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। এই অস্থিরতা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় স্পর্শকে এক্ষুনি বের করতে হবে। কারণ অস্থিরতা দুর্বল হয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ। আর সে এই মুহূর্তে দুর্বল হতে চায় না।
আর সে কেনই বা অস্থির হবে? তার দায়িত্ব তো পিয়াসাকে অস্থির করা।
স্টেজ পারফরম্যান্স শুরু হওয়ার পর স্পর্শ ও সূচি একসাথে স্টেজে উঠলো। দুজনই একসাথে কাপল ডান্স দিচ্ছিলো। পিয়াসা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো স্পর্শ ও সূচির দিকে। কেন যেন মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। স্পর্শ ও সূচিকে একসাথে দেখে সহ্য করতে পারছিলো না সে। তাই পিয়াসা সেখান থেকে উঠে চলে এলো। এদিকে রিয়াদ পিয়াসাকে এভাবে উঠে আসতে দেখে তার পিছু পিছু এলো।
পিয়াসার পাশে দাঁড়িয়ে রিয়াদ বললো,
“কি হলো? চলে এলে যে!”
“বাসায় চলে যাবো ভাবছি। কেন যেন ভালো লাগছে না।”
“আমি সহ যাবো?”
“আপনি কেন যাবেন?”
“তোমাকে একা কিভাবে ছাড়বো আমি?”
পিয়াসা মুচকি হেসে বললো,
“আমি একা যেতে পারবো।”
“বেশি কথা না। চলো, আমি নামিয়ে দেবো।”
পিয়াসা দূর থেকে স্পর্শ ও সূচির দিকে তাকালো। তারপর কি ভেবে রাজি হয়ে গেলো।
স্পর্শ স্টেজ থেকে নেমে পিয়াসা ও রিয়াদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। সিয়াম স্পর্শের কাঁধে হাত রেখে বললো,
“হারিয়ে ফেলার সব রাস্তা নিজেই খুলে দিয়ে কি আফসোস করছিস?”
“মানে?”
“বুঝতে পারছিস না, স্পর্শ?”
স্পর্শ নির্বিকার ভাব নিয়ে বললো,
“আমি কিছুই বুঝতে চাই না।”
কথাটি বলে স্পর্শ ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গেলো।
একমাস পর-
আজকাল পিয়াল একটু আলাদা ব্যবহার করছে। দেরীতে বাসায় আসা, সারাক্ষণ ফোনে ব্যস্ত থাকা, বন্ধুদের সময় কম দেওয়া, পড়াশুনার আগেপাছেও না থাকা ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিকেলে স্পর্শ ও তার বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছিলো তখনই শিস দিতে দিতেই ঘরে ঢুকলো পিয়াল।
পিয়ালকে দেখেই নিশান বলে উঠলো,
“কি রে তুই বাসায় আজ এতো তাড়াতাড়ি এলি যে? তোকে রাত বারোটার আগে ঘরে তো ভাবায় যায় না। কি এমন নতুন রঙ লেগেছে কে জানে!”
পিয়াল কিছু না বলে রুমে চলে গেলো। পিয়ালের এই ভাবটা কারোই পছন্দ হলো না। এদিকে পিয়াল রুমে ঢুকে ফোন হাতে নিয়ে তার প্রিয় নম্বরটিতে ফোন করলো।
“কেমন আছো, তিয়াসা? তোমাকে খুব মিস করছি।”
“ভালো আছি। আচ্ছা, তুমি কিন্তু তোমার বন্ধুদের বলবে না আমার কথা। আমি চাই আমাদের সম্পর্কটা যাতে সিক্রেট থাকে। আর আমি কিন্তু সেই শর্তেই রাজি হয়েছি।”
“আরে আমার তিয়ু, আমি কাউকে জানাবো না। ভালোবাসি যে তোমায়।”
তিয়াশা রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো,
“আমিও যে ভালোবাসি।”
এদিকে-
পিয়াসার বাবা মিস্টার আজীজ খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন কয়েকদিন ধরে। অফিসেও অনেক দিন যাচ্ছেন না। বেশিরভাগই ফোনে ব্যস্ত থাকেন। কার সাথে যেন কথা বলে তিনি কখনো ঝগড়া করেন বা কখনো উদ্বিগ্ন কন্ঠে কথা বলেন। পিয়াসা এসব কিছুই বুঝে না। তবে বাবা-মার চুপচাপ ভাবটা দেখে এইটুকু বুঝতে পারলো কোনো না কোনো ঝামেলা চলছে।
বিকেলে কলেজের পর স্পর্শের সাথে দেখা করলো পিয়াসা।
পিয়াসার মন খারাপ দেখে স্পর্শ জিজ্ঞেস করলো,
“কি ব্যাপার মন খারাপ কেন? কিছু কি হয়েছে?”
“না, তেমন কিছু না। আসলে বাবার মন ভালো না। হয়তো ব্যবসায় কোনো সমস্যা হয়েছে।”
পিয়াসার কথাটি শুনে বাঁকা হেসে কফির কাপে চুমুক দিলো স্পর্শ। পিয়াসা এদিকে স্পর্শকে তার পারিবারিক সমস্যার গল্প শুনাচ্ছে আর স্পর্শ আয়েশ করে কফিতে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ পিয়াসা স্পর্শের হাত ধরে বললো,
“আমি তোমাকে অনেক বিশ্বাস করি স্পর্শ। তুমি সবসময় আমার পাশে থাকবে তো?”
স্পর্শ পিয়াসার গালে হাত রেখে বললো,
“আমি কি পারবো তোমাকে ফেলে দিতে?”
স্পর্শের সাথে দেখা করেই বাসায় ফেরার পথে একটা রিকশায় তুবাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। পিয়াসা মনে মনে বললো,
“এটাতো তুবা ছিলো! কিন্তু তুবার পাশে ছেলেটা কে? ছেলেটাকেও পরিচিত মনে হচ্ছে যে!”
পিয়াসা বাসায় ফিরেই কিছু একটা ভেবে স্পর্শকে ফোন করে বললো,
“হ্যালো, তুমি তোমার বন্ধুদের ছবি পাঠাতে পারবে? কিছু মনে করো না। প্রয়োজনেই চাইলাম।”
স্পর্শ পিয়াসার কথায় একটু অবাক হয়ে বললো,
“আচ্ছা দিচ্ছি, কিন্তু আগে প্রয়োজনটা আমাকে বলো।”
“আগে দাও, নিশ্চিত হয়েই তোমাকে বলবো।”
স্পর্শ তার বন্ধুদের ছবি পাঠানোর পর একজনের ছবি দেখে পিয়াসা মনে মনে বললো,
“এটাই তো সেই ছেলে যাকে তুবার সাথে আজ দেখেছি। তুবা এখন স্পর্শের বন্ধুকেও ছাড় দিলো না?”
স্পর্শ ছবি পাঠানোর পর আবার কল দিলো। জিজ্ঞেস করলো,
“কি হলো? বলবে না?”
পিয়াসা স্পর্শের এক বন্ধুর ছবি মার্ক করে তাকে পাঠিয়ে বললো,
“আমি এই ছেলেটাকে আজ দেখেছিলাম রিকশায়, আমার বান্ধবীর সাথে। আমার মনে হয়েছিলো তোমার সাথেই দেখেছি। তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য ছবি চাইলাম।”
স্পর্শ ছবি দেখে বললো,
“পিয়াল?”
“হুম, নাম তো জানি না।”
স্পর্শ অবাক হলো। আর মনে মনে ভাবলো,
“পিয়াল নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছে কিন্তু আমাদেরই জানালো না? অদ্ভুত তো!”
এদিকে পিয়াসা তুবাকে ফোন করে বললো আগামীকাল দেখা করতে। পিয়াসার কথামত পরের দিন তুবা চলেও এলো।
পিয়াসা তুবাকে দেখে শুরুতেই কোনো খোঁজ খবর না নিয়ে রাগী গলায় বললো,
“আবার আরেকটা ধরেছিস তুই?”
তুবা পিয়াসার কথাটি শুনে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে নির্বিকার ভাব নিয়ে বললো,
“শুনেছি রিয়াদের সাথে দেখা হয়েছে তোর? পিয়ু, রিয়াদ আর স্পর্শ দু’জনই আছে তোর। আমাকেও আমার মতো থাকতে দে। আমি তো আটকাচ্ছি না তোকে।”
“আমি রিয়াদ ভাইয়াকে ভালোবাসি না তুবা। তুই চাইলে আমি তোর আর রিয়াদ ভাইয়ার একটা সম্পর্ক সৃষ্টি করিয়ে দিতে পারবো। কিন্তু তবুও এসব ছেড়ে দে। তুই নিজের ভবিষ্যতটা দেখ। কখনো এসব জানাজানি হয়ে গেলে?”
“আরেহ আমি তো জাস্ট রিলেশন করছি, খাচ্ছি, ঘুরছি আর শপিং করছি। কারো সাথে ঘুমাচ্ছি না যেভাবে ভবিষ্যতের কথা তুলছিস।”
পিয়াসা তুবার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো। তারপর ঠাস করে তুবার গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বললো,
“আমার লজ্জা করছে তোকে আমার কাজিন বলতে। তুই আসলে কোনো ভালো ছেলে ডিজার্ভই করিস না।”
কথাটি বলেই পিয়াসা চলে গেলো। আর তুবা ছলছল চোখে পিয়াসার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
মনে মনে বললো,
“ভালোবেসেও ভালোবাসা পাই নি আমি। তাই আজ সেই ভালোবাসাকেই কিনে নিয়েছি।”
||
চলবে-
#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-২৫:
||
স্তব্ধ হয়ে বাড়ির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পিয়াসা। তার চোখের কোণে অশ্রু জমছে। পিয়াসার পাশেই তার মা, মিসেস আজীজ দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছেন। সবাই তাকে শান্ত করতে ব্যস্ত।
পিয়াসার বাবা মিস্টার আজীজকে পুলিশ ভ্যানে উঠানো হয়েছে। কারণ তাকে দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার করছে পুলিশ। পিয়াসা ও তার পরিবারের কেউই বিশ্বাস করতে পারছে না আজীজ এমন কিছু করতে হবে। তিনি বারবার বলেই যাচ্ছেন, তাকে ফাঁসানো হয়েছে। কিন্তু কেউ তাকে বাঁচাতে পারছে না, কারণ প্রমাণের অভাব।
পিয়াসা তার বাবাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা। আর তাই বাবাকে এই অবস্থায় দেখে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে।
এদিকে স্পর্শ ও তার বন্ধুরা ছাদে উঠে এই পুরো ঘটনার মজা নিচ্ছে। শুধুমাত্র আকাশ আর হাবীব ছাড়া সবাই পিয়াসার মলিন মুখ দেখে হাসি-তামাশা করছে।
নিশান স্পর্শের কাঁধে হাত রেখে বললো,
“তোর প্রতিশোধের একটি ধাপ যথাযথভাবে শেষ হয়েছে।”
স্পর্শ চুপ করে দাঁড়িয়ে পিয়াসাকে দেখছে। সে নিশানের কথার কোনো উত্তর দিলো না।
রুদিতার কাছ থেকে পিয়াসার বাবার গ্রেফতারের খবর পেয়ে রিয়াদ এক মিনিটও অপেক্ষা করলো না। সে সোজা পিয়াসাকে দেখতে তার বাসায় চলে এলো। এর আগে স্পর্শদের ভার্সিটি থেকে পিয়াসাকে তার বাসায় নামিয়ে দিয়েছিলো রিয়াদ। তাই বাসা খুঁজে পেতে সমস্যা হয় নি তার। পিয়াসা যেই এলাকায় থাকে রিয়াদ যখন সেই এলাকায় ঢুকছিলো, তখনই পুলিশ ভ্যান তার গাড়িটা অতিক্রম করে চলে যায়। রিয়াদ গাড়ি থেকে নেমে পিয়াসাকে দেখে অনেক কষ্ট পেলো। এর আগে সে কখনোই পিয়াসাকে এতোটা বিধ্বস্ত দেখে নি৷
পিয়াসা এখনো স্থির দৃষ্টিতে শূন্য রাস্তার দিকেই তাকিয়ে আছে। রিয়াদ পিয়াসার কাছে এসে তার হাতটা শক্ত করে ধরলো। পিয়াসা তার ভেজা চোখ দুটি রিয়াদের চোখের মাঝে আবদ্ধ করলো। ক্ষীণ কন্ঠে পিয়াসা বললো,
“আমার বাবা অনেক ভালো। কেউ হয়তো বাবাকে ফাঁসিয়েছে।”
রিয়াদ পিয়াসার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“আল্লাহর উপর ভরসা রেখো। তুমি নিজেকে এভাবে দুর্বল করে দিও না।”
ছাদ থেকে রিয়াদ আর পিয়াসাকে একসাথে দেখে স্পর্শের বন্ধু তকির বললো,
“সুচিস্মিতার তো দেখছি এই ছেলের সাথে ভালোই সম্পর্ক। এর আগেও ক্যাম্পাসে ছেলেটিকে দেখেছি, আর আজও।”
স্পর্শের চোখ দুটিতে ভীষণ রাগ ফুটে উঠেছে। সে হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে। সিয়াম স্পর্শের দিকে একনজর তাকিয়ে বুঝলো তার মেজাজ খুব খারাপ। এক্ষুনি তাকে শান্ত করতে হবে। নয়তো আবার কি না কি করে বসে। তকিরকে ইশারায় চুপ করিয়ে দিলো সিয়াম। তারপর স্পর্শের কাঁধে হাত রেখে বললো,
“স্পর্শ, চল ঘরে যায়। তোর এতোদিনের পরিকল্পনা তো পরিপূর্ণ হলো আজ। এখন একটু মাথাটা ঠান্ডা রাখ।”
স্পর্শ সিয়ামের কথা শুনে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। তারপর বাঁকা হেসে বললো,
“খুব শীঘ্রই আরেকটি ধাপ শুরু হবে।”
স্পর্শের কথা শুনে তার বন্ধুরা অবাক হয়ে গেলো। শাকিল জিজ্ঞেস করলো,
“এবার কি করবি?”
স্পর্শ বুকে হাত গুঁজে বললো,
“বিয়ে করবো সুচিস্মিতাকে।”
স্পর্শের বন্ধুরা হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
পিয়াল বললো,
“বিয়ে? সুচিস্মিতাকে? ব্রো, আর ইউ সিরিয়াস?”
তকির রাগী কন্ঠে বললো,
“ওই মেয়েটাকে তুই বিয়ে করবি?”
নিশান হেসে বললো,
“দূর, স্পর্শ আমাদের সাথে ফাজলামো করছে। তাই না দোস্ত?”
শাকিল কিছু একটা ভেবে বললো,
“আমি যা ভাবছি, তুই কি তা-ই করবি?”
সিয়াম আর পিয়াল শাকিলের দিকে তাকিয়ে একসাথে বললো,
“তুই আবার কি ভাবছিস?”
শাকিল স্পর্শের কাঁধে হাত রেখে বললো,
“তুই ওকে বিয়ে করে কষ্ট দিবি?”
শাকিলের কথায় নিশান আর তকির অট্টহাসি দিয়ে উঠলো। নিশান বললো,
“সিনেমা হবে, সিনেমা। আর আমরা দেখবো লাইভ সিনেমা।”
স্পর্শ শীতল কণ্ঠে বললো,
“বিয়ে করে ছেড়ে দেবো। তবে এর আগে আরো কিছু কাজ বাকী।”
তকির দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,
“বিয়ে না করেই বরং কাজটা করে ফেল। বিয়ে করে ঝামেলা বাড়াচ্ছিস কেন? আমরাও না হয়…….”
কথাটা শেষ করার আগেই স্পর্শের অগ্নি দৃষ্টি দেখে তকির চুপ হয়ে গেলো।
স্পর্শ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“আমরা না হয় বলতে কি বোঝাতে চাইছিস?”
তকির আমতা-আমতা করে বললো,
“ত…তুই যা ভাবছিস তা না৷”
আকাশ তকিরের কলার চেপে ধরে বললো,
“একটা মেয়েকে নিয়ে এমন বাজে কথা বলতে তোর লজ্জা করে না?”
তকির মাথা নিচু করে বললো,
“সরি, স্পর্শ।”
স্পর্শ রাগী কন্ঠে বললো,
“সুচিস্মিতাকে আঘাত করার অধিকার আমার। আর ভালোবাসবোও আমি একাই। কেউ ওর দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকাতে পারবে না।”
কথাটি বলেই স্পর্শ নিচে নেমে গেলো। স্পর্শ নামার পর শাকিল তকির আর নিশানের দিকে আঙ্গুল তাক করে বললো,
“তোদের দুজনের মতলব খারাপ। খবরদার৷ বাজে চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দে। মেয়েটার সাথে আমাদের কোনো লেনদেন নেই। স্পর্শ তার সাথে যা ইচ্ছে করুক। আমরা এর মধ্যে যাতে না থাকি। আফটার অল আমাদের একটা ভবিষ্যৎ আছে।
তকির আর নিশান মাথা নিচু করে ছাদ থেকে নেমে গেলো। শাকিলও তাদের জ্ঞান দিতে দিতেই নামলো। কিন্তু পিয়াল আর সিয়াম চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
পিয়ালের পিয়াসার জন্য অনেক খারাপ লাগছে। নতুন প্রেমে পড়ার পর থেকেই তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তার নতুন প্রেমিকা তিয়াশাকে সে অনেক ভালোবাসে। তবে সে এখনো জানতে পারে নি, তিয়াশাই হলো পিয়াসার কাজিন তুবা। তবে পিয়ালের মেয়েদের প্রতি আলাদা একটা ভক্তি জন্ম নিয়েছে। তাই সে পিয়াসার কষ্টে মনে মনে একটু হলেও কষ্ট পায়। যেমনটা এই মুহূর্তে সিয়ামে পাচ্ছে। স্পর্শ তার প্রথম প্রেমে পড়ার সংবাদটি সিয়ামকেই দিয়েছিলো। যেহেতু সে-ই স্পর্শের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। পিয়াসাকে ভালোবেসে ফেলার পর থেকে ঘৃণা করার আগ পর্যন্ত স্পর্শের মনে পিয়াসার প্রতি যতো অনুভূতি ছিলো, সব কথায় সে সিয়ামের সাথেই ভাগ করতো। তাই সিয়ামের দৃষ্টিতে পিয়াসা একটু আলাদা, আর খুন করার মতো অপরাধকে সমর্থন করা বা অনেক ছেলেদের সাথে প্রেম করার মতো মেয়ে সে নয়৷ কিন্তু স্পর্শ পিয়াসাকে ঘৃণা করার পর থেকেই তার সব অনুভূতিগুলো ঘৃণার নিচে চাপা পড়ে গেছে। তাই প্রতিশোধের আগুনে স্পর্শ বুঝতে পারছে না, পিয়াসা খারাপ নাও হতে পারে। কিন্তু সিয়াম যেহেতু অনুভূতি আর প্রতিশোধ উভয়ের বাইরে অবস্থান করছে, তাই সে বুঝতে পারছে এখানে কিছু একটার ঘাটতি আছে। কিন্তু কিসের ঘাটতি তা সে বের করতে পারছে না। আর না পারছে স্পর্শকে বোঝাতে। যতোবারই সে স্পর্শকে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে বলে ততোবারই নিশান আর তকির তাকে উসকে দেয়।
অন্যদিকে আকাশ আর হাবীব এসবের মধ্যে একেবারেই নিজেদের সংযুক্ত রাখতে চাইছে না। তারা হুমকি দিয়ে দেয়, যদি পিয়াসার সাথে খারাপ কিছু করার চিন্তা করে তাহলে থানায় মামলা করবে। তাই আকাশ আর হাবীবকে বাসা থেকে বের করে দেওয়ার জন্য তকির আর নিশান অনেক কিছুই করেছে। কিন্তু সিয়ামের কথায় তারা আর যায় নি। কারণ সিয়াম জানে তাদের ভয়ে কোনো অঘটন ঘটবে না। কিন্তু তারা চলে গেলে নিশান আর তকির খুব সহজেই স্পর্শকে বিগড়ে দিতে পারবে। আর তখন কিছুই হাতের নাগালে থাকবে না।
একটা উক্তি আছে,
“কিছু নকল বন্ধু এবং তাদের বিষাক্ত শক্তি আপনার শুভ সত্ত্বাকে প্রসারিত ও উন্নত করা থেকে বিরত রাখতে পারে।”
ঠিক তেমনি স্পর্শের জন্য তকির আর নিশান হচ্ছে বিষাক্ত শক্তি। তারা উভয়ে স্পর্শকে ধীরে ধীরে পিয়াসার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আর স্পর্শও চোখ বন্ধ করে হারিয়ে যাচ্ছে মিথ্যে জগতে।
তুবা খালুর খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পিয়াসার বাসায় চলে এলো। যদিও পিয়াসা তার উপর খুবই রেগে আছে। তবুও বোনের পাশে থাকাটা তার কাছে এই মুহূর্তে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তাই কোনো কিছু না ভেবেই সে চলে এসেছে।
এদিকে রিয়াদ পিয়াসার পাশে বসে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। বাসায় এখন কান্নাকাটির রোল। পিয়াসার মামা-চাচারা ভালো উকিলের সাথে যোগাযোগ করতে ব্যস্ত, আর মামী-চাচীরা সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে মিসেস আজীজকে।
আর রিয়াদ হাঁটু গেড়ে পিয়াসার পাশে বসে আছে তার হাত ধরে৷ কারোরই সেদিকে খেয়াল না থাকলেও তুবার দৃষ্টি রিয়াদ আর পিয়াসার বদ্ধ হাতের মাঝেই আটকে গেছে। তার বুকটা হঠাৎ করেই মুচড়ে উঠলো। তবুও নিজেকে সংযত করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো।
তুবা গলির মোড়ে অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে রিয়াদ আর পিয়াসার কথায় ভাবছে। হঠাৎ পরিচিত কন্ঠের স্বর শুনে সে পেছন ফিরে তাকালো৷ সামনে থাকা মানুষটিকে দেখে তার চোখ কপালে উঠলো। অস্ফুটস্বরে বললো,
“পিয়াল!”
পিয়াল অবাকের সাথে খুশিও হলো। হেসে তুবাকে রাস্তার মাঝে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তিয়ু, মাই লাভ, তুমি এখানে?”
তুবা এক ঝটকায় পিয়ালকে সরিয়ে দিয়ে বললো,
“কি করছো তুমি? রাস্তায় কেউ এমন করে?”
পিয়াল মুচকি হেসে বললো,
“এটা আবার নতুন কি? আমরা কবে লুকিয়ে লুকিয়ে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরেছি, বলো?”
তুবা রাগী কন্ঠে বললো,
“এখানে আমার এক আত্মীয়ের বাসা আছে। কেউ দেখে ফেললে?”
“সত্যিই? আমার বাসাও এইখানে। চলো তোমাকে আমার বন্ধুদের সাথে দেখা করিয়ে দেই। তারা অনেকদিন ধরেই আমার পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইছে। কিন্তু তোমার সেই যত্তসব উল্টোপাল্টা শর্ত!”
“খবরদার, উল্টোপাল্টা শর্ত বলবে না। আর এখন যাও তো।”
পিয়াল নরম সুরে বললো,
“রাগ করেছো, তিয়াশা?”
তুবা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“এখানেই কি সব কথা বলবে?”
“তুমি চাইলে তোমাকে নিয়ে যেতে পারি অন্য এক রাজ্যে।”
“সরি, আমি এখন প্রচুর ব্যস্ত। তোমাকে এই মুহূর্তে সময় দেওয়া সম্ভব না।”
কথাটি বলে তুবা হন হন করে চলে গেলো। আর পিয়াল চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
||
চলবে–