অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-২৬

0
682

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-২৬
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ

||

প্রতিদিন পিয়াসাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে থাকে স্পর্শ। বারবার পিয়াসাকে বোঝায়, সে আজীজ সাহেবের জন্য অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্পর্শই পিয়াসার বাবার এই পরিণতির জন্য দায়ী।
স্পর্শ তার মামার এক বন্ধুর সহায়তা নিয়ে পিয়াসার বাবার নামে মিথ্যে মামলা দায়ের করে। যার ফলে পিয়াসার বাবা আজ বিনা অপরাধে শাস্তি পাচ্ছে। স্পর্শের সাথে পিয়াসার বাবার কোনো শত্রুতা ছিলো না। কিন্তু পিয়াসার উপর প্রতিশোধ নিতেই সে সর্বপ্রথম আজীজ সাহেবকেই টার্গেট করে। কারণ পিয়াসাকে দুর্বল করার একমাত্র মাধ্যম আজীজ।

এদিকে-
পিয়াসা রাত দিন বাবার চিন্তায় অস্থির থাকে। আর পিয়াসার এই অবস্থায় পিয়াসাকে পুরোপুরি সঙ্গ দেয় রিয়াদ।

আজীজ সাহেবের উপর মামলা হওয়ার পর থেকে শুধু তাকে জেল থেকে ছাড়ানোর ব্যাপার নিয়েই নয়, পুরো পরিবার এখন পিয়াসার ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত। পিয়াসা তার বাবা-মায়ের একমাত্র কন্যা। আর তাদের বংশও যথেষ্ট ভালো। কিন্তু বাবার অপরাধে মেয়ে সারাজীবন কেন শাস্তি ভোগ করবে? পিয়াসার ভবিষ্যৎ কি? পিয়াসার জন্য কি ভালো ঘর থেকে কখনো প্রস্তাব আসবে না? এসব প্রশ্ন শুনতে শুনতে পিয়াসা ক্লান্ত।

অন্যদিকে সবার চিন্তার অবসান ঘটিয়ে রিয়াদ পিয়াসাকে বিয়ে করার প্রস্তাব রাখলো৷ রিয়াদের পরিবারের প্রথমে আপত্তি থাকলেও রুদিতা সবাইকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে ফেললো। মিসেস আজীজেরও এতে কোনো সমস্যা নেই। রিয়াদ ছেলে হিসেবে অনেক ভালো। আর এখন তো শুধুই কথাবার্তা বলে পাকাপাকি করেছে। বিয়ে আরো কয়েকবছর পর হবে। কিন্তু রিয়াদের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে তা পিয়াসা এখনো জানতে পারে নি। কারণ তাকে কেউ জানায় নি। আর না জানানোরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
মিসেস আজীজ এখন মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তাটা বাদ দিয়ে স্বামীর মুক্তির অপেক্ষায় বসে আছেন।

আজ কলেজের পর পিয়াসা স্পর্শকে ফোন দিয়ে বললো,
“তুমি আমার সাথে একটু দেখা করবে?”

স্পর্শ বললো,
“তুমি তো জানোই আমি এখন খুব ব্যস্ত। আমার এক সপ্তাহ পর পরীক্ষা।”

পিয়াসা মলিন মুখে বললো,
“স্পর্শ, আমি এই মুহূর্তে খুবই একা।”

স্পর্শ কোনো প্রতিক্রিয়া না দিয়েই ফোন কেটে দিলো। আর পিয়াসা মন খারাপ করে একটা রিকশা নিয়ে চলে গেলো তার প্রিয় জায়গাটিতে। সারসন রোডের মুখে রিকশা থামিয়ে একা একা হাঁটতে লাগলো সে। তার এই রাস্তায় একা একা হাঁটতে ভালোই লাগে। যানবাহনের ভীড় তেমন একটা না থাকায় অনায়েসে হাঁটতে পারে সে। হাঁটতে হাঁটতেই পিয়াসা ভাবছে, কেন সে স্পর্শকে যেভাবে চেয়েছে, ওভাবে পায় নি? কেন স্পর্শ কখনোই তার প্রয়োজনে পাশে ছিলো না? কেন সে স্পর্শের ভালোবাসায় ঘাটতি খুঁজে পায়? তার কেন মনে হয় স্পর্শ তাকে ওতোটা ভালোবাসে না, যতোটা সে স্পর্শকে ভালোবাসে?

এসব ভাবতে ভাবতেই পিয়াসার মনে ভীতির সৃষ্টি হলো। স্পর্শকে প্রচন্ডরকমের ভালোবেসে ফেলেছে সে। এখন স্পর্শকে হারিয়ে ফেললে পিয়াসা সত্যি সত্যিই হয়তো পাগল হয়ে যাবে।

হঠাৎ পিয়াসার ফোনে রিয়াদের কল আসায় তার ভাবনায় ছেদ পড়লো। কল রিসিভ করার পর রিয়াদ বললো,
“নিঝুম, তুমি কি এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছো?”

“না। কেন?”

“কোথায় তুমি?”

“আমি সারসন রোডে।”

“তুমি ওখানে কি করছো?”

“এমনি হাঁটতে এলাম।”

“আচ্ছা তুমি দাঁড়াও রাস্তার মোড়ে। আমি কয়েক মিনিটের মধ্যেই আসছি।”

পিয়াসা মোড়ে এসে দাঁড়ানোর দুই মিনিটের মধ্যেই রিয়াদ চলে এলো। তারপর পিয়াসাকে সাথে নিয়ে চলে গেলো একটি রেস্টুরেন্টে।

পিয়াসা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?”

“হ্যাপি বার্থডে, নিঝুম।”

“আপনি কিভাবে জানলেন আজ আমার জন্মদিন?”

“আমি তো প্রথম থেকেই জানতাম। আর জেনে নেওয়ার মানুষের কি অভাব আছে, বলো?”

“ধন্যবাদ।”

পিয়াসা মনে মনে বললো,
“আজ তোমাকে আমার পাশে চেয়েছিলাম, স্পর্শ। কিন্তু তোমার হাতে তো আমার জন্য কোনো সময় নেই।”

রিয়াদ আজ পুরো দিন পিয়াসার মুখে হাসি ফোটাতেই ব্যস্ত ছিলো। আর সে সক্ষমও হয়েছে। পিয়াসাকে নিয়ে আলাদা ভাবে লাঞ্চ করা, বিকেলে শপিংমলে নিয়ে যাওয়া, তারপর সন্ধ্যায় সবাই মিলে একসাথে কেক কাটা। সবকিছুই রিয়াদ পিয়াসার জন্যই করেছিলো। খানিকক্ষণের জন্য পিয়াসা ভুলেই গিয়েছিলো যে বাবা এখন তার কাছে নেই। কারণ এই দিনটিতে পিয়াসা ঠিক এমন সব আবদার করতো তার বাবাকে। আর আজীজ সাহেব একমাত্র মেয়ের সব আবদার পূরণ করতেন।

সন্ধ্যায় সব সারপ্রাইজ পাওয়া শেষে পিয়াসা রিয়াদের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,
“যা আশা করিনি আজ তার চেয়েও বেশি পেয়েছি। আপনাকে কিভাবে ধন্যবাদ দেবো আমি?”

“ধন্যবাদ দিতে হবে না।”

পিয়াসা মুচকি হেসে বললো,
“বাবা কিন্তু পরের বছর থেকে আমাদের সাথেই থাকবে।”

“অবশ্যই।”

এরপর রিয়াদ মনে মনে বলল,
“আমিও থাকতে চাই তোমার মনের কাছাকাছি। খুব শীঘ্রই তুমি আমার হবে, নিঝুম।”

এদিকে-

তুবা আর পিয়ালের প্রেম ভালোই চলছে। পিয়াল দিন দিন তুবার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। তুবা ছাড়া যেন সে কিছুই ভাবতে পারে না। তুবার রাগ ভাঙানোর জন্য সে সবকিছুই করতে প্রস্তুত। অন্যদিকে পিয়ালের সব অভ্যাসই তুবার অনেক ভালো লাগে। ধীরে ধীরে সেও পিয়ালকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। কিন্তু যেই সম্পর্কটার শুরুই হয়েছে মিথ্যে নামের মাধ্যমে সেই সম্পর্কের পরিণতিটা কেমন হতে পারে তা তুবা ভালোভাবেই জানে৷ তাই সে পিয়ালকে আর সত্য জানানোর সাহস পায় নি।

বিকেলে তুবা পিয়ালের কাঁধে মাথা রেখে গল্প করছিলো। হঠাৎ পিয়ালের ফোনের দিকে তাকিয়ে তুবা স্তব্ধ হয়ে গেলো। পিয়াল তুবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
“কি দেখছো?”

তুবা ফোনের দিকে ইঙ্গিত করে বললো,
“ছেলেটাকে কে?”

পিয়াল স্পর্শের ছবির দিকে তাকিয়ে বললো,
“স্পর্শ, আমার বন্ধু। আমরা একসাথেই থাকি। বলতে পারো এই বন্ধুগুলোই আমার সবকিছু।”

পিয়ালের কথাটি শুনে তুবার বুকটা ধক করে উঠলো। পিয়াসাও কিছুদিন আগে এসে বলেছিলো স্পর্শের বন্ধু পিয়াল। কিন্তু সেই মুহূর্তে সে এসব গায়ে মাখে নি। ভেবেছিলো জানাজানি হলে কি আর হবে? সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে! এর চেয়ে বেশি কিছু তো আর হবে না। কিন্তু তুবার কাছে এখন এই সম্পর্কটাই যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

পিয়াল তুবাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো,
“কি ভাবছো?”

তুবা কিছু একটা ভেবে বললো,
“তুমি না বললে তোমরা একসাথে থাকো? কোথায় থাকো একসাথে? ওইদিন যে রাস্তায় দেখা হয়েছিলো ওই গলিতেই থাকো?”

“হ্যাঁ। ওখানেই থাকি।”

তুবা কিছুটা অবাক হলো৷ মনে মনে বললো,
“স্পর্শ পিয়ুর বাসায় পাশেই থাকে, অথচ পিয়ু জানেই না। নাকি পিয়ুকে বলে নি। কিন্তু কেন বলে নি?”

পিয়াল হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“স্পর্শের জন্য খুব খারাপ লাগে। ওর বাবার মৃত্যুর পর ও খুব শক্ত হয়ে গেছে। ওর অনুভূতিগুলোও সব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তুমি বিশ্বাসও করতে পারবে না স্পর্শ কতোটা ভালো ছেলে ছিল।”

তুবা বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“যেভাবে বলছো মনে হচ্ছে এখন খারাপ হয়ে গেছে!”

পিয়াল মলিন মুখে মাথা নেড়ে বললো,
“হুম, এখন বড্ড খারাপ হয়ে গেছে।”

“কিভাবে বুঝলে খারাপ হয়ে গেছে? নেশা করে না তো?”

পিয়াল তুবার কথা শুনে হাসতে লাগলো। তুবা অবাক হয়ে বললো,
“হাসার মতো কি বললাম আমি?”

“আরেহ দূর, সিগারেট ছাড়া কিছুই খায় না। ওতোটাও খারাপ হয় নি৷ কিন্তু যারা ওর বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী তাদের জন্যই সে অনেক খারাপ হয়ে গেছে।”

তুবা বিস্ফোরিত চোখে পিয়ালের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বুঝলাম না ঠিক।”

“আংকেলকে যারা খুন করেছে আর যারা সাহায্য করেছে তারা কেউই শাস্তি পায় নি। কারণ কোনো প্রমাণ নেই তার কাছে। আর যে এই খুনের সত্যতা প্রমাণ করতে পারবে সেই মেয়েটিকেই স্পর্শ প্রচন্ড ভালোবাসতো। কিন্তু মেয়েটি ধোঁকা দিয়ে সেই খুনির সাথে সম্পর্ক রেখেছিলো। আর এগুলো জানার পর থেকেই স্পর্শ মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলো।”

তুবা স্তব্ধ হয়ে পিয়ালের কথাগুলো শুনেই যাচ্ছে। তার চোখ দুটি জ্বালা করছে খুব। ধরা গলায় বললো,
“এখন কি সেই মেয়েটাকে আর ভালোবাসে না?”

“না, প্রচন্ড ঘৃণা করে।”

“তাহলে সম্পর্ক রেখেছে কেন?”

পিয়াল মুখ ফসকে বলে ফেললো,
“প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।”

কথাটি বলেই পিয়াল তুবার দিকে তাকালো। ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুমি কিভাবে জানলে স্পর্শ মেয়েটির সাথেই সম্পর্ক রেখেছে?”

তুবা আমতা-আমতা করে বললো,
“তুমিই তো বললে।”

“আমি তো বলি নি। সত্যিই আমি বলেছিলাম?”

তুবা পিয়ালকে বুঝিয়ে দিয়ে বললো,
“আরেহ তুমিই বলেছিলে। নয়তো আমি কিভাবে জানবো?”

“ওহ, হয়তো আমিই বলেছি।”

তুবার মাথা সম্পূর্ণ খালি হয়ে গেছে। স্পর্শ পিয়াসার কাছ থেকে প্রতিশোধ নিচ্ছে, কিন্তু কেন? যেই অপরাধ তুবা করেছে, সেই অপরাধের শাস্তি পিয়াসা কেন পাবে?

তুবা মনে মনে বললো,
“আমি আজই পিয়ুকে সব জানিয়ে দেবো। কিন্তু ও কি আমাকে বিশ্বাস করবে?”

||

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here