অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-২৭,২৮

0
594

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-২৭,২৮
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-২৭:

||

তুবা অনেকক্ষণ ধরেই পিয়াসাকে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পিয়াসা কল রিসিভ করছে না। বিরক্ত হয়ে তুবা পিয়াসার বাসায় চলে এলো। বাসায় এসে দেখলো পিয়াসা মন খারাপ করে বসে আছে। তুবা পিয়াসার পাশে বসে বললো,
“কেমন আছিস পিয়ু?”

পিয়াসা তুবার পাশ থেকে সরে গিয়ে একটু দূরে গিয়ে বসলো। তুবা পিয়াসার ব্যবহারে মলিন হেসে বললো,
“জানি আমি অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছি। কিন্তু এবার আমি মিথ্যে নই। আমি সত্যিই পিয়ালকে ভালোবেসে ফেলেছি। আর তোর সাথে যেই অন্যায় করেছি, তার জন্যও আমি এখন অনুতপ্ত।”

পিয়াসা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আমার তোকে কিছুই বলার নেই। তবে এইটুকু বলবো, যা হয়েছে আমি তা মনে করতে চাই না আর।”

তুবা পিয়াসার পাশে এসে দাঁড়ালো। তারপর পিয়াসার কাঁধে হাত রেখে বললো,
“তোর কাছে একটা আবদার করবো, রাখিস প্লিজ।”

“কি আবদার?”

“স্পর্শকে ভুলে যা পিয়ু।”

পিয়াসা অবাক দৃষ্টিতে তুবার দিকে তাকালো। তুবা পিয়াসার হাত ধরে বললো,
“পিয়ু, স্পর্শ তোকে ভালোবাসে না৷ পিয়ালই আমাকে বলেছে। স্পর্শ প্রতিশোধ নিতে চাইছে তোর থেকে। ও মনে করছে, তুই ওর বাবার খুনিকে সাহায্য করেছিস।”

পিয়াসা এক ঝটকায় তুবার হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
“এমন কেন মনে করবে স্পর্শ?”

“কারণ আমি অতিন্দ্রিয়া সেজে রকির সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম। কিন্তু স্পর্শ মনে করে তুই অতিন্দ্রিয়া। কারণ ছবিটা তোরই ছিলো। রকি ভাবতো সে তোর সাথে প্রেম করছে৷ আর……”

পিয়াসা তুবাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“স্পর্শ কখনোই এমন করবে না।”

তুবা জোর গলায় বললো,
“আমাকে আগে কথাটা শেষ করতে দে।”

পিয়াসা কোনো উত্তর না দিয়ে তুবার দিকে তাকিয়ে রইলো। রকি কিভাবে এই খুন করেছিলো আর তুবা রকিকে কিভাবে সাহায্য করেছিলো সবকিছুই পিয়াসাকে জানিয়ে দিলো তুবা। সব শুনে পিয়াসা দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠলো।

তুবা পিয়াসার হাত ধরে বললো,
“ছেলেটা তোকে ভালোবাসে না পিয়ু। ও তোকে ব্যবহার করছে। ও তোর ক্ষতি করতে চায়। তুই স্পর্শকে ছেড়ে দে৷ স্পর্শকে ভুলে যা পিয়ু।”

পিয়াসার চোখ বেয়ে দরদর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। সে বিশ্বাস করতে পারছে না তুবাকে। আবার স্পর্শের ব্যবহার দেখে তুবাকে মিথ্যেও বলতে পারছে না। কারণ স্পর্শ সম্পর্কের শুরু থেকেই পিয়াসার ব্যাপারে খুব উদাসীন ছিলো৷ পিয়াসা যতোটুকু ভালোবাসা দিয়েছিলো এই সম্পর্কে, তার অর্ধেকও স্পর্শ দেয় নি। তাই কেন যেন বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝেই আটকে গেছে পিয়াসা।

তুবার কথায় বাস্তবে ফিরে এলো পিয়াসা। তুবা বললো,
“রিয়াদ ভাইয়া কিন্তু তোর অনেক খেয়াল রাখে৷ তুই বরং একবার উনাকে নিয়ে ভেবে দেখিস।”

কথাটি শুনে পিয়াসা রাগী দৃষ্টিতে তুবার দিকে তাকালো। তারপর চেঁচিয়ে বললো,
“আমি স্পর্শকে তোর কথায় অবিশ্বাস করতে পারবো না। হয়তো নিজের সম্পর্ক বাঁচানোর জন্য তুই স্পর্শকে ভুল প্রমাণ করতে চাইছিস। আর তুই রকিকে সাহায্য করে অনেক বড় অন্যায় করেছিস। স্পর্শ যদি জানতে পারে তুই এসবে জড়িত ছিলি, তোকে কি মনে করবে ও?”

“স্পর্শ কিছু মনে করুক বা না করুক, তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। কিন্তু তোর কোনো ক্ষতি হোক সেটা আমি কিভাবে মেনে নেবো?”

“তুবা, তোর কথা যদি সত্য হয়, তাহলে আমার সবচেয়ে বড় ক্ষতি তুই করেছিস।”

পিয়াসা চোখের জল মুছে বললো,
“স্পর্শকে আমি জিজ্ঞেস করবো কেন এমন করেছে!”

তুবা ব্যস্ত হয়ে বললো,
“পিয়ু, এমন করিস না বোন। তুই স্পর্শকে সব জানিয়ে দিলে আমার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। আমি না বুঝে ভুল করে ফেলেছি। আমি একবার রিয়াদকে হারিয়েছিলাম। এখন বুঝেছি রিয়াদ আমার জেদ ছিলো। কিন্তু পিয়ালকে আমি অনেক ভালোবাসি। আমার অতীত জানলে ও আমাকে ঘৃণা করবে।”

“আর স্পর্শ যে আমাকে ঘৃণা করে? আমি কিভাবে মেনে নেবো এই সত্যটা?”

“তুই ওকে ভুলে যা। স্পর্শ তোকে ভালোই বাসে না। ভালোবাসলে কি কখনো প্রতিশোধ নিতে আসতো?”

পিয়াসা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
“তুই এখনো নিজেরটাই ভাবছিস। তুই অনেক স্বার্থপর তুবা।”

তুবা মাথা নিচু করে রইলো। মনে মনে বললো,
“পিয়ু যদি জানতে পারে স্পর্শ ওকে এখনো ভালোবাসে। তাহলে ও সব জানিয়ে দেবে স্পর্শকে। আর ওদের সম্পর্কটা তখন ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার আর পিয়ালের সম্পর্কটাই তখন শেষ হয়ে যাবে। আমার পিয়ুকে বোঝাতে হবে স্পর্শ ওকে শুধুই ঘৃণা করে। ঘৃণার আড়ালে যেই ভালোবাসাটা আছে ওটা দেখিয়ে দিলে, স্পর্শ আর পিয়াসা কখনোই আলাদা হবে না। বরং আমিই আমার ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলবো।”

তুবার বলা কথাগুলো ঝড়ের বেগে পিয়াসার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না স্পর্শ তাকে এতো বড়ো ধোঁকা দিচ্ছে। সারারাত নির্ঘুম বসে ছিলো পিয়াসা। নিজেকে খুবই একা মনে হচ্ছে তার। অন্যদিকে পাশের ঘরে পিয়াসার মা নামাজে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছেন। স্বামীর মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত তার চোখে ঘুম আসবে না হয়তো।
ঘরটিকে মনে হচ্ছে মৃত ঘর। যেন কোনো প্রাণ নেই এই ঘরে থাকা মানুষদের।

এদিকে-
সকালের সূর্যরশ্নি জানালের পর্দা ভেদ করে আসতেই পিয়াসা বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। সারা রাত বিছানায় শুধু এপাশ ওপাশ করেই কাটিয়েছে। সকাল হতেই ফ্রেশ হয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে প্রথমেই স্পর্শকে ফোন করলো। রিং হতেই পিয়াসা ভাবতে লাগলো।

“আমি একবার স্পর্শকে কিছু বলার সুযোগ দিতে চাই। না জানিয়ে আমি এই সম্পর্ক ত্যাগ করতে পারবো না।”

অপরপাশে কল রিসিভ হতেই পিয়াসা থমকে গেলো। স্পর্শ হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে। কিন্তু পিয়াসা কোনো উত্তর দিতে পারছে না। শব্দগুলো তার কন্ঠনালীতেই আটকে গেছে। তার নিজেকে এই মুহূর্তে বোবা মনে হচ্ছে।

স্পর্শ বললো,
“সুচিস্মিতা, কথা বলছো না যে?”

“স্পর্শ, একটা প্রশ্ন ছিলো।”

স্পর্শ অবাক হয়ে বললো,
“কি প্রশ্ন?”

“তুমি কেন ফিরে এসেছিলে আমার জীবনে? ভালোবাসতে তাই নাকি অন্য কিছু?”

স্পর্শ পিয়াসার কথা শুনে চুপসে গেলো। মনে মনে বললো,
“ও হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন করলো?”

পিয়াসা তাগাদা দিয়ে বললো,
“খুব বেশি সময় নেই। ছোট একটা উত্তর। কিন্তু এতো সময় নিচ্ছো কেন?”

স্পর্শ নরম কন্ঠে বলতে লাগলো,
“আমি তোমার প্রশ্ন শুনে হঠাৎ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এই কয়েকদিন পড়ার চাপে তোমাকে কম সময় দিচ্ছি, তাই তুমি এমন প্রশ্ন করছো কিনা তাই ভাবছিলাম। আমিও বুঝতে পারছি অনেক কম সময় দিচ্ছি, আমার সুচিস্মিতাকে। কিন্তু আমি ওতো ভালো বয়ফ্রেন্ড হয়তো হতে পারি নি। তাই তুমি হয়তো বারবার আমার উপর অসন্তুষ্ট হও। আর আমি ভাবছিলাম তুমি আমাকে বুঝবে। জানি তোমার পরিবারের অবস্থা এখন ভালো নেই। আর আমি এই মুহূর্তে তোমাকে সময়ও দিতে পারছি না। কিন্তু সুচিস্মিতা, আমার মায়ের চিকিৎসা করানো, আমার বোনদের ভবিষ্যতের জন্য আমাকে ভালোভাবে পড়াশুনা করতে হবে। তুমি তো আছোই আমার পাশে। তুমি আছো এই আশায় তো আমি এখনো শক্ত আছি। নয়তো অনেক দুর্বল হয়ে যেতাম।”

স্পর্শের কথায় পিয়াসার মনের ভার কিছুটা কমলো। তবুও সে শক্ত কন্ঠে বললো,
“আমার প্রশ্নের উত্তরটা সোজাসুজি দাও।”

“ভালোবাসি তাই।”

“তুমি কিভাবে জানলে আমার ঠিকানা?”

“আমি তো হঠাৎ একদিন তোমাকে একটা গলির মোড়ে দেখেছিলাম। তারপর থেকেই তোমার পিছু নিয়েছি। আর এরপর একদিন তোমার সামনে চলে এসেছি।”

“ভালোবাসলে অনেক আগেও ফিরতে পারতে।”

“আমার কাছে ওই মুহূর্তে তোমাকে খোঁজার চেয়েও আমার মা আর বোন দুটির পাশে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আর খুঁজে পেলেও কি হতো? আমার সবকিছু জেনে তুমি যদি আমার কাছে থাকতে না চাইতে? আর আমার মস্তিষ্ক তোমাকে খুঁজে নেওয়ার অবস্থায় ছিলো না তখন। আমার অবস্থানে থাকলে তুমি হয়তো বুঝতে পারতে। আর আমি তো ভেবেছি তুমি সারাজীবন আমার কাছে স্মৃতি হয়েই থাকবে।”

“তুমি একটাবার সেই এলাকায় গিয়ে খোঁজ নিতে পারতে।”

স্পর্শ শীতল কণ্ঠে বললো,
“আমার বাবা খুন হয়েছিলো ওই এলাকায়। আমার দ্বিতীয়বার সাহস ছিলো না ওখানে যাওয়ার।”

“তুমি জানো কারা মেরেছে তোমার বাবাকে?”

স্পর্শ কিছু একটা ভেবে শীতল কণ্ঠে বললো,
“রকি খুন করেছিলো। কারণ আমি ওকে মেরেছিলাম। সুচিস্মিতা, তোমার মনে আছে আমি প্রতিদিন তোমাকে ফলো করতাম?”

“হ্যাঁ।”

“একদিন রকি তোমাকে বিরক্ত করছিলো। সেদিন আমি রকিকে বলতে গিয়েছিলাম যাতে তোমাকে আর কখনো বিরক্ত না করে। কিন্তু সেদিন সে অকারণেই আমার সাথে হাতাহাতি করে বসলো। এরপর থেকে সেই ক্ষোভটা নিয়েই বসেছিলো রকি। আর একদিন আমার বাবাকে খুন করেই সেই প্রতিশোধ নিয়েছিলো।”

পিয়াসা অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললো,
“তুমি কি ভাবছো আমার কারণেই তোমার বাবার খুন হয়েছে?”

“কখনো না। ওমন কথা তুমি কিভাবে ভাবলে?”

“হয়তো প্রতিশোধ নিচ্ছো আমার থেকে।”

স্পর্শ কথাটি শুনে একদম চুপ করে রইলো। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। পিয়াসা যে তাকে সন্দেহ করছে এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত৷ বরং সন্দেহটা এতোদিন কেন ছিলো না সেটাতেই বেশি অবাক ছিলো স্পর্শ। কারণ স্পর্শের দৃষ্টিতে অতিন্দ্রিয়ায় পিয়াসা। আর অতিন্দ্রিয়া সব জেনেশুনে দ্বিতীয় বার স্পর্শের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে, তাও আবার তার স্পর্শের প্রতি ছিলো অন্ধবিশ্বাস। এই বিষয়টা নিয়েই এতোদিন ভাবছিলো স্পর্শ। আর আজ সেই সন্দেহের তীর এতোদিন পর নিশানা খোঁজে পেলো? স্পর্শ ভাবছে, এটা হয়তো অতিন্দ্রিয়ার নিজেকে ইনোসেন্ট প্রমাণ করার কৌশল।

সে মনে মনে নিজেকে বলতে লাগলো,
“আমি কোনো কৌশলেই ধরা দেবো না। তোমার কাছে প্রমাণ করেই ছাড়বো যে আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি আর আমি তোমার ব্যাপারে কিছুই জানি না। তোমাকে বুঝতেই হবে, আমি এখনো তোমাতেই আসক্ত।”

স্পর্শ নরম কন্ঠে পিয়াসাকে বললো,
“যদি তাই ভাবো তাহলে তুমি আমাকে ছেড়ে দাও। তবুও এমন কথা বলো না। জীবনে আপন বলতে মা আর দুই বোন ছাড়া কেউ নেই, যেখানে মা মানসিক ভাবে খুব অসুস্থ। তোমাকেও আমি আপন ভেবে ফেলেছি, আর তুমি এখন এসব বলছো? আল্লাহ হাফেজ। রাখছি আমি। ভালো থেকো সুচিস্মিতা।”

পিয়াসাকে কিছু বলতে না দিয়ে স্পর্শ ফোন কেটে দিলো। আর মনে মনে বললো,
“এখন যদি তুমি ফিরে আসো তাহলে আগের পরিকল্পনায় সব চলবে। আর যদি ফিরে না আসো তাহলে তোমাকে জোর করেই ফিরিয়ে আনবো। তবুও তুমি আমারই হবে সুচিস্মিতা।”

পিয়াসা চুপচাপ ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। স্পর্শকে প্রতারক ভাবতে পারছে না। আবার অন্ধবিশ্বাস করতেও ভয় লাগছে। ভয়টা যে একেবারে মনে চেপে বসেছে, এখন প্রাণ খুলে ভালোবাসার সাহসটাও পাচ্ছে না সে।

||

চলবে–

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-২৮:

||

আজকাল অনুভূতিগুলো দাম হারিয়ে ফেলেছে। চোখ বন্ধ করে ফেলে আসা সেই দাম হারানো অনুভূতির কথা ভাবছে পিয়াসা। জীবনটা হঠাৎ এভাবে মোড় ঘুরিয়ে ফেলবে তা কল্পনায় করে নি সে। যেই মানুষটিকে অসম্ভব ভালোবেসেছিলো সেই মানুষটিই এখন তার কাছে অপরাধী।

এদিকে স্পর্শকে ঘিরে ধরেছে তার বন্ধুরা। পিয়াসাকে ফাঁসানোর জন্য নতুন পরিকল্পনা করছে নিশান আর তকির। আর স্পর্শ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। অন্যদিকে আজ রাতেই স্পর্শের বন্ধু আকাশ আর হাবীব নতুন বাসায় উঠবে, তাদের সাথে পিয়ালও এই বাসা ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে। সবকিছুর ভীড়ে স্পর্শের মনের মধ্যে শূণতা কাজ করছে।
রুমের মধ্যে কেউ প্যাকিং করতে ব্যস্ত আর কেউ পরিকল্পনা করতে ব্যস্ত। সব শব্দ মিলেমিশে হট্টগোল বাঁধিয়ে দিয়েছে স্পর্শের মাথায়। একপ্রকার বিরক্ত হয়েই সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে ছাদে চলে গেলো সে। ছাদে গিয়ে পিয়াসার বাসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সিয়ামও স্পর্শের পিছুপিছু ছাদে চলে এলো। সে স্পর্শের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
“মন খারাপ?”

স্পর্শ মলিন হেসে বললো,
“আমার সুচিস্মিতাকে ভুলতে খুব কষ্ট হবে। আমি এখনো মানতে পারছি না ও সবকিছু জেনে গেছে। ও জেনে গেছে আমি ওর সাথে প্রতারণা করছি। ও জানে আমি ওকে ভালোবাসি না। যা ছিলো সব অভিনয়। কিন্তু সত্যটা অন্যরকম। সত্যটা হলো আমি ওর সাথেই সারাজীবন কাটাতে চাই।”

“তুই একবার মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে দেখ, কেন রকিকে সাহায্য করেছে।”

“চোরকে চুরির কথা জিজ্ঞেস করলে কখনো কি স্বীকার করবে? আচ্ছা বাদ দে এসব কথা। ও এমনিতেই আমার সাথে কথা বলছে না। আগামীকাল থেকে ওর কলেজের ফাইনাল এক্সাম শুরু। হয়তো এই জন্যই ফোন দিচ্ছে না।”

এদিকে তুবা ইনিয়েবিনিয়ে স্পর্শের সব তথ্য পিয়াল থেকে নিয়ে নিচ্ছে পিয়াসা আর স্পর্শের সম্পর্কটা পুরোপুরি ভাঙানোর জন্য। আর তুবা সফলও হয়েছে। এক মাসের মধ্যেই তার হাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ চলে আসে। আর সে সাথে সাথেই পিয়াসার কাছে যায় স্পর্শের মিথ্যে সম্পর্কের রহস্য উন্মোচন করতে।

পিয়াসা সবেমাত্র পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরিছে তখনই তুবাকে তার রুমে বসা দেখে কিছুটা বিরক্তবোধ করলো। তুবা পিয়াসাকে দেখার সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করলো,
“তোর আর স্পর্শের সম্পর্ক কি শেষ?”

পিয়াসা বিরক্তির সুরে বললো,
“এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে তুই বাসায় এসেছিস?”

“না।”

“তাহলে কেন এসেছিস সেটাই বল।”

“কিছু ছবি দেখাতে এসেছি।”

“ছবি দেখাতে কেউ বাসায় আসে? হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালেও চলতো।”

তুবা পিয়াসার কথা শুনে মলিন মুখে বললো,
“মনে হচ্ছে আমি এসেছি তাই খুব বিরক্ত হয়েছিস?”

পিয়াসা শীতল দৃষ্টিতে তুবার দিকে তাকালে, তুবা ছবিগুলো পিয়াসার দিকে এগিয়ে দিলো। পিয়াসা ছবিগুলো দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলো।

তুবা বললো,
“দেখেছিস? স্পর্শই সেই ছেলেটা যে তোদের আগের এলাকায় গিয়েছিলো, আর জোর করে বাসায় ঢুকেছিলো। ও তোর উপর নজর রাখার জন্য তোর বাসার আশেপাশেই বাসা খুঁজছিলো। আর এখন তোদের সামনের বিল্ডিংটাতেই স্পর্শ থাকে। আর এই ছবিটা দেখ। কিছু কি পরিচিত মনে হচ্ছে?”

পিয়াসা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“বখাটে বাইকারটা।”

“জি, এটা তোর প্রেমিকই। আর বাইকটা শাকিলের। পিয়াল আমাকে বলেছে ওদের সব বন্ধুদের মধ্যে শুধু শাকিলেরই বাইক আছে।”

“কিন্তু ও এসব কেন করেছিলো?”

“কারণ ও তোকে মানসিকভাবে ভেঙে দিতে চেয়েছিলো, যাতে তুই ডিপ্রেশনে থাকিস। আর ডিপ্রেশনে থাকা মানুষগুলো একটু ভালোবাসা পেলেই লুফে নেয়। তাদের সহজে বোকা বানানো যায়। আর সেদিন খুলশিতে তোকে ইচ্ছে করে দুই ঘন্টা বসিয়ে রাখা, আর আনোয়ারাতে তোকে ওর বন্ধুদের সামনে অপমান করাটাও ওর পরিকল্পনায় ছিলো। আরেকটা পরিকল্পনা ছিলো তোর বিশ্বাস অর্জন করা। এবার তুই আমাকে উত্তর দে, তুই কি কখনো ওর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলি?”

“হ্যাঁ।”

“ও অনেক যত্ন নিয়েছিলো তাই না?”

“হুম। এখানেও কি কোনো কারণ আছে?”

“হ্যাঁ, আছে। ও চেয়েছে তোর কাছে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য প্রেমিক হিসেবে প্রমাণ করতে। নয়তো এতোদূর একটা ছেলে আর একটা মেয়ে, অন্ধকার রাতে একসাথে একটা বাড়িতে! ও তোকে সেদিন পবিত্র রেখেছে, ভবিষ্যতে তোকে কলুষিত করার জন্য।”

পিয়াসার পুরো পৃথিবী থমকে গেছে তুবার কাছ থেকে এমন কথা শুনে। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না সে এতোদিন মিথ্যে ভালোবাসাকে সত্য ও পবিত্র ভাবছিলো।

তুবা আবার বললো,
“শেষ ছবিটা দেখেছিস? মেয়েটাকে চিনিস?”

“হ্যাঁ, চিনি। সূচি, স্পর্শের ক্লাসমেট।”

তুবা হালকা হেসে বললো,
“পিয়াল তো বললো সূচি ওর গার্লফ্রেন্ড। আর সূচি তোর ব্যাপারে মানে অতিন্দ্রিয়ার ব্যাপারে সবকিছুই জানে।”

পিয়াসা মলিন মুখে তুবার দিকে তাকিয়ে রইলো। তুবা পিয়াসার হাত ধরে তাকে সান্ত্বনা দিতে যাবে তখনই পিয়াসা এক ঝটকায় তুবাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
“আমি অতিন্দ্রিয়া নই। তুই অতিন্দ্রিয়া। তোর জন্য আমি কেন এসব সহ্য করছি?”

“সরি পিয়ু। কিন্তু এখন তোকেই অতিন্দ্রিয়া সাজতে হবে। কারণ আমি পিয়ালের কাছে নিজেকে দোষী প্রমাণ করতে চাই না। ভালো হয়, তুই স্পর্শকে ছেড়ে দিয়ে নতুন জীবন শুরু কর।”

পিয়াসা রাগী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তুবার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর তুবার হাত চেপে তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বললো,
“তুই আমার বোন কখনোই ছিলি না। তুই হচ্ছিস আমার সবচেয়ে বড় শত্রু। তুই শুধু নিজের দিকটাই ভাবছিস। আর হ্যাঁ, আমি স্পর্শের সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেবো, কিন্তু নিজেকে সঠিক প্রমান করার পর। এভাবে অন্যের চোখে অপরাধী হয়ে আমি বেঁচে থাকতে পারবো না।”

পিয়াসা দরজা বন্ধ করে দিতে যাবে তখনই তুবা বললো,
“তুই অতিন্দ্রিয়া না সেটা কিভাবে প্রমাণ করবি? রকি মনে করে তুই অতিন্দ্রিয়া, স্পর্শও মনে করে তুই অতিন্দ্রিয়া। স্পর্শের কাছে যা প্রমাণ আছে সব কিছুই তোকেই অপরাধী হিসেবে প্রমাণ করে। তাহলে তুই কিভাবে নিজেকে সঠিক প্রমান করবি?”

পিয়াসা অবাক দৃষ্টিতে তুবার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
“এসব নোংরা খেলা কোথা থেকে শিখেছিস তুবা?”

“আমি পিয়ালের চোখে অপরাধী হতে চাই না। আর এর জন্য আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।”

“আমার আর কিছুই বলার নেই। আজ আমার ক্ষতি যারা করেছে কাল তারা নিশ্চিত এই পাপের শাস্তি পাবে। আমি অভিশাপ দিচ্ছি না। অভিশাপ দেওয়ার মতো অধিকার আমার নেই। কিন্তু আমার মনের আক্ষেপ সৃষ্টিকর্তা তো বুঝবেন। একটা কথা তো আছেই, আল্লাহ ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না।”

“ভয় দেখাচ্ছিস আমাকে?”

পিয়াসা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। তারপর গুটি গুটি পায়ে মায়ের ঘরে চলে গেলো। মিসেস আজীজ ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছেন। স্বামীর চিন্তায় তার চোখে ঘুম নেই, তাই জোর করেই ঘুমানোর জন্য তিনি এই ওষুধ খাচ্ছেন। পিয়াসা চুপচাপ মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। তারপর মায়ের হাত ধরে নিরবে চোখের জল ফেলতে লাগলো। আর মনে মনে বললো,
“জীবনে প্রথম ভালোবেসেছি সাথে ধাক্কাও খেয়েছি। এই ধাক্কা আমাকে অনেক বেশি বড় করে দিয়েছে। এখন আমার মধ্যে হয়তো কোনো ভালোবাসায় আর অবশিষ্ট নেই।”

কয়েকদিন পর-
পিয়াসা পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফেরার পথে স্পর্শ তার সামনে এসে দাঁড়ালো। স্পর্শ পিয়াসার হাত ধরে বললো,
“তুমি কি আমার সাথে আর কথা বলবে না? তুমি আমাকে কোন বিষয়ে ভুল বুঝছো?”

পিয়াসা স্পর্শের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। স্পর্শ পিয়াসাকে এক পাশে নিয়ে গিয়ে বললো,
“কি হয়েছে? কথা বলছো না কেন? এতোদিন ভেবেছি তোমার পরীক্ষা চলছে তাই কথা বলছো না। আর এখন পরীক্ষা শেষ তবুও?”

পিয়াসা ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“তুমি ভালোভাবেই জানো আমি কেন কথা বলছি না। তাই তুমি আমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় বসে ছিলে এই কথা বলো না।”

“চলো আমরা কোথাও বসি।”

“না, দুইঘন্টা খুলশিতে বসিয়ে রেখেছিলে আর বলেছিলে মায়ের সাথে কথা বলছো। কিন্তু যেদিন তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম দেখেছিলাম আন্টি তোমার সাথে কথা বলা তো বহুদূর, তোমার কাছেও আসতে চায় না। কিন্তু সেদিন আমার মাথায় এসব আসে নি। তোমার নিজের কথায় তুমি সেদিনই ফেঁসে গিয়েছিলে। কিন্তু আমি বোকা, তোমাকে চিনতে পারি নি।”

“সুচি…..”

স্পর্শকে থামিয়ে দিয়ে পিয়াসা বললো,
“শাট আপ। আমি সুচিস্মিতা নই। তোমার দৃষ্টিতে আমি একজন আসামী। তাই প্রতিশোধ নিতে ফিরে এসেছো। কিন্তু আমার ভালোবাসাটা তুমি কখনো অনুভব করতে পারো নি। পারলে বুঝতে আসামী কি আদৌ আসামী, নাকি তোমার দেওয়া একটা মিথ্যে অপবাদের অপরাধী।”

স্পর্শ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। এই মুহূর্তে সে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।

পিয়াসা আবার বললো,
“আমি নিজেকে সঠিক প্রমান করতে পারবো না। তবে একটা কথা বলবো, আমি কারো সাথে কখনোই ছলনা করি নি। আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে কখনোই ভালোবাসিনি। আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু আমি তো তোমার কাছে মাত্র কয়েকদিনের আবেগ ছিলাম। তুমি আমাকে কখনোই ভালোবাসো নি। ভালোবাসলে তুমি মিথ্যে অপবাদ নিয়ে আমার কাছে প্রতিশোধ নিতে আসতে না। তুমি সূচির সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছো। কিন্তু আমার সাথে যা ছিলো সব অভিনয়। আর আমি তো এতোদিন স্বপ্ন দেখছিলাম। একটা অপ্রিয় মুহূর্তের স্বপ্ন। এই মুহূর্তটা যে হঠাৎ অপ্রিয় হয়ে উঠবে তা আমি কখনোই কল্পনা করি নি।”

পিয়াসা মাথা নিচু করে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর স্পর্শের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি তোমার বাবার খুনিকে সাহায্য করি নি। আমার সাথেই অনেক বড় অন্যায় হয়েছে। তাই তুমি আরেকবার বিচার করে দেখো। হয়তো তোমার ভুল ভাঙতে পারে।”

কথাটি বলে পিয়াসা চলে গেলো। আর স্পর্শ এখনো সেই স্থানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। তার বুকটা একদম খালি খালি লাগছে। নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে তার প্রিয় সুচিস্মিতাকে আটকাতে আর বলতে
“আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমিও তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। আমার ভালোবাসা, ঘৃণা কোনটাই অভিনয় ছিলো না। আমি তোমাকে যতোটা যত্নের সাথে ভালোবেসেছিলাম, ততোটাই নিষ্ঠার সাথে ঘৃণা করেছি। কারণ তোমাকে ঘৃণা না করলে আমার বাবার সাথে অন্যায় করা হতো। আর আমি এই অন্যায় কখনোই করতে পারতাম না। কোনো প্রমান যদি তোমাকে একটাবারের জন্য নিরপরাধী প্রমান করতে পারে, আমি সত্যিই তোমাকে আর কখনো ঘৃণা করতাম না। প্রিয় মানুষকে ঘৃণা করতেও কষ্ট হয়। এই কষ্ট কেউ বুঝবে না। আমার কাছে তোমার আর রকির সেই কথোপকথনের ছবিগুলো আছে, যেটা প্রমান করে দেয় তুমিই আমার বাবার হত্যার সাথে জড়িত। তাহলে তোমাকে কেন ক্ষমা করবো আমি? কোন যুক্তিতে আমি প্রতারক? প্রতারণা তো তুমিই আমার সাথে করেছিলে।”

পিয়াসা রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর অশ্রু জড়াচ্ছে আর মিথ্যে পৃথিবী থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য মুখে মাস্ক আর চোখে গ্লাস লাগিয়েছে। অশ্রুগুলো এই মিথ্যে মানুষগুলো বুঝবে না। যেখানে প্রিয় বোন আর প্রিয় মানুষটিই মিথ্যে, সেখানে মুহূর্ত আর জগতটিকে বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে পিয়াসার।

||

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here