#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,বোনাস পর্ব
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
কয়েক দিন পর পিয়াসা স্পর্শের কথামতো রকির সাথে দেখা করতে তার বাড়িতে গেলো। পিয়াসা যদিও মনে মনে ভয় পাচ্ছিলো, তবুও সে অনেক সাহস নিয়েই রকির সাথে দেখা করতে গিয়েছে। স্পর্শ পিয়াসাকে একটা রেকর্ডার দিয়েছে, যাতে তাদের কথোপকথন অটো রেকর্ড হয়ে যায়।
পিয়াসা জীবনে প্রথম এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। ছোটবেলা থেকেই তার আর্মিতে জয়েন করার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু বয়স যতোই বাড়তে লাগলো তার নিজেকে নিজের কাছেই দুর্বল মনে হতে লাগলো। তবে আজ সেই ছোটবেলার ইচ্ছে শক্তিটা বাড়িয়ে পিয়াসা মনে মনে নিজেকে একজন গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য মনে করতে লাগলো। মনকে বোঝাতে লাগলো, এটা তার মিশন। আর এই মিশন সাকসেসফুল হলেই, সে তার পরিবারকে রক্ষা করতে পারবে। যদিও এটা সে শুধুই মনকে শক্ত করার জন্য ভাবছিলো। কিন্তু সত্যটা হলো, তার এই মুহূর্তে প্রচন্ড ভয় করছে।
পিয়াসা রকির জন্য বাইরে অপেক্ষা করছিলো। আর মনে মনে সে আল্লাহকে ডাকছিলো।
পিয়াসা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, সত্যের বিজয় অবশ্যই হবে। আর এই সত্যটাও খুব শীঘ্রই প্রকাশ পাবে।
আজ স্পর্শ যদি তাকে অপহরণ না করতো, তবুও সে স্পর্শের বাবার খুনীদের শাস্তির জন্য যতোটুকু করা যায়, তার সবটুকুই করতো। স্পর্শ তাকে ব্ল্যাকমেইল করে বাধ্য করেছে এই জায়গায় আসতে। অথচ, স্পর্শ একটাবার তাকে আবদার করলো না? তাকে একবার সুন্দর করে অনুরোধ করতো। পিয়াসা সেই অনুরোধে তার জীবনটাই ত্যাগ করে দিতো। কিন্তু আজ স্পর্শকে তার বিশ্বাস হচ্ছে না। হ্যাঁ, যদিও সে এখনো ভালোবাসে স্পর্শকে। ঘৃণা করতে পারছে না। বরং মায়া হচ্ছে স্পর্শকে দেখে। কিন্তু বিশ্বাসটা যে হারিয়ে গেছে।
সম্পর্কে শুধু ভালোবাসা থাকলে হয় না, বিশ্বাসটাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পিয়াসা তো স্পর্শকে আর কখনোই বিশ্বাস করতে পারবে না। তাই এই সম্পর্ক হয়তো আর কখনোই জোড়া লাগানো সম্ভব নয়।
বিশ্বাস একপ্রকার আয়না,
যা ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগানো যায় না,
আর জোড়া লাগালেও তা আর সুন্দর দেখায় না,
তাই বিশ্বাস ভাঙলে তার কোনো সংশোধনই মানায় না।
রকি পিয়াসাকে দেখেই চমকে উঠলো। সে অবাক হয়ে বললো,
“তুমি ওই এলাকার মাইয়া? কি জানি নাম তোমার……হুমমমম?”
রকি কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
“অতিন্দ্রিয়া। হো, তোমার লগেই তো প্রেম করছি। তা তুমি কি মনে করে আইলা? তোমার বাবা তো আমার লগে তোমার বিয়ায় দিলো না। কতোবার কইরা প্রস্তাব পাঠাইলাম। আমি কি কোনো অংশে কম? আমি এখন নেতার লগে উঠা বসা করি।”
পিয়াসা সাহস করে বললো,
“তাই তো চলে এসেছি আবার। আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি, রকি। কিন্তু ওই মুহূর্তে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। বাবা-মা জেনে গিয়েছিলো আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে। আমাকে অনেক বকাও দিয়েছে। বলেছে, তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাতে আমি কোনো কথা না বলি। জানো, আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। বাবা, আমার উপর এতো কড়া নজরদারি করেছিলো, আমি আর তোমার সাথে যোগাযোগই করতে পারি নি। তারপর ভেবেছি, পড়াশুনা শেষ করে না হয় কিছু একটা করবো। ততোদিনে বাবা-মার বিশ্বাসটাও অর্জন করে নিয়েছি। আর আজ অনেক কষ্ট করেই তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। আবার দেরী করে ফিরলে যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি?”
রকি পিয়াসার কথাশুনে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। সে খুশিতে গদগদ হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে একদম পিয়াসাকে জড়িয়ে ধরতে যাবে তখনই পিয়াসা পিছিয়ে গিয়ে বললো,
“না, এখন আমার সাথে এসব পেচাপেচি করতে এসো না। সব কিছুই দুই পরিবার মেনে নেওয়ার পর। আমি শুধু তোমাকে জানাতে এসেছি যে এখনো আমার মনে তোমার জন্য জায়গা আছে।”
রকি দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগলো। রকির হাসি দেখে পিয়াসা মনে মনে বললো,
“জায়গা না, কচু আছে। একবার তোকে খাঁচায় বন্দি করতে পারলেই হলো।”
রকি তার চ্যালাপেলাদের উদ্দেশ্য করে বললো,
“ওই তোরা কে আছোস, তোদের ভাবীর জন্য নাস্তা-পানির ব্যবস্থা কর।”
পিয়াসা মনে মনে বললো,
“এই মুহূর্তে নিজেকে বাংলা সিনেমার নায়িকা মনে হচ্ছে। এখন শুধুই নায়কের অভাব আছে। আর শেষ সময়ে পুলিশ বাহিনীর এন্ট্রি হবে কিনা তাই ভাবছি।”
রকি পিয়াসার মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে বললো,
“কি ভাবতাছো সুন্দরী?”
“রকি, আমি আরো আগেই তোমার সাথে দেখা করতে আসতাম। কিন্তু সাহস হয় নি। তোমার যেই রূপ দেখেছি, মনে হয়েছে তোমার সাথে নিজেকে জড়িয়ে আমি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবো।”
“আমার আবার কি রূপ দেখলা তুমি?”
“মনে নেই, তুমি যে ওই ছেলেটার বাবার সাথে কি যেন করেছিলে? ছেলেটা আমাকে পছন্দ করতো, ব্যস, এইটুকুই। তাতেই তুমি ওর এতো বড় ক্ষতি না করলেও পারতে?”
রকি গম্ভীরমুখে বললো,
“যা করছি ভালা করছি। তুমি এসব বুঝবা না সুন্দরী। ছেলেটার আক্কেল হইছে এবার৷ এখন মা আর বোন দুইটারে নিয়ে থাকবো। আর শুনো, ওই পোলা কোনো কামের ছিলো না। কিন্তু আমি তার বাপরে খুন কইরা, তারে কামের বানাই দিছি। তুমি ওই পোলার কথা আর বইলো না আমারে।”
“তুমি সত্যিই খুন করেছিলে? মানে কেউ জানতে পারে নি?”
“হো, আমিই খুন করছি। রাত্তিরে ঘরে আইতাছিলো, আর তার ব্যাগ ভর্তি টাকা ছিলো। সব এক্কেবারে ছিনাইয়া নিছি। তারপর বাইক থেকে নাইমা কচকচ কইরা দুই কোপ দিয়াই পালাইয়া আইছি। আর প্রমাণ কই? সবাই জানে আমিই খুন করছি। এমন পাওয়ার খালি আমার হাতেই আছে। কিন্তু কারো কাছে প্রমাণ নাই শুধু।”
পিয়াসা কথাগুলো আর সহ্য করতে পারছিলো না। মলিন মুখে বললো,
“আমি কাল আবার তোমার সাথে দেখা করতে আসবো। আজ কেউ জানে না। কাল সময় নিয়ে আসবো।”
রকি চাচ্ছিলো না পিয়াসাকে ছাড়তে। তবুও পিয়াসা অনেকটা জোরপূর্বক নিজেকে রকির হাত থেকে বাঁচিয়ে এনেছে। রেকর্ডার হাতে নিয়ে সে স্পর্শকে ফোন করে জানিয়েছে তার হাতে সব প্রমাণ আছে। স্পর্শ এই কথা শুনে সাথে সাথেই রওনা দিলো।
এদিকে রকি এতো সহজেই সব সত্য স্বীকার করে নিয়েছে, তা পিয়াসার বিশ্বাসই হচ্ছে না। পরক্ষণেই তার মনে পড়লো, রকি তো অতিন্দ্রিয়া অর্থাৎ পিয়াসাকেই সব জানিয়েছিলো। এখানে অবিশ্বাসের কিছুই নেই। কারণ রকি আগেও অতিন্দ্রিয়াকে সব বলেছিলো। আর রকির দৃষ্টিতে অতিন্দ্রিয়ায় পিয়াসা।
এরপর স্পর্শ তার বন্ধুদের নিয়ে সেই জায়গায় উপস্থিত হলো, যেখানে পিয়াসা অপেক্ষা করছিলো। সব প্রমাণ দেখার পর সিয়াম স্পর্শকে বললো,
“পিয়াসাকে বাসায় দিয়ে আসলে ভালো হয়।”
কিন্তু নিশান বললো,
“আগে রকিকে গ্রেফতার করা হোক।”
পিয়াসা আর কিছুই বললো না। কারণ সে উল্টাপাল্টা কিছু করলে তার বাবা-মার ক্ষতি হবে।
এরপর স্পর্শের বাবার কেইস আবার চালু হলো। স্পর্শ উকিলের সহায়তায় সব প্রমাণ দেখালো। তারপরই রকিকে গ্রেফতার করা হলো। আর সেদিনই স্পর্শ পিয়াসাকে ছেড়ে দিলো।
পিয়াসা বাড়িতে ফেরার পর মিস্টার এন্ড মিসেস আজীজ মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে যান। তাদের ফ্ল্যাটের আশেপাশে একপ্রকার ভীড় জমে যায়। মামলা করে হয়েছিলো, তাই বাসায় পুলিশ আসা শুরু হয়। একটার পর একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে পিয়াসা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
“যে অপহরণ করেছে সে কোনো টাকা দাবী করে নি, তাহলে কেন অপহরণ করেছে?”
“নিশ্চয় মেয়েটা প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলো। আর প্রেমিক এখন তাকে ছেড়ে দিয়েছে।”
“ছি! ছি! এতোদিন ছেলেটার সাথে না জানি কি করেছে!”
এসব প্রশ্ন রীতিমতো পিয়াসাকে পাগল করে দিচ্ছে। কিন্তু পিয়াসার কাছে এসবের কোনো উত্তর ছিলো না। সে একদমই চুপ করে রইলো। আর পিয়াসার চুপ থাকাটা পিয়াসার বাবা-মাকে আরো অস্থির করে তুলছে। শেষমেশ মান-সম্মান বাঁচাতে পিয়াসার বাবা-মা পিয়াসাকে নিয়ে এলাকা ছাড়লেন। তবে এবার তারা গ্রামেই চলে গেলেন।
আর এদিকে কয়েক সপ্তাহ পর রিয়াদ বাবা-মার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে আবার পিয়াসাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলো।
পিয়াসা বাসায় ফিরে আসার পর রিয়াদ তাকে কোনো প্রশ্ন করে নি, শুধু এইটুকু বলেছিলো,
“আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।”
এই একটা বাক্য শুনে পিয়াসার বুকটা হালকা হয়ে গিয়েছিলো। এমন একটা পরিস্থিতি যখন বাবা-মাও তার বিরুদ্ধে চলে গেছে, তখন একমাত্র রিয়াদই তার পাশে দাঁড়িয়েছে। আর এই মানুষটা মন থেকেই তাকে বিয়ে করতে চাইছে। তাই এবার পিয়াসা আর না করে নি।
শেষমেশ পরিবারের সম্মতি না নিয়েই রিয়াদ পিয়াসাকে বিয়ে করে ফেলে। বিয়ের পর রিয়াদ সিদ্ধান্ত নিলো পিয়াসাকে নিয়ে সে চট্টগ্রামের বাইরে চলে যাবে। কারণ এই মুহূর্তে পিয়াসার ভালো পরিবেশ প্রয়োজন, যা তাকে অতীত ভুলিয়ে দেবে। আর রিয়াদ তা-ই করলো। বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যেই পিয়াসা আর রিয়াদ পাড়ি দিলো তাদের নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে।
||
এতোটুকু লিখেই কলম থামালো আদি। তারপর বিড়বিড় করে বললো,
“আমিও কি এভাবে নিজের ভুলের জন্য আমার শিল্পীকে হারিয়ে ফেলবো? আজ স্পর্শ হারিয়ে ফেলেছে পিয়াসাকে। কিন্তু সে এখনো এই সত্যটাই জানতে পারে নি। স্পর্শের পিয়াসা, তার প্রিয় সুচিস্মিতা এখন অন্যের স্ত্রী। তাকে এতো সহজে এই সত্য জানানো যাবে না। তাকে ধীরে ধীরে জানানো হবে। আর তিলে তিলে মারা হবে। আমি নিজ হাতে স্পর্শকে মারবো। কারণ আমার মতো প্রতিশোধ পরায়ণ পুরুষদের এভাবেই মেরে ফেলা উচিত।”
চলবে–