#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব ৩৫: (অন্তিম পর্ব)
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামি
||
বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির পরশ অনুভব করছে পিয়াসা।হাত বাড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটার দিকে। দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা পিয়াসার গালে এসে পড়ছে। আর এই মোহনীয় সৌন্দর্য উপভোগ করছে দু’জন প্রেমিক। একজনের দৃষ্টি পিয়াসার আড়ালে, আর অন্যজনের দৃষ্টি তার বহু পরিচিত। পিয়াসা তার সাদা সুতির শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে পেছন ফিরে তাকালো। সে কফির মগ হাতে নিয়ে নেশাখোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মানুষটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। মানুষটির চোখের চাহনি তার বহু পরিচিত। আর এই দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে পিয়াসা পার করেছে বহু বর্ষা। আর এই বর্ষার মাসটি তার পাশে থাকা মানুষটির প্রিয় ঋতু। তার জীবনের রঙিন মুহূর্তগুলো যখন অপ্রিয় মুহূর্তগুলোর চাপে ঝিমিয়ে পড়েছিলো, তখনই সেই ঝিমিয়ে পড়া মুহূর্তগুলোকে জাগিয়ে দিয়ে তার জীবনে এসেছিলো রিয়াদ।
এখন পিয়াসার জীবনের ধূসরতা কেটে গেছে। কারণ তার প্রতিটি মুহূর্তকে রঙিন করার জন্য রিয়াদ আছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, পিয়াসা রিয়াদকে প্রচন্ডভাবে ভালোবাসে না। তবে যতোটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততোটুকুই ভালোবাসে। কিন্তু এতোটুকু সে জানে রিয়াদকে ছাড়া সে অচল। কারণ রিয়াদই তার একমাত্র আশ্রয়স্থল।
দীর্ঘ সাতবছরের সংসারে এতোটুকু অনুভূতি সৃষ্টি হওয়া কি ভুল? মানুষ কিন্তু এতোটাও কঠোর হয় না।
ভালো না বাসলেও স্বামীর সব দায়িত্ব সে হাসিমুখে পালন করে। চার বছর আগেই তাদের ঘর আলো করে এসেছিলো তাদের পুত্র সন্তান প্রিয়। আর দুই মাস আগেই প্রিয়কে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এসেছে তার ছোট ভাই দৃশ্য। দুই ছেলেকে নিয়ে পিয়াসা আর রিয়াদ ভালোই আছে।
পিয়াসা বারান্দার রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ওমন করে কি দেখছো?”
রিয়াদ কফির মগে এক চুমুক দিয়ে পা দুটি টান টান করে রেখে বললো,
“আমার নিঝুমকে দেখছি। যতোবার দেখি, ততোবারই প্রেমে পড়ে যাই।”
“হয়েছে আর প্রেমে টেমে পড়তে হবে না। আধাঘন্টা ধরেই কফি খাচ্ছো। ঠান্ডা হয়ে যায় নি?”
রিয়াদ চেয়ার ছেড়ে উঠে পিয়াসার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। তারপর তার হাত দুটি পিয়াসার দুইপাশে রেলিঙের উপর রেখে পিয়াসার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। পিয়াসা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। এতো বছর সংসার করলেও, সে এখনো রিয়াদের আদর পেতেই লজ্জায় একেবারে নুইয়ে পড়ে।
রিয়াদের তার লজ্জাবতী নিঝুমকে নিজের করে পেতে অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। বরং পিয়াসার এই লজ্জা পাওয়াটাই রিয়াদকে আরো বেশি পাগল করে দেয়।
রিয়াদ বললো,
“একদম জমে গেলে যে!”
পিয়াসা রিয়াদকে সরিয়ে দিয়ে আবার ঘুরে বৃষ্টির দিকে তাকালো।
তাদের বারান্দার মুখোমুখি কোনো অস্তিত্বের উপস্থিতি সম্ভব না। কারণ তারা আটতলায় থাকে। আর সামনের বিল্ডিংয়ের মাত্র পাঁচতলা পর্যন্তই সম্পূর্ণ হয়েছে। যদিও বিল্ডিংটা দশতলা। কিন্তু প্রায় দুইবছর হচ্ছে কাজটা অসম্পূর্ণই থেকে গেছে। রিয়াদ শুনেছে বাকীটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ যার বাড়ি তিনি মারা গেছেন। আর এখন তার স্ত্রী তার দুই সন্তানকে নিয়ে কোনোভাবে ফ্ল্যাটের ভাড়া দিয়েই চলছেন। বিল্ডিং উপরে তোলার সামর্থ আর নেই। সন্তানরা বড়ো হলে হয়তো তারাই ভেবে দেখবে বাকীটা।
পিয়াসা আর রিয়াদ বেশিরভাগ সময় বারান্দায় বসে গল্প করে, আশেপাশে যেহেতু মানুষ নেই। কিন্তু তাদের আড়ালেই রয়ে যায় দুটি চোখের গভীর চাহনি। আড়ালে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দুটি চোখ তার বহু বছরের ভালোবাসাকে দেখে মনকে শান্ত রাখে। মাঝে মাঝে ভিজে যায়, মাঝে মাঝে অজান্তেই হেসে ফেলে। সারারাত পিয়াসার মায়াভরা মুখটা দেখে কাটিয়ে দেয় সে। মনের মধ্যে শূণ্যতা থাকলেও কাউকে বোঝায় না সে কতোটা কষ্টে আছে।
সাতবছর আগে পিয়াল যেদিন বাসায় ফিরে স্পর্শকে জানিয়েছিলো পিয়াসা এখন রিয়াদের স্ত্রী, সেদিন থেকেই স্পর্শ একদম চুপচাপ হয়ে যায়। বন্ধু বলতে সিয়াম আর পিয়াল ছাড়া এখন আর তার কেউ নেই। গত বছরই পিয়াল তার বাবা-মার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হয়েছে। সিয়ামের জন্যও এখন পাত্রী দেখা হচ্ছে। আর এদিকে শুধু একাকীত্বকেই সঙ্গী করে নিয়েছে স্পর্শ। পিয়াসাকে হারিয়ে ফেলার দুই বছরের মধ্যেই সে তার মাকেও হারিয়ে ফেলে। মায়ের মৃত্যুর পর আরো একা হয়ে যায় স্পর্শ। এরপর পড়াশুনা শেষ করে রিম-ঝিমকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। স্পর্শ আগে থেকেই জানতো পিয়াসার ঠিকানা। কিন্তু পিয়াসাকে অন্যের সাথে দেখলে আরো দুর্বল হয়ে পড়বে তাই আর দেখা করে নি। তবে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলো। কিন্তু কোনো উত্তর আসে নি। পিয়াসা আদৌ চিঠিটি পড়েছে কি পড়ে নি তাও জানে না স্পর্শ। ঢাকায় আসার পর স্পর্শ পিয়াসার বাসার আশেপাশেই ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে। এখানের একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয় রিম-ঝিমকে। দুই বোনকে নিয়ে একা একা ভালোই আছে সে। তবে মাঝে মাঝে পিয়াসাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার জন্য তার বাসার পাশে অর্থাৎ পিয়াসা যেই বাসায় থাকে তার মুখোমুখি বাসাটির আটতলায় উঠে দাঁড়িয়ে থাকে। দারোয়ানের সাথে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা থাকায় এই সুযোগটা একমাত্র স্পর্শের জন্যই প্রযোজ্য।
রিয়াদ আর পিয়াসাকে এক সাথে দেখেই স্পর্শের বুকটা হু হু করে উঠলো। পিয়াসাদের বারান্দা থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সে পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বুকে হাতটা চেপে ধরে বললো,
“সুচিস্মিতা, তুমি আজীবন আমার হৃদয়ে থাকবে। আমি আজীবন তোমায় ভালোবাসবো। আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি ঠিকই, কিন্তু তোমার ঠোঁটের ফাঁকে মিষ্টি সেই হাসিটা দেখেই ভালো আছি। যেই যন্ত্রণা তোমাকে দিয়েছিলাম, তুমি আমার হলেও পুরোপুরি সুখী হতে না। কারণ আমি যে তোমার বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছিলাম। আমি জানি বিশ্বাস ভাঙলে প্রিয় মানুষকেও ভীষণ অপ্রিয় মনে হয়।”
স্পর্শ তার ঝাপসা হয়ে আসা চোখগুলো কচলে নিলো। তারপর অশ্রুগুলো শার্টের হাতায় মুছে ছাদ থেকে নেমে পড়লো। নিচে নেমে দারোয়ানকে দেখে মুচকি হাসলো।
দারোয়ান বললো,
“তোমারেই দেখলাম, প্রেমিকার লাইগগা কান্দো। তুমি বিয়ে করি লও বাবাজান। সুখী হইবা।”
স্পর্শ মুচকি হেসে বললো,
“চাচা, সুখী হলে জীবনটা বৃথা হয়ে যাবে। জীবনে যেই ভুল করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত করা এখনো বাকী। হয়তো এই জীবনটাই চলে যাবে।”
“কিডা করলা বাবাজান, খুনটুন করলেও তো মাফ পাইয়া যায় এহন।”
“কিছু খুনের ক্ষমা হয় না। খুনটা যখন বিশ্বাসের হয়, একটা কোমল হৃদয়ের হয় তখন তো ক্ষমা পাওয়া অসম্ভব।”
||
আবুল ফজলের একটা উক্তি মনে পড়েছে আদির। “অনেক কিছু ফিরে আসে, ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু সময়কে ফিরিয়ে আনা যায় না।”
পিয়াসাকে কাছে পাওয়ার সময় এখন স্পর্শের শেষ। সে এখন শুধু অনুভব করেই ভালোবাসবে। এই অনুভবের মাঝেও সুখ আছে।
আদির মনের গভীরতা আরো বাড়ছে। সে গভীরভাবে অনুভব করছে স্পর্শ ঠিক কতোটা যন্ত্রনায় আছে। কিন্তু তার পাঠকরা কি সেই যন্ত্রণা উপলব্ধি করবে, নাকি পরিশেষে হেসে বলবে, “ভালোই হয়েছে, এমন ছেলেদের এটাই পরিণতি হওয়ার ছিলো।”
হ্যাঁ, বলবে। বলুক। তাদের অধিকার আছে বলার। সেই স্বাধীনতা সে দিয়েছে পাঠকদের। তবুও মনটা ভারী ভারী লাগছে। কাল্পনিক চরিত্রের প্রতিও কি মায়া জান্মানো সম্ভব, তাও একজন লেখক হয়ে? যতোই যাইহোক মায়া দিয়ে কি হবে? লেখকদের একটু শক্ত মনের হতে হয়। তাই সব দুর্বলতা পাশ কাটিয়ে আবার কলম হাতে নিলো। আজই এই গল্পটা শেষ করবে আদি।
||
স্পর্শের বন্ধু আকাশ পড়াশুনা শেষ করে বাইরের দেশে সেটেল্ড হয়ে গেছে। আর হাবীব বর্তমানে ভালো একটা কোম্পানিতে জব করছে। দুজনই বিয়ে করেছে। কিন্তু শাকিল আপতত অবিবাহিত। তবে তারও মাসে ভালোই আয় হয়। চাকরীর পাশাপাশি ইউটিউব চ্যানেলেও কাজ করে। সোশাল মিডিয়ায় খুব এক্টিভ থাকে। এককথায় শাকিল মোটামুটি সেলেব্রিটি। কিন্তু নিশান আর তকিরের অবস্থায় খারাপ। তকির অনার্সে খুব খারাপ রেজাল্ট করে বসে। পরবর্তীতে আবার পরীক্ষা দেয়। কিন্তু মনোবল যে হারিয়েছে আর আগ্রহ পাচ্ছিলো না। তাই শেষমেশ বাবার ব্যবসায় হাত দিয়েছে। কিন্তু ব্যবসা সম্পর্কে তেমন কোনো জ্ঞান না থাকায় সুবিধে করতে পারছে না। আর বেকার যুবকের বিয়েও এতো সহজে হয় না। সেই সূত্রে তকিরের অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। তবে নিশান ভালোই আছে। একটা রেস্টুরেন্ট খুলেছে আর তা দিয়েই চলে যাচ্ছে। বিয়েও করেছিলো দুইবার, কিন্তু একটাও তার সফল হয় নি। প্রথম স্ত্রী বিয়ের ছয়মাসের মাথায় তার প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায়। আর দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে তার চারমাসের একটা কন্যা শিশুও আছে। কিন্তু সেও স্বামীকে ছেড়ে দেয়, কারণটা যদিও নিশানের কাছে ওতো গুরুতর ছিলো না। মূলত নিশানের মেয়ে কলিগদের সাথে সখ্যতা একটু বেশিই ছিলো, আর তার দ্বিতীয় স্ত্রী এটা একদমই পছন্দ করতো না। পরিশেষে সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে। তবে মেয়েটা নিশানের কাছেই আছে। যখন থেকেই সে মেয়ের বাবা হয়েছে তখন থেকেই সে বুঝতে শুরু করেছে তার অতীতের ভুল। পিয়াসার সাথে সে অনেক বেশি অন্যায় করে ফেলেছে। সেও তো কারো মেয়ে ছিলো। আর আজ তারও একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে।
অপরাধবোধ নিয়েই জীবন কাটাচ্ছে কিছু মানুষ। আর সেই অপরাধের মূল আসামী তুবা, যে নিজের সুখের জন্য অন্যের সুখ ছিনিয়ে নিয়েছে। আর আজ সে-ই অন্যের সুখের জন্য নিজের সুখ ত্যাগ করেছে।
সাত বছর আগেই তুবার বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে যায়। এরপর তুবার বিয়ে দিতে অনেক ঝামেলা হয়। ভালো পাত্র পাওয়া যাচ্ছিলো না। কারণ তার বাবা-মার ডিভোর্স হয়েছে। আর এই দাগটা তুবার গায়েও লেগে গেছে। যদিও আড়ালে রয়ে গেছে তুবার আরো কিছু দাগের ইতিহাস।
কিন্তু প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিয়েই নিয়েছে। তুবার বিয়ে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সে সুখে নেই। সুখের নেশায় মত্ত থাকা তুবার কোল জুড়ে একটা সন্তান এলো না গত চার বছরে। যার ফলে তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর আজই তুবার স্বামীর বিয়ে। তুবা একপাশে দাঁড়িয়ে অশ্রু আড়াল করছে। পাশে তুবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে তুবার অসহায় মা।
ক্লান্ত কন্ঠে তিনি বলে উঠলেন,
“আমাদের পিয়ুর দুইটা ছেলে আছে। আর কি দুর্ভাগ্য আমার মেয়ের কোলে একটাও এলো না।”
তুবা মায়ের দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকালো। মনে মনে বললো,
“পিয়াসার সাথে আমি অন্যায় করেছিলাম। কিন্তু আমি তো ক্ষমা চেয়েছি। আর পিয়াসা তো সুখেই আছে রিয়াদের সাথে, তবুও আমার সুখেই নজর পড়লো? আজ যদি পিয়াসা দুঃখী হতো তবে মেনে নিতাম, আমি আমার পাপের ফল ভোগ করছি। কিন্তু এখন কি এই শাস্তি আমার চলতেই থাকবে? এতো বড়ো অপরাধ কি আমি করেছি, যার শাস্তি সারাজীবন পেতে হবে?”
কিছু মানুষ অপরাধ করেও বুঝে না কতোটা অপরাধী সে। তুবাও হয়তো বুঝতে পারছে না, আর বুঝবেও না কখনো। বোঝার থাকলে অনেক আগেই বুঝে ফেলতো।
সন্ধ্যায় প্রিয় আর দৃশ্যকে খাইয়ে দিয়ে রুম গোছাতে লাগলো পিয়াসা। রিয়াদ একটা কাজে একটু বাইরে গিয়েছে৷ এই সুযোগে ঘরদোর গুছিয়ে নেবে সে। টেবিলের বই-খাতা ঠিক করতেই বইয়ের ফাঁক থেকে একটা খাম বেরিয়ে এলো। আকাশী রঙের খামটি দেখে পিয়াসার বুকটা ধক করে উঠলো। এটি সেই খাম যেটিতে তার ভালোবাসার মানুষটির শেষ স্মৃতি জড়িয়ে আছে। খামটি খুলে চিঠিটি পড়তে পড়তেই মেঝেতে বসে পড়লো পিয়াসা। তার চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে এলো। ইচ্ছে করছিলো চিঠির মালিককে একটু ছুঁয়ে দিতে। তাকে একটাবার দেখতে।
“প্রিয় সুচিস্মিতা,
প্রিয় প্রিয়ংবদা,
প্রিয় এণাক্ষী,
তিনবার সম্বোধন করেছি তোমাকে। কারণ তোমাকে প্রাণখুলে সেই তিন শব্দের বাক্যটি শুনাতে পারি নি কখনো। কিন্তু যেই মুখ দিয়ে শুধুই মিথ্যে ভালোবাসার গল্প বলেছিলাম, সেই ভালোবাসা সত্যি হলেও মুখের ভাষাটা মিথ্যে ছিলো। সত্য-মিথ্যার ভীড়ে ভালোবাসার শুদ্ধতা আসে না। তাই হয়তো এই জীবনে আমি তোমাকে ভালোবাসি এই কথাটা প্রাণখুলে বলতে পারলাম না। তবে লিখে বলছি, সত্যিই আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি যেই ভুল করেছিলাম, তার শাস্তি হয়তো তোমাকে হারিয়ে ফেলেই পেয়েছি। তোমাকে পেয়ে গেলে তোমার মূল্যটা বুঝতে পারতাম না। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি তুমি আমার কাছে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। ওগো সুচিস্মিতা, তুমি আমার হৃদয়ে আজীবন বেঁচে থাকবে। তোমার সুন্দর সাজানো সংসারটা ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই, কোনো অধিকার আমার নেই। রিয়াদের মতো ছেলে ভাগ্য করেই কেউ স্বামী হিসেবে পায়। আর আমি আমার ভাগ্যবতী সুচিস্মিতাকে সেই সুখ থেকে কিভাবে বের করে আনবো? তুমি আমাকে কতোটুকু ভালোবাসো আমি জানি না। আদৌ কতোটুকু ভালোবাসা অবশিষ্ট আছে সেটাও জানা নেই। তবুও একটাই আবদার থাকবে, আমাকে ক্ষমা করে দিও। জানি এই চিঠির কোনো উত্তর আসবে না। কেন আসবে বলো? প্রেমিকা কি এখন তার পুরোনো প্রেমিকের জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে চিঠি লিখবে? স্বামীর চোখের আড়ালে কি বারান্দায় একটা কলম আর সাদা পৃষ্ঠা নিয়ে বসার কি সময় আছে তার? যদি উত্তর আসে, আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো। আমি তোমার চিঠির অপেক্ষায় থাকবো।
ইতি
স্পর্শ।”
পিয়াসা চিঠির মাঝেই নাক ডুবিয়ে দিলো। স্পর্শের শরীরের ঘ্রাণ লেগে আছে এই চিঠির প্রতিটি অক্ষরে। পিয়াসা চিঠিটি খামে ঢুকিয়ে রাখলো। এটি তার ভালোবাসার শেষ স্মৃতি।
পিয়াসা মনে মনে বললো,
“আমিও খুব ভালোবাসতাম তোমাকে। হয়তো এখনো তোমার প্রতি সেই ভালোবাসা রয়েই গেছে। তোমাকে আমি পুরোপুরি ঘৃণা করতে পারি নি। আবার ভুলতেও পারি নি। হয়তো তুমি আমার চিঠির অপেক্ষায় আছো। কিন্তু স্পর্শ, আমি আর পারবো না এই চিঠির উত্তর দিতে। রিয়াদকে আমি ভালোবাসিনি। কিন্তু ভালোবাসার চেয়েও বেশি কিছু আমি রিয়াদের জন্য অনুভব করেছি। শ্রদ্ধা, মায়া, বিশ্বাস, দায়িত্ব এই শব্দগুলো আমাকে রিয়াদের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। আমি ভালোবাসি তোমাকে, কিন্তু তোমাকে দেখলে আমার মনে কোনো শ্রদ্ধা জন্মায় না, উলটো অপ্রিয় মুহূর্তের সেই তোমাকেই আমি প্রচন্ড ঘৃণা করতে চাই। তোমাকে ভালোবাসি, তবুও আমি রিয়াদের ভালোবাসার মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি। ছেলেটা আমাকে এতো সূক্ষ্ম আর যত্নের সাথে ভালোবাসে, আমি সেই ভালোবাসার মায়া ফেলে তোমাকে নিয়ে ভেবে দুই লাইন লিখতেও পারি না। বারংবার মনটা রিয়াদের ভাবনায় ডুব দেয়। তুমি জানো স্পর্শ? সে আমাকে খুব বিশ্বাস করে, আর আমি তো তাকে অন্ধ বিশ্বাস করি। শুনেছি, জীবনে একবার ঠকলে দ্বিতীয় বার কাউকে বিশ্বাস করা যায় না, আর আমি? আমি তো অন্ধ বিশ্বাস করে সেই শুনা কথাটাই মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়েছি। আমার উপর এখন দায়িত্ব, রিয়াদের আর রিয়াদের সন্তানদের। যেই মানুষটা একটা সময় তার পরিবার ছেড়ে আমাকে গ্রহণ করেছিলো, সেই মানুষটাকে এক সেকেন্ডের জন্য ঠকিয়ে, তার আড়ালে আমি কিছুই করতে চাই না। সে আমার আদ্যোপান্ত সব খবর জানে। আর আমি তাকে না জানিয়ে তোমাকে কিভাবে চিঠি লিখতে বসি? যেহেতু জানানো সম্ভব না, সেহেতু এই চিঠি লেখাটাও হয়তো অসমাপ্ত রয়ে যাবে। তবে আমি তোমাকে আজো ভালোবাসি। মাঝরাতে তোমার কথা খুব মনে পড়ে। তবে সত্যি কথা কি জানো স্পর্শ, তোমাকে মনে পড়লেও আমি একটুও দুঃখী হয় না। কারণ রিয়াদের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালে আমার সব দুঃখ গলে যায়। তোমার চেয়েও সে বেশি ভালোবাসে আমাকে। কিন্তু আমি যে তোমাকে ভালোবাসি, তাই এখনো তোমার অনুভূতির সাথেই আটকে আছি। তবে আমি ভালোই আছি। জীবনে সুখ আর সুখ থাকলে জীবনটা খুব তিক্ত মনে হতো। তাই জীবনে সুখ-দুঃখ দুটিই প্রয়োজন। স্পর্শ, তুমি আমার জীবনে দুঃখ হয়েই থেকো। আমি রিয়াদের ভালোবাসায় ডুব দিয়ে আবার সুখী হয়ে নেবো।”
রাত বাড়ছে। স্পর্শ জানালার বাইরে আকাশটা দেখতে ব্যস্ত। হাতে তার পিয়াসার দেওয়া সেই বার্থডে গিফট। খুব সুন্দর একটা ঘড়ি। স্পর্শ এখন এই ঘড়িটাই ব্যবহার করে। পুরোনো ঘড়িটার প্রতি তার এতো মায়া দেখে অনেকেই অনেক কথা বলে। স্পর্শ শুধু একটাই উত্তর দেয়,
“এটা আমার ভালোবাসার শেষ চিহ্ন।”
পিয়াসা সেদিন স্পর্শকে একটা চিঠিও দিয়েছিলো। স্পর্শ সেই চিঠি পড়তে পড়তে মুখস্থ করে ফেলেছে। স্পর্শের জন্য অপেক্ষা আর তার অতীতের কিছু কালো অধ্যায় নিয়েই পিয়াসা চিঠিটি লিখেছিলো। এই চিঠি আগে পড়লেও স্পর্শ আরেকবার ভেবে দেখতো সব। কিন্তু ওই যে নিয়তি! নিয়তি চায় নি পিয়াসা তার হোক। তাই চিঠিটাও পড়েছিলো পিয়াসাকে হারানোর পর।
পিয়াসাকে কাছে পাওয়ার অপেক্ষাটা কখনো শেষ হবে না স্পর্শের। তার অসমাপ্ত ভালোবাসা আজীবন তার গলায় কাঁটার মতো বিঁধে থাকবে। আজ রিম-ঝিমের দায়িত্ব আছে তাই হয়তো নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। তারা মা-বাবাকে হারিয়েছে, এখন যদি ভাইকেও হারিয়ে ফেলে তাহলে চরম অন্যায় হবে। প্রকৃতি তাদের সাথে খুব অন্যায় করেছে। কিন্তু স্পর্শের এই অনাথ বাচ্চা দুটির সাথে অন্যায় করার সাহস নেই। তাই সে বেঁচে আছে তার রিম-ঝিমের জন্য। তবুও শূন্যতায় সে রাত কাটাচ্ছে। হয়তো এভাবেই আরো অনেক রাত কেটে যাবে। সাতবছর যেহেতু কম পড়েছে পিয়াসাকে ভুলতে, হয়তো আরো সাতবছরও কম পড়বে। কারণ সে পিয়াসাকে যতোই দেখে ততোই ভালোবাসে। আর স্পর্শ এভাবেই পিয়াসাকে ভালোবাসতে চায়।
পিয়াসা হয়তো কখনোই জানবে না, এখনো মাঝরাতে একটা ছেলে জানালের পাশে দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনকে সান্ত্বনা দিয়ে ভাবে,
“এই চাঁদ আমরা দুজনেই দেখছি, এই এক আকাশের নিচেই তো আমরা আছি।”
বৃষ্টির দিনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিবিলাসী পিয়াসার মুখটা দেখে চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসা ছেলেটির খবর এখন পিয়াসার আড়ালেই।
এখন মাঝে মাঝে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কল্পনায় হাত এগিয়ে দেয় স্পর্শ। কারণ পিয়াসা সেই হাতটি ধরেই রাস্তা পার হবে। কিন্তু ভ্রান্তি কাটলেই দেখে পিয়াসার হাতটি আঁকড়ে ধরে রেখেছে রিয়াদ।
স্পর্শ ডায়েরীর ফাঁক থেকে বের করলো সেই শুকনো গোলাপটি। জীবনে কিছুই তো সে পেলো না। যা পেয়েছিলো সবই সে হারিয়ে ফেলেছে। অবশিষ্ট আছে শুধু সেই অপ্রিয় মুহূর্ত ও শুকনো একটি গোলাপ।
||
এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদি ডায়েরীটা বন্ধ করলো। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুমন্ত বর্ণালীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। নিজেকে বড্ড সুখী মনে হচ্ছে তার। কারণ তার কাছে বর্ণ আছে।
প্রতিটি আদি আর স্পর্শের উচিত তাদের জীবনে আসা প্রতিটি বর্ণ আর পিয়াসার যত্ন নেওয়া। তাদের আগলে রাখাটা যতোই কঠিন হোক, তাদের কাছে পাওয়াটাই প্রশান্তির। আর এই শান্তি মাঝে মাঝে জীবনকে অনেক সহজ করে দেয়।
#সমাপ্তি….