#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-০৬,০৭
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৬:
||
রকিং চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে বসে আছে স্পর্শ। চোখগুলো টকটকে লাল হয়ে আছে৷ দেখে বোঝা যাচ্ছে না, সেই চোখ দুটি কি প্রকাশ করতে চাইছে, ক্ষোভ নাকি যন্ত্রণা!
স্পর্শের পাশেই বসে আছে তার বেস্ট ফ্রেন্ড সিয়াম। স্পর্শের চুপচাপ ভাবটা তাকে আরো ভাবাচ্ছে।
সে চিন্তিত কন্ঠে বললো,
সিয়াম: কি করবি এখন?
স্পর্শ কোনো উত্তর দিলো না। সামনের টেবিলের উপর ফুলদানিতে থাকা শুকনো গোলাপটির দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে।
সিয়াম একটু জোর গলায় বললো,
সিয়াম: এভাবে চুপ করে থাকলে কোনো সমাধান হবে না স্পর্শ! আংকেলকে যারা খুন করেছে তারা মুক্ত বাতাসে ঘুরছে। তুই কিভাবে সহ্য করছিস এসব? এখন তো জেনেও গিয়েছিস খুনি কারা। আর খুন করার কারণটাও অজানা নেই এখন। এবারও কি চুপ করে বসে থাকবি?
সিয়াম স্পর্শের উত্তরের আশায় বসে আছে। কিন্তু স্পর্শের এমন গা ছাড়া ভাবটা দেখে তার রাগ উঠে যাচ্ছে।
এবার একটু বিরক্তির সুরে বললো,
সিয়াম: আজ এতোটা বছর পুরোনো শহর ছেড়ে এই পরিত্যক্ত ঘরে বসে আছিস। আন্টি অসুস্থ, রিম-ঝিম অযত্ন- অবহেলায় শুকিয়ে যাচ্ছে। আর তুই? দেবদাস হয়ে বসে আছিস? তাও একটা নাম না জানা মেয়ের জন্য! যেই মেয়ে আজ তোর এই পরিণতির জন্য দায়ী। পরীক্ষার দিন ছাড়া একটা দিনও ভার্সিটির গেইটে পা রাখিস নি। রেজাল্টের মারাত্মক অবস্থা হচ্ছে তোর। স্পর্শ তুই নিজেকে কোথায় হারিয়ে ফেলেছিস? এভাবে পড়াশুনা করলে একটা চাকরীও জুটবেনা কপালে। আন্টির চিকিৎসার খরচ কোথা থেকে আসবে তখন? রিম-ঝিমকে পড়াশুনা কে করাবে? আর কতোদিন আংকেলের জমানো টাকায় চলবি? শেষ তো একদিন হয়ে যাবে! তখন কি করবি?
স্পর্শ: রিম-ঝিমকে পড়াশুনা করাবো আমি। এখনো তো ছোট ওরা। মাত্র চার বছর চলছে। ততোদিনে আমি আর এই স্পর্শ থাকবো না।
সিয়াম: এই স্পর্শকে দেখতেও চাই না আমরা।
স্পর্শ: আমি ফিরতে চাই আবার। সুচিস্মিতা….. না, না ভুল বলে ফেলেছি। সে কোনো সুচিস্মিতা নয়, সে আমার জীবনে আসা একজন অপ্রিয় অতিথি। যার আগমনে আমি আজ নিঃস্ব। যে আমায় নিঃস্ব করে দিয়েছে, তাকেও আমি একেবারেই নিঃস্ব করে দেবো। কাউকে মুখ দেখানোর সুযোগ রাখবো না। ভালোবেসে যতোটা কষ্ট পেয়েছি, প্রতিশোধ নিয়ে দ্বিগুণ উল্লাস করবো আমি।
সিয়াম: মেয়েটা কিন্তু মারাত্মক ধূর্ত। এই সমাজে এতো নিকৃষ্ট চরিত্র থাকতে পারে, তা বিশ্বাসই হয় না। আর বন্ধু, তুইও না বোকার মতো সেই মেয়ের পেছনে ছুটেছিস?
স্পর্শ: ফুল যেমন কাঁটায় আবৃত থাকে। দূর থেকে সুন্দর মনে হয়। কিন্তু কাছে গেলে কাঁটা দেখা যায়। আমিও দূরের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে পড়েছিলাম। কাছে আসলে হয়তো তার চরিত্রের দাগটা একটু হলেও নজরে পড়তো। কিন্তু আমি এখন আমার জায়গায় আর কোনো স্পর্শকে দেখতে চাই না।
স্পর্শের চোখের ছলছল ভাবটাতে পিয়াসার প্রতি ক্ষোভ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। যেই মেয়েটির কথা ভাবলে এই চোখ দুটিতে আলোর ঝলকানি দেখা যেতো, সেই চোখে আজ ঘৃণা। যেই চোখ দুটি কয়েক বছর আগেও পিয়াসাকে দেখার জন্য উৎসুক ছিলো, আজ সেই চোখে প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্খা ফুটে উঠেছে৷
||
কিন্তু কেন? কেন পিয়াসাকে ঘৃণা করবে স্পর্শ? পিয়াসার দোষটা কোথায়? সে তো এখনো অপেক্ষায় আছে স্পর্শ চৌধুরীর। এখনো বারান্দায় উঁকি দেয় সেই অপেক্ষিত চোখ দুটি একবার দেখার আশায়। পিয়াসা জানে, স্পর্শ আর সেই বাসায় থাকে না। সে মেনে নিয়েছে স্পর্শ নামের ছেলেটি তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সে বুঝে ফেলেছে এই মানুষটা এসেছিলো শুধু অল্প সময়ের জন্য। সে যদি সত্যিই পিয়াসাকে ভালোবাসতো, তবে কি একটিবার আবার সেই এলাকায় হেঁটে যেতো না? পিয়াসাকে এক নজর দেখার জন্য আবার সেই পুরোনো শহরে আসতো না? হয়তো চলে গেছে বাসা ছেড়ে, কিন্তু ঠিকানা তো জানা আছে। তবুও কেন আসে নি সে আবার? সে কি জানে না একটি মেয়ে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে তাকে খুঁজে?
||
এদিকে-
পিয়াসার বাবা-মা দুজনই খুব চিন্তিত মুখে বসে আছেন। আজকাল পিয়াসার বাইরে বের হওয়া আর পিয়াসাকে একলা বাসায় রেখে যাওয়া, দুটোই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে।
রকি কয়েকদিন পর পর বিয়ের প্রস্তাব পাঠাচ্ছে। একমাত্র মেয়েকে এমন বখাটে ছেলের সাথে বিয়ে তারা কখনোই দেবেন না।
আর রকি বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েও ক্ষান্ত হয় নি, সে পুরো এলাকায় রটিয়ে ফেলেছে পিয়াসার সাথে তার বহু বছরের প্রেম চলছে।
এলাকায় পিয়াসার সমবয়সী সব মেয়েরাই তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে বিরক্ত করে, যা রীতিমতো পিয়াসার সহ্য সীমার বাইরে চলে গেছে।
-তুমি রকি ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড?
-ওই দেখ, ভাবী যাচ্ছে!
-আমাদের এলাকার ডনের বউ।
-আপু, রকি ভাইয়া তোমার বর হলে তুমি অনেক প্রভাব নিয়ে চলতে পারবে।
এদিকে-
পিয়াসার বাবা-মা থানায় মামলা করেছেন রকির বিরুদ্ধে, কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। উলটো তাদের হুমকি দিয়ে চলে গেছে রকির চ্যালাপেলারা।
রকি শহরের একজন প্রভাবশালী লোকের সহায়তা পেয়ে এমন গা ছাড়া ভাব নিয়ে চলাফেরা করার সুযোগ পাচ্ছে। মানুষের কাছ থেকে অনর্থক চাঁদা তুলে নিজের ব্যাগ ভর্তি করছে সে। ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজ করেও সে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে পারছে।
পিয়াসার বাবা-মা এতো সব অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এলাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।
কয়েক সপ্তাহ পর-
আজ স্পর্শ ফিরে এসেছে পুরোনো শহরে। শহরে পৌঁছে প্রথমেই সে মামার বাসায় গেলো। মামা স্পর্শকে দেখে অনেক খুশি হলেন। স্পর্শের মামী চা নাস্তার ব্যবস্থা করতে গেলেন রান্নাঘরে।
স্পর্শ: মামা, তোমার সাহায্যের প্রয়োজন ছিলো।
মামা: হ্যাঁ, বল বাবা। আমরা তোর সাথেই আছি।
স্পর্শ: প্রিয়াংকার তো পরীক্ষা শেষ। এখন ওর কোনো পড়াশুনার চাপ নেই আপতত।
মামা: হ্যাঁ৷
স্পর্শ: রিম-ঝিমকে তোমাদের কাছে রাখতে চাইছি। আমি হোস্টেলে উঠবো। চাকরি খুঁজছি এখন। আমার যোগ্যতায় যদি কোনো চাকরি পাওয়া যায়, আমি অবশ্যই করবো।
মামা: তোর মা?
স্পর্শ: মাকে গ্রামে রেখে এসেছি। শহরে রাখার মতো অবস্থা নেই আমার কাছে।
মামা: এখানে রেখে যা।
স্পর্শ: না, মামা। রিম-ঝিমকে সামলে রাখো শুধু। মায়ের পাগলামোগুলো তোমরা সহ্য করতে পারবে না। থাকুক যেখানে আছে। গ্রামের এক চাচী দেখছে মাকে। বড়ো ভালো সেই মহিলা। মাকে একদম বোনের মতো দেখে। মা ভালোই থাকবে গ্রামে। আর মায়ের সুস্থ হওয়ার তো কোনো সম্ভাবনা নেই। সারাজীবন এমন থাকবে হয়তো। একটা দিনও কেউ সহ্য করতে পারবে না মাকে। আমার মা, তাই আমি সহ্য করছি।
মামা: এভাবে বলছিস কেন স্পর্শ?
স্পর্শ: বাবার মৃত্যুটা মা মেনে নিতে পারে নি মামা। একদম মুষড়ে পড়েছিলো মা। আমিও এতোটা মুষড়ে পড়ি নি। কিন্তু মায়ের এই অবস্থাটা আর মেনে নিতে পারছি না। রিম-ঝিমকেও সহ্য করতে পারে না মা। চিনেও না আমাদের কাউকে। আমি না হয় সামলে নেবো সব। কিন্তু বাচ্চা দুইটা মা ছাড়া বড়ো হচ্ছে, বিষয়টা মানতে পারছি না আমি। ওদের জন্য দুটো বছর ঘরে ছিলাম। ওরা ছোট তাই। কিন্তু আমি নিজেই যদি কিছু করতে না পারি, তাহলে ওদের ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যাবে। তাই পড়াশুনার পাশাপাশি আমাকে কাজ করতে হবে।
মামা চুপ করে তাকিয়ে আছেন স্পর্শের দিকে। মামী আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন স্পর্শের কথা।
তিনি হঠাৎ সামনে এসে বললেন,
মামী: রিম-ঝিমকে সামলে নেবো আমরা। আগেও তো বলেছি ওদের দুজনকে আমাদের কাছে রেখে যাও। কিন্তু তুমি শুনলে না।
স্পর্শ: কাকা-চাচাদের কাছ থেকে যা আশা করি নি, তাই পেয়েছি। কিছু সম্পর্কের এমন মৃত্যু ঘটবে তা ভাবতেও পারি নি। আবার নতুন করে আরো কিছু সম্পর্কের ইতি ঘটাতে চাই নি। তবুও আজ বাধ্য হলাম। ফিরিয়ে দিও না। হয়তো একদিন আমি সব শোধ করার যোগ্যতা রাখবো।
মামা কড়া গলায় বললো,
মামা: আমরা এতোটাও স্বার্থপর না স্পর্শ?
স্পর্শ: মামা, মামী, ক্ষমা করবে। এই ভয়ংকর জীবনে এসে যেই অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারপর আর কাউকে বিশ্বাস করা অনেকটা জটিল।
মামী: স্পর্শ, তুমি রিম-ঝিমকে নিয়ে এসো। আমরা ওদের খেয়াল রাখবো। প্রিয়াংকা তো বাচ্চা অনেক পছন্দ করে। ওর ভালোই সময় কাটবে।
স্পর্শ এক গ্লাস পানি খেয়ে উঠে পড়লো।
মামী: কিছু খেলে না যে!
স্পর্শ: অনেক কাজ আছে আমার। কিছু মনে করো না। এখন তো রোজ আসা-যাওয়া থাকবে। আজ না হয় আসি।
স্পর্শের মামা-মামী আর কিছুই বললো না। তারা স্পর্শের অবস্থাটা আন্দাজ করতে পারছে৷
হঠাৎ বাবার অকাল মৃত্যু আর মায়ের মানসিক অবনতি দুটোই স্পর্শকে অনেকটা শক্ত করে ফেলেছে।
মানুষের জীবনে হঠাৎ যে ঝড়ের আগমন ঘটে, তা মানুষকে একদম নিঃস্ব করে দিয়ে যায়। মাঝে মাঝে সেই ঝড়ের আঘাত কাটিয়ে উঠতে বহু সময় লাগে। আবার হুট করে জোড়া লেগে যাওয়া মানুষটি অসম্ভব ভয়ংকর হয়ে উঠে। স্পর্শের মতো একটা শান্ত ছেলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড় যে কতোটা ভয়ংকর ছিলো, তা হয়তো সবার বোঝার বাইরে। আর সেই ঝড় কাটিয়ে সে যে কতোটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে তাও সবার আড়ালেই রয়ে গেলো।
চলবে—
#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৭:
||
স্পর্শ মামার বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো সেই পরিচিত এলাকায় যেখানে কিছু অপ্রিয় স্মৃতির জন্ম হয়েছিলো। প্রতিটা রাস্তা স্পর্শকে টানছে।
স্পর্শের মনে পড়ে গেলো কয়েক বছর আগের স্মৃতি।
পিয়াসা সকাল সকাল শাড়ি পড়ে বারান্দায় তার বাগানের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলো। স্পর্শ পিয়াসাকে শাড়িতে প্রথম দেখেছিলো সেইদিন। তাই কাছ থেকে দেখার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এলাকার গলির মোড়ে এসে দাঁড়ায় স্পর্শ। কারণ স্পর্শ জানে আজ পিয়াসার স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
পিয়াসা ঘর থেকে বের হওয়ার পর গলির মোড়ে স্পর্শকে এক নজর দেখে রিক্সায় উঠে পড়ে। রিক্সায় উঠতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো পিয়াসার। কারণ শাড়ি আজ প্রথম পড়েছে। আর তাই শাড়ি কোনো ভাবেই সামলাতে পারছিলো না।
পিয়াসা রিক্সায় উঠার পর স্পর্শও একটা রিক্সা নিয়ে পিয়াসার পিছু পিছু আসতে থাকে। পিয়াসার স্কুলের পাশের মাঠটিতেই রিক্সা থামে। অনুষ্ঠান সেই মাঠেই হবে। আশেপাশে প্যান্ডেলও বাঁধানো হয়েছে। কিন্তু পিয়াসা ভাড়া দিতে যাবে তখনই রিক্সাওয়ালা মামা বললো,
-আপা, ভাড়া দেওয়া হইছে।
পিয়াসা: কি বললেন? আমি তো এখনো টাকা বেরই করলাম না।
-আপনে না। এক ভাইজান দিছে।
পিয়াসার কথাটি শুনে মনে পড়লো রাস্তায় স্পর্শকে দেখেছে।
মিনমিনিয়ে বললো,
পিয়াসা: সে আমার ভাড়াটাও দিয়ে দিলো?
পিয়াসা আরো কিছু ভাবার আগে তার বান্ধবী তাকে টেনে নিয়ে গেলো প্রোগ্রামে। আর স্পর্শ অভিভাবকদের সারিতে গিয়ে বসলো।
স্পর্শ ভাবছে,
স্পর্শ: যেহেতু স্কুলের প্রোগ্রামে শাড়ি পড়েছে তবে সে কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেবে। সেই সুযোগে নামটাও জানা হয়ে যাবে।
কিন্তু স্পর্শের দূর্ভাগ্য, পিয়াসা সেই অনুষ্ঠানে নৃত্য তো পরিবেশন করেছিলোই কিন্তু তা ছিলো দলীয় নৃত্য। অনেকে একসাথে সেই নৃত্যে অংশ নেওয়ায় নাম জানা হয় নি আর।
নৃত্য শুরুর পর পিয়াসার নৃত্যের তালে একেবারেই হারিয়ে গিয়েছিলো স্পর্শ। ঘোর ভাঙলে আশেপাশে দু একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলো পিয়াসার পরিচয়। কিন্তু কেউ পিয়াসাকে চিনতো না।
পুরনো দিনের স্মৃতি থেকে বের হয়ে স্পর্শ পিয়াসার বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো। হঠাৎ খেয়াল করলো পিয়াসাদের বাসার কাছেই লেখা আছে ঘর ভাড়া দেওয়া হবে।
স্পর্শ ভাবলো,
স্পর্শ: এই বাসায় ভাড়া নিলে হয়তো প্রতিশোধ নেওয়া আরো সহজ হবে। শত্রু যদি প্রতিবেশি হয়, সেই শত্রু সহজে চেনা যায় না।
স্পর্শ গেইটের ভেতরে ঢুকে বাড়ির মালিকের দরজায় বেল দিলো। একজন ছটপটে বয়ষ্ক মহিলা দরজাটা খুলে দিলেন।
তারপর চেঁচিয়ে বললেন,
-কি চায়?
স্পর্শ: নিচে দেখলাম, বাসা ভাড়ার……….
-বুঝেছি। উপর তলায় ডানপাশের বাসাটি খালি। ফ্যামিলি বাসা, তিন রুমের। ডায়নিং, ড্রয়িং, কিচেন আর তিনটা বাথরুমও আছে। দেখবেন?
স্পর্শ: জি দেখালে ভালো হয়।
স্পর্শকে নিয়ে উপরের তলায় উঠে গেলো মহিলাটি। বেল বাজানোর সাথে সাথেই তুবা এসে দরজা খুলে দিলো।
তুবা: জি, কাকে চাইছেন?
-আমি বাড়ির মালিকের মা। এক মাস হয়েছে এসেছি। তোমরা না বাড়ি খালি করছো? আমার ছেলে বাইরে গেছে তাই আমি নিয়ে এলাম এই ছেলেটাকে। ও একবার দেখবে বাসাটা কেমন!
তুবা: বাসায় তো এই মুহূর্তে কেউ নেই৷
-আমার ছেলে বলেছে কেউ আসলে বাসা দেখিয়ে দিতে। তোমরা তো বাসা ছেড়ে দেবে, এখন ঢুকতে দিচ্ছো না কেন?
তুবা: এখনো তো ছাড়ি নি। উনাকে এভাবে বাসায় কেন ঢুকাবো? বাসায় এখন কেউ নেই।
-আমি এতো কিছু বুঝি না। একটা নতুন ভাড়াটিয়া কি হারিয়ে ফেলবো নাকি?
স্পর্শ চুপচাপ তাদের তর্ক শুনছে। সে বুঝতে পেরেছে এই মহিলা অনেক রাগী ও জেদি। উনি যা ভাবেন, তাই করেন যেকোনো মূল্যে। স্পর্শ চাইলে বলতে পারতো পরে আসবে। কিন্তু সে ইচ্ছে করেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো।
তুবা: আচ্ছা একটু দাঁড়ান।
তুবা ভেতরে ঢুকে পিয়াসাকে উঠিয়ে দিলো ঘুম থেকে। কয়েকদিনের জ্বরে পুরো শরীরটা কাঁপছে তার। ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না। পিয়াসাকে তুবা একটি চেয়ারে বসিয়ে দিলো।
তারপর দরজার কাছে এসে বললো,
তুবা: দাদু বাসায় কেউ নেই আর? ইলমাম, আপনার নাতি?
-আছে তো। কেন?
তুবা: ইলমামকে তো চিনি আমরা। আর আপনাকে কখনো দেখি নি। তাই কিভাবে অপরিচিত মানুষকে আসতে দেবো ঘরে?
– আচ্ছা, বুঝেছি।
মহিলাটা একটু উঁচু গলায় ডাকলেন।
-ইলমাম, দাদুভাই৷ একটু উপরে আসো তো!
ইলমাম দাদীর কন্ঠ শুনে উপরে উঠে এলো। তারপর স্পর্শ ইলমামসহ ঘরে ঢুকলো। ড্রয়িং, ডায়নিং পার করে একটি ঘরে উঁকি দিলো স্পর্শ। আর সেখানেই আয়নার মধ্যে পিয়াসাকে দেখে থমকে গেলো। পিয়াসা মাথাটা চেয়ারের হাতলে ফেলে রেখেছে। আর চোখটাও বন্ধ করে রেখেছে। আগের চেয়ে অনেক বড়ো বড়ো লাগছে। খোলা চুলগুলোও এলো মেলো হয়ে আছে। চোখ-মুখ অনেক শুকনো।
স্পর্শ পিয়াসাকে দেখে একটু কষ্ট পেলেও আবার মনটা তার ভালো হয়ে গেছে এই ভেবে তার কষ্টের জন্য দায়ী মানুষটা আজ অসুখী।
স্পর্শ: ভালো লেগেছে৷ আমি আগামীকাল এসে জানাবো।
এই বলে স্পর্শ চলে গেলো। কিন্তু স্পর্শ আর আসে নি। আর আসবেও না। কারণ এই এলাকার সাথে তার যোগসূত্র যার জন্য, সে নিজেই এই এলাকা ছেড়ে দেবে। এখন শুধু জানার বাকী পিয়াসার নতুন স্থানটা কোথায়!
এক বন্ধুর সহযোগিতায় একজন লোককে ঠিক করলো পিয়াসার নতুন ঠিকানা বের করার জন্য। এক সপ্তাহের মধ্যে লোকটি পিয়াসাদের ঠিকানা বের করেও ফেললো। যেই বাসায় পিয়াসারা উঠেছিলো সেই বিল্ডিংয়ের সামনেই স্পর্শ তার কিছু বন্ধুদের নিয়ে উঠলো। স্পর্শের বন্ধুরা আগে একটা হোস্টেলে থাকতো। সেখানে অনেক অসুবিধে হওয়ায় তারাও রাজি হয়ে যায় একটি বাসায় একসাথে থাকার ব্যাপারে। তবে সিয়াম ছাড়া বাকীরা জানতো না স্পর্শের উদ্দেশ্যটা কি।
স্পর্শ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি সেই বিল্ডিংয়ে। তবে এবার আগের বারের মতো মুখোমুখি নেই তারা৷ স্পর্শ ছয়তলায় থাকে। পিয়াসার ফ্ল্যাট চারতলায়। আর অনেকটা দূরেও। তবুও আবছা আলোতেও সে পিয়াসার অবয়ব দেখে চিনে ফেলে। তাই হয়তো পিয়াসার উপর নজর রাখতে কোনো অসুবিধে হয় না।
||
এভাবে কি একটা সম্পর্ক শুরু না হয়েও শেষ হয়ে যায়? কি আছে এর পেছনে? কেনই বা এতোটা ঘৃণা জমানো আছে এই মনে?
স্পর্শ কি ভুল ভাবছে পিয়াসাকে? নাকি সত্যিই পিয়াসা অপরাধী?
||
কলেজ ছুটির পর সময় কাটানোর জন্য বাচ্চা পড়াতে যায় পিয়াসা। আজও টিউশন শেষে বাসায় ফিরছিলো। তখন সন্ধ্যার একদম শেষভাগ।
বর্তমানে পিয়াসা বাবা-মা সহ যে বাসায় উঠেছে সেই বাসাটি একটি আবাসিক এলাকায়। তাই আশেপাশে মানুষের আনাগোনা অনেক কম।
পিয়াসা রাস্তায় আনমনেই হাঁটছিলো। নিস্তব্ধতা ভালোই লাগছিলো তার। কিন্তু হঠাৎ একটি বাইক এসে তার সামনে দাঁড়ালো। পিয়াসা খানিকটা পাশ কেটে যেতে নিলে বাইকটা আবার ঘুরে এসে পিয়াসার পথ আটকে ধরলো।
পিয়াসা বিরক্ত হয়ে বললো,
পিয়াসা: সমস্যা কি?
হেলমেটের কারণে বাইকারের মুখটা দেখতে পারছিলো না পিয়াসা। বারবার মানুষটা তার রাস্তা আটকে তাকে বিরক্ত করছিলো।
বাইকারটি হঠাৎ পিয়াসার কোমর ধরে তাকে বাইকের কাছে নিয়ে এলো।
পিয়াসা চেঁচিয়ে বললো,
পিয়াসা: এইটা কেমন অসভ্যতা?
পিয়াসার কথায় ছেলেটির কোনো হেলদোল হলো না। সে ইচ্ছে করে পিয়াসাকে টিজ করতে লাগলো।
চোখটা ছলছল করে উঠলো পিয়াসার। আশেপাশে কোনো মানুষজনের চিহ্নও নেই। ভয়ে তার বুকটা কাঁপছে। কিন্তু ছেলেটা পিয়াসাকে একদমই ছাড়ছে না। বাইকে বসা অবস্থায় তাকে জড়িয়ে ধরে নিজের কাছেই আটকে রেখেছে। ছেলেটির চোখটাও দেখা যাচ্ছে না। দেখে গেলে হয়তো পিয়াসা বুঝতো দুটি শান্ত চোখ খুব সূক্ষ্ম ভাবে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার অপেক্ষায় ছিলো স্পর্শ। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথেই বন্ধুর বাইক নিয়ে বের হয়েছিলো পিয়াসার উপর নজর রাখতে। কিন্তু শূন্য রাস্তায় পিয়াসাকে একা হাঁটতে দেখেই তার মনে মনে দুষ্টু বুদ্ধি চেপে বসলো। তাই পিয়াসাকে বিরক্ত করার জন্য বাইক নিয়ে পিয়াসার পথ বার বার আটকে দিচ্ছিলো।
এদিকে-
পিয়াসা ছেলেটির কোনো হেলদোল না দেখে জোর করেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। তারপর একটা দৌঁড় দিয়ে চলে যাওয়ার সময় স্পর্শ পিয়াসার ব্যাগ ধরে টান দিয়ে পিয়াসাকে আবার বাইকের কাছে নিয়ে এলো। পিয়াসা ভয় পেয়ে গেলো বাইকারটির আচরণে।
পিয়াসা: দেখেন ভাইয়া, ছাড়ুন আমাকে। প্লিজ।
স্পর্শ: কেন ভালো লাগছে না?
পিয়াসা: মানে?
স্পর্শ অট্টহাসি হেসে বললো,
স্পর্শ: কোন পুরুষের জন্য রাস্তায় হাঁটছেন একা একা? কিন্তু মিস এই এলাকা তো ভদ্রলোকেদের। আপনার জন্য হয়তো অন্য এলাকায় যাওয়া উচিত হবে। আর এই এলাকায় আপনার মূল্য খুবই সামান্য।
পিয়াসা স্পর্শকে হালকা ধাক্কা দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
পিয়াসা: আপনাদের মতো নিচুস্তরের মানুষদের জন্য মেয়েরা সন্ধ্যায় ঘরের বাইরে অনিরাপদ। আপনাদের মতো বখাটেদের জন্য মেয়েরা স্বাধীনতা পেয়েও পরাধীন। নিজের মনের কালো দাগটা দূর করুন। বোন না থাকলেও কোনো এক মায়ের গর্ভ থেকেই কিন্তু আপনার জন্ম হয়েছে, নাকি আকাশ থেকে টুপ করে ভূমিতে এসে পড়েছিলেন? মেয়েদের রেস্পেক্ট করতে শিখেন।
স্পর্শ মনে মনে বাঁকা হাসলো।
স্পর্শ: ঋতুর মতো ছেলে পরিবর্তন করা, টাকার জন্য ছেলেদের সাথে মিথ্যে অভিনয় করা এসব মেয়েদের আবার রেস্পেক্ট?
পিয়াসার ইচ্ছে করছিলো ছেলেটার মুখে কয়েক ঘা বসিয়ে দিতে। কিন্তু হেলমেটটির জন্য তার ইচ্ছেটা পূর্ণ হচ্ছে না। তাই সে বুদ্ধি করে ছেলেটির কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য, নিজের হাত মুঠো করে খুব জোরে ছেলেটির বুকে একটা ঘুষি মারলো। পিয়াসার ঘুষিতে ব্যথা লাগলেও স্পর্শ তেমন রিয়েক্ট করলো না। বরং পা দিয়ে একটা ধাক্কা দিয়ে পিয়াসাকে রাস্তায় ফেলে দিলো।
তারপর বাইক থেকে নেমে পিয়াসার সামনে বসে বললো,
স্পর্শ: তোর মতো ক্যারেক্টারলেস মেয়েদের জায়গা রাস্তায়।
পিয়াসা আর কিছু বলতে পারলো না। ক্যারেক্টারলেস শব্দটা শুনে নিজেকে নোংরা লাগছিলো তার।
পিয়াসা ভাবছে,
সে কি এমন জঘন্য কাজ করেছে যে তাকে এই শব্দটা শুনতে হলো? সে আর নিতে পারে নি কথাগুলো। চোখ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু গড়াতে লাগলো।
এদিকে স্পর্শ কথাটি বলে, বসা থেকে উঠে হন হন করে চলে গেলো।
রাতে আর ঘুমোতে পারে নি স্পর্শ। সারা রাত পিয়াসার গভীর চোখের কোণে জমে থাকা জলগুলো তাকে বিরক্ত করছিলো।
||
চলবে-