অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-১০,১১

0
914

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ,পর্ব-১০,১১
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১০:

||
স্পর্শ মামার বাসা থেকে বের হয়েই রাস্তায় হাঁটছে। হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনে বিরক্ত হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো পিয়াসার কল। যদিও পিয়াসার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই, তবুও মিথ্যে সম্পর্কটা চালিয়ে যাওয়ার খাতিরে কলটা রিসিভ করলো।

পিয়াসা নরম কন্ঠে বললো,
পিয়াসা: স্পর্শ! কোথায় তুমি?

স্পর্শ চুপ করে আছে।

পিয়াসা: তুমি কি খুব ব্যস্ত?

স্পর্শ: না, বলো কি বলবে!

পিয়াসা: তুমি ফ্রি আছো?

স্পর্শ একটু জোরেই বললো,
স্পর্শ: বললাম তো একবার। কি হয়েছে বলো?

পিয়াসা এবার চুপ হয়ে গেলো।

স্পর্শ বুঝতে পেরে বললো,
স্পর্শ: সরি। মাকে দেখতে বাড়িতে যাচ্ছি। তোমাকে তো বলেছি, মা অসুস্থ। তাই একটু চাপে আছি।

পিয়াসা মলিন হেসে বললো,
পিয়াসা: ওহ আচ্ছা। সমস্যা নেই। যাও মায়ের কাছে।

স্পর্শ: কি বলতে চেয়েছিলে?

পিয়াসা: তোমার সাথে একটু দেখা করতে চেয়েছি আজ।

স্পর্শ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো,
স্পর্শ: তোমার বাবা-মা জানতে পারলে?

পিয়াসা: বাবা-মা আজ অফিস থেকেই বাড়িতে চলে যাবে। ফিরতে একটু রাত হবে।

স্পর্শ কি ভেবে বাঁকা হাসলো।

স্পর্শ: আচ্ছা, তুমি এক্ষুনি খুলশি আসো।

স্পর্শের কথায় পিয়াসার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে খুলশি চলে এলো। গাড়ি থেকে নেমেই স্পর্শকে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ে তার বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগলো।

স্পর্শ পিয়াসার সামনে এসে হুট করেই পিয়াসার হাতটা শক্ত করে ধরলো।

পিয়াসা: হ্যাপি বার্থডে স্পর্শ।

স্পর্শ মুচকি হাসলো।

পিয়াসা: তোমার জন্য গিফট।

স্পর্শ: সুচিস্মিতা আমার সাথে দেখা করেছে এর চেয়ে বড় গিফট কি হয়! তোমায় কাছে পাওয়াটাই আমার কাছে অনেক।

লজ্জায় পিয়াসার মুখটা লাল হয়ে যাচ্ছে।

তারা একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। খাবার অর্ডার দিয়ে স্পর্শ একটু বাইরে দাঁড়িয়ে কাকে যেন ফোন দিলো। পিয়াসার দিকে তাকিয়ে কি যেন বলছিলো সে। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এলো।

পিয়াসা: আচ্ছা, তুমি বাড়িতে যাবে না?

স্পর্শ: তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর যাবো।

এক ঘন্টা পর স্পর্শের একটা ফোন আসায় সে বের হলো। কিন্তু অনেকক্ষণ পরও আসছে না দেখে পিয়াসা চিন্তিত মুখে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে আর স্পর্শের নম্বরে ফোন দিচ্ছে। কিন্তু নম্বরটি বারবার বন্ধ দেখাচ্ছে। এদিকে রেস্টুরেন্টের বয় বিল দেওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। পিয়াসা ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলো। সে কিছুক্ষণ সময় চেয়ে তুবাকে ফোন করলো। কিন্তু তুবাও ফোন রিসিভ করছে না। আশেপাশে জানাজানি হয়ে গেছে একটা মেয়ে বয়ফ্রেন্ডের সাথে খেতে এসেছে, আর সেই বয়ফ্রেন্ড বিল না দিয়েই চলে গেছে।

অপমানে চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছে পিয়াসার। দূর থেকেই স্পর্শ পিয়াসার মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে। স্পর্শের মনে এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু অনুভূতিটা বিষাদের নাকি শান্তির তা বুঝতে পারছে না সে।

এদিকে-
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে পিয়াসা। এতোগুলো মানুষের ভীড়ে নিজেকে খুবই অসহায় লাগছে তার। মন মানতে চাইছে না যে, স্পর্শ তাকে এভাবে একা রেখে চলে যেতে পারে। মাত্র কিছু টাকা নিয়ে বের হয়েছে সে। দামী রেস্টুরেন্টে আসার কোনো প্ল্যান ছিলো না তার। শুধু স্পর্শের জন্য কেনা গিফটগুলো স্পর্শকে দেওয়ার জন্যই দেখা করতে চেয়েছিলো। কিন্তু স্পর্শ তাকে জোর করেই নিয়ে এসেছে খুলশির দামী রেস্টুরেন্টে। এক কাপ কফির দাম যেখানে পিয়াসার হাতের নাগালের বাইরে, সেখানে স্পর্শ আরো অনেক কিছুই অর্ডার করে ফেলেছে।

পিয়াসা তুবাকে কল করেই যাচ্ছে। কিন্তু সে ফোন ধরছে না। যদি বাবা-মা কোনোভাবে বুঝতে পারে সে এতো বড়ো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে, তাকে আর কোনোদিন বাসা থেকে বের হতে দেবে না। এমনকি তার সব স্বাধীনতা বন্ধ হয়ে যাবে।

মোটামুটি দুই ঘন্টা পর স্পর্শ পিয়াসার সামনে এসে বসলো। পিয়াসা স্পর্শকে দেখে চুপ করে রইলো। আর স্পর্শ অবাক হওয়ার ভান ধরে বললো,

স্পর্শ: সুচিস্মিতা! তুমি কাঁদছো কেন? তুমি কি ভেবেছো আমি হারিয়ে গেছি? আমি আমার সুচিস্মিতাকে একা ফেলে চলে যাবো নাকি পাগলী!

পিয়াসা এখনো চুপ করে আছে।

স্পর্শ পিয়াসার হাতটি নিজের হাতের মাঝে আবদ্ধ করলো। তারপর নরম কন্ঠে বললো,

স্পর্শ: কি হয়েছে সুচিস্মিতা? কাঁদলে তোমায় একদম মানায় না। কাঁদছো কেন?

পিয়াসা চোখের পানিগুলো মুছে বললো,
পিয়াসা: আমি বাসায় যাবো।

স্পর্শ পিয়াসার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
স্পর্শ: আরেকটু বসো।

পিয়াসা: না। আমি বাসায় যাবো।

স্পর্শ: আচ্ছা, তুমি জানতে চাইলে না আমি কোথায় ছিলাম এতোক্ষণ?

পিয়াসা: না, জানতে চাই না আমি। আমি এক্ষুনি বাসায় যাবো।

এরপর চেয়ার ছেড়ে উঠে কিছু টাকা স্পর্শের সামনে রেখে বললো,
পিয়াসা: সরি, এর বেশি টাকা আমার কাছে ছিলো না। আমি পরে কখনো দিয়ে দেবো।

স্পর্শ চেয়ার ছেড়ে উঠে পিয়াসার কাছাকাছি চলে এলো।

রাগী কন্ঠে বললো,
স্পর্শ: কিসের টাকা দিচ্ছো তুমি আমাকে? আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি তাই টাকা দিচ্ছো? টাকার গরম দেখাচ্ছো আমাকে?

পিয়াসা: টাকার গরম দেখাচ্ছি না। কিন্তু টাকার গুরুত্বটা বুঝাতে চাইছি। আজ প্রথম সামান্য কিছু টাকার জন্য আমাকে এভাবে এতোগুলো মানুষের সামনে অপমানিত হতে হলো। আমি চাইলে বিল দিয়ে চলে যেতে পারতাম। দুই ঘন্টা মানসিক চাপ নিয়ে আমার একটা জায়গায় বসে ছটফট করতে হতো না। কিন্তু তখন আমাকে বাবা-মার সাথে যোগাযোগ করতে হতো। কিন্তু আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি তা কেউ জানে না।

স্পর্শ নরম সুরে বললো,
স্পর্শ: সরি, সুচিস্মিতা।

পিয়াসা: প্লিজ। দুই ঘন্টা একটা মেয়েকে একা কার ভরসায় রেখে গিয়েছিলেন? আমি কিন্তু আপনার ভরসায় এসেছি। তার অর্থ হলো, আপনাকে বিশ্বাস করেছি। আমাদের সম্পর্কটা মাত্র শুরু, আর শুরুতেই আপনি এমন করলেন? এখন হয়তো আপনার সাথে কোথাও গেলে আমার নিজেকে নিরাপদ মনে হবে না।

কথাগুলো বলে পিয়াসা এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। স্পর্শ বিল দিয়ে বের হওয়ার সাথে সাথেই তার বন্ধু তকির আর নিশান এগিয়ে এলো তার দিকে।

তকির: রেগে গেলো মনে হচ্ছে?

নিশান: ব্রেকাপ করে ফেলেনি তো?

স্পর্শ: রেগে গেছে, তবে ব্রেকাপ করে নি। সমস্যা নেই, আমি ম্যানেজ করে ফেলবো। প্রথম ডোজ দিয়েছি মাত্র, আরো অনেক ডোজ বাকী আছে।

নিশান: তোর বার্থডে গিফট তো ভালোই হলো! সুচিস্মিতার চোখের জল দেখা গেলো। আর তাকে অপমান করার সুযোগটাও পেয়ে গেলি।

তকির: সাথে পেয়েছে বোনাস।

স্পর্শ: বোনাস কি পেলাম?

তকির: কি দিয়েছে তোকে?

স্পর্শ: এসব দেখার সময় নেই আমার। অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে যাবো আমি।

নিশান: আচ্ছা, যা। আল্লাহ হাফেজ।

স্পর্শ গাড়িতে উঠেই জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলো। পিয়াসার গভীর অশ্রুসিক্ত চোখ দুটি বারবার তাকে ভাবাচ্ছে। এই চোখের মাঝে ছিলো স্নিগ্ধতা, ছিলো অমায়িকতা। কিন্তু একটি বারের জন্যও তাকে মিথ্যে মনে হয় নি কেন? কেন মনে হয় নি সে ছলনা করেছে? কেন মনে হয় নি সে টাকার জন্য খুনীকে সাহায্য করেছে? কেন আবার ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে তাকে?
কিন্তু কোথাও তো কিছু আটকে যাচ্ছে। কোথাও বাঁধা পড়ে যাচ্ছে এই অনুভূতি।

বাড়িতে পৌঁছেই প্রথমে পুরোনো বাড়িতে গিয়ে উঠলো স্পর্শ। এই ঘরটি স্পর্শের বাবা প্রথম বানিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি আর আসেন নি এই বাড়িতে। এর নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। হয়তো থাকতেও পারে। তবে স্পর্শ তা জানতো না। কিন্তু এইটুকু শুনেছে যে এই বাড়িতে থাকা অবস্থায় স্পর্শের দাদী মারা যান। আর যার ফলে মায়ের স্মৃতি ভুলে থাকার জন্য স্পর্শের বাবা জীবদ্দশায় এই বাড়িতে পা রাখেন নি। কারণ স্পর্শের বাবার কিছু কার্যকলাপে স্পর্শের দাদী কষ্ট পেয়েছিলেন। তাই তার মৃত্যুর পর স্পর্শের বাবা নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে ফেলেছেন সবার থেকে। যদিও এটি লোকমুখে শুনেছে। এর আদৌ কোনো সত্যতা আছে কিনা তা স্পর্শ জানে না।

পুরোনো বাড়িতে ঢুকেই নিজের রুমে চলে যায়। রুমটি অবশ্য তার নিজের নয়, এটি তার দাদীর রুম। সে বাড়িতে আসলে এই রুমেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। দাদীর আলমারী খুলে পিয়াসার দেওয়া গিফট একপ্রকার অযত্নেই তুলে রাখলো সে। একটিবার খুলেও দেখে নি।

ফ্রেশ হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে নতুন বাড়িতে গেলো স্পর্শ। এই বাড়িটি তার ছোট চাচার বাড়ি। তিনি মারা যাওয়ার পর এই বাড়িতে কেউ আসে নি থাকতে। তাই সেখানেই আপতত স্পর্শের মা থাকেন একটি ঘরে। বাড়িতে গিয়ে দেখলো মাকে রুম বন্দি করে রাখা হয়েছে। যিনি মায়ের দেখাশুনা করেন তার কাছ থেকে ঘরের চাবি নিতে গেলো স্পর্শ।

চাচী: বাবা, ঢুকো না ঘরে এখন। সে তো এখন খুবই ছটফট করছে। তোমায় দেখলে না জানি কি করে বসে!

স্পর্শ: কি করবে?

চাচী: তোমায় আঘাত করতে পারে।

স্পর্শ: আপনি চাবিটা দেন। আমায় আঘাত করলেও সমস্যা নেই। আমি আমার মাকে সেই অধিকার দিয়েছি।

চাচীর হাত থেকে চাবি নিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে গেলো স্পর্শ। ঘরে ঢুকে দেখলো মা বাবার ছবি হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। স্পর্শ ধীর পায়ে মায়ের পাশে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু স্পর্শকে দেখে তিনি লাফিয়ে উঠলেন। কয়েক হাত দূরে গিয়ে বসে স্পর্শকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলেন। স্পর্শ একটু দূরত্ব রেখে বসে পড়লো সেই ঘরে।

||

চলবে–

#অপ্রিয়_মুহূর্ত_ও_শুকনো_একটি_গোলাপ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১১:

||
স্পশের চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসতে লাগলো তার। কি যেন গলায় আটকা পড়েছে। অশ্রুগুলোও আর বাঁধা মানলো না। ঝরঝর করে ঝরতে লাগলো আর স্পর্শও ডুকরে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,

স্পর্শ: মা, আজ আমার জন্মদিন। তুমি এই দিনেই আমায় এই সুন্দর পৃথিবীটা দেখিয়েছিলে। আমি যখন প্রথম তোমায় জিজ্ঞেস করেছি আমার নাম কেন স্পর্শ রেখেছো! তুমি আমায় শুনিয়েছিলে তোমার অনুভূতির কথাগুলো। বাবা খুব ব্যস্ত থাকতো। তোমায় একটু সময় দিতে পারতো না। তাই তোমার একটু খানি স্পর্শের প্রয়োজন ছিলো। যেই স্পর্শ তোমার সময়টা ছুঁয়ে দেবে, তোমার দিনগুলোকে ছুঁয়ে দেবে, তোমার হাসি-যন্ত্রণা সব ছুঁয়ে দেবে। আমি সেই স্পর্শ হয়ে এসেছি। আমায় কোলে নিয়ে তুমি অনেক সুখী হয়েছিলে আজকের এইদিনে। মা, আমি বাবাকে কখনো তোমার মতো করে ভালোবাসিনি। তোমার আক্ষেপ দেখে বড় হয়েছিলাম। তাই ভাবতাম বাবা হয়তো তোমায় ভালোবাসে না। তোমায় খুব বেশি ভালোবাসতাম আমি, তাই বাবাকে আমি অনুভব করতে পারি নি। বুঝতে পারি নি ভালোবাসি বললেই ভালোবাসা যায় না। কিছু ভালোবাসি বলতে না পারাতেও ভালোবাসা থাকে। বাবা শুধু আমাদের জন্য নিজেকে ত্যাগ করেছে। আমার পড়াশুনার জন্য, রিম-ঝিমের ভবিষ্যতের জন্য নিজের সুখগুলো ভুলে গিয়েছিলো। আমাকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর জন্য আমায় অভাব দেখিয়েছিলো। আজ বিলাসিতা শেখালে তোমাদের প্রয়োজনটা বুঝতাম না।

স্পর্শের মা চুপ করে তাকিয়ে আছেন স্পর্শের দিকে। মনোযোগ দিয়ে ছেলের কথা শুনছিলেন।

স্পর্শ সাহস পেয়ে বললো,
স্পর্শ: তোমার কোলে মাথা রাখতে দেবে?

মা এখনো চুপ করে আছেন। তাই স্পর্শ নিজেই এগিয়ে গেলো। কিন্তু স্পর্শের এগিয়ে আসা দেখে তিনি স্পর্শের দিকে স্টিলের একটা গ্লাস ছুড়ে মারলেন, যেটি স্পর্শের নাকের সাথে ধাক্কা খেলো। প্রচন্ড ব্যথায় নাক ধরে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালো।

স্পর্শ: এতো রাগ! এভাবে মারলে আমায়? আচ্ছা, তুমি আর রাগ করে থেকো না। আমি সব ঠিক করে দেবো। আমি আবার আসবো মা। তোমার এই কষ্টের জন্য দায়ী আমি। আমি সেই মেয়ের মায়ায় জড়িয়ে না পড়লে বাবাকে তারা খুন করতো না। মেয়েটিকে আমি শেষ করে দেবো, মা। তাকেও আমার মতো অসহায় বানিয়ে ছাড়বো। একদম অসহায় মুখে আমার কাছে এসে ভিক্ষা চাইবে, বাবার মৃত্যুর পর যেমনটা আমি চেয়েছি সাহায্য ভিক্ষা, ঠিক তেমনই।

স্পর্শ ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ির বাইরে চলে এলো। চাচী দৌঁড়ে এসে বললেন,
চাচী: বাবা তুমি কি থাকবে না আজ?

স্পর্শ: দম বন্ধ হয়ে আসবে এই বাড়িতে থাকলে। কিভাবে পারবো খোলা হাওয়ায় থাকতে, আমার মা যেখানে বন্দি সেই ঘরে। আমি চলে যাচ্ছি চাচী।

পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে চাচীর হাতে দিলো স্পর্শ৷

স্পর্শ: সব টাকা আপনিই রেখে দেন। মায়ের খরচ চাচাকে পাঠাবো। তিনি আপনাকে দেবেন প্রয়োজন হলে। আর মাঝে মাঝে মাকে নিয়ে একটু আশেপাশে ঘুরবেন। মায়ের ঘুরতে ভালো লাগে। আমায় দেখলে তো ঝামেলা করবে। আপনার কথা তো শুনে, তাই বললাম।

চাচী: তুমি চিন্তা করো না, বাবা। আমি সামলে নেবো।

স্পর্শ মলিন হেসে হাঁটতে লাগলো। নাকটা লাল হয়ে আছে তার। হয়তো কয়েকঘন্টা পর কালো হয়ে যাবে। কিন্তু সে এমন ভাবে হাঁটছে যেন কিছুই হয় নি। কারণ এই সত্য গ্রাম ছেড়ে তাকে মিথ্যে শহরে যেতে হবে। যেই শহরে মুখোশধারীদের ভীড়ে তাকে বাঁচতে হবে। আঘাত পেতে হবে আরো। তাই এসব ছোটখাটো আঘাতে মুষড়ে পড়লে চলবে না।

এদিকে-
অনেকবার ফোন দেওয়ার পরও পিয়াসা স্পর্শের কল রিসিভ করছে না। মনে মনে ভয় জমছে স্পর্শের মনে। সে হারিয়ে ফেলবে না তো সুচিস্মিতাকে?

স্পর্শকে অবেলায় বিছানায় শুয়ে বসে সময় কাটাতে দেখে পিয়াল বললো,
পিয়াল: সুচিস্মিতাকে কি সত্যিই হারিয়ে ফেলেছিস? মুখ ভার করে আছিস যে! ফোন ধরছে না?

স্পর্শ: না, এতো সহজে হারিয়ে যেতে দেবো না৷ আমার প্রতিটা যন্ত্রণার হিসেব দিয়েই সে মুক্তি পাবে। আর ফোন ধরছে না তো কি হয়েছে! সামনেই তো বাসা। একেবারে উঠিয়ে নিয়ে আসবো।

পিয়াল: ভাই, তুই আসলেই দিন দিন ভয়ংকর হয়ে যাচ্ছিস! ভদ্র ছেলেটা একেবারে বিগড়ে যাচ্ছে। আন্টি কিন্তু তখন আমাদের দোষ দেবে। বলবে, আমার ছেলেকে তোমরা নষ্ট করে ফেলেছো।

স্পর্শ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
স্পর্শ: মা কি কখনো আর আমাকে চিনবে? আর কখনো হয়তো মায়ের শাসন আমায় স্পর্শ করবে না। মায়ের বকুনি খাওয়ার সুযোগ আর এই কপালে নেই। কারণ আমার মা যে থেকেও নেই।

পিয়াল স্পর্শের কাঁধে হাত রেখে বললো,
পিয়াল: চিন্তা করিস না বন্ধু। সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন যা, সুচিস্মিতার রাগ কমানোর ব্যবস্থা কর।

স্পর্শ সন্ধ্যায় বাস স্টপের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। প্রতিদিন টিউশন করিয়ে পিয়াসা এইখানেই নামে। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি। সাদা-কালো শাড়িতে পিয়াসাকে বাস থেকে নামতে দেখে অবাক হলো স্পর্শ।

পিয়াসা একটু জোরেই পা চালিয়ে যাচ্ছিলো। স্পর্শ পিয়াসার পেছন পেছন হাঁটছে আর ভাবছে,
স্পর্শ: সুচিস্মিতা কয়েক বছর আগেও শাড়ি পড়ে ভালোভাবে হাঁটতে পারতো না। আর আজ দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে!

স্পর্শ পিয়াসাকে পেছন থেকে ডাকলো।

স্পর্শ: সুচিস্মিতা!

পিয়াসা ঘাড় ঘুরিয়ে স্পর্শের দিকে একনজর তাকিয়ে আবার হাঁটতে লাগলো। স্পর্শ পিয়াসার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।

স্পর্শ: আমাকে কি একবার সুযোগ দেওয়া যায় না?

পিয়াসা: আমি এই মুহূর্তে আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি না।

স্পর্শ: তুমি আমাকে একবার এক্সপ্লেইন করার সুযোগটা তো দাও!

পিয়াসা: প্লিজ এভাবে রাস্তার মধ্যে আমার পথ আটকে দাঁড়াবেন না। সুন্দর দেখায় না এসব।

স্পর্শকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় স্পর্শ পিয়াসার হাত ধরে তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো।

স্পর্শ: সুচিস্মিতা, তোমাকে ভালোবাসি আমি। আমার কেউ নেই তুমি ছাড়া৷ এখন তুমিও কি আমায় নিঃস্ব করে দেবে?

পিয়াসা স্পর্শের হাত ছাড়িয়ে বললো,
পিয়াসা: আপনি যখন তখন আমার হাত ধরবেন না। এগুলো ভালো দেখায় না। আর আমারও ভালো লাগে না এসব।

স্পর্শ দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণ করলো। তারপর পিয়াসার কাছ থেকে একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে নরম সুরে বললো,

স্পর্শ: আচ্ছা, সরি। আমি আর তোমার কাছে আসবো না। আমি অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলছি, তাই না? আসলে ওইদিন হঠাৎ আমার গ্রামের এক চাচীর কল এসেছিলো। উনি আমার মায়ের দেখাশুনা করে। ওহ, তোমাকে তো বলাও হয় নি, আমার মা মানসিক ভাবে অসুস্থ। বাবার মৃত্যুর পর থেকে মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। চাচীর কলটা তোমার সামনে ধরতে চাই নি। ভেবেছি তোমার মনটা খারাপ হয়ে যাবে। আমার মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে তোমার হাসিটা বিলীন হয়ে যাক, তা আমি চাই নি। সুচিস্মিতা, সেই দিন আমি মায়ের সাথে কথা বলে মাকে শান্ত করাচ্ছিলাম, তাই এতো সময় লেগেছিলো। কিন্তু তোমাকে ফেলে আমি কখনো যেতাম না। এতোটা কেয়ারলেস আমাকে কিভাবে ভাবলে তুমি?

স্পর্শের মিথ্যে কথায় পিয়াসার রাগটা বিলীন হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, যা পিয়াসার মুখের কোমলতা দেখেই বুঝে ফেলেছে স্পর্শ।

মনে মনে হাসলো স্পর্শ। পিয়াসা স্পর্শের কাছে এসে বললো,
পিয়াসা: আপনি এই কথা আমাকে সেদিন বলেন নি কেন?

স্পর্শ: তুমি আমায় বলার সুযোগ দিলে কোথায়!

পিয়াসা: আন্টি কেমন আছেন এখন!

স্পর্শ: আগের মতোই। আচ্ছা, এসব কথা বাদ দাও। এসব মনে পড়লে অনেক খারাপ লাগে আমার। এখন বলো আজ শাড়ি পড়ে কোথা থেকে আসলে?

পিয়াসা: কলেজে প্রোগ্রাম ছিলো। ওখান থেকেই টিউশনে চলে গেলাম।

স্পর্শ: অনেক সুন্দর লাগছে আমার সুচিস্মিতাকে।

পিয়াসা মুচকি হাসলো।

পিয়াসা: আচ্ছা, দেরী হয়ে যাচ্ছে অনেক। রাতে ফোনে কথা হবে। ঠিক আছে?

স্পর্শ: আচ্ছা।

হাত নাড়িয়ে পিয়াসাকে বিদায় দিলো স্পর্শ। পিয়াসা চলে যাওয়ার পর বাসায় ঢুকলো সে।

স্পর্শের বন্ধুরা স্পর্শকে দেখে তাকিয়ে রইলো উৎসুক দৃষ্টিতে। স্পর্শ শার্টের হাতার ভাঁজ খুলতে খুলতে ঘরে ঢুকে একটা দুষ্টু হাসি দিলো।

স্পর্শের হাসি দেখে বন্ধুরা চেঁচিয়ে বললো,
তার মানে পটিয়ে ফেলেছিস?

স্পর্শ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

সবাই স্পর্শকে ঘিরে ধরলো কিভাবে সুচিস্মিতাকে পটিয়েছে সেই গল্প শুনার জন্য। স্পর্শও বন্ধুদের সাথে অনেক হাসাহাসি করলো, পিয়াসাকে বোকা বানিয়ে। কিন্তু তাদের মধ্যে চুপচাপ বসে স্পর্শের কপটতার গল্প শুনছিলো আকাশ আর হাবীব।

ব্যথিত কন্ঠে আকাশ বললো,
আকাশ: একটা মেয়ের বিশ্বাস নিয়ে ছলনা করে, আবার বন্ধুদের সামনে বুক ফুলিয়ে স্বীকার করছিস?

তকির: এই তুই চুপ কর। এতো মহান হতে হবে না তোকে। স্পর্শ, তুই তোর জায়গা থেকে একদম ঠিক!

হাবীব: একদমই না। সেই মেয়েটা যদি সত্যিই ছলনাময়ী হতো, আজ তোর ছলনা তার কাছে কি ধরা পরতো না? একটা মেয়ে যদি এতোই খারাপ হয়, তার কাছে এই সম্পর্ক এতোটা মূল্যবান কখনোই মনে হতো না! স্পর্শ, তুই ভুল করছিস। কোথাও তো একটা সমস্যা আছে! আরেকবার না হয় যাচাই করে দেখ।

স্পর্শ চেঁচিয়ে বললো,
স্পর্শ: যাচাই করে দেখেছি। এমনি এমনি বিশ্বাস করি নি এসব! রকির সাথে তার সম্পর্ক ছিলো! আমার কাছে সব ছবি আছে। তাদের ঘনিষ্ঠ চ্যাটের ছবিগুলো কি আমি অস্বীকার করবো?

হাবীব: চ্যাটগুলো যদি মিথ্যে হয়!

স্পর্শ: কেন মিথ্যে হবে? ওর ছবি ছিলো ওয়ালে। ছবি আদান-প্রদান করেছে ওরা।

সিয়াম স্পর্শের কাঁধে হাত রেখে বললো,
সিয়াম: সম্পর্ক হয়তো ছিলো! কিন্তু মেয়েটা খুনী তো ছিলো না।

স্পর্শ: ও জানতো আমার বাবাকে খুন করেছে রকি। তবুও চুপচাপ সব মেনে নিয়েছে। ও জানতো আমি তাকে খুব ভালোবাসতাম, তবুও সেই ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও কোনো দয়া হয় নি তার আমার প্রতি৷ আমি তো খুব ভালোবেসেছিলাম তাকে, প্রথম দেখায় তার প্রেমে পড়েছিলাম। কিন্তু সে আমার পরিবারকে একেবারে শেষ করে দিয়েছে। আমিও তাকে শেষ করে দেবো। ওর মুখ থেকে বের করবো রকির সব কুকীর্তির ঘটনা৷

স্পর্শ চোখের জল আটকে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।

পিয়াসার ছবি হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
স্পর্শ: তুমি শুধুই যদি আমার সুচিস্মিতা হয়ে থাকতে, খুব ভালোবাসতাম তোমায়। এখন আমি তোমাকে আর হাসতে দেবো না। সরি, সুচিস্মিতা। এট লিস্ট আমার মা আজ সুস্থ থাকলে তুমি বেঁচে যেতে, আমার ছোট বোন দুইটা মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত না হলে তুমি বেঁচে যেতে। কিন্তু আজ এতোগুলো মানুষের খুশির জন্য, তোমার শান্তিতে বেঁচে থাকার কোনো মূল্য নেই।
||

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here