#অপ্সরী-৩
তুমুল তর্ক চলছে হাফিজ-মুন্নি দম্পতির মাঝে৷ খাটের দুইপ্রান্তে বসে আছে দু’জন। মেয়েকে বিয়ে দেয়ার বিপক্ষে একের পর এক যুক্তি দাঁড় করিয়ে যাচ্ছে হাফিজ সাহেব। তবে মুন্নি বেগম সন্তুষ্ট হওয়ার মত কোনো যুক্তি দাঁড় করাতে পারছে না৷ বারবার তিনি একই লাইন ঘুরিয়ে ফির বলে যাচ্ছেন,
– মাইয়্যা যথেষ্ট বড় হইছে। আরো বড় করতে গেলে বুড়ি হইয়া যাবে৷ বুড়ি হওয়ার আগে বিদায় করো।
মুন্নি বেগমের একই কথা শুনতে শুনতে বিরক্তি ধরে এলো হাফিজ সাহেবের। গলার স্বর খানিকটা উঁচিয়ে বললো,
– ত্যানা প্যাঁচাইয়ো না তো মুন্নি! এক গান গাইতেই আছো৷ ঠিকঠাক একটা যুক্তিও তো দেখাইতে পারলা না। আমার মাইয়্যারে আমি ১৮ বছর ঘরে বসায়া পালতে পারলে ৩৬ বছরও পালতে পারব। কে আমার মাইয়্যারে বুড়ি ডাকলো নাকি জোয়ান ডাকলো সেইসবে আমার কিছু আসে যায় না৷ তোমার এত আপত্তি থাকলে কানে তুলা দিয়া বইসা থাকো আর নয়তো বাপের বাড়ি চইলা যাও। আমি আমার মেয়েরে নিয়া এইখানে থাকব। আমাদের সঙ্গে থাকতেও হবে না, আমার মেয়েরে নিয়া মানুষের সমালোচনাও তোমার শুনতে হবে না।
হাফিজ সাহেবের দিকে অনেকটা তেড়ে এগিয়ে আসলো মুন্নি বেগম। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– যুক্তি লাগব তোমার? যুক্তি খুঁজো? হ্যাঁ? তুমি যেইসব যুক্তি দেখাইছো ঐগুলা কি ঠিক ছিলো?
– কি ঠিক ছিলো না কও তো শুনি?
– আমারে বললা মেয়ে ছোট। আমারে যখন ধইরা নিয়া বিয়ে করছিলা তখন আমার বয়স কত ছিলো? ১৬ বছর ছিলো। তখন মনে হয় নাই মুন্নি এখনো ছোট, ওরে বিয়ে করা ঠিক হবে না?
মাইয়্যার জ্ঞান বুঝ হয়নাই বললা। আমার হইছিলো জ্ঞান বুদ্ধি? আমিও তো ছোটই ছিলাম। তবুও জোর কইরা বিয়ে করলা৷ তোমার সংসারে আইসা তোমার মায়ের গুতানি খাইয়া জ্ঞান বুদ্ধি সব হইছে। তবুও তো তোমার মাইয়্যার কপাল ভালো হাসিবের মা খুব সরল মনের মানুষ। তোমার মায়ের মতন তো ব্রিটিশ না ঐ মহিলা। ছেলের দোষ বাইর করলা সে বেশি কথা বলে৷ তোমার মাইয়্যা কি কম কথা বলে? ভাঙ্গা রেডিও তো সারাদিন বাজতেই থাকে৷ নিজের মাইয়্যা ভাঙ্গা রেডিও বাজাইলে খুব সুন্দর আর পরের ছেলে কথা বললে দোষ! আর কি বললা, ছেলে তোমার মাইয়্যারে খুব বিরক্ত করব। তুমি আমারে কম বিরক্ত করছো মাইশার বাপ? তোমার অত্যাচারে আব্বা আমার স্কুল বন্ধ করলো, বান্ধবীর বাড়ি যাওয়া বন্ধ করলো, খুব দরকার ছাড়া ঘরের উঠানে দাঁড়ানোও বন্ধ করলো। তোমারে আমি জীবনে একটা ইশারাও দেই নাই আর তুমি পুরা এলাকা ছড়াইলা তোমার সঙ্গে আমার প্রেম! কত ভালো জায়গায় বিয়ে হইত আমার! বিয়েগুলা সব তুমি ভাঙ্গাইলা তোমার আমার মিথ্যা প্রেমের গল্প শোনাইয়া৷ এরপর কি করলা! মা রে নিয়া হাসপাতাল থেইকা আসার পথে আমারে উঠায়া নিয়া বিয়ে করলা। কম কাহিনি করছো তুমি? তুমি আবার এত ভালো ছেলেটার দোষ ধরো! তুমি নিজে কি?
মুখ টিপে হাসছে হাফিজ সাহেব। প্রতিবার এভাবে হেসেই দু’জনের মাঝে অদৃশ্য সাদা পতাকা টেনে ঝগড়ার ইতি টানেন তিনি৷ লজ্জায় ছোট হয়ে আসা চোখজোড়া দিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকান স্ত্রীর দিকে৷ প্রায়ই তার স্ত্রী খোঁটা দেয়ার ছলে সোনালী অতীতগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়। লজ্জায় মাথা নুয়ে এলেও অদ্ভুত ভালো লাগায় মনটা অবশ হয়ে আসে৷ চোখের সামনে উত্তর পাড়ার রাস্তা ধরে দুই বেণী ঝুলিয়ে ক্লান্ত চেহারার স্কুল ফেরত কিশোরী মুন্নি ভাসতে থাকে৷ নতুন করে মুন্নির জন্য প্রেম-প্রেম লাগে। আহ্লাদী স্বরে হাফিজ সাহেব স্ত্রীকে বললো,
– কি যে করো না! রাত-বিরাতে কেউ এইসব পুরানা ইতিহাস নাড়াচাড়া দেয়! আসো তো, আইসা ঘুমাও। বেশি রাত জাগলে তোমার চোখের নিচে কালি পইড়া যাবে।
– এইখানে আমি সম্বন্ধ পাকা করতে চাই। তুমি আমারে ছেলের খোঁজ খবর আইনা দিবা কিনা বলো?
– দিবো, দিবো। সকাল তো হইতে দিবা? এতরাতে খোঁজ নিবো কই?
খাটের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে জড়োসড়ো হয়ে ফ্লোরে বসে আছে মাইশা। তখন ঘটে যাওয়া সেই লোমহর্ষক ঘটনা থেকে এখনো সে বেরিয়ে আসতে পারছে না৷ কয়েক সেকেন্ডের ঘোরটা কাটছে না৷ মনের মাঝে থেমে থেমে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মানুষটা কি কাছে চলে এসেছিলো! তার নিঃশ্বাসের উত্তাপ গালে চোখে এসে মিশে যাচ্ছিলো। রেগে লাল হয়ে যাওয়া চোখগুলো যেন চিৎকার করে জানান দিচ্ছিলো,
“তোকে এক্ষুনি লবন মরিচ মেখে খেয়ে ফেলব আমি।”
আর তার স্পর্শ! কেউ কি কখনো এভাবে তার ঠোঁট হাত চেপে ধরেছিলো? নাহ্, ধরেনি তো। প্রথম, এই লোকটাই প্রথম ছুঁয়ে দিলো তাকে। গায়ে কাঁটা দেয়া অনুভূতি! তার গায়ের মাখা বডিস্প্রের ঘ্রানটা এখনো নাকে লেগে আছে৷ ঐ যে তখন কাছে এসেছিলো, তখনই বোধ হয় সেই ঘ্রানটা তার গায়েও মেখে গিয়েছে। কানে বারবার সেই বউ ডাকটা, আজ রাতেই ধরে নিয়ে বিয়ে করে ফেলব লাইনটা সাইরেনের মত বেজে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে নিজেকে মদ খাওয়া মাতাল মনে হচ্ছে কিংবা সাঁতার না জানা এক প্রাণী যে নাম না জানা এক অনুভূতির সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে।
খাটের উপর মোবাইল বাজছে৷ অলস ভঙ্গিতে মাইশা হাত বাড়িয়ে ফোনের স্ক্রিনে দেখতে পেলো অপরিচিত নাম্বার। অন্যসব দিনের মত আজ অপরিচিত নাম্বার দেখে মনে কৌতুহল জাগছে না৷ ফোনের ওপাশে কে হতে পারে সে নিয়ে কোনো প্রশ্নও জাগছে না। নিজের ঘোর কাটিয়ে উঠতেই ব্যস্ত সে। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জড়িয়ে আসা কন্ঠে শুনতে পেলো,
– ঘুমাওনি এখনো!
– কে বলছেন?
– হাসিব।
চুপ হয়ে রইলো মাইশা। নামটা শুনেই মনের মাঝে চলতে থাকা ঝড়টা আরো বেগ পেলো। এক মুহূর্তের জন্য বোধ হয় হৃৎস্পন্দনটাই থেমে গিয়েছিলো। হাসিব বললো,
– এ্যাইইই বেয়াদব, মানুষের ঘুম নিয়ে ছিনিমিনি খেলো কেন? আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে আমাকে বড় ভাই কেন বানিয়ে দিলে? এটা তুমি কি বললে তখন? কেন বললে? তোমার বাবা কেন বললো তোমাকে এখন বিয়ে দিতে চায় না? আজ তোমরা বাপ বেটি মিলে আমার কলিজায় কয়শো ফুটো করেছে সে খবর কি তোমরা জানো?
মাইশার হাত পায়ে কাঁপুনি ধরেছে। চুলের গোঁড়ায় ঘাম জমছে। জিহ্বায় জড়তা লেগেছে৷ মনে হচ্ছে যেনো ঠোঁটের সঙ্গে জিহ্বায় কেউ এসে পেরেক গেঁথে দিয়ে গেছে। কোনোকিছু বলতে চেয়েও পারছে না বলতে।
কিছু মুহূর্ত চুপচাপ কেটে গেলো। মাইশার সাড়াশব্দ না পেয়ে হতাশ হয়ে হাসিব বললো,
– তোমার ঘরের ফ্যানের শব্দ আমাকে কেন শোনাচ্ছো? আমি তো ফ্যানের শব্দ শুনতে কল করিনি, করেছি একটুখানি তোমার কন্ঠস্বর শোনার জন্য। ঘুমাতে পারিনা আমি মাইশা! আমার মত ঘুমকাতুরে মানুষ দেড়মাস ধরে ঠিকমত ঘুমাই না। এর জন্য তুমি দায়ী, তুমি!তুমি! তোমার কাছে আমার ঘুম আটকে আছে। কি অসহায় আমি তোমার কাছে ভেবে দেখো তো একটু! এতদিন একটু আধটু যাও ঘুমাতে পারতাম, আজ থেকে তাও হবে না। বাপ বেটি মিলে আমার বাকি ঘুমটাও খেয়ে নিলে৷ আমি যদি বুকে ব্যাথা হয়ে মারা যাই তাহলে তার দায় থাকবে তোমাদের বাপ বেটির। তোমরা খুনী। বন্ধুদের বলে যাবো আমি মারা যাওয়ার পর পুরো শহরের দেয়ালে দেয়ালে তোমাদের ছবি পোস্টার করে টাঙিয়ে দিতে। ছবির নিচে লিখা থাকবে এরা দুইজন খুনী৷ এই শহরের নিরীহ এক প্রেমিককে বাপ বেটি মিলে খুন করেছে।
এখনো নীরব মাইশা। আরো কিছু মুহূর্ত কেটে যায় এপাশ-ওপাশের নীরবতায়৷ খানিকবাদে আহ্লাদী হয়ে হাসিব বললো,
– আমার কাছে আসো না প্লিজ! চোখজোড়ায় দুই-চারটা চুমু খেয়ে যাও। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যাও। আমি ঘুমাতে চাই মাইশা, একটা লম্বা ঘুম দিতে চাই।
(চলবে)
-মিম