#অবন্তর_আসক্তি
#পর্ব_২৬,২৭,২৮
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
২৬
কোলের উপর রেখে বক্সের গা থেকে রেপিং পেপার খুলতে লাগল বর্ষা। একটা হ্যান্ড পেইন্টেড শুভ্র সাদা শাড়ি। চোখ ধাধানো সৌন্দর্য তার শাড়ির আঁচলের ও পাড়ের দিকটায় কৃষ্ণচূড়া ফুলের মতল ডিজাইন করে পেইন্ড করেছে। দেখে অনুমান করা যাচ্ছে, যে আর্ট করেছে সে এই শাড়িটা খুব যত্ন সহকারে হ্যান্ড পেইন্ড করেছে। শাড়ির আঁচল পুরোটা জুড়ে কৃষ্ণচূড়া ফুলে পেইন্ড করা। বর্ষা শাড়িটা বিছানার উপর রাখল বক্সটার ভেতর থেকে এবার দুই মুঠ হাতের কাঁচের চুড়ি বের করল দুই রঙের চুড়ি লাল ও সাদা চুড়িগুলো নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখছে। কাঁচের সাথে কাঁচ বারি লেগে টুনটুন শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে। ফিক করে হেসে ফেলল বর্ষা। চুড়ি গুলো শাড়ির উপরে আলতো করে রেখে দিলো। এবার বের করল টপ কানের দুল সেটাও ফুলের মধ্যে, চারপাশে সাদা মধ্যে একটা ছোট্ট ফুলের ডিজাইন। দুলটার সাথে ছোট একটা বক্স সেই বক্সের মধ্যে একটা পায়েল। বক্সটার মধ্যে আবারও হাত দিলে বের হয়ে আসে খোঁপায় বাঁধার প্লাস্টিকের সাদা ফুল। সবশেষে একটা চিরকুট দেখে মৃদু হেসে চিরকুট টা হাতে নিয়ে খুলল,
“ সব কিছু তোর জন্য শুধু আজকে দিন উপলক্ষে, সব কিছু দিয়ে সেজে নিচে চলে যায়। ”
বর্ষা ওয়াশরুমে চলে গেলো রুমে এসে শাড়ি পরে নেয়। রুমে বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজ গোঁজ করতে লাগল।
বর্ষা তৈরি হয়ে হল রুমে এসে উপস্থিত হলো সকলে তার বড় প্রশংসা করল দেখতে সুন্দর লাগছে। শাড়ির ডিজাইনটাও সুন্দর বলল। বর্ষা প্রত্যত্তরে মৃদু স্বরে বলল, “ থ্যাঙ্কিউ ”
সকলে এখানেই আছে শুধু নেই অভ্র। সকলে একজোট হয়ে অপেক্ষা করছে অভ্রর জন্য, সে আসলেই না সকলে বের হতে পারবে। বর্ষা চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বলল, “ ও ছেলে ওর কেন রেডি হতে একশ ঘন্টা লাগবে? ”
রিয়া মুখের উপর একহাত দিয়ে ফিসফিসে আওয়াজে বলল, “ তোর পেছনে তাকিয়ে দেখ আসছে। ”
রিয়ার কথা শুনে বর্ষা পেছনে সিঁড়ির উপরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দেখল অভ্র সিঁড়ি দিয়ে নামছে। একটা নেভি ব্লু টি শার্ট পরছে, আর কালো জিন্স, তার উপর গাঢ় এস কালার লেদার জ্যাকেট, ব্লু আর এস এর কম্বিনেশনে কেচ পরেছে চুলগুলো কালো সিঁড়ি দিয়ে যেভাবে নামছে লম্বা লম্বা চুলগুলো কপালের উপর এসে বারি খাচ্ছে । কী চমৎকার দৃশ্য বর্ষা হাজার চেষ্টা করেও চোখ ফেরাতে পারছেনা অভ্রকে অমায়িক সুন্দর ও কিউট লাগছে। বর্ষা তার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে।
অভ্র একহাত দিয়ে চুলগুলো পেছনের দিকে ঢেলে দেয় সকলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “ স্যরি একটু লেট হয়ে গেলো। কিন্তু এখন চলো। ”
সকলের উদ্দেশ্য কথা বলার মধ্যে বর্ষার দিকে আড়চোখে একনজর তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠল, “ খুব সুন্দর লাগছে। শাড়িটা মানিয়েছে তোর গায়ে। ”
প্রত্যত্তরে বর্ষা নির্বাক রইল। একসাথে সকলে বের হয়ে পরল। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে নূর ইসলাম পই পই করে বলে দিয়েছেন রাত নয়টার আগে সব ছেলে মেয়ে জেনো বাড়িতে চলে আসে।
_________
চারদিকে শুধু অন্ধকার গাড়ির হেডলাইটের আলোয় সামনের রাস্তা টুকুই শুধু যা দেখা যাচ্ছে। বার কয়েক জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে অভ্রর উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছুঁড়ল বর্ষা, “ আমরা কোথায় যাচ্ছি? ”
অভ্র ড্রাইভিং করছিল সামনে নজর রেখেই উত্তর দিলো, “ মনপোড়া দ্বীপ মুকসবিল ”
পেছন থেকে অস্ফুটস্বরে রিমা বলে উঠল, “ কিহহ? ওই যে নতুন দ্বীপ হইছে ওইটায়? ”
“ হুম! ওইটাই এখন তোরা এক্সাইটেড না হয়ে চুপ করে বস। ”
ত্রিশ মিনিট পর সকলে সেখানে পৌঁছে যায়। দ্বীপে যেতে কিছুটা হাঁটতে হবে প্রায় পাঁচ মিনিটের কাঁচা রাস্তা হেঁটে যেতে হয়। গাড়ি রাস্তার পাশে খোলা মাঠে পার্ক করে সকলে একসাথে রওনা হলো। এদিকটা পুরো গ্রামের মতো সব জাগায় শুধু ঝোপজঙ্গল গাছতলা। এদিকে লাইটও নেই অন্ধকারে জঙ্গল থেকে সাপ বের হতে পারে। সেজন্য অভ্র আগে থেকে সকলকে সাবধান করে দেয়। সকলে জেনো চারপাশ দেখে চলাচল করে৷ সকলে ফোনের টর্চ লাইট অন করে হেঁটে চলেছে।
দ্বীপে আগে থেকেই উপস্থিত আছে বর্ষার সকল চাচাতো ফুফাতো ভাইয়েরা। দ্বীপে পৌঁছে ওদের খুঁজে বের করে সেখানে যায়। দ্বীপটা নতুন তাই তেমন কিছু নেই। একটা নাগরদোলা, দুই অনেক দূরে দূরে মানুষের বসার জন্য চেয়ার টেবিল। এক বড় রুম সব জায়গায় বড় বড় আম, কাঁঠাল ও অনন্য গাছ। সন্ধ্যার পরের দৃশ্য টা খুবই সুন্দর।
সকলে একসাথে খোলা মাঠে ঘাসের উপর বসে রয়েছে। দিগ দিগন্ত থেকে ঠান্ডা হিমেল বাতাস এসে গা কাঁপিয়ে তুলছে। সকলের থেকে এক ফুট গ্যাপ রেখে শুকনো লাকড়ি দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়েছে।
বর্ষার সামনে একটা কেক তাতে মোমবাতি জ্বলছে। খানিকক্ষণ বাদ বাদ আসা উড়ন্ত হাওয়া মোমবাতি টা কে নিভু নিভু করে দিচ্ছে।
কাব্য আচমকা অভ্রর উদ্দেশ্য বলে উঠল,“ ভাই আজ তো বর্ষার বার্থডে তো ওকে ডেডিকেট করে একটা গান ধর ”
কাব্যর সাথে তালে তাল মিলিয়ে সহমত প্রকাশ করল, নাহিদ, নিভ, মুরাদ ও আদ্রিক মেয়েরাও কম নয় রিয়া, রিমা, বৃষ্টি, তিন্নি, আহিতা, মাহিরা, নিঝুম ওরাও তো আছে। সকলে মিলে রিকুয়েষ্ট করল বলে অভ্র আর না করতে পারে না। এতবার বলার পরও গানটা না গাইলে এটা বেয়াদবি করা হবে। রিমা ওর গিটার টা অভ্রর দিকে বাড়িয়ে দিলো। সে গিটারে টুংটাং সুর তুলে গান গাইতে শুরু করল।
❝ যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো
চলে এসো এক বর্ষায়,
এসো ঝরো ঝরো বৃষ্টিতে জল ভরা দৃষ্টিতে
এসো কমলো শ্যামলো ছায়,
চলে এসো এক বর্ষায়!
যদিও তখনো আকাশ থাকবে বৈরি,
কদমও গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরী,
উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো
ঝলকে ঝলকে নাচিবে বজলি আলো
তুমি চলে এসো,
চলে এসো এক বর্ষায়।
নামিবে আঁধার বেলা ফুরাবার পরে
মেঘমল্লার বৃষ্টিরো মনে মনে,
কদমও গুচ্ছ খোপায় জড়ায়ে নিয়ে,
জল ভরা মাঠে নাচিব তোমায় নিয়ে চলে এসো
তুমি চলে এসো এক বর্ষায়। ❞
গানটা সকলে মুগ্ধ হয়ে শুনেছে। বর্ষা অভ্র যখন গান গাইছিলো তখন তার মুখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল। এমন মনোরম পরিবেশ, ঠান্ডা বাতাস, সামনে আগুন জ্বলছে তার সাথে গিটার বাজিয়ে অভ্র গান গেলো তাকে ডেডিকেট করে। আগুনের লালচে-হলুদ আলোতে অভ্রর মুখটা অধিক মায়াবী লাগছিল। চোখ ফেরাতে পারেনি বর্ষা অভ্রর উপর থেকে চোখ জোড়া জেনো তার অবাধ্য হয়ে গেছে। চাইলেও সরাতে পারছে না পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে। গানটায় বর্ষার হৃদয় ছুঁয়ে দিয়েছে। কেননা, গানটায় তার নাম ছিল। কিন্তু গানটার পেছনে অর্থ গুলো বর্ষা বা কেউই বুঝেনি।
কেক কাটা হলো সকলকে বর্ষা একটু একটু খাইয়ে দিলো। সকলে বর্ষার হাতে তাদের আনা গিফট বক্স দিলো বর্ষা মৃদু হেসে সকলকে ছোট্ট করে বলল, “ থ্যাঙ্কিউ ”
___________
বাড়ি ফিরে আসতে রাত নয়টার উপরি বেজে যায়। এতে একটু আকটু বকাঝাড়ি শুনতে হয় বাড়ির ছেলেদের।
রুমে এসে শাড়ি চেঞ্জ করে নেয় বর্ষা। বাড়িতে ফিরার পথে সকলে মিলে রেস্টুরেন্ট গিয়েছিল সেখানেই খেয়ে এসেছে। তাই রাতে খেতে হবে না। বিছানার উপর বসে গিফট বক্স গুলো এক এক করে খুলে দেখছে। কয়েকটা বক্স খোলা শেষ অন্য বাকিগুলোতে হাত দিলে বক্সগুলোর ভেতর থেকে একটা নীল রঙের কাগজ বের হয়ে আসে। ভ্রু কুঞ্চিত করে কাগজটার দিকে তাকিয়ে রইল চারজন। ফোঁসফোঁস করতে করতে রিয়া বলল, “ নে এসে গেছে তোর চিঠিবাজের চিঠি। ”
রিমা খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, “ নে নে খোলে জোরে জোরে পড় আমরাও একটু শুনি। ”
বৃষ্টি ভ্রু উঁচু করে বিমূঢ় কন্ঠে বলল, “ কে এই ছেলেটা হুমম? ভালোবাসলে এত লুকোচুরি কিসের? সামনাসামনি এসে বললেই তো হয়। ”
বর্ষা ওদের কথা উপেক্ষা করে কাগজটা হাতে নিয়ে খুলে পড়তে লাগল,
❝ আমার শুভ্র সাদা পরী ”
“ তোমার শুভ্র সাদা রঙে শাড়ির আঁচলে বিবর্ষ হয়ে হুঁশশ হারিয়েছি আমি। এই মেয়ে এই, তুমি কি জানো আজ কতবার আমি হাবুডুবু খেয়েছি তোমার শাড়ির আঁচলে? আজ আমার কল্পনার ও বাহিরে সুন্দর লেগেছে তোমাকে। সত্যি বলছি তুমিই হচ্ছো আমার শুভ্র রাঙা পরী। তুমি কি জানো শুভ্র পরী? আজ তোমায় পাওয়ার ইচ্ছে আমায় বিষণ জ্বালা দিচ্ছে। আজ অনেক ইচ্ছে করেছিলো। হেঁটে তোমার সামনে চলে যাই। তুমি চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলে আমি আলতো পরশে চুম্বন এ্যঁকে দেই তোমার চোখের উপরে। এই শুভ্র পরী। তুমি কি জানো? তুমি খিলখিল করে হেসে উঠলে হেসে উঠে আমার পৃথিবী? আচ্ছা শুভ্র পরী তুমি কি হারিয়ে যাবে কভু? তুমি কি আমার একান্তই আমার প্রিয়জন হবে? ❞
ভারী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চিরকুট টা বিছানার উপর রেখে দিলো, গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো বর্ষা তখনই বৃষ্টি চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, “ আরও একটা চিঠি ”
বর্ষা ইচ্ছুক দৃষ্টিতে তাকালো। এবার চিঠির কাগজটার রঙ হলুদ।
জিহ্বা দিয়ে উপর নিচ ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিয়ে কাগজটা খুলে পড়তে লাগে এটাতে লিখা:
❝ ওই শোনো তোমার মুখের হাসি আমি বড্ড ভালোবাসি!
তোমার গালের তিল’টা কে ভালোবাসি!
তোমার মায়াবী চোখের দুষ্ট মিষ্টি লাজুক চাহনি টা কে আমি ভালোবাসি!
তোমার এক পায়ের নুপুরের ছুনছুন শব্দ’টা কে ভালোবাসি!
তোমার মাথার লম্বা লম্বা ঘন কালো কেশ গুলোকেও আমি ভালোবাসি।
তোমার কপালের কালো টিপ টাকে আমি ভালোবাসি।
তুই লজ্জা পেয়ে যখন মাথা নত করে চোখ বন্ধ করে ফেলো তখন তোমার লজ্জা মাখা মুখখানি দেখতে ভালোবাসি।
কথা বলতে বলতে হুটহাট ফিক করে হেঁসে ফেলো তখন তোমার ওই হাসিটা দেখতে ভালোবাসি।
তোমাকে মন ভরে দেখতে চাই।
তুমি অপরূপ সুন্দরী তোমার রূপের প্রসংশা করার অধিকার শুধু আমার আছে।
তোমাকে দেখার অধিকার শুধু আমার।
তোমাকে কেউ সুন্দর বললে আমার বুকের বা পাশটায় জ্বলে বড্ড যন্ত্রণা হয়।
তুমও শুধু আমার তোমাকে ভালোবাসার অধিকার আমার। আমি পাগল উন্মাদ হয়েছি শুধু তোমারই প্রেমে। তুমি আমার ভালো বাসা ভালো থাকার ঔষধ। তুমি যে আমার ভালোবাসার এক কুঁড়েঘর। তুমি যে আমার চাতকপাখি! ❞
জোরে জোরে পড়ার শব্দ শুনে দরজার সামনে দাঁড়ালো অভ্র। পড়া শেষ করে স্থির বসে রইল বর্ষা। বৃষ্টি বর্ষার হাতে গুঁতো দিয়ে বলল, “ কি ভাবছিস? ”
বর্ষা ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে তাকালো, তা দেখে রিমা বলল, “ ও নিশ্চয়ই চিঠি বাজের প্রেমে পরে গেছে। ”
বৃষ্টি সম্মোহনী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “ রিমা যা বলছে তা কি সত্যি? ”
বর্ষা উপর নিচ মাথা দুলালো অর্থাৎ হ্যাঁ।
রিয়া আকস্মিক চাহনি ফেলে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “ চিঠি বাজের প্রেমে পরেছিস মানে তো ওই বেটা আদ্রিক। তুই ওই আদ্রিকের প্রেমে পরেছিস? ”
বর্ষা নির্বাক হয়ে মাথা নত করে ফেলল। তা দেখে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থসকা অভ্র দরজার পর্দা এক হাতে খাবলে ধরলো। মাত্রারিতিক্ত ক্ষোভ নিয়ে অভ্র তৎক্ষনাৎ সেখান থেকে নিজের রুমে চলে যায়। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে টি-টেবিলের উপর সজোরে লাণ্থি মারল। রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে হুংকার ছাড়ল, “ আদ্রিক ”
অপরাধীর মতো বসে রয়েছে বর্ষা। হাল্কা একটু মাথা তুলে দুইদিকে ডানে বামে নাড়ালো মানে হচ্ছে না।
রিয়া অস্ফুটস্বরে জানতে চাইলো, “ এভাবে মাথা নাড়ানোর মানে কি? ”
বর্ষা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নির্মূলকন্ঠে বলল, “ আমি প্রেমে পরিনি কিন্তু আমার মন বলে আমি একজনকে ভালোবেসে ফেলেছি। ”
রিমা বলল, “ সেই তো এই চিঠিবাজ আদ্রিক? ”
বর্ষা আবারও দুইদিকে মাথা নাড়ালো মানে না। বৃষ্টি ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “ মানে? ”
বর্ষা শীতলকন্ঠে বলল, “ আমি আদ্রিককে ভালোবাসি না৷ আমি অ? ”.
কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো বর্ষা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রিয়া বলল, “ তুই তো কি? ”
বর্ষা চটজলদি বিছানা থেকে নেমে পরল বাকিদের উদ্দেশ্য বলল, “ কিছু না। রাত অনেক হয়েছে এখন আমি ঘুমাবো তোরা যা। ”
তিনজনের একজন ও চুল পরিমান ও নড়লো না। কাকে ভালোবাসে বর্ষা না জানা পর্যন্ত তারা কোত্থাও যাবে না।
অবশেষে বাধ্য হয়ে নাম বলতেই হলো। আকস্মিক তিনজনে চিৎকার দিয়ে উঠল, “ সত্যিইই? ”
বর্ষা লজ্জা পেয়ে ওড়নার আড়ালে মুখ লুকালো।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার পরে আর অভ্রকে কেউ দেখতে পায় না। বর্ষা তার বড় আম্মু অর্থাৎ অভ্রর আম্মুর কাছে শুধালে তিনি বলেন, অভ্র সাভার চলে গেছে। নিমিষেই মন খারাপ হয়ে যায় বর্ষার মুখ ভাড়ি হয়ে আসে৷ বার কয়েক অভ্রর নাম্বারে কল দেয় ফোনে রিং হচ্ছে কিন্তু কল রিসিভ করছে না। বিরক্তিতে ফোন বিছানার উপর ঢিল মেরে ধুপ করে মাটিতে বসে পরল। খাটের উপর ফোনটা হুট করে বেজে উঠল। হাত বাড়িয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখল অভ্র কল বেক করেছে। সাথে সাথে কল রিসিভ করে বর্ষা বলে উঠল, “ অভ্র ভাইয়া তুমি কোথায়? ”
ফোনের অপরপাশ থেকে বলল, “ দুঃখিত আমি অভ্র নই, আমি মুজাহিদ। ”
বর্ষা তেজি কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “ অভ্র ভাইয়ার ফোন আপনার কাছে কিভাবে আসলো? আপনি কি ফোনটা চুরি করেছেন? ”
ফোনের অপরপাশের লোকটি ক্রোধিত স্বরে বললেন, “ আজব কিসব কথা বলছেন আপনি? মাথা ঠিক আছে আপনার? আপনার অভ্র ভাইয়া গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। বেশি ক্ষতি হয়নি শুধু হাতে পাশে চোট লেগেছে আপনারা ফ্যামিলি মেম্বার রা এসে উনাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যান। যতসব পাগলের কারবার। ”
মুজাহিদ হাসপাতালের নাম ও কেবিন নাম্বার কত বলে কল কেটে দেয়। বর্ষা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় হল রুমে। বাড়ির বড়’রা সোফায় বসে চা বিস্কুট খাচ্ছিলেন ও অফিসের কাজের বিষয়ে কথা বলছেন। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে হাফ ছেড়ে বর্ষা অভ্রর এক্সিডেন্টের খবর জানায়। তারা সকলে বর্ষার কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ প্রায় স্থির তাকিয়ে রইল। পরক্ষণেই বর্ষার আব্বু ও বর্ষার বড় সেজো ছোট চাচুরা সকলে মিলে এড্রেস অনুযায়ী হাসপাতালের উদ্দেশ্য বের হয়ে গেলেন।
#চলবে?
#অবন্তর_আসক্তি
#পর্ব_২৭
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে অভ্র। হাতে তার ক্যানুলা লাগানো। অভ্রর ফ্যামিলি মেম্বার হসপিটালে পৌঁছালে মুজাহিদ অভ্রর ওয়ালেট মোবাইল সব কিছু তাদের হাতে দিয়ে বিদায় নেয়। অভ্রর বাবা মুজাহিদের দুই হাত ধরে কৃতজ্ঞতা জানায়। প্রত্যত্তরে মুজাহিদ বলে, “ ধন্যবাদ দেওয়ার মতো কোনো মহত কাজ আমি করিনি। তবে একটা কথা বলতে চাই। আপনাদের বাড়িতে হয়তো একটা পাগল মেয়ে আছে সে কল দিয়েছিল এই ফোনে আমি কল বেক করলে সে বলে আমি নাকি অভ্রর ফোন চুরি করেছি। সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে মেয়েকে মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করতে হবে প্রতিবার এমন যদি করে। আপনাদের পরিবারের মেয়ে আপনাদের কথাগুলো শুনতে হয়তো ভালো লাগছে না এতগুলো কথা বলার জন্য দুঃখিত। আমি এখন আসি। ”
হাসপাতাল থেকে অভ্রকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। অভ্রর আম্মু তিনি কান্না কাটি জুড়ে দিলেন। ওতো ভোরে বের হওয়ার সময় তিনি বাঁধা দিয়েছিলেন। যেতে বারণ করে ছিলো কিন্তু অভ্র নিষেধাজ্ঞা শুনেনি।
মনোয়ারা বেগম সকলের উদ্দেশ্য বললেন, “ তোমরা এভাবে কান্না কাটি করো না। আল্লাহ’র কাছে শুকরিয়া আদায় কোরো তিনি আমাদের অভ্রকে বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করেছেন। ”
অভ্র সকলের দিকে তাকিয়ে টুকটাক কথা বলছে কিন্তু বর্ষার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। বর্ষা আগ বাড়িয়ে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলেও তার উত্তর অভ্র দিচ্ছে না।
বর্ষা হঠাৎ অভ্রর পরিবর্তনের কারণ খুঁজে না পেয়ে মন মরা হয়ে রুমে চলে গেলো।
রাতে সকলে একসাথেই ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছে। অভ্রর হঠাৎ খাবার গলায় আঁটকে গেলো বর্ষা উঠে গিয়ে একটা গ্লাসে পানি ঢেলে অভ্রর দিকে বাড়িয়ে দিলো। অভ্র বিস্মিত স্বরে বলল, “ আমি কারো কাছে পানি চাইনি। ”
উপস্থিত সকলের সামনে অপমান বোধ করল বর্ষা। গ্লাসটা টেবিলের উপর শব্দ করে রেখে চলে গেলো বর্ষা তার রুমের দিকে রাতে খেলোও না অব্ধি। কপাল ভাজ করে আকস্মিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিন্নি অভ্রর দিকে হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ সেও জানে না।
বর্ষা আগ বাড়িয়ে বহু বার কথা বলার জন্য গিয়েছে সে অভ্রর রুমে বিপরীতে অভ্র অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে। আজ চার দিন ধরে অভ্র বর্ষার সাথে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে। সইতে না পেরে বর্ষা নিজেকে গুটিয়ে নিলো অভ্রকে দেখলেই সে এখন নিজ থেকেই সরে যাচ্ছে। এতে অভ্রর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। সময় সে তো নিজের মতো একটু একটু করে চলে যাচ্ছে। এরমধ্যে বর্ষাকে ওই চিঠিবাজ আর কোনো চিঠি দেয়নি৷ রাস্তার পাশে একা দাঁড়িয়ে ছিল বর্ষা। প্রাইভেট থেকে বাড়ি ফিরার জন্য রিক্সার অপেক্ষা করছে। বর্ষা আর আহিতা এক সাথে এসেছিল যাওয়ার কথাও একসাথেই ছিল কিন্তু মাঝখান থেকে মুরাদ এসে তার সঙ্গে আহিতাকে নিয়ে যায়৷ অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কোনো রিক্সা খালি পাওয়াই যাচ্ছে না। তখনই বর্ষার সামনে একটা পুঁচ্কি মেয়ে এসে উপস্থিত হলো। তার এক হাতে শুধু বকুল ফুলের মালা আরেক হাতে একটা কাগজ, মেয়েটা বর্ষার হাতে ফুলের মালা ও কাগজটা গুঁজে দিয়ে বলল, “ এগুলো তোমার একটা ভাইয়া দিতে বলছে। ”
বলে মেয়েটা দৌঁড়ে চলে গেলো। পেছন থেকে বর্ষা বাচ্চা মেয়েটাকে আওয়াজ দিলো বহুবার কিন্তু বাচ্চাটি আর পেছন ফিরে তাকায়নি।
হুট করে বর্ষার থেকে এক ফুট দূরত্বে এসে একটা গাড়ি থামলো। গাড়ির পাশেই একটা বাইক। বর্ষা চোখ ছোটছোট করে দু’জনের দিকে তাকালো।
গাড়ির ভেতর থেকে আদ্রিক বলল, “ এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। চলো তোমাকে তোমার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবো। ”
নিভ ও কোনো অংশে কম যায় না সে চেঁচিয়ে বলে উঠল, “ বর্ষা তুই আমার বাইকে উঠ। আমি তোর বাসায়ই যাচ্ছি একসাথে না হয় যাবো। ”
শুকনো ঢোক গিলে বর্ষা দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ আমার কারো লিফ্ট চাই না। আমি পায়ে হেঁটেই বাড়ি যাবো, বলার জন্য ধন্যবাদ। ”
বলে বর্ষা ধুপধাপ পা ফেলে হাঁটতে শুরু করল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আদ্রিক নিভ’র দিকে তাকিয়ে আছে আর নিভ আদ্রিকের দিকে। কেননা, দু’জনের একজনের সাথেও বর্ষা যেতে রাজি হলো না।
দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটছে বর্ষা। ওদের দু’জনকে নাকচ করার কারণ হচ্ছে, আদ্রিকের সাথে গেলে নিভ কষ্ট পাবে। আর নিভ’র সাথে গেলে আদ্রিক। তাই দুজনকে ইগনোর করে নিজে হেঁটে যাচ্ছে। তবুও ওরা কেউ জেনো মন খারাপ না করে।
নিভ নাছোরবান্দা পেছন পেছন বাইক নিয়ে এসে বর্ষার সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে নিজে বাইক থেকে নেমে বর্ষার উদ্দেশ্য বলে, “ তোর সাথে একটু কথা ছিলো৷ আর তখন ওইভাবে চলে না আসলেই পারতিস। ”
“স্যরি। আমি চাইনি আমার জন্য তোদের মধ্যে মনকষাকষি হোক। ”
“ স্যরি? আমি কি তোকে স্যরি বলতে বলছি নাকি? তোকে একটা কথা বলার জন্যই ছুটে আসা। আমার ছুটি শেষ কাল ভোরেই চিটাগং ফিরে যেতে হবে। ভালো থাকিস, আল্লাহ হাফেজ ”
বলে বর্ষার সামনে থেকে চলে গেলো নিভ। কিছুক্ষণ পর আদ্রিক এসে উপস্থিত হয়ে বলে উঠল, “ কি বলে গেলো ও? ”
“ আমার ফ্রেন্ড আমাকে কি বলে গেলো সেটা আপনাকে কেন বলবো? ”
“ হুম ঠিক বলেছো। ওটা তোমাদের পার্সোনাল কথা। সে যাইহোক, আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই বর্ষা। তুমি অনুমতি দিলে বলবো, ”
“ কি কথা? ” ঠোঁট বাঁকা করে প্রশ্ন ছুঁড়ল বর্ষা।
আদ্রিক বর্ষার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পরল। দুই আঙুলের তর্জনী দিয়ে ধরে আছে একটা রিং
সেটা বর্ষার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ কাল তোমাকে দেখার পর থেকে আর কোনো ভাবেই নিজেকে আঁটকে রাখতে পারছি না। কাল সাদা শাড়িতে তোমাকে পুরো শুভ্র পরী লাগছিল৷ আমি তোমার জাস্ট ফ্রেন্ড হয়ে থাকতে পারবো না। আমি যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছি সেদিন থেকে পাগলের মতো তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাবো। তুমি কি হবে আমার সারাজীবনের ছায়াসঙ্গী?”
বর্ষা হতবিহ্বল তাকিয়ে রইল তার মস্তিষ্ক তাকে জানান দিচ্ছে আদ্রিকই চিঠিবাজ। সেকেন্ডের মধ্যে বার কয়েক চোখের পলক ফেলল বর্ষা। শুকনো ঢোক গিলে এক দৌঁড়ে ছুটে চলে যায়। আকস্মিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আদ্রিক বর্ষার যাওয়ার পিঠে।
বাড়িতে ছুটে এসে রুমের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। হাতের চিঠিটা ছুড়ে ফেলে দেয় কাগজটা কোথায় গিয়ে পরল তা দেখল না বর্ষা। দুই হাত দিয়ে চুলের গোড়ায় শক্ত করে টেনে ধরে আছে। এই বুঝি চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলবে এমন। ভাবতেই চোখ দিয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পরল। ওই চিঠি কিছুতেই পরবে না। সেজন্যই তো ছুঁড়ে ফেলে দিলো। চিঠিবাজ আদ্রিক ভাবতেই বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে ভারী দীর্ঘশ্বাস। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। চোখ দিয়ে অবশ্য অশ্রু ঝরছে। শুধু মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।
#চলবে?
#অবন্তর_আসক্তি [২৮]
#sharmin_akter_borsha (লেখিকা)
_____________
দু’দিন ধরে নিজেকে ঘর বন্দী করে রেখেছে বর্ষা। তার রুম থেকে বের হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। বর্ষার খাবার রুমে দিয়ে যায় ওর আম্মু। বড় ও ছোট ভাইবোন সবাই বর্ষার খোঁজ নিতে এসেছে বার কয়েক। কেনো সে সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে জানতে চেয়েছে? প্রত্যত্তরে স্মিত হেসে বর্ষা বলে, ‘ আমার কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। সব কিছু জেনো শূন্য লাগে। মনে হয়, আমার কিছু একটা চাই, যেটা পেলে আমার শূন্যতা পূর্ণতায় রূপান্তর হবে। ‘
বর্ষার কথা শুনে টিটকারি মেরে কাব্য ও অপূর্ব এক সাথে বলল, ‘ তোর বিয়ে দিতে হবে বুঝা গেছে। মামা কে বলতে হবে তুই তোর জামাইয়ের শূণ্যতা অনুভব করছিস তুই। ‘
বর্ষা ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে বলে উঠল, “ তোরা যা তো আমার রুম থেকে বা’ল যতসব ফাউল পোলাপানের গোডাউন ”
রাগে ফোঁসফোঁস করতে লাগে বর্ষা। তারাও হাসতে হাসতে রুম ছেড়ে চলে যায়। বর্ষা শতশত পাহাড় সমান অভিমান নিয়ে বসে রয়। সবাই আসলেও অভ্র আসেনি বলে।
সকাল নয়টা বাজে বর্ষা রুম থেকে বের হয়ে ছাঁদের দিকে যাচ্ছিল। আর কত ঘরে বসে থাকবে? আর একটা মানুষ একা কতক্ষণই বা থাকতে পারে? বর্ষার এখন ফ্রেশ হাওয়া প্রয়োজন। তাই ছাঁদে যাচ্ছে তখনই ওকে ডাক দিলো ওরই ছোট ফুপু। ফুপুর কাছে গিয়ে ক্ষীণকন্ঠে জানতে চায়, “ কি হয়েছে ফুপি? কিছু বলবে? ”
বর্ষার ছোটো ফুপি কাজল তিনি বাটিকা তেলের বোতল বর্ষার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ মাথাটা ধুয়েছি দুইদিন তেল দেওয়ার সময় পাইনাই। সকাল থেকে মাথাটা ঘুরছে একটু তেল দিয়া দে। ”
বর্ষা ও ‘না’ করে না তেলের বোতল নিয়ে চুলে সিঁতি কেটে চুলের গোঁড়ায় গোঁড়ায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। কাজল মুখ ফসকে বলে ফেলেন, “ একটু পর ওই শাড়িটা পরিস যেটা গত সপ্তাহে আমি তোকে কিনে দিছিলাম। ”
ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো বর্ষা, “ কিন্তু কেনো ফুপি? ”
মিসেস কাজল বললেন, “ কেন রে তোর বড় ফুপু তোকে কিছু বলে নাই? বা বাড়ির কেউ তোকে কিছু বলে নাই? ”
কথার ছলে চুলে তেল দেওয়া প্রায় শেষের দিকে বর্ষা আহত কন্ঠে বলল, “ কোন বিষয়ে কি কথা বলবে? ”
মিসেস কাজল হেসে হেসে উত্তর দিলেন, “ আজ যে তোকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে। ”
স্তব্ধ বসে রয় বর্ষা। তার কান কে জেনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না। মিসেস কাজল আবারও বললেন, “ তুই এমন তব্দা লেগে আছিস কেন? চুল আঁচড়ে দে তেল তো দেওয়া শেষ। ”
বর্ষা বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কর্কশকন্ঠে বলে উঠে, “ আমি পারবো না আঁচড়াতে, তোমার চুল তুমি আঁচড়াই লও। ”
বলেই ছুটে চলল বর্ষা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো রিমার রুমে। রিমা, রিয়া, বৃষ্টি বিছানার উপর বসে গল্প করছিল। রুমে আরও অনেকেই ছিলো তারা রুমের অন্য দিকটায় দাঁড়িয়ে ছিল আর কিছু সোফায় বসে ছিল। বর্ষা রুমে ঢুকে এদিক সেদিক লক্ষ্য না করে রিয়া, রিমা, বৃষ্টির উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছুড়ল, “ আমাকে নাকি আজকে দেখতে আসছে তোরা কি এই বিষয়ে কিছু জানিস? ”
বর্ষার কথায় সকলের ফিউস উড়ে যায় সকলে হা হয়ে তাকিয়ে আছে। বর্ষা বিমর্ষ কন্ঠে আবারও বলে উঠল, “ কি হলো চুপ করে আছিস কেন? ”
রিয়া আঙুল দিয়ে পেছনে ইশারা করল। বৃষ্টি দুই হাত দিয়ে চোখ ঢেকে নিলো। রিমা দুই দিকে ডানে বামে মাথা নাড়ালো মানে জানে না তারাও কিছু। রিয়ার হাতের ইশারায় আকস্মিক চাহনি ফেলে বর্ষা পেছনে ঘুরে তাকালো। প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র। বিরক্তিতে কপালের চামড়া ভাজ পরেছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ভ্রুক্রটি কুঞ্চিত করে রাগী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল অভ্র, “ তোকে দেখতে আসছে মানে? আর কে বলছে? ”
বর্ষা অভ্রর রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে থাকতে না পেরে মাথা নিচু করে ফেলেছে। মাত্রারিতিক্ত রাগ ও ক্ষোভে অভ্রর চক্ষু জোড়া রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। দেখতে ভয়ংকর লাগছে চোখজোড়া। দৃষ্টি নত রেখে আমতা আমতা করে বলল, “ ছোটটট ছোটো ফুপি বলছে ”
“ কি বলছে? ” হুংকার দিয়ে উঠল অভ্র।
ভয় পেয়ে দুই পা পিছিয়ে যায় বর্ষা। নির্বাক দাঁড়িয়ে রয় তা দেখে রাগ আরও বৃদ্ধি পেলো অভ্রর।
পাশে থাকা টি-টেবিলের ওপর লাণ্থি মেরে বলল, “ সব সময় তো সেজে গুঁজেই থাকিস। আজ একটু বেশি করে সাজবি। যাতে তোকে দেখে তাদের পছন্দ হয়। আর যত তারাতাড়ি সম্ভব বিদায় হবি। ”
বলে অভ্র রুম ছেড়ে চলে যায়। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো বর্ষা। উল্টো রাগ দেখিয়ে সেও অভ্রর পেছন পেছন রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
রুমের মধ্যে ঢুকে ঠাসস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। ঘন্টাখানিক পর দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো বর্ষা। হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকল পুতুল ও সুমাইয়া বর্ষার বড় ফুপাতো ও খালাতো বড় বোন। দু’জনে রুমে ঢুকে বর্ষাকে ঠেলে রুমের মধ্যে নিয়ে আসে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। স্তব্ধ প্রায় বর্ষার দৃষ্টি ওর দুই বড় বোনদের উপর নিক্ষিপ্ত। বর্ষা খেয়াল করে দেখল ওর পুতুল আপুর হাতে একটা শপিং ব্যাগ। সে বিছানার উপর ব্যাগটা রেখে তা থেকে একটা জাম কালারের শাড়ি বের করল। শাড়ির সাথে মেচিং করে ব্লাউজ ও কিছু জুয়েলারি এনেছে। বর্ষা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থেকে ক্ষীণকন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে, “ এইসব কি? আমার রুমে নিয়ে আসছো কেন? সাজতে হলে নিজেদের রুমে গিয়ে সাজো। ”
সুমাইয়া বর্ষার দুই কাঁধের উপর হাত রেখে স্মিত হেসে বলল, “ তোকে রেডি করানোর জন্য চাচি আম্মু আমাদের এইসব দিয়ে পাঠিয়েছে। এখন বেশি কথা বলিস না তো চল তারাতাড়ি তৈরি হতে হবে। উনারা নাকি কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাবে। ”
বর্ষা ফোঁস ফোঁস করে বলল, “ কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাবে মানে কি? ”
“ মানে তারা আমাদের এখানে কয়েক মিনিটের মধ্যে চলে আসবে আর বাড়ির সকলে একসাথে লাঞ্চ করবে। সিম্পল! ” পুতুল বলল।
“ তোমরা যতটা সিম্পল বলছো ততটা সিম্পল নয়। ” বর্ষা হাফসাফ ছেড়ে বিছানায় বসে বলে উঠল।
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ল সুমাইয়া, “ সহজ নয় মানে? ”
“ কিচ্ছু না। তোমরা দুজনে বের হও আমার রুম থেকে আমি এইসব পরবো না। ” বর্ষা তেজি কন্ঠে বলে উঠল।
“ পরবো না বললে তো হবে না পরতেই হবে। ” বর্ষার হাতে ধরে পুতুল বলল।
দুজনে জোর করেই ত্রিশ মিনিটে রেডি করে ফেলল। শাড়ি, হাতে চুড়ি, চোখে কাজল, ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক, ফেসে ফেস পাউডার এইটুকুই সামান্য সাজেই বেশ সুন্দর লাগছে। মন মরা হয়ে বিছানার উপর বসে রয় বর্ষা। দরজা খুলে দিতেই বাকি ভাইবোনেরাও চলে আসে। সকলে মিলে রুমের মধ্যে হৈ-হুল্লোড় লাগিয়ে দিয়েছে। কেউ-ই জানে না কারা দেখতে আসছে। সে নিয়েই একটু বেশি মাতামাতি তাদের। বর্ষার হাতের সাথে হাত গেষা লাগিয়ে বারবার বলছে। ” মুখ দেখে যত দেবে তার থেকে অর্ধেক কিন্তু আমাদের সকলকে দিবি। ”
মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে বর্ষা ওদের সকলের কথা কান দিয়ে শুনছে শুধু কিন্তু মাথা তুলে দেখার আগ্রহ নেই। দরজার দিকে নজর যেতেই একজনের পা দেখতে পেলো। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলে দরজার দিকে তাকালো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও বর্ষার দিকে। বর্ষা তাকাতেই অভ্র ঠোঁট বাঁকা করল জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে রুমের সামনে থেকে চলে গেলো।
এরই মধ্যে অপূর্ব একবার এসে বলে গিয়েছে, “ ছেলের বাড়ির সকলে এসে পরেছে। দাদাজান বলেছে দশ মিনিট পর বর্ষাকে নিয়ে নিচে যেতে। ”
প্রচুর কান্না পাচ্ছে বর্ষার ইচ্ছে করছে বাড়ি থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে এসব যে তার সহ্য সীমানার বাহিরে।
দশ মিনিট বাদ বর্ষার মা ও তার ছোটো ফুপি দুজনে বর্ষার রুমে এসে উপস্থিত হয় তাকে নিতে। বাকি বড় চাচি আম্মু ছোট চাচি আম্মু বড় ফুপি সকলে তাদের আপায়নে ব্যস্ত। বর্ষা যেতে চাচ্ছে না কারো সামনে, ইতস্তত বোধ করছে সে কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছে না। ছোট ফুপি হঠাৎ বলে উঠল, “ দেখতে আসলেই তো বিয়ে হয়ে যায় না। এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন তুই? ”
প্রত্যত্তরে বর্ষা কিছুই বলেনি। হল রুমে বসে সকলে গল্পগুজব করছে। সামনে টেবিলের উপর সাজানো রয়েছে হরেকরকমের খাবারের আয়োজন। কেউ তেমন কিছুই খায়নি৷ নূর ইসলাম কিছুটা জোর করলে তার মান রাখার জন্য সামনে থাকা ব্যক্তিরা টুকটাক সব কিছু খেয়ে দেখেন। এরই মধ্যে বর্ষাকে নিয়ে তাদের সামনে বসানো হয়। চোখ জোড়া বন্ধ করে শাড়ি খাবলে ধরে রাখছে বর্ষা। হৃদপিণ্ড কেঁপে কেঁপে উঠছে সামনে বসে থাকা লোক গুলোর কথা চিন্তা করতেই। পিটপিট করে তাকানোর চেষ্টা করছে বর্ষা আঁড়চোখে সামনে বসা ছেলেটাকে দেখার জন্যে, চোখে চোখ পরতেই বর্ষার চোখ জোড়া বের হয়ে আসার অতিক্রম ঘটায়। হতভম্ব হয়ে পরে বর্ষা মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে আসছে ওর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে উঠল, “ আদ্রিক? ”
আদ্রিক বর্ষার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট জোড়া বাঁকা করে তৃপ্তিময় হাসি দিলো। পাশ থেকে বর্ষার প্রিন্সিপাল স্যার মানে আদ্রিকের বাবা বলে উঠল,
“ বর্ষা আমাদের কলেজের একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী। আমার বর্ষাকে আগে থেকেই অনেক পছন্দ। ওর কাজকর্ম পড়াশোনা আচার-আচরণ সব দিক দিয়ে ও খুবই লক্ষী মেয়ে। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এখন আপনাদের যদি কোনো দ্বিধা না থাকে তাহলে আমরা আগামী সপ্তাহের মধ্যে বিয়ের কার্জকলাপ সেরে ফেলতে চাচ্ছি। ”
নূর ইসলাম বলে উঠল, “ এক সপ্তাহ পর বিয়ে এত তারাতাড়ি? ”
সকলের চোখের আড়ালে বর্ষার চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু কণা গড়িয়ে পরল। তার চোখ দু’টো জেনো এখন শুধু একজন কে-ই খুঁজে চলেছে৷
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে উঠল, “ ছেলে যখন ভালো তাহলে বিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে হলে সমস্যা কি? ”
সকলের দৃষ্টি এখন সিঁড়ির দিকে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে হেঁটে আসছে অভ্র। বর্ষা নিজের কানকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এই কথাটা মানে একটু আগে বলা কথাটা অভ্র বলেছে সে ঠিক শুনেছে তো? নাকি তার মতিবিম্ব হয়েছ। বর্ষাকে অবাক করে দিয়ে কাব্য বলে উঠল, “ অভ্র ঠিকই বলেছে শুভ কাজে দেরি কেনো? আর আমরা সকল ভাইয়েরা মিলে সব দিক সামলে নেবো। ”
নূর ইসলাম নাতিদের কথায় ভরসা পেলেন ও জাহাঙ্গীর আলম কে কথা দিলেন এক সপ্তাহ পর শুক্রবার দিন দুজনের চার হাত এক করে দিবেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে বর্ষা অভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। অভ্রর সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সে সকলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।
সকলের সামনে থেকে উঠে ছুটে গেলো বর্ষা। মনোয়ারা বেগম পরিস্থিতি সামলে বললেন, “ অনেক লাজুক আমার নাতনি লজ্জা পেয়ে চলে গেছে। ”
রুমের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো বর্ষা। চলে গেলো ওয়াশরুমে মাথার উপরের শাওয়ার অন করে নিচে দাঁড়িয়ে পরল। উপর থেকে পানি টপটপ করে পরছে তার গায়ে। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু পারছে না। নীরবে ঝর্ণার পানির সাথে চোখের পানি মিলেমিশে গড়িয়ে পরছে। ধম বন্ধ হয়ে আসছে তার সে কিছুই করতে পারল না। তাকে কেনো কেউ জিজ্ঞেস করলো না সে রাজি কি না?
কেনো?
#চলবে?