#অবন্তর_আসক্তি
#পর্ব_৩৮,৩৯,৪০
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
৩৮
‘ কিরে তুই এখনো রেডি হসনি? সকাল এগারো টা বাজতে চললো। কখন যাবি দেখা করতে? ‘
‘ এই তো আম্মু এখনই রেডি হচ্ছি। কিন্তু তার আগে বলো আব্বু কোথায়? ’
‘ রুমে ‘
” আচ্ছা টাটা ‘
বলে ছুটে চলে গেলো বর্ষা। রুমের সামনে এসে দেখল বর্ষার বাবা বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসে কিছু ফাইল চেইক করছে। বর্ষা ওর বাবার সামনে গিয়ে এক বাক্যে বলল, ‘ আমি যাবো। কিন্তু একটা শর্তে। ‘
বর্ষার বাবা বর্ষার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, ‘ কি শর্ত? ‘
বর্ষা হাফ ছেড়ে বলল, ‘ জায়গা আমি ঠিক করবো। কোথায় দেখা করবো৷ কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে অচেনা লোকদের সাথে বসে কথা বলা খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ‘
বর্ষার বাবা কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘ ঠিক আছে। তোমার যেমনটি ইচ্ছে। ‘
বর্ষা চোখজোড়া ছোটছোট করে বাঁকা হাসল। রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। কিছুক্ষণ শাওয়ার নেওয়ার পর গোলাপী রঙের গাউন পরে বের হয়ে আসে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হালকা সাজগোজ করে নেয়। যেমন হালকা লিপস্টিক আর চোখে কাজল। মোবাইলে টাইম দেখে রুম থেকে বের হয়ে পরে।
বাড়ির বাহিরে, গাড়ির দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে অভ্র বর্ষাকে দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে, পরক্ষণে সে হাসি বিলীন হয়ে যায়। বর্ষা হেঁটে অভ্রর সামনে আসতে অভ্র ধীর কন্ঠে বলল, ‘ এত সাজগোজ করে আসছিস কেন? বোরকা পরে আসতে পারতি তো? ‘
বর্ষা স্মিত হেসে বলল, ‘ তোমার সাথে ঘুরবো তাই এখন বেশি বকবক না করে চলো। ‘
অভ্র বর্ষার কথার মানে বুঝলো না। গাড়িতে উঠে সিট বেল্ট লাগিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। ওইদিকে বর্ষার ঠিক করা জায়গায় ছেলেগুলো গিয়ে অপেক্ষা করছে। বর্ষা আর অভ্র গাড়ি দিয়ে এক ঘন্টা ঘোরার পর সেথায় পৌঁছালো কিছু কেনার ছিল বর্ষার সেগুলোই কিনেছে এতক্ষণ। বর্ষা গাড়ি থেকে নামে তার হাতে একটা ব্লাক কালারের বাক্স। দুই হাত দিয়ে ধরে হেঁটে যাচ্ছে। অভ্র গাড়ির দরজা দিয়ে মাথা কিছু বের করে বর্ষার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুদূর যেতে অভ্রর চোখের আড়ালে চলে গেলে বর্ষা। এটা সেই জায়গা যেখানে বিয়ে ঠিক হওয়ার আনন্দে আহিতা পার্টি দিয়েছিল। বর্ষাকে দেখে এগিয়ে আসলো কাব্য। বর্ষার ডান হাতের কব্জি চেপে ধরে বলল, ‘ এতক্ষণ লাগলো কেন তোর আসতে? প্রায় এক ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। ‘
‘ রাস্তায় জ্যাম ছিলো তাই লেট হয়েছে। এখন তুমি লেট করাচ্ছো। ‘
কাব্য কথা না বাড়িয়ে বর্ষার সামনে থেকে সরে গেলো। গাড়িতে বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে বলে গাড়ি থেকে নেমে বর্ষার পিছু পিছু গিয়ে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পরে অভ্র। বর্ষা টেবিলের কাছে পৌঁছানোর পর প্রথম ছেলেটা টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ায়। হাতে তার একটা রুমাল। ছেলেটা দেখতে সাধারণ, বোকা স্বভাবের হাতের রুমাল টা দিয়ে চেয়ারের উপরে মুছতে লাগল অহেতুক কিন্তু চেয়ার আগে থেকে পরিষ্কার। টেবিলের উপরেও মুছতে লাগল। তা দেখে বর্ষা বাঁকা হেসে বক্সটার ভেতর থেকে একটা পিজ্জা বের করল। প্যাকেট খুলে ছেলেটার দিকে এক পিস বাড়িয়ে দিলো। যেহেতু সে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। সে বিধায় চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। পেছন ঘুরে তার সম্মন্ধে বর্ষাকে বলতে লাগল। তার নাম, কি করে, বাড়িতে কে কে আছে ইত্যাদি বলতে লাগে। রুমাল ঝেড়ে পিছনে বর্ষার দিকে ঘুরে স্তব্ধ হয়ে যায়। বর্ষা একাই অর্ধেক পিজ্জা শেষ করে ফেলেছে। সেটা বড় কথা নয় বড় কথা হলো বর্ষা খুবই বাজে ভাবে খাচ্ছে পুরো বাচ্চাদের মতো করে গালে, মুখে, নাকে হাতে টেবিলের উপরে সস লাগিয়ে নাজেহাল অবস্থা করে ফেলেছে। ছেলেটা বর্ষার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল, ‘ একি অবস্থা করেছেন আপনি? ‘
বর্ষা খাওয়া অফ করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ কোই কি করেছি?’
পরক্ষণে আবারও বলল, ‘ ওওও, আপনি খাবারের কথা বলছেন। এটাতো আমার প্রতি দিনের অভ্যাস। গালে টালে ভরছে তাই না? কিন্তু কি করবো বলেন? এভাবে না খেলে আমার পেট ভরে না। এই নেন আপনিও খান। ‘
এক পা পেছনে গিয়ে বলল, ‘ না দরকার নেই। আপনি বরং এই রুমাল টা নিন হাত ও মুখ পরিষ্কার করুন। ‘
বর্ষা রুমালটা হাতে নিয়ে মুখ পরিষ্কার করল। হাত মুছে নিয়ে টেবিল মুছতে লাগল। ছেলেটা ভালো করে বুঝতে পারল, যে মেয়েকে সে দেখতে আসছে ও মেয়ে অনেক খচ্চর অপরিষ্কার। সে এই পরিস্থিতি থেকে পলায়ন করার জন্য বলে উঠল, ‘ মিস বর্ষা আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি। ‘
বলেই সে উড়াধুড়া দৌঁড় দিলো। বর্ষা লোকটার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সশব্দে হেসে উঠল। হাসি কন্ট্রোল করে বলল, ‘ তাড়াতাড়ি আসবেন আমি এখানে অপেক্ষা করছি। ‘
গাছের আড়াল থেকে ফিক করে হেসে ফেললো অভ্র। টেবিলের উপরে খাবার এলো মেলো করে রেখে দিলো। কালো বক্সটার ভেতর থেকে একটা বোতল বের করল। বোতলের মুখটা খুলে হাতে কিছুটা হুইস্কি ঢেলে খাবারের উপর ছিটিয়ে দিলো। পরক্ষণে টেবিলের উপর মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে পরার মতো রইল। দ্বিতীয় জন এসে বর্ষাকে ডাক দিলো। বর্ষা মাথা সোজা করে লোকটার দিকে তাকিয়ে মাতলামো কন্ঠে বলল, ‘ আরে আপনি আসুন বসুন। ’
বলতে বলতে টেবিলের নিচ থেকে বোতলটা বের করে লোকটার মুখের উপর ছিটিয়ে দিলো। লোকটা মুখে হাত দিয়ে ‘ বাবা গো ‘ বলে দৌঁড় দিলো।
পেছন থেকে নেশার এক্টিং করে বর্ষা লোকটাকে ডাকে দিল। কিন্তু সে যে দৌঁড় দিয়েছে ভুলেও আর পেছনে ঘুরে তাকাবে না৷ ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুলে গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে আসে অভ্র। বর্ষার সামনে চেয়ার টেনে বসে বলল, ‘ ম্যাম! আপনার ওই বক্সে পিজ্জা আর হুইস্কি ছাড়া কি অন্য কিছুও আছে খাওয়ার মতো এমন? ‘
বর্ষা হেসে মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে বলল, ‘ কফি আছে খাবে? ‘
.
.
.
হল রুমে সবাই বসে রয়েছে বর্ষা ও বাকিরা বসে টিভি দেখছে। বাড়ির বড়রা বসে কিছু কথা আলোচনা সমালোচনা করছে। বর্ষার বাবা মলিন কন্ঠে বললেন, ‘ দুজন ছেলে মেয়েটাকে দেখতে গেলো কিন্তু কারোরই পছন্দ হলো না। অথচ ছবি দেখে কত কথাই না বলেছিল। ‘
নূর ইসলাম ও বাকিরা বর্ষার বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘ মেয়ে কি নদী ভেঙে পানিতে পরে যাচ্ছে নাকি? ওদের পছন্দ হয়নি অন্য কারো হবে তাছাড়া পড়াশোনা করছে করতে থাকুন। আর কোনো দিন বিয়ের কথা বার্তা বলিস না। এতে করে মেয়েদের বিয়ের প্রতি লাজলজ্জা ভেঙে যায়। ‘
বর্ষার মনে মনে হাসতে হাসতে করুণ অবস্থা শুধু শব্দ করে হাসতে পারছে না। ছেলেরা দু’জনই মেয়ে পছন্দ হয়নি বলে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে।
সবাই হল রুমে উপস্থিত দেখে বর্ষা সেখান থেকে চলে আসল। অভ্রর রুমে এসে অভ্রকে না দেখতে পেয়ে সোজা চলে যায় ছাঁদে। চারদিকে অন্ধকার তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। বর্ষা ভেবে নেয় অভ্র এখানে নেই তাই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে অভ্রর কন্ঠস্বর ভেসে আসে সে বলে, ‘ কি বলতে আসছিস? ‘
অভ্রর কন্ঠ শুনে আন্দাজে ছুটে যায় বর্ষা। ঠিক পেছন থেকে অভ্রকে জড়িয়ে ধরে। অভ্র বর্ষার দুই হাতের উপর হাত রেখে তাকে নিজের সামনে দাঁড় করালো। শালিনকন্ঠে বলল, ‘ এত খুশি কেনো তুই? ‘
বর্ষা সামনে থেকে অভ্রকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ তারা বিয়ে ভেঙে দিছে। বলেছে তাদের মধ্যে কারোরই আমাকে পছন্দ হয়নি। ‘
অভ্র জেনো এই কথাটাই শুনতে চাচ্ছিলো। বর্ষাকে শক্ত করে তার বাহুডোরে চেপে ধরে কপালে আলতো চুমু একে দিয়ে বলল, ‘ তোর জন্য আইসক্রিম রেখেছি ফ্রিজে দেখিসনি এখনো? খুশির খবর শুনলে মিষ্টি মুখ করতে হয়। যা ছুটে গিয়ে আইসক্রিম টা নিয়ে আয়। ‘
বর্ষা অভ্রকে ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে আইসক্রিম নিয়ে আসে। অভ্রর সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠা নামা করায় ক্লান্ত হয়ে পরেছে। আইসক্রিমের প্যাকেট খুলে একটা আইসক্রিম দুজনে মিলে খেলো।
বর্ষার দুইগালে অভ্র ওর দুইহাত রেখে বলে উঠল, ‘ আমার হিরোইন ‘
বর্ষা অভ্রর কথা শুনে ফিক করে হেসে উঠল। অভ্র সাথে সাথে বুকের মধ্যে আড়াল করে নিলো তাকে। জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু একে দেয়। বর্ষা লজ্জায় পঞ্চমুখ হয়ে অভ্রর বুকে মাথা লুকালো।
চলবে?
#অবন্তর_আসক্তি
#পর্ব_৩৯
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
ব্যস্ত শহরে ব্যস্ত সবাই, সে ব্যস্ততার মাঝে একটি সুখবর মুখের সচ্ছ হাসি ফুটানোর জন্য যথেষ্ট। কিছু ভালোলাগা ও কিছু ভালো মুহূর্ত যা সব সময় সরনীয় করে রাখতে চাচ্ছে বর্ষা। কিন্তু যাকে ঘিরে তার সকল আশা আকাঙ্খা সেই লাপাত্তা। আজ এক সপ্তাহ হলো অভ্রর কোনো খোঁজ নেই। চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছে বর্ষা। ওইদিন ছিলো শনিবার যেদিন অভ্র হন্ন হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়।
দুপুরের পরপর আহিতা সহ ওর বাবা মা বর্ষাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। আহিতার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়েছে তারই বিয়ের কার্ড দিতে এসেছে। আহিতা, বর্ষা ও রিয়ার সাথে কোলাকুলি করে মুচকি হাসে। বিয়েতে যাবে খুব সাজবে ভাবে বর্ষা। ঘন্টা খানিকের মতো বসে হালকা কিছু নাস্তা খেয়ে তারা চলে যায়। বর্ষা ও তাদের সামনে থেকে চলে আসে। সে ভাবে খবরটা অভ্রকে জানানো যাক। রুম থেকে বের হয়ে অভ্রর রুমের দিকে যাচ্ছিলো বর্ষা তখন তার নজরে পরলো অভ্র মোবাইল কানে লাগিয়ে কারো সাথে কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। উপর থেকে কয়েক বার ‘অভ্র ভাইয়া’ বলে আওয়াজ দিলো বর্ষা কিন্তু অভ্র শুনতে পায়নি। অভ্র সে তো ওর মতো হেঁটে যাচ্ছে বর্ষা সিঁড়ি বেয়ে তারাহুরো করে নামতে নিলো শেষ সিঁড়িতে পা লেগে পরে যায়। ব্যাথা পায়নি কিন্তু সামনে তাকালে দেখে ততক্ষণে অভ্র চলে যায়।
গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার শব্দ শুনে ফ্লোর থেকে উঠে আবারও দৌঁড় দেয়। বাহিরে গিয়ে দেখলো, অভ্র গেরেজ থেকে গাড়ি বের করে গেইট দিয়ে বেরও হয়ে গেছে। বুক ভারী হয়ে আসে বর্ষার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ভেতরে চলে যায়। ভেবে নেয় রাতে ফিরে আসার পর বলবে কিন্তু অভ্র আর ফিরে আসলো না।
আজ সাতদিনে না জানি কত কল দিয়েছে মেসেজ পাঠিয়েছে কিন্তু কোনো খবর নেই। কোনো কিছুর রিপ্লাই আসেনি। লেকের পাশে লেকের জলে পা ভিজিয়ে বসে আছে বর্ষা। পেছন থেকে কারো গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসলো সে বললো, ‘ এই ভোর দুপুর বেলা তুমি একা এখানে কি করছো? ‘
বর্ষা পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখল আদ্রিক দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রিককে দেখে অস্বস্তিতে পরে যায় বর্ষা। মলিন হেসে বর্ষার পাশে বসে বলল, “ অস্বস্তি হচ্ছে? হওয়ার-ই কথা। ”
আদ্রিকের কথার পিঠে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল বর্ষা পরক্ষণে হাফ ছেড়ে বলল, ‘ আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে আসি। ‘
বলে উঠে দাঁড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে কয়েক কদম সামনে এগিয়ে গেলো। পেছন থেকে আদ্রিক বলে উঠল, ‘ আমরা ভালো বন্ধু হতে পারি বর্ষা। অতীত মনে রেখে কোনো লাভ নেই তুমিই বলেছিলে। তাহলে আজ কেনো আমাকে দেখে পালিয়ে যাচ্ছো? ‘
বর্ষা মাঝ পথে দাঁড়িয়ে পরল পেছনে আদ্রিকের দিকে তাকালো। আদ্রিক হেঁটে বর্ষার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ অতীতের সব কিছু ভুলে চলো নতুন করে শুরু করি। ফ্রেন্ডস? ‘
বর্ষা নিঃশ্বাস ফেলে কিছুটা হেসে বলল, ‘ হুম! ফ্রেন্ডস। ‘
তৎপর দু’জন আগের মতো বন্ধুর সম্পর্কে আবদ্ধ হলো। আদ্রিক জোর করায় বর্ষা আরও কিছুক্ষণ লেকের পাশে বসে থাকে দু’জনে বেশ কিছুক্ষণ সময় একসাথে বসে গল্প করে পাড় করে। আদ্রিক ভাবান্তর দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করি? ‘
বর্ষা আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ হুম ‘
আদ্রিকে লেকের জলে ইটের টুকরো ঢিল ছুঁড়ে বলল, ‘ তুমি কাউকে ভালোবাসো? ‘
বর্ষা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘ হুম। ‘
আদ্রিক মলিন হেসে ফের বলল, ‘ কে সেই ভাগ্যবান? ‘
বর্ষা মাথা নিচু করে বলল, ‘ আপাতত নাম বলতে পারবো না। ‘
আদ্রিক আর পাল্টা কোনো প্রশ্ন করেনি। নিশ্চুপ প্রায় মিনিট খানেক বসে রইল পরক্ষণে বলে উঠল, ‘ আইসক্রিম খাবে? ‘
বর্ষা মাথা দুই পাশে নাঁড়িয়ে বলল, ‘ না ‘
‘ আচ্ছা তাহলে চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেই। ‘ আদ্রিক বলল।
বর্ষা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ আমি একা যেতে পারবো। ‘
আদ্রিকের থেকে বিদায় নিয়ে পথ চলতে শুরু করল। হঠাৎ প্রচুর বাতাস বইতে শুরু করল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল আকাশে কালো মেঘ জমেছে নির্ঘাত এখন বৃষ্টি নামবে। বর্ষা একটা বড় গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পরল আশে পাশে দোকান পাট নেই। যেখানে গিয়ে দাঁড়াবে আছে শুধু বড় বড় গাছপালা। সরু রাস্তা তাই গাড়িও খুব কম চলাচল করে এ দিকটায়। গাছের নিচে দাঁড়ানোর পরপর আকাশ ভেদ করে বৃষ্টি নেমে আসে পৃথিবীর বুকে। গাছের পাতা চিপচিপ করে ফোঁটা ফোঁটা পানি বর্ষার গায়ে পরছে। বর্ষা গুটিশুটি মেরে গাছের শিকরের সাথে ল্যাপ্টে বসে পরে। বৃষ্টি ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে।
বৃষ্টি তে ভিজলে বর্ষার কোনো না কোনো এক রোগ দেখা দেয় জ্বর, বা ঠান্ডা কাশি। গাছের সাথে ল্যাপ্টে বসে থেকেও অনেকটা ভিজে গেছে সে ঠান্ডায় শীতে কাঁপছে। গাছের ডালপালা ও অনবরত নড়ে যাচ্ছে বাতাস বইছে তীব্র। আকাশে কালো মেঘে অন্ধকার ছেয়ে গেছে। বিকট শব্দে বার কয়েক বজ্রপাত হয়েছে। চারদিক কেমন জেনো অন্ধকার হয়ে গেছে তেমন কোনো কিছু নজরে পরছে না। চোখ জোড়া বন্ধ করে রেখেছে শীতে ঠোঁট জোড়া কেঁপে কেঁপে উঠছে।
রাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি যাচ্ছিল। গাড়ির হেডলাইটের আলোতে দেখলো একটা মেয়ে গাছের নিচে বসে আছে। গাড়ি ব্রেক করে দরজা খুলে ছাতা হাতে কেউ একজন বর্ষার দিকে ছুটে যাচ্ছে। গাছের সাথে হেলান দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে বর্ষা। একহাত দিয়ে ছাতা ধরে অন্য হাত দিয়ে বর্ষাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ক্ষীণকণ্ঠে সে বলে উঠল, ‘ বর্ষা? ‘
হাত ধরে দেখলো গা ঠান্ডা হয়ে গেছে। কয়েকবার ডাকার পরও কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বুঝে গেলো বর্ষা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। পাঁজা কোলে তুলে নিলো সে বর্ষাকে। গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে দিলো। বর্ষা প্রায় পুরো ভিজে গিয়েছে যার জন্য ওকে কোলে নেওয়ায় লোকটাও ভিজে গেছে। গাড়িতে উঠে হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। এরইমধ্যে বহুবার ‘বর্ষা উঠ প্লিজ কি হয়েছে তোর কথা বল। ‘ বলে ডেকেছে কিন্তু বর্ষার কোনো হেলদোল নেই। ঝড় তুফানের মধ্যে গাছের নিচে বসে ছিল কেনো? কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না তার। তুফানি বাতাসে গাছের ঢাল ভেঙে রাস্তার মাঝে পরে আছে। গাড়ি ব্রেক করে গাড়ি থেকে নামলো। থুতনিতে হাত দিয়ে ধরে কিছুক্ষণ ডালটার দিকে তাকিয়ে থেকে একাই ডালটা অতি কষ্টে রাস্তার সাইডে রেখে গাড়ির কাছে গেলো। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে আবারও গাড়িতে উঠে বসলো। বর্ষার দিকে চোখ পরলে সে দেখতে পায়। বর্ষা স্তব্ধ বসে রয়েছে কোনো হেলদোল নেই। কপালে হাত দিয়ে দেখলো গা ঠান্ডা হয়ে গেছে ভয়ে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল তার, ‘বর্ষা’ বলে চিৎকার দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল। হারানোর ভয়ে চোখের কার্নিশ বেয়ে একফোঁটা অশ্রু কণা গড়িয়ে পরল।
চলবে?
#অবন্তর_আসক্তি
#পর্ব_৪০
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
হাসপাতালে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের বাহিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বর্ষার বাবা। কিছুক্ষণ আগেই হাসপাতালে এসে পৌঁছিয়েছে। বর্ষার অবস্থা খারাপ হতে দেখে সোজা হাসপাতালে নিয়ে আসে বাড়িতে কল করে ইনফর্ম করে দিয়েছে। আকাশে কিছুক্ষণ পরপর বিকট শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টি পরছে থামার কোনো নামই নেই। গাড়ি থেকে নেমে বৃষ্টি তে ভিজে বর্ষাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। দুপুরের পরপর কোনো ডাক্তার থাকে না। সকলে তিনটার পর আসে। আল্লাহর রহমতে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে একজন ডাক্তার ছিল তিনিই বর্ষাকে দেখছেন।
কিয়ৎক্ষণ পর ডাক্তার এসে বলেন, ‘ পেসেন্ট একদম ঠিক আছে ঘন্টা খানেকের মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসবে। টেনশন করার কিছুই নেই। ‘
বর্ষার বাবা ডাক্তারের হাত ধরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। কেবিনে ঢুকে বর্ষার পাশের চেয়ার টেনে বসল। বর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চাপাকন্ঠে বলল, ‘ তোকে কে বলেছে বৃষ্টিতে ভিজতে? আমি অল্পতে সেখানে না পৌঁছে, তোকে না দেখলে কি হতো মা? জানিস যে বৃষ্টিতে ভিজলে অসুস্থ হয়ে পরিস তবুও কেন এমনটা করিস? ‘
.
.
বিকেল পাঁচ টা বাজে, ~
বৃষ্টি কিছুটা কমলে বাড়ির সকলে হাসপাতালে চলে আসে। এখনো বর্ষার জ্ঞান ফিরেনি একে একে সবাই ওকে দেখে গেছে।
কিছুক্ষণ আগে তিন্নির ফোনে একটা কল আসে। কলটা করেছে অভ্র, সে বাড়িতে এসেছে আজ সাতদিন পর। বাড়িতে কাউকে না পেয়ে তিন্নিকে কল দেয়। সবাই কোথায় গেছে জানার জন্য তিন্নি কল রিসিভ করে সবটা বিস্তারিত অভ্রকে জানালো।
বর্ষা হাসপাতালে এডমিট শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে অভ্র হাসপাতালে। অভ্রর আসতে অনেকটা লেট হয় ততক্ষণে ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে যায়। তাই সে দেখা করতে পারে না। আবারও দেখা করতে পারবে রাত আটটার পর। ততক্ষণ সে বাহিরে বসে অপেক্ষা করবে।
মাগরিবের আজানের পূর্বে বাড়ির মহিলারা বাড়িতে ফিরে যায়। হাসপাতালে অভ্র ছাড়া কেউ নেই। অভ্র নিজে যেচে দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে। হাসপাতালে রাতে সেই থাকবে। বাড়ির কোনো মুরব্বি কে কষ্ট করে থাকতে হবে না। বৃষ্টি, রিয়া, রিমা ওরা থাকতে চেয়েছিল কিন্তু অভ্র ওদের ও সবার সাথে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
সাতটার দিকে হাসপাতালের বাহিরে আসে অভ্র কেউ একজন তার সাথে দেখা করতে এসেছে। লোকালয়ের আড়ালে অন্ধকার স্থানে দু’জনে দেখা করে। অভ্র গুরুগম্ভীর হয়ে তার কথাগুলো শুনে তারপর তাকে চলে যেতে বলে।
হাসপাতাল থেকে দুই মিনিট দূরে একটা রেস্টুরেন্ট রয়েছে। হাল্কা নাস্তা করার জন্য অভ্র সেখানে চলে যায়।
আটটা বাজতে এখনো দশ মিনিট বাকি। হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওনা হলো সে। এরইমধ্যে জ্ঞান ফিরে এসেছে বর্ষার। হাসপাতালে এসেই জানতে পারে অভ্র। ঠিক আটটা বাজলে বর্ষার সাথে দেখা করতে কেবিনে প্রবেশ করে। বর্ষা চোখ জোড়া খোলে উপরে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। অভ্র ধীর কন্ঠে জানতে চাইলো, ‘ উঠে গেছো তুমি? ‘
বর্ষা ঘাড় ঘুরিয়ে অভ্র দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো পরক্ষণে বলল, ‘ কে আপনি? ‘
অভ্র ভ্রুযুগল কুঁচকে বর্ষার পাশে চেয়ার টেনে বসে বলল, ‘ মানে? মজা করছো তুমি? ‘
‘ আজব আপনি আপনাকে চিনি না। অথচ আপনার সাথে মজা করতে যাবো কেন? ‘ বর্ষা বলল।
‘ তুমি সত্যি আমাকে চিনতে পারছো না? ‘ সন্দেহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
বর্ষা ডানে বামে দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে ‘না’ বলল।
অভ্র দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল, ‘ তুমি আমাকে ভুলে গেছো? আচ্ছা বলো তো তোমার নাম কি? ‘
বর্ষা ফট করে বলে উঠল, ‘ শারমিন আক্তার বর্ষা ‘
অভ্র উপর নিচ মাথা দুলিয়ে বলল, ‘ তাহলে তুমি শুধু আমাকেই ভুলে গেছো। ‘
মনমরা হয়ে অভ্র আবারও বলতে শুরু করল, ‘ কোথায় ভেবেছিলাম বাড়িতে এসে তোমার আর আমার বিয়ের কথা বলবো কিন্তু দেখো তুমি আমাকেই চিনতো পাচ্ছো না। ‘
বর্ষা চোখজোড়া বড়সড় করে বলল, ‘ বিয়ে? আমাদের বিয়ের কথা? ‘
অভ্র ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে মাথা দুলিয়ে সরু কন্ঠে বলল, ‘ যাগ্গে ব্যাপার না। তোমার যখন সব মনে পরবে তখন না হয় আবারও ভাববো। এখন আমি উঠি। ‘
বলে অভ্র উঠে যাবে তখন বর্ষা ওর হাত দিয়ে অভ্রর হাত ধরে টান মেরে অভ্রকে আগের ন্যায় চেয়ারে বসালো। বেডের উপর আস্তে করে উঠে বসল বর্ষা পরক্ষণে মলিন কন্ঠে বলল, ‘ তুমি তখন বললে আমাদের বিয়ের কথা বলবে? ‘
অভ্রর হাসি পেলো খুব কিন্তু হাসি দমিয়ে রেখে বলল, ‘ হ্যাঁ কিন্তু তোমার তো কিছু মনে নেই। ‘
বর্ষা অভ্রর দিকে তাকিয়ে শানিতকন্ঠে বলল, ‘ আমার সব মনে আছে। আমি তো শুধু নাটক করছিলাম। ‘
বর্ষা তার ফেসটা পুরো বাচ্চাদের মতো করে রেখেছে তা দেখে ফিক করে হেসে উঠে অভ্র৷ ওর হাসির শব্দ শুনে মাথা তুলে তাকালো বর্ষা। অভ্র তার আঙুল দিয়ে বর্ষার কপালে টোকা দিলো। বর্ষা ‘ আউচ ‘ বলে শব্দ করে কপালে হাত ঠেকালো।
অভ্র হেসে হেসেই বলল, ‘ আমি আগেই বুঝতে পেরেছি বোকাপাখি। ‘
বর্ষা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। কেবিনের জানালা খোলা তাই বাহিরের ঠান্ডা বাতাস রুমে প্রবেশ করছে শুভ্র সাদা পর্দা গুলো বাতাসে উড়ছে। আকাশে আজ চাঁদ উঠেছে দুইদিন পর। গত দুই দিন রাতে আকাশে চাঁদ তো দূরের কথা তাঁরা ও ছিল না মেঘে ঢেকে ছিল পুরো আকাশটা। অভ্র জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো আকাশে চাঁদ টা দেখতে আজ বেশ অমায়িক সুন্দর লাগছে।
অভ্র বর্ষার দিকে ঘুরে বসলো। বর্ষার থুতনিতে হাত রেখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ ওই আকাশে এক চাঁদ, আমার সামনে এক চাঁদ। আমার সামনে বসা চাঁদটার হাত ধরে ওই দূর আকাশের চাঁদ টাকে আমি দেখতে চাই রোজ। ‘
বর্ষা লজ্জা পেলো মৃদু হেসে অভ্রর বুকে মুখ লুকালো। অভ্র দুই হাত দিয়ে বর্ষাকে আঁকড়ে ধরলো। ঠোঁটে ল্যাপ্টে আছে অমায়িক প্রাণোচ্ছল হাসি।
বর্ষা অভ্রর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসে আওয়াজে বলল, ‘ তুমি যদি চাও ডুবে যেতে পারি তোমার ভালোবাসার মুগ্ধতায়। ‘
চলবে?