অবন্তর_আসক্তি #সারপ্রাইজ_পর্ব

0
1644

#অবন্তর_আসক্তি
#সারপ্রাইজ_পর্ব
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
বাইরে ঝুম বৃষ্টি আর বজ্রপাত হচ্ছে। যদিও এখন বর্ষাকাল নয় কিন্তু তবুও বাংলাদেশে আজকাল আর ঋতুভেদ বলে কিছুই হয়না।

হাসপাতালের এক কেবিনে অভ্র সেন্সলেস হয়ে শুয়ে আছে। আদ্রিকের দেওয়া আঘাতের ফলে অভ্র সেন্সলেস হয়ে যায়। হাসপাতালে নিয়ে আসার পর অভ্রর ট্রিটমেন্ট চলে সে সুস্থ আছে কিন্তু এখনো জ্ঞান ফিরেনি।

অন্য দিকে বর্ষার অপারেশন চলছে, আইসিইউর সামনে বাড়ির প্রতিটা মানুষ দাঁড়িয়ে কাঁদছে। কয়েকজন তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলছে, কান্নাকাটি না করতে। এখানে কান্না করে চোখের জল নষ্ট করে কোনো লাভ নেই। বরংচ লাভ আছে আল্লাহকে ডাকা এই বিপদের মূহুর্তে একমাত্র সাহায্য করতে পারবেন যিনি তিনিই হচ্ছেন মহান আল্লাহ তায়ালা।

নিভ আর মুরাদ বর্ষাভ্রকে ধরাধরি করে গাড়িতে উঠায় সেখান থেকে কাছেপিঠে কোনো এক হাসপাতালে নিয়ে আসে। মুরাদ কল দিয়ে সকলকে ইনফর্ম করে দেয় তারাও হাসপাতালের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরেন। বর্ষাকে আইসিইউতে ঢোকানোর পর থেকেই মুসুল দ্বারায় বৃষ্টি হচ্ছে। অভ্রকে ইমার্জেন্সিতে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তারপর তাকে কেবিনে শিফট করে দেয়। বাড়ির সকলের কাছ থেকে লুকানোর মতো অবশিষ্টাংশ এখন আর কিছুই নেই! বাধ্য হয়ে মুরাদ সমস্ত কিছু তাদের কাছে পূণরায় আবৃত্তি করেন। সব কিছু জানার পর তারা নিজেদেরও দোষী মানতে লাগেন। লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে তাদের। অভ্রর সাথে কেবিনে দেখা করতে যায়। ঘুমন্ত অভ্রর চুলে হাত বুলিয়ে তার সাথে করা অন্যয়ের জন্য ক্ষমা চায়।

আইসিইউ থেকে ডাক্তার বের হয়ে আসলেন এবং সকলের উদ্দেশ্য বললেন, “ টেনশনের কিছু নেই, আমরা গুলি বের করতে সক্ষম হয়েছি! ঘন্টাখানেকের মধ্যে পেসেন্ট কে কেবিনে শিফট করা হবে। তখন আপনারা তার সাথে দেখা করতে পারবেন। তবে পেসেন্টের জ্ঞান ফিরতে কয়েক ঘন্টাও লাগতে পারে আবারও কয়েক দিনও লাগতে পারে। ” বলে ডাক্তার চলে গেলেন।

দু’ঘন্টা পর অভ্রর জ্ঞান ফিরে আসে, অভ্রকে দেখে তার মা কান্না জুড়ে দেয়। দুইহাতে ছেলেকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগেন। সকলের কাছ থেকে অভ্র ক্ষমা চায়। তারাও অভ্রর কাছ থেকে ক্ষমা চায়।

খানিক সুস্থ অনুভব করার পর, অভ্র বর্ষার সাথে দেখা করতে আসে, এদিকে বর্ষার এখনো জ্ঞান ফিরেনি।

অভ্র নিজেও অসুস্থ হওয়ায় ডাক্তার তাকে রেস্ট করার জন্য তার কেবিনে যেতে বলেন। অভ্রকে এক প্রকার জোর করেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে অবশ্য যেতে চায়নি।

মুরাদের নাম্বারে একটা কল আসে, কল রিসিভ করতে নিঝুম রাগান্বিত কন্ঠে বলে, ‘ বর্ষা সেই সকালে তোর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল এখনো আসেনি। তুই জানিস ও কোথায়? ‘

ভারী নিঃশ্বাস ফেলে মুরাদ বর্ষার গুলি লাগার কথা বলল এবং তাকে বলল হাসপাতালে চলে আসতে। নিঝুম আর কোনো কথা না বলে কল কেটে দেয়। প্রিয়মকে তার নানির কাছে রেখে অর্ণবকে সাথে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরে।

বর্ষাভ্রর পরিবার ও বাকিরা বর্ষার কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অভ্র কেবিনের ভেতরে গিয়েছে একান্ত বর্ষার সাথে কিছু সময় কাটানোর জন্য, বর্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে অভ্র বলছে, ‘নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসো তাহলে এতগুলো বছর দূরে কিভাবে ছিলে হুহহ বলো রাগরাগিণী? এখনও কি অভিমানে চোখ বুঝে থাকবে?’

হাসপাতালের সামনে গাড়ি থেকে নেমে সোজা রিসিপশনে চলে যায় নিঝুম৷ বর্ষা নামের পেসেন্ট কত নাম্বার কেবিনে আছে জিজ্ঞেস করে। রিসিপশনে একটা মেয়ে বসেছিল সে কিছু একটা দেখে বলল, ‘ ম্যাম ১০২ নাম্বার কেবিনে! ‘

‘ থ্যাঙ্কিউ! ’ বলে অর্ণবের হাত ধরে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে নিঝুম।

কিয়ৎক্ষণ পর,

অর্ণবকে নিয়ে নিঝুম সকলের সামনে এসে দাঁড়ালো। অর্ণব দেখতে ছোট্ট রাজকুমারের মতো ফুটফুটে সুন্দর, উপস্থিত সকলের দৃষ্টি স্থির তার উপর আকর্ষিত লাগছে অর্ণবকে তাদের কাছে। কষ্টের মধ্যেও অর্ণবের মুখটা দেখে সকলের মুখে এক তৃপ্তিময় হাসির রেখা ফুটে উঠে।

আহিতা ও মুরাদ নিঝুমের উদ্দেশ্য বলে, ‘ শুনেছিলান তোর মেয়ে হয়েছে কিন্তু ওকে তো দেখতে ছেলেদের মতো লাগছে। ’

ভ্রুযুগল কুঁচকে অপূর্ব অর্ণবের দিকে তাকিয়ে আছে। সে সকলের থেকে কিছুটা দূরে ও একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। অর্ণবের কাছে হেঁটে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসলো৷ চুলগুলো তে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “ ও নিঝুমের বাচ্চা কিভাবে হতে পারে? ওকে তো দেখতে পুরোপুরি অভ্রর মতো লাগছে, দেখে মনে হচ্ছে অভ্র’রই ছেলে! ”

অপূর্বর কথায় সকলে কড়া দৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে তাকালো তাদের ও মনে হলো সত্যিই তো তাই অর্ণবের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তারা সেদিকে লক্ষ্যই করেনি।

মুন্নি পেছন থেকে সামনে এসে দাঁড়ালো, অর্ণব এখানে উপস্থিত কাউকেই চিনে না শুধু মুন্নি আর নিঝুম ব্যতিত। মুন্নিকে দেখা মাত্রই অর্ণব ধীর কন্ঠে চেচিয়ে বলল, “ খালামনি! ”

বলে ছুট্টে গিয়ে মুন্নিকে জড়িয়ে ধরলো। সকলে হতবুদ্ধি হয়ে মুন্নির দিকে তাকালো ভ্রুযুগল কুঁচকে বলে উঠল, ‘খালামনি?’

মুন্নি হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাদের সকলের দিকে তাকালো জিভ দিয়ে ঠোঁট জোড়া হালকা ভিজিয়ে বলল, “ তোমরা সবাই ঠিক ভাবছো! ওর নাম অর্ণব আর আমি ওর সেজো খালামনি! অর্ণব বাহিরের কেউ নয়, ও তোমাদের নিজের রক্ত। অর্ণবের বাবা মা আর কেউ নয় বর্ষা-অভ্র। অর্ণব বর্ষা আর অভ্রর ছেলে। ”

মুন্নির কথায় সকলে অবাক হয়। মুন্নি তাদেরকে বর্ষা ও অভ্রর বিয়ের কথা বলে, তাদের ওই রাতে গ্রামের লোকের জোর করে বিয়ে দিয়েছিল এবং তারা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতো। তিন্নি সেও পিছিয়ে থাকেনি তিন্নিও বলে সবকিছু অভ্র কতটা পাগলামি করেছিল বর্ষার জন্য।

মুন্নি আরও বলে, ‘ বর্ষার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার, এবং না ফিরে আসার একমাত্র কারণ অর্ণব! ও চায়নি তোমরা অর্ণবের সম্পর্কে জানো। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, ও ভেবেছিল ও প্রেগন্যান্ট জানলে তোমরা ওর বাচ্চা টাকে নষ্ট করে ফেলবে সে ভয়েই তোমাদের থেকে দূরে গিয়ে ও সন্তান জন্ম দেয়৷ কোনো ভাবেই নিজের সন্তানের ক্ষতি সে চায়নি। মা তো কিভাবে নিজের বাচ্চাকে মেরে ফেলবে? আমি ওর বড় বোন, আমি মনপুড়া যাওয়ার আগের দিন রাতে আমার পা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল বর্ষা। আর মিনতি করেছিল ওকে জেনো আমার সাথে নিয়ে যাই। আর ওর বাচ্চাকে সুস্থ ভাবে পৃথিবীতে আসতে জেনো সাহায্য করি। আমি ওর কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারি তাই ওকে নিজের সাথে নিয়ে চলে যাই। ’

সবকিছু শোনে সকলের চোখে পানি চলে আসে। তারপর মুন্নি অর্ণবকে তার নানা-নানি, দাদা-দাদি ও পরিবারের বাকি সদস্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারাও ইমোশনাল হয়ে অর্ণবকে জড়িয়ে ধরে কপালে গালে চুমু খায়। এত বছর পর পরিবার পেয়ে অর্ণবও খুশিতে ডগমগ করছে। সে তো জানতোই না তার এতবড় একটা পরিবার আছে।

অর্ণব ক্ষীণকন্ঠে বলল, “ আমার আম্মু কোথায়? আমি আমার আম্মুর কাছে যাবো। ”

অর্ণবকে মুন্নি কেবিনের দরজা হাল্কা খোলে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়৷ সাদা চাদরের বেডের উপর বর্ষাকে শুয়ে থাকতে দেখে অর্ণব তার দিকে দৌঁড়ে যায়। অভ্র অর্ণবকে আসতে দেখে একহাত তার সামনে তুলে ধরে অর্ণবের উপর দৃষ্টি সংযত রেখে বলল, ‘ কে তুমি এখানে কি করছো? ’

অর্ণব নির্মূলকন্ঠে বলল, “অর্ণব আহমেদ!”

ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে অভ্র বলল, “কে অর্ণব আহমেদ? ”

অর্ণব একহাত তার মায়ের দিকে তাক করলো অর্থাৎ বর্ষার দিকে, অর্ণবের হাতের ইশারা লক্ষ্য করে অভ্র বর্ষার দিকে এক পলক তাকালো পরক্ষণে আবারও অর্ণবের দিকে তাকালো।

অর্ণব বর্ষার দিক থেকে হাত সরিয়ে নিজের বুকের উপর রেখে বলল, ‘ আমি আমার মা’য়ের ছেলে। ”

হতবিহ্বল চোখে অভ্র অর্ণবের দিকে তাকায়। শাহাদাত আঙুল বর্ষার দিকে তাক করে সে অস্ফুটস্বরে বলে, ‘ ও তোমার মা? ‘

অর্ণব উপর নিচ মাথা নাড়ায়। অভ্র ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে অর্ণবের দিকে। অভ্র যে অবাক হয়েছে তা বুঝতে বাকি নেই অর্ণবের। এক’পা দু’পা এগিয়ে আসে অভ্রর দিকে আর সন্দিহান কন্ঠে বলে, “ আপনি অনেক সুন্দর! আপনাকে দেখতে অনেকটা আমার মতো, আপনি কে আঙ্কেল? ”

অভ্র একহাত বাড়িয়ে দিলো অর্ণবের দিকে, চোখের পাপড়ি দুইবার পলক ফেলে বলল, ‘ এদিকে আসো! ‘

অর্ণব অভ্রর কাছে আসে তারপর অভ্র অর্ণবকে কোলে তুলে নেয়৷ দুইহাতে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ভারী নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। অর্ণব সে-ও অভ্রর বুকের মধ্যে চুপটি করে রয়েছে।

কিয়ৎক্ষণ পর অভ্র অর্ণবকে নিজের সামনে বসালো, অর্ণবের দুইগালের উপর অভ্র তার হাত রেখে বলল, “ অর্ণব আমি তোমার বাবা! ”

অর্ণব যে তার বাবার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এক পিপাসকের মতো ফটফট করতো। আজ সে তার বাবার কোলে বসে আছে। অস্ফুটস্বরে ‘বাবা’ বলে কান্না করে দেয় অর্ণব।

বর্ষার একহাত শক্ত করে ধরে অভ্র ও অন্য হাত দিয়ে ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। এত বছর ধরে সে জানতোই না তার একটা ছেলে আছে আর সে এত বড় ও হয়েগেছে। এত বছর পর ছেলে তার বাবাকে পেলো আর বাবা তার ছেলেকে পেলো, বলে বুঝানো যাবে না এই মূহুর্ত কতটা মধুর।
.
.
.
বাতাসের সাথে কৃষ্ণচূড়া গাছটা থেকে জোড়ে পরছে লাল লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল।

সামনেই অর্ণব খেলা করছে অন্য বাচ্চাদের সাথে, গাছের নিচে হাতে হাত রেখে বসে আছে বর্ষাভ্র।

অভ্র বর্ষার হাত শক্ত করে ধরে ঠোঁটের সামনে আনলো হাতের উল্টো পিঠে আলতো করে এক চুমু দিয়ে বলল, “ভালোবেসে ধরেছি এই হাত! ভালোবেসে সারাজীবন ধরে রাখবো। কথা দিচ্ছি যতই বিপদ আপদ আসুক না কেনো, এই বর্ষাভ্রর অভ্র কখনো তার রাগরাগিণীকে ছেড়ে যাবে না। ”

বর্ষা অভ্রর হাতের উপর তার অন্য হাতটি রেখে বলল, “ কথা দিচ্ছি, আমিও আর কখনো তোমাকে ভুল বুঝবো না।”

তখনই অর্ণব “আম্মু-আব্বু” বলে জোরে জোরে চিৎকার করে এগিয়ে আসতে লাগল, বর্ষা ও অভ্রর মাঝখানে এসে বসলো অর্ণব। দুজনের হাতের উপর নিজের ছোট্ট ছোট্ট হাতটি রেখে বলল, “ আমার আব্বু আম্মু আর আমি আমাদের হ্যাপি ফ্যামিলি! ”

বলে ফিক করে হেসে ফেললো অর্ণব সে সাথে সাথে বর্ষা ও অভ্র দুইপাশ থেকে অর্ণবের গালে চুমু একে দিলো। অর্ণব দুইহাতে তার মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে আর এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আজ ওরা তিনজনেই খুব খুশি। জীবনের সব বাধা প্রতিকুলতা পার করে নিজেদের মতো করে ভালোবাসাময় জীবনে সম্পূর্ণ ভালোবাসাতে পূর্ণ ওরা।

#সমাপ্ত ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here