অবশেষে তুমি -পর্ব তিন এবং শেষ ,

0
6771

অবশেষে তুমি
-পর্ব তিন এবং শেষ
,
,
ভাইয়ার হঠাৎ করে এমন চিৎকার শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি করে ড্রইং রুমে আসতেই শুনতে পেলাম ভাইয়া আয়ান কে বলছে,,,
,
— তোমার সাহস হয় কি করে আমার বোনকে বিয়ে করতে চাও। মানলাম তুমি ডক্টর। কিন্তু সবাই যখন জিজ্ঞেস করবে ছেলের বাবা কি করে তখন আমি কি বললো, সে একজন দিনমজুরি।
,
আয়ান ভাইয়ার কথা শুনে বললো,,,
— কেন দিনমজুরি বুঝি মানুষ না?
— দ্যাখো, আমার পরিস্কার কথা আমার বোনকে ভুলে যাও। এই শহরের সব থেকে ধনী লোকের ছেলের সাথে আমার বোনের বিয়ে দিবো।
— ভাইয়া , আমি ইরা কে সুখী রাখবো। প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না।
— আর একটা কথা ও বলবে না। চলে যাও আজকের পর থেকে ইরার সাথে যোগাযোগ করবে না।
,
,
আমি ভাইয়ার কথা শুনে থ হয়ে গেলাম। যেটা আমার ভয় ছিল ওটাই হলো। আয়ান গরীব ঘরের ছেলে। ওর বাবা অনেক কষ্ট করে ওকে লেখা পড়া শিখিয়েছে। কিন্তু আমার তো কোনো সমস্যা নেই। তাহলে ভাইয়া এমন বিহেব কেন করছে। আমি সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলাম ভাইয়ার সামনে। ভাইয়াকে বললাম,,,
,
—ভাইয়া, আমি আয়ানকে বিয়ে করলে সুখী হবো। ওকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা পসিবল না।
,
আমি ভাবতে ও পারিনি যে ভাইয়া আমাকে কোনো দিন চোখ রাঙিয়ে কথা বলেনি সে আজ আমার গায়ে হাত তুলবে। আমার মুখে সমস্ত শরীরের শক্তি মিশিয়ে একটা চড় দিয়ে বললো,,
— বাহ, তোর তো অনেক উন্নতি হয়েছে। নিজের ভালো মন্দ সব বুঝে গেছিস। একবার ও চিন্তা করিস? ওই বাবা ভাইয়ের কথা। যারা তিল তিল করে বড়ো করে একটু একটু করে সপ্ন দেখে বোনের জন্য। সিদ্ধান্ত এখন তোর হাতে। তুই যা ইচ্ছে করতে পারিস৷
,
এই বলেই ভাইয়া চলে গেলো। মা তাড়াতাড়ি করে আমার কাছে এসে আয়ান কে উদ্দেশ্য করে বললো,,,
,
— বাবা তুমি কিছু মনে করো না। ওকে অনেক বেশি ভালোবাসে ওর ভাই। কোনো দিন এভাবে ভাই বোনের কথা কাটাকাটি হয়নি। আজ রাগের মাথায় কি দিয়ে কি হয়ে গেলো। তুমি চলে যাও।
,
আয়ান একবার আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরছে। আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। ভাইয়া আমার গায়ে হাত তুললো সেটা আয়ানের সামনে। নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। নিজের ঘরে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। কষ্ট কোনটা বেশি লাগছে বুঝে উঠতে পারছি না।
,
এভাবে কেটে গেলো কয়েকদিন। আমি ঘর থেকে বের হতাম না। কারে সাথে কথা বলতে চাইতাম না। মা বাবা জোর করে খাইয়ে দিতো। ভাইয়া ও বাসায় ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করতো না। অনেক রাত করে বাসায় ফিরতো। সব কিছু এলোমেলো হয়ে যেতে লাগলো। আমি আমার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
,
সেদিন রাতে আয়ান কে ফোন করে জানালাম,,
,
— হ্যালো আয়ান?
–কেমন আছো ইরা? তোমাকে কতোবার ফোন করেছি তোমার ফোন বন্ধ। জানো আমি কতো টেনশন করেছি।
— তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।
— বলো কি বলবে? কোথায় দেখা করতে হবে বলো?
–আয়ান তুমি আমাকে ভুলে যাও।
— তোমার মাথা ঠিক আছে ইরা? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?
— আমি ঠিক আছি। কিছুদিন পর আমার বিয়ে। আমাকে ফোন করবে না কোনো দিন।
,
আয়ান কে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলাম। মোবাইলের ভিতর থেকে সিম বের করে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেললাম। মনে হচ্ছিল আমি আমার ভালোবাসা ও এভাবে ভেঙে ফেলেছি।
আয়ান তোমাকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি কিন্তু সেটা আর বলা হবে না। অনেক গুলো আপন মানুষদের ভালোবাসা আজ বাচিয়ে রাখতে আমার ভালোবাসা শেষ করতে হলো। তুমি আমায় ক্ষমা করে দিও।
,
,
এভাবে কেটে গেলো এক বছর। আগের মতো সব কিছু হলেও আয়ানকে আমি ভুলতে পারতাম না। নিজেকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করলে ও রাত শেষে হাজার ও সৃতি উঁকি দিতো মনের জানালায়।
,
একদিন অনিকের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো।
বিরাট কোটিপতির ছেলে। বাড়ির সবাই খুব খুশি। আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ তোমাদের খুশি দেখতেই আমি আমার ভালোবাসা নিজের হাতে খুন করেছি।
,
বাসর রাতে অনিক কে সব কিছু বলে আমি আমার জীবনের আরেকটি ভুল করেছিলাম। তাই তো আমার তাঁর মাশুল তিলে তিলে দিতে হচ্ছে।
,
সে দিন অনিক আমার উপরে অনেক বেশি রাগ করে বাইরে চলে গিয়েছিল। সব দোষ আমার। যে আমাকে নিজের থেকে বেশি ভালোবাসতো তাকে একদিন ফিরিয়ে দিলাম। আর যে নতুন করে ভালোবেসে আপন করে নিতে চাইলো তাকে অতিত বলে দিয়ে তার মনে ঘৃণা জন্ম দিলাম। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি আসলেই কপাল পোড়া। আমার কপালে সুখ শয়না। না হলে বার বার ভালোবাসা দরজায় এসে ও কেন ফিরে যায়।
,
হঠাৎ করে আমার ফোনে কল এলো। কেউ একজন বললো,,
,
— আপনি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আসুন অনিক গুরুতর এক্সিডেন্ট করেছি।
,
আমি কথাটা শুনে কি করবে বুঝতে পারছি না। তাড়াতাড়ি করে অনিকের নম্বর এ ফোন করলাম। ওপাশ থেকে একজন ফোন ধরলো,
আমি বললাম,,
— কে আপনি?
— আপনি আমাকে চিনবেন না। যাকে ফোন করেছেন সে এখন হাসপাতালে ভর্তি। অবস্থা বেশি ভালো না তাড়াতাড়ি চলে আসুন।
,
আমার বুকটা ঢিবঢিব করছে। অনিকের কিছু হবে না তো। পাগলের মতো হাসপাতালে ছুটে গেলাম।
ডক্টর বললো অবস্থা অনেক খারাপ। নেশা অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিল। চোখে গুরুতর আঘাত পেয়েছে। চোখ দুটো নিয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।
,
আমার বাবা মা ভাই অনিকের বাবা মা সবাই হাসপাতালে। কি করবে বুঝতে পারছি না। আমি চেয়ারে বসে পরলাম। নিজেকে মনে হচ্ছে একটা খুনি। মনে হচ্ছে আমি নিজেই মরে যাই। সব কিছু আমার জন্য।
হঠাৎ করে আমার খেয়াল হলো এটা আয়ানের হাসপাতাল। আচ্ছা ও কি এখনো জব করে নাকি চলে গেছে।
নিশ্চয়ই আমাকে ঘৃণা করে অনেক। আসলে আমি এমনই আমার কপালে ভালোবাসা নামক সুখ পাখি নেই।
,
একটু পর ডক্টর এসে বললো,,
— আমাদের এখনই অপারেশন করতে হবে। চোখের অবস্থা বুঝতে পারছি না।
,
এই বলেই চলে গেলো। আমরা অপেক্ষা করে যাচ্ছি। কয়েকঘন্টা পর ডক্টর বের হয়ে বললো,,
— আপনাদের রোগী এখন বিপদমুক্ত। উনার চোখ ঠিক হয়ে গেছে। নতুন করে চোখ লাগাতে হয়েছে।
,
আমরা সবাই অবাক হয়ে গেলাম। নতুন চোখ কে দিলো এতে তাড়াতাড়ি। ডক্টর কে জিজ্ঞেস করা হলো,,
— স্যার, কে সেই লোক যে নিজের চোখ দিয়ে আমার স্বামীকে বাঁচিয়ে দিলো।
— দেখুন , মিসেস অনিক৷ আমাদের বলতে নিষেধ করেছেন। এটা বাস্তব যে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে সে আপনার স্বামী কে বাচিয়ে দিলো। সে অনেক মহান মানুষ৷ আপনাদের কাছ থেকে সে কোনো বিনিময় চায় না। কোনো উপকারো সে আশা করে না।
,
এই বলেই চলে গেলো। সবাই অনিকের কাছে ভিতরে দেখা করতে চলে গেলো। আমি ওই জায়গায় দাড়িয়ে আছি। হিসাব মিলাতে পারছি না কে সে?
সে কি আমাকে চিনে?,
,
এমন সময় মিলা আমার সামনে দাঁড়ালো। এতো দিন পর ওকে দেখে আমি অবাক। মিলা আমার সামনে এসে বললো,,,
— কেমন আছিস?
— মিলা তুই?
— হুমমম,, তোদের সে দিনের ঘটনা শুনে আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম যোগাযোগ করতে কিন্তু তোর ভাইয়া আমাকে একদিন রাস্তায় দেখে বলেছিল তোর সাথে কোনো দিন যেন যোগাযোগ না করি।
,
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,,
— আমরা কেউ ভালো নেই মিলা? এ সবের জন্য আমি দায়ী।
— তোর বর এখন সুস্থ।
ওর কথা শুনে অবাক হয়ে বললাম,,

— তুই কি ভাবে জানলি?
— আমি সব জানি। আয়ান ভাইয়া তোকে এখনো পাগলের মতো ভালোবাসে। তাঁর চোখ দুটো দিয়ে প্রমান করে দিলো সে তোকে কতোটা ভালোবাসে।
,
আমি মিলার কথা শুনে কি বলবো বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। মাথা ঘুরে পরে যাবো৷ মিলা আমাকে বললো,,
— তুই শান্ত হ। আয়ান ভাইয়া ভালো আছে। চোখ দেওয়ার আগে বলে গেছে চোখ দুটো সে শুধু মাত্র তোকে দেখার জন্য দিয়েছে। যেন মন ভরে তোকে দেখতে পারে।
,
আমি আর সয্য করতে পারছিলাম না। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম।
,
আজ দশ দিন পর অনিকের চোখের ব্যানডেজ খুলবে। আমি আয়ান কে এক নজর দেখার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। ও নাকি পরদিন এই হাসপাতাল থেকে চলে গেছে। কোথায় কেউ জানে না। মিলা ও আর যোগাযোগ করে নি।
,
আমি অনিকের সামনে বসে আছি। ও আস্তে আস্তে চোখ খুলে আমার দিকে তাকালো। আমি ওর চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছি। আমি জানি না আমার চোখ কাকে দেখছে আয়ানের চোখ নাকি অনিকের চেহারা?
,
অনিক এই প্রথম ভালোবাসা মাখা হাত দিয়ে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো।আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরে অনিকের হাত ভিজে যাচ্ছে। অনিক আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। ওর বুকে মাথা রেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছি।
আর মনে মনে বলছি,,

আয়ান তুমি ভালো থেকো। তোমাকে আমি সারা জীবন মনে রাখবো। “অবশেষে তুমি” শুধু তোমার তুলনা এটা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে গেলে।

,

,

—সমাপ্ত
–লেখা অধরা জেরিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here