অবশেষে_পরিণয় পর্ব_৬

0
4843

অবশেষে_পরিণয় পর্ব_৬
#জান্নাতুল_নাঈমা

আরুশ চোখ খুলে সামনের মানুষ টা এবং তাঁর গলা ফাটানো দেখে প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করলো।
নিশ্চয়ই সারারাত গোয়েন্দাগিরি করে নাতনীকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে সফল হয়েছেন।
আরুশ দ্রুত ওঠতে নিতেই খুশি ঘুমের ঘোরে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো আরুশকে।
“ওরে খুশি তুই যদি জানতি আমার সামনে কে তাহলে এভাবে ধরা তো দূরের কথা আমার দশহাত দূরেও থাকতি না ”

খুশির দিকে অসহায় মুখ করে চেয়ে রইলো।
খুশির দাদী রোকসানা তালুকদার তাই দেখে কপাল চাপড়াতে লাগলো,,,

— হায় হায় রে আমার নাতনীটারে এক রাতেই বশ করে ফেলেছে গো। ও খোকা তুই কই গেলিরে দেখে যা তোর মেয়ের কি সর্বনাশই না ঘটলো রে।
খোকা তুই কই।

আরুশ উপায় না পেয়ে খুশিকে পাজাকোল করে নিয়ে দাঁড়ালো। মনে মনে বেশ বকছে তাকে।
কি মরা ঘুম দিলি খুশি তোর দাদী এবার আমার প্রাণ না নিয়ে ছাড়বে না।
অসহায় মুখে দাদীর দিকে চেয়ে বললো,,,

— দাদী দয়া করে চুপ থাকেন।
বাড়িতে মেহমান ভরপুর। এমন কিছু করবেন না যে আমার বা আপনার পরিবারের সম্মানহানি হয়। আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছুনা। গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে।

–চুপপ হতচ্ছাড়া তোর মতলব আমি বুঝিনা ভাবছোস। দাঁড়া খোকাকে সব বলবো আমি।
আগেই বুঝেছিলাম তোর মধ্যে ঘাবলা আছে।
শয়তান ছেড়া এইবার দেখ আমি কি জিনিস।

আরুশ দাদীর পুরো শরীরে চোখ বুলিয়ে বললো,,,

— আপনি কি জিনিস তা কি আমি এতোদিনে বুঝিনি নাকি। কিন্তু আমি কি জিনিস তা কি আপনি জানেন।
দাদা মশাইয়ের মতো কিন্তু আমি না আমি তাঁর থেকেও বেশী হট সবদিক দিয়ে। আর আমার মাথাটা দ্বিগুন হট বলেই চোখ টিপ দিলো।

দাদী ১০০ডিগ্রি রাগ নিয়ে চেয়ে আছে।
আরুশ দাদীর সামনে এসে খুশিকে নামিয়ে তাঁর কাঁধে মাথা দিয়ে বললো,,,

— ওকে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিন। আর এখানে যা দেখেছেন ভুলে যান। বয়স হইছে স্মৃতি শক্তি এতো প্রখর করে লাভ কি বলেই বাকা হেঁসে চলে গেলো আরুশ।

দাদী খুশিকে জরিয়ে নিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,,

— ছোটলোকের বাচ্চা,, বড় বাড়ির মেয়ে কে ফাঁসানোর মতলব দেখ আমি কি করি।
.
খুশির বাবা বউ ভাতের অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতেই জোর জুলুম করেই তাঁর পুরো পরিবার কে নিয়ে গেলেন।
আয়েশা বেগম এতো অনুরোধ করলেন তবুও মোশতাক তালুকদার মেয়েকে রেখে গেলেন না।
যাওয়ার সময় রোকসানা তালুকদার বেশ দাম্ভিকতার সাথে আরুশকে বলে গেলেন,,

— ব্রাহ্মণ হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার ভুল করতে নাই দাদাভাই।

আরুশের আর বুঝতে বাকি রইলো না এই মহিলা ছেলের কানে বিষ ঢেলেছে।
যাওয়ার সময় খুশি বার বার লুকিয়ে লুকিয়ে আরুশের দিকে তাকাচ্ছিলো আরুশ খুব সাবধানে হাতে ইশারা করে তাঁকে আশ্বস্ত করলো।
.
প্রায় দশদিন কেটে গেছে খুশির সাথে না দেখা না কথা। কোনভাবেই যোগাযোগ করতে পারছেনা আরুশ। আয়েশা বেগম খুশির মা কে ফোন দিলেও সে সব টা এড়িয়ে যায়। একবারো খুশিকে দেয় না।
এদিকে আরুশ পাগল হয়ে যাচ্ছে কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না তাঁর। কি করবে না করবে কিচ্ছু ভেবে পাচ্ছে না।
তখনি ফোন এলো বন্ধু নিরবের।

— হ্যালো।

— হ্যালো আরুশ আমি নিরব বলছি।

— তা তো বুঝতেই পারছি নাম্বার সেভ বল।

— তুই না বলছিলি খুশির সাথে যোগাযোগ করতে
পারছিস না,স্কুল ছুটি হইছে তাই তোর শালাকে আটকে রেখেছি,বাড়ির পথে যাচ্ছিলো সীমিত আকারে কিডন্যাপ করেছি।
কান্নাকাটি করছিলো তাই চকলেট, আইসক্রিম দিয়ে আমার দোকানে বসিয়ে রাখছি তারাতারি আয় ।
.
মূহুর্তেই আরুশের মুখে হাসি ফুটে ওঠলো।
হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো কয়েকগুন দ্রুত বাইকের চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেলো সে।
ঝড়ের গতিতে বাইক থামালো নিরবের দোকানের সামনে। দোকানের ভিতর তাঁর পিচ্চি বউয়ের পিচ্চি ভাই আইসক্রিম খাচ্ছে। ঠোঁটে হাসি একে এগিয়ে গেলো দোকানের ভিতর।
.
আরুশকে দেখেই মিলনের মুখে হাসির ঝলকানি দিলো। চিৎকার করে বললো,,,

— আরুশ ভাইয়া তুমি ,, এই দেখো এই ভাইয়াটা আমাকে কিডন্যাপ করে আইসক্রিম খাওয়াচ্ছে।
আমি খাচ্ছি খুব খুদা লাগছে আমার,,
কিডন্যাপ হইছি বলে তো না খেয়ে থাকতে পারিনা। কিডন্যাপার খুব ভালো দেখো কতো চকলেট,
কতো আইসক্রিম,, আমি চুপচাপ বসে থাকলে পুরো দোকানের সব চকলেট,আর আইসক্রিমই নাকি আমায় দেবে হিহিহি।

আরুশ হোহো করে হেসে ওঠলো।
মোড়া টেনে মিলনের সামনাসামনি বসে নিরবকে বললো,,
— ঠান্ডা পানি দে ভাই গলা শুকিয়ে গেছে।

মিলনের দিকে চেয়ে বললো,,

— খুশি কোথায়রে??কেমন আছে??

মূহুর্তেই মিলনের মুখটা ভাড় হয়ে গেলো।

— তুমি খুব খারাপ আরুশ ভাইয়া খুব খারাপ।

আরুশের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠলো।
ঠিক এইভাবে খুশিও বলে অবশ্য সে আরো বেশি কিছু এড করে যেমন,,

— তুমি খুব খারাপ আরুশ ভাইয়া,, তুমি খুব খারাপ,, তুমি শুধু আমায় ব্যাথা দাও।

ভাবতেই চোখ দুটো ভরে এলো তাঁর।
নিজেকে একটু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে বললো,,,

— কেনো কি করেছি আমি??

মিলন বললো,,,

— তুমি খুশি আপুর সাথে খারাপ কাজ করতে চেয়েছো তাই তো বাবা তোমাদের বাড়ি যেতে নিষেধ করে দিছে। আমাদের বাড়ির কেউ ও বাড়ি মুখো হলে ঠ্যাং ভেঙে দিবে আর দুবছর পর আপুকে বিয়েও দিয়ে দেবে। ছেলে ঠিক করাই আছে।

আরুশের চোখ দুটো রক্ত বর্ন ধারন করলো।
আরেকটু ঝুকে মিলনকে ধরে বললো,,,

— কি বলছিস এসব কি হয়েছে??

— তুমি আপুকে বশ করেছো তাই তো আপু তোমার জন্য কান্না করে। বাবার হাতে কতোগুলা মাইর খেয়েও বলে আপু তোমাদের বাড়ি আসবেই তুমি নাকি কিছু করোনি তুমি আপুকে ভালোবাসো।
কিন্তু দাদী বলেছে তোমার মা টোটকা জানে, সম্পত্তির লোভে বশ করেছো আপুকে।
আরুশ ভাইয়া সত্যি তুমি এতো খারাপ কেনো?
কেনো বশ করেছো আপুকে বলো?

আরুশের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।
কি শুনছে এসব সে খুশিকে মেরেছে তালুকদার সাহেব এতো বড় স্পর্ধা এইটুকুন বাচ্চা মেয়ের গায়ে হাত তুলতে বিবেকে বাঁধলো না ।
রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,,,

— আমি বা খুশি কোন খারাপ কাজ করিনি মিলন।
এসব তোর দাদী বানিয়ে বলেছে।

নিরব পানি এগিয়ে দিতে আরুশ পানির গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেললো। রাগ হচ্ছে তাঁর ভীষণ রাগ হচ্ছে। কি করবে বুঝে ওঠতে পারছে না কোবরকম নিজেকে শান্ত করে বললো,,,

— তোর আপুকে কলেজে এডমিট করায়নি??

— করিয়েছেতো বাবা দিয়ে আসে নিয়ে আসে।
দাদী বলেছে একা গেলে তুমি নাকি ধরে নিয়ে যাবাগা।

আরুশ বসা থেকে ওঠে দাড়ালো পিছন ঘুরে নিজের চুল খামচে ধরলো। কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না তাঁর কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না।
.
খুশির কলেজের সব ইনফরমেশন নিয়ে খুশির নতুন বন্ধু তাঁরার ইনফরমেশনও জোগার করলো।
এক বিকালে তাঁরার সাথে দেখাও করলো আরুশ।
খুশির ব্যাপারে টুকটাক জেনে নিয়ে কিছুটা শান্তি লাগলো তাঁর কিন্তু এভাবে চলবে না তাকে খুশির সাথে যেভাবে হোক দেখা করতে হবে কিন্তু কিভাবে সম্ভব বাইরে তালুকদার বাড়ির লোকের অভাব নেই।
সে নিজেকে নিয়ে ভয় পায় না ভয় পায় খুশিকে নিয়ে। কারন খুশির মনের কথা সে এখনো পুরোপুরি জানেনা তাই যেভাবেই হোক খুশির সাথে তাঁকে দেখা করতেই হবে।
মাঝরাতে তালুকদার বাড়ির দেয়াল টপকে পাইপ বেয়ে খুশির রুমের জানার কাছে এক লাফে নামলো আরুশ।
জানালার পর্দা সরাতেই চমকে গেলো সে।
খুশির পাশে তাঁর দাদী শুয়ে আছে, খুশিও গভীর ঘুমে মগ্ন।
রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার। দেয়ালে সাজোরে এক ঘুষি দিলো।

— শয়তান বুড়ি তোর দম্ভ যদি এই আরুশ ভেঙে গুড়িয়ে না দেয়। তোর কূটনৈতিকতা যদি এই আরুশ না ভেঙে দিয়েছে শুধু ওয়েট করে যা একবার খুশিকে পাই তারপর তোর মতো বুড়িকে শিক্ষা দিতে আমার দুমিনিটের ব্যাপার।
.
নবীনবরন অনুষ্ঠান পুরো কলেজ ভর্তি মানুষ আর মানুষ এমন দিনে কে রাখবে কার খোঁজ।
এতো ভীড়ের মাঝেও তালুকদার বাড়ির কয়েকজন চ্যালাদের নজরে পড়লো । আরুশ তার তেরো,চৌদ্দ জন ফ্রেন্ডকে ঐসব চ্যালাদের দেখিয়ে দিলো।
এবার জমবে মজা সব ফ্রেন্ডরা মিলে চ্যালাদের বেশ বিরক্ত করতে লাগলো। তাঁদের এটেনশন খুশির থেকে সরানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করলো এবং সফলও হলো।
এই সুযোগে আরুশ গিয়ে খুশির হাত চেপে ধরে টেনে ভীড় থেকে বের করে নিয়ে একটা ফাঁকা রুমে ঢুকে পড়লো।
খুশি উত্তেজিত হয়ে বললো,,,

— আরুশ ভাইয়া তুমি,,,

মূহুর্তেই আরুশ খুশির মুখে হাত দিয়ে চেপে কথা বলতে নিষেধ করে শক্ত করে জরিয়ে নিলো বুকের মাঝে।

এতো শক্ত করে ধরেছে যেনো নিজের ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলবে একদম। খুশির যেনো দম জায় জায় অবস্থা খুশি যতোই ছাড়াতে চায় আরুশ ততোই গভীরভাবে জরিয়ে নেয়।
এবার খুশিও আর সরলো না সেও দুহাতে আঁকড়ে ধরলো আরুশের পিঠ।
অন্যরকম এক অনুভূতিরা ছুঁয়ে গেলো তাঁর মন প্রান জুরে।
দুজনের অবস্থা এমন যেনো বহুযুগ পর দুজন নর-নারী তাঁদের ভালোবাসার তৃষ্ণা মেটাচ্ছে।
দুজন মানুষ যেখানে দুজনকে সহ্য করতে পারতো না। সব সময় রাগ,, ঝগড়া লেগেই থাকতো,, কতো ঝগরা কতো না তর্ক,, সেই দুজনকে যখন অন্যরা এসে আলাদা করার চেষ্টা করলো ঠিক তখন তাঁরা দুজন আঁকড়ে ধরতে চাইছে একে অপরকে।
এটাইকে তাহলে ভালোবাসার চির ধারিত নিয়ম??
ঠিক যেমন পুরো পৃথিবী এক দিকে আর এরা দুজন একদিকে।
.
বেশকিছু সময় পর আরুশ খুশিকে ছেড়ে দুহাতে খুশির গালে আলতো করে চেপে কপালে চুমু খেলো।
তারপর গালে, নাকে,থুতনিতে তারপর ঠোঁটের দিকে এগুতেই খুশি জোরে শ্বাস নিতে নিতে মুখ সরিয়ে নিলো। আরুশ মলিন দৃষ্টি তে চেয়ে আছে মনে হচ্ছে বহুযুগ পর তাঁর “দিলের রানীকে” সে খুঁজে পেয়েছে।
.
হঠাৎ ই আরুশ খুব শক্ত করে কোমড় চেপে নিজের অনেকটা কাছে নিয়ে এলো খুশিকে।
খুশি চমকে গিয়ে আরুশের দিকে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেলো আরুশের চোখ দুটো ভীষণ রকমের লাল।

আরুশ ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে বললো,,,

— মোশতাক তালুকদার তোকে মেরেছে??

কথাটা শোনা মাএই চমকে গেলো খুশি।
মুখ চিপে কেঁদে ওঠলো,, যা দেখে আরুশের বুকে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো।
এর আগেও খুশি অনেক কান্না করেছে তাঁর সামনে কিন্তু সেই কান্না আর এই কান্না এক নয়।
এই কান্নায় রয়েছে তীব্র ব্যাথা যেই ব্যাথা দুজনেরই শরীর নয় মনে দাগ কেটে দিচ্ছে।

— প্লিজ খুশি এভাবে কাঁদিস না আমার বুকে ব্যাথা লাগে।
খুশি সমানে ফোঁপাতে লাগলো। এতোদিনের জমিয়ে রাখা কান্নাগুলো সে প্রকাশ করছে তাঁর মানুষ টার কাছে।
কাঁদবে নাইবা কেনো,, বাবা মায়ের আদরের একমাএ মেয়ে, শুধু কি বাবা মা তালুকদার বাড়ি,
সরকার বাড়ির সকলের চোখের মনি সে।
তাঁর গায়ে একটা ফুলের টোকাও কেউ পড়তে দেয় না সেখানে তাকে মেরেছে শুধু দুটো থাপ্পড় দিয়ে খ্যান্ত হয়নি মুখে মুখে কথা বলায় লাঠি দিয়ে কয়েকটা বাড়িও দিয়েছে যার দাগ এখনো স্পষ্ট।

আরুশ দ্বিগুণ ক্ষেপে গেলো খুশিকে আরো শক্ত করে চেপে মুখোমুখি মুখ করে বললো,,,

— কোথায় মেরেছে বল আমায়,,একদম কাঁদবি না,, কাঁদবি না তুই। চিৎকার করে ওঠলো আরুশ।

চলবে……
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।
কেমন হচ্ছে না জানালে লেখার আগ্রহ হারিয়ে যায়।
ভালো মন্দ যেমনই লাগুক অবশ্যই জানাবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here