অবাধ্য মন,পর্ব_১
শোভা_আক্তার(লাভলী)
হাতে প্রেমপত্র নিয়ে বসে আছে জানভি। মুখে লজ্জামাখা হাসি ফুটে উঠেছে তার। তার মনের প্রত্যেক কথা সে এই পত্রে লিখে দিয়েছে। এখন শুধু তার অপেক্ষা। সে আসলে জানভি তাকে পত্র দিয়ে দিবে। হঠাৎ পাশ থেকে একটা ভারী কন্ঠ ভেসে আসলো।
“তুমি সত্যি ওকে ভালোবাসো?”
জানভি কন্ঠ শুনে সেখানে তাকাল। তার ক্লাসমেট রাহুল দাঁড়িয়ে আছে। জানভি এক নজর পত্রে রেখে আবার রাহুলের দিকে তাকাল।
“হ্যাঁ”
রাহুল তালিচ্ছ্যের হাসি দিয়ে ধীরপায়ে হেটে এসে জানভির পাশে বসলো। সামনের দিকে তাকিয়ে বলল-
“একবার বেশী না একবার ভালো মতো ভেবে নাও তুমি ওকে আজ মনের কথা বলবে কিনা। আমি যতটুকু জানি স্নিগ্ধ রায় কাওকে ভালোবাসার মানুষ না।”
জানভি লম্বা নিশ্বাস ফেলে ব্যাগের ভেতর পত্রটা রেখে উঠে দাঁড়াল।
“আপাতত আমি কারো কথা শুনে স্নিগ্ধকে ভুল বুঝতে পারবো না। আমি তার চোখে আমার জন্য ভয় দেখেছি। সেদিন আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে ব্যাথা পাওয়ায় সে কেমন পাগলের মতো ছুটাছুটি করেছিল দেখো নি?”
রাহুল দাঁড়িয়ে জানভির চোখে চোখ রেখে বলল-
“স্বাভাবিক, স্নিগ্ধর ধাক্কার কারণেই তুমি পড়েছিলে। তোমার যদি কিছু হয়ে যেত তোমার পরিবার ওকে আস্ত রাখতো বলো?”
“রাহুল, প্লিজ আমাকে একা ছেড়ে দাও। ভার্সিটির প্রত্যেকে জানে তুমি স্নিগ্ধকে একদমই সহ্য করতে পারো না। ওর প্রতি তোমার মনে অনেক ঘৃণা রয়েছে। তাই আমি তোমার কথা শুনে স্নিগ্ধকে ভুল বুঝবো না।”
বলেই জানভি ঘুরে হাঁটা ধরলো। রাহুল তাকিয়ে আছে জানভির যাওয়ার পথে। তার ভয় করছে খুব মেয়েটার জন্য।
জানভি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। স্নিগ্ধর চেহারা তার বন্ধ চোখের জগতে ভাসছে। ছেলেটা চঞ্চল প্রকৃতির। কথায় কথায় রেগে যায়। অন্যদের সাথে মারপিট করে। কিন্তু মনের দিক থেকে নিখুঁত। হঠাৎ জানভির চোখের উপর কেও হাত রাখলো। জানভি চমকে উঠল। মানুষটার হাতের উপর হাত রেখে নিশ্চিন্তের নিশ্বাস ফেলল।
“মিস্টার রায়, ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে আমায়।”
স্নিগ্ধ হেসে জানভির চোখ ছেড়ে জানালার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। জানভি স্নিগ্ধকে দেখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল-
“আজও দেরি করে এলে।”
“শীতকলে ঘুম থেকে উঠতে মন চায় না।”
“অলস কোথাকার”
স্নিগ্ধ হেসে জানভির হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে আসলো। জানভি ও স্নিগ্ধর চোখ বরাবর। জানভি ঢোক গিলল স্নিগ্ধর চোখ দেখে। হঠাৎ কাশির শব্দ আসলো। দুজন দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে রাহুল এগিয়ে আসছে। স্নিগ্ধ বিরক্ত হয়ে বলল-
“আর একটু পর আসা যেত না?”
রাহুল দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
“ভার্সিটির ক্লাস তোমার কথার মতো শুরু হবে না। স্যার আসছেন, গিয়ে নিজের জায়গায় বসো।”
স্নিগ্ধ আরো বিরক্ত হলো। মায়া মায়া চেহারা বানিয়ে জানভির দিকে তাকাল। জানভি নিজের হাত ছাড়িয়ে বলল-
“যান জনাব গিয়ে বসুন। ছুটি হোক আপনাকে কিছু জানানোর আছে।”
বলেই জানভি লজ্জায় ভরা হাসি দিয়ে গিয়ে নিজের বেঞ্চে বসলো। স্নিগ্ধ বাঁকা হাসি দিলো জানভির আচরণ দেখে।
ছুটি হতে আরো ১০ মিনিট বাকি। রাহুল বার বার তার হাতের কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখছে। ছুটি হলে সে যেভাবেই হোক জানভিকে স্নিগ্ধর কাছ থেকে দূর রাখবে। জানভি বার বার চোখ ঘুরিয়ে স্নিগ্ধকে দেখছে। স্নিগ্ধ গালে হাত দিয়ে হাসিমুখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। জানভি হেসে চোখ সরিয়ে ফেলল। ধীরে ধীরে ১০ মিনিটও ফুরিয়ে গেল। ছুটির ঘন্টা বাজতেই সবাই এক এক করে ক্লাস থেকে বের হলো। জানভি দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে পত্রটা বের করে স্নিগ্ধর দিকে এগিয়ে গেল। স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে ব্যাগ কাঁধে
ঝুলালো। জানভিকে দেখে মুচকি হেসে বলল-
“বলো কি বলতে চাও।”
জানভি স্নিগ্ধর দিকে পত্রটা এগিয়ে দিলো। স্নিগ্ধ পত্রটা নিয়ে খুলে প্রথম লাইন পড়লো। তারপর আবার পত্রটা ভাজ করে জানভির হাতে দিয়ে বলল-
“এভাবে চলবে না। আমি যেভাবে পুরো ভার্সিটির মাঝে দাঁড়িয়ে তোমাকে প্রপোজ করেছিলাম তুমিও ঠিক সেভাবেই জবাব শোনাবে।”
“কিন্তু স্নিগ্ধ”
“কোনো কিন্তু না। পত্রকে কি লিখা আছে আমি জানি না। যদি তুমি আমাকে রিজেক্টও করতে চাও সবার সামনে করো। আমার সমস্যা নেই।”
জানভি কিছু বলার আগেই হাতে টান অনুভব করলো। পেছনে ফিরে দেখে রাহুল। স্নিগ্ধ বিরক্ত হয়ে বলল-
“তুমি আবার আমাদের মাঝে আসছো কেন?”
রাহুল স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল-
“তোমার প্ল্যান আমি সাকসেস হতে দিবো না।”
“প্ল্যান? কিসের প্ল্যান?”
রাহুল জানভিকে সরিয়ে স্নিগ্ধর বরাবর এসে চোখে চোখ রেখে বলল-
“নাটক করবি না স্নিগ্ধ রায়। আমি সব জানি তোর সম্পর্কে।”
স্নিগ্ধ দাঁতে দাঁত চেপে রাহুলকে সজোরে ধাক্কা মেরে দিলো। রাহুল কিছুটা পিছিয়ে গেল। জানভি অবাক হয়ে তাদের দুজনকে দেখে বলল-
“তোমরা এখন মারামারি করতে চাও? আমি বুঝতে পারি না তোমাদের সমস্যা কি। কেন একে অপরকে সহ্য করতে পারো না?”
রাহুল উঁচু স্বরে বলল-
“কারণ ও আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে জঘন্যতম মানুষ।”
স্নিগ্ধ এগিয়ে আসতে নিলো রাহুলকে মারার জন্য। কিন্তু জানভি থামিয়ে দিয়েছে। স্নিগ্ধকে শান্ত থাকতে বলে জানভি রাহুলকে বলল-
“রাহুল তুমি স্নিগ্ধকে কেন ঘৃণা করো আমি জানি না। আর জানতেও চাই না। কিন্তু তোমার এইটুকু জেনে রাখা উচিত স্নিগ্ধ আর আগের মতো নেই। ও বদলে গিয়েছে।”
“কয়লা ধুলে ময়লা যায় না দেবজানি। তুমি ভুল মানুষের সাথে পথ চলছো।”
জানভি আর উত্তর দিলো না। রাহুলকে বুঝাতে বুঝাতে সে ক্লান্ত। থাক আর কিছু সে বলবে না। আপাতত এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো। জানভি স্নিগ্ধর হাত ধরে বাহিরে নিয়ে গেল। রাহুল হাতমুঠো শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে।
“আমার কথা বিশ্বাস করলে না। এখন তোমার সাথে যা হবে সেটার সম্পূর্ণ দায় তুমি।”
জানভি আর স্নিগ্ধ ভার্সিটির মাঠের বরাবর দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ঘিরে রেখেছে ভার্সিটির অনেকেই। স্নিগ্ধ পকেটে হাত দিয়ে জানভির উত্তরের অপেক্ষায় আছে। জানভি লজ্জায় মাথা তুলতে পারছে না। সবার সামনে সে কিভাবে স্নিগ্ধকে নিজের মনের কথা বলবে? স্নিগ্ধ আড়চোখে ছাত্রছাত্রীদের ভিরে থাকা তার বন্ধুদের দিকে তাকাল। তারা সবাই হাসছে। স্নিগ্ধ চোখ টিপ মেরে জানভির দিকে তাকাল।
“নিজের মনের কথা বলতে যাচ্ছো। পাপ করছো না যে ভয় পাবে।”
জানভি মাথা তুলে স্নিগ্ধকে দেখে আবার সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বলল-
“আমার ভুল আজব ধরণের অনুভূতি হচ্ছে।”
স্নিগ্ধ মুচকি হেসে জানভির কাঁধে হাত রেখে বলল-
“জানভি, ভাবো এখানে কেও নেই। শুধু তুমি আর আমি দাঁড়িয়ে আছি। তারাতাড়ি বলো আমার তর সইছে না।”
জানভি মুচকি হেসে মাথা নাড়াল। হাতে থাকা পত্রটার ভাজ ধীরে ধীরে খুলে একবার চোখ বুলিয়ে লম্বা নিশ্বাস ফেলে স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল-
“ভালো লাগে তোমার সাথে সময় কাটাতে। ভালো লাগে তোমার হাতে হাত রেখে হাঁটতে। ভালো লাগে তোমার বেসুরো কন্ঠের গান শুনতে। ভালো লাগে আমার প্রতি তোমার যত্ন দেখতে। ভালো লাগে তোমার মুখে সবসময় হাসি দেখতে। স্নিগ্ধ, প্রথম দেখায় সবার মতো আমিও তোমাকে ভুল ভেবেছিলাম। সবাই যেমনটা বলে তুমি তো তার বিপরীত। বরং, আমার চোখে দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষ তুমি। জানো, যখন তুমি আমাকে নিজের মনের কথা বলেছিলে আমি অনেক অবাক হয়েছিলাম। ভয় করছিল খুব। তুমি আমাকে সত্যি ভালোবাসো কিনা ভাবতে ভাবতে আজ ৫ মাস হয়ে গেল। আজ ৫ মাস পর আমি তোমাকে জবাব দিতে চলেছি। স্নিগ্ধ রায়, আমি তোমাকে ভালোবাসি। অনেক বেশী ভালোবাসি।”
“শেষ কথাটা উঁচু স্বরে বলো যাতে সবাই শুনতে পায়।”
জানভি হাসিমুখে উঁচু স্বরে বলল-
“ভালোবাসি স্নিগ্ধ, তোমাকে অনেক ভালোবাসি।”
চারপাশ থমথমে অবস্থা। স্নিগ্ধ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জানভির দিকে। জানভির ঠোঁটে হাসি মুখে লজ্জা। নিচের দিকে তাকিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে সে। হঠাৎ হাসির শব্দ আসলো। জানভি ভ্রু কুঁচকে মাথা তুলে স্নিগ্ধর দিকে তাকাল। স্নিগ্ধ উঁচু স্বরে হাসছে। আশে পাশে যারা ছিল তারাও অবাক হয়ে স্নিগ্ধকে দেখছে। স্নিগ্ধর বন্ধুরা হাসতে হাসতে এগিয়ে আসলো। তাদের মধ্যে একজন স্নিগ্ধর দিকে ৫০০ টাকার একটা বান্ডেল এগিয়ে দিয়ে বলল-
“মেনে নিয়েছি তুই পাক্কা প্লে বয়। নে তোর টাকা, তুই আসলেও মহান।”
জানভি থতমত খেয়ে সবার চেহারা দেখছে। স্নিগ্ধ হাসতে হাসতে টাকার বান্ডেল নিয়ে জানভির দিকে তাকাল। জানভি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধ লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল-
“জানভি, বিশ্বাস করো আমি তোমার মন ভাঙতে চাই নি। কিন্তু কি করবো বলো।আমার ইগো হার্ট হয়েছিল যখন আমার বন্ধুরা বলেছে আমি ভালো মানের প্লে বয় না। জানো তো এই ভার্সিটিতে তুমি সবচেয়ে আলাদা। সবসময় পড়া পড়া পড়া। এত এত ছেলেটা তোমার উপর লাইন মারার চেষ্টা করছে কিন্তু না। তুমি তো কাওকে পাত্তাই দিচ্ছিলে না। তারপর আমার বন্ধুরা বলল এই পড়াকু মেয়েটাকে পারলে প্রেমের জালে ফাসিয়ে দেখা তাহলে মানবো তুই নাম্বার ওয়ান প্লে বয়। তো আজ আমি প্রমাণ করলাম আমি সত্যি নাম্বার ওয়ান প্লে বয়।”
জানভি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধর প্রত্যেক কথা তার বুকে গিয়ে বিঁধছে। মনে হচ্ছে কেও বুক ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছে তার। স্নিগ্ধ হাসতে হাসতে টাকার বান্ডেল থেকে কিছু টাকা বের করে জানভির মাথার উপর ছেড়ে দিলো। টাকা বাতাসে ভাসতে ভাসতে জানভির আশে পাশে পড়ে গেল। জানভি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। স্নিগ্ধ মন খারাপ করে বলল-
“তোমাকে হার্ট করতে চাই নি জানু। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। আমি তো ভাবতেই পারি নি তুমি আমাকে এত বিশ্বাস করবে। তোমাকে অনেকেই আমার বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ দিয়েছিল কিন্তু তুমি তবুও বিশ্বাস করো নি। এতে কার দোষ বলো?”
জানভি কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে নিয়ে গিয়ে স্নিগ্ধর হাত ধরে বলল-
“মজা করছো তাই না? করে লাভ নেই আমি জানি তুমি এমন না।”
“না জানু, আমি সত্যি বলছি। আমাকে তারা ডেয়ার দিয়েছিল। তাই তো তোমার সাথে প্রেমের নাটক করতে হলো।”
“অনেক হলো স্নিগ্ধ, প্লিজ আর মজা করো না। আমি বললাম না আমি বিশ্বাস করি না তুমি এমনটা করতে পারো। চলো এখন আমাকে বাসায় ড্রপ করো।”
স্নিগ্ধ বিরক্ত হয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে বলল-
“তোমার চাকর না আমি। এই কয় মাস ডেয়ারের কারণে তোমার প্রত্যেক ন্যাকামো সহ্য করেছি কিন্তু আর না।”
“স্নিগ্ধ প্লিজ, থামো এখন। আমি বললাম তো আমি কখনো তোমাকে অবিশ্বাস করবো না।”
জানভির চোখ বেয়ে পানি পরলো। স্নিগ্ধ চোখ ফিরিয়ে নিলো জানভির কান্না দেখে। জানভি স্নিগ্ধর সামনে হাতজোড় করে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল-
“প্লিজ স্নিগ্ধ, আর মজা করো না। আমি সত্যি সহ্য করতে পারবো না এটা। তুমি প্লিজ বলো তুমি মজা করছো।”
স্নিগ্ধ জানভির দিকে তাকিয়ে বলল-
“যদি তোমাকে সত্যি ভালোবাসতাম তাহলে কখনো মজা করতাম না। তারা আমাকে ডেয়ার দিয়েছিল জানভি।”
জানভি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো স্নিগ্ধর দিকে। এতটা পাষাণ ছেলেটা কিভাবে হলো? জানভির মাথা কাজ করছে না। স্নিগ্ধ এক নজর জানভিকে দেখে তার বন্ধুদের নিয়ে হাঁটা ধরলো। জানভি ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধ কি সত্যি চলে যাচ্ছে? জানভি চিৎকার করে স্নিগ্ধর নাম ধরে ডাকলো। স্নিগ্ধ জানভির ডাক শুনে দাঁড়াল। কিন্তু পেছনে ফিরলো না। জানভি কিছু বলতে চায়। কিন্তু বলতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে কেও তার গলা চেপে ধরে রেখেছে। জানভির সাড়াশব্দ না পেয়ে স্নিগ্ধ পেছনে ফিরলো। জানভি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধ লম্বা নিশ্বাস ফেলল জানভিকে দেখে। জানভি কিছু ভাবতে না পেয়ে ঘুরে দৌড় দিলো। স্নিগ্ধ জানভির যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে। দৌড়াতে দৌড়াতে জানভি ভার্সিটি থেকে বের হয়ে গেল। স্নিগ্ধর হঠাৎ খুব খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে সে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু হারিয়ে ফেলল।
স্নিগ্ধ বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরলো। ভীষণ মনমরা লাগছে তার। বাসায় ফিরে পরিস্থিতি দেখে তার চোখ কপালে উঠে গেল। তার মা সোফায় বসে চিৎকার করে কান্না করছে। মায়ের পাশে বসে বার বার জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে কিন্তু মা জবাব দিচ্ছে না। বাবা গ্লাসে পানি নিয়ে এগিয়ে আসলেন। স্নিগ্ধ বাবাকে জিজ্ঞেস করায় বাবা বলেন স্নিগ্ধর নানার মৃত্যু হয়েছে। স্নিগ্ধ থমকে বসে রইলো। বাবা স্নিগ্ধকে বলল তৈরী হয়ে নিতে উনারা কলকাতা যাবেন। স্নিগ্ধর নানাবাড়ি কলকাতায়। বাবার কথায় স্নিগ্ধ মাথা নাড়াল। সন্ধ্যার মধ্যে তারা কলকাতায় যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিলো। যাওয়ার পথে স্নিগ্ধ শুধু জানভির কথা ভাবছিল। কেন যেন তার মন খুব ছটফট করছে। তার ইচ্ছে করছে একবার জানভিকে দেখতে। স্নিগ্ধ চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিলো।
৩ মাস পর…..
স্নিগ্ধ কলকাতা থেকে মুম্বাই চলে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই তার জীবনে যেন ঝড় এসে পড়েছে। বিপদের উপর বিপদ আসছে আর যাচ্ছে। আজ স্নিগ্ধ ও তার বাবা মা বাংলাদেশে ফিরেছে। স্নিগ্ধ দেশে ফিরে সর্বপ্রথম কল করলো তার বন্ধুদের। তার সর্বপ্রথম প্রথম ছিল জানভি কেমন আছে। কিন্তু তার বন্ধু বলল জানভি সেদিন পর থেকে আর ভার্সিটি আসে নি। স্নিগ্ধ ভয় পেয়ে গেল তার বন্ধুর কাছ থেকে এই কথা শুনে। জানভি ঠিক আছে তো? স্নিগ্ধ জানভির বাড়ির ঠিকানা জানে। সে দ্রুত জানভির বাড়িতে গেল। গিয়ে সে অবাক না হয়ে পারলো না। জানভির ফ্ল্যাটে তালা দেয়া। নিচের ফ্ল্যাটের মানু্ষদের জিজ্ঞেস করায় স্নিগ্ধ জানতে পারলো তারা সবাই দেড় মাস আগেই বাড়ি চেঞ্জ করে ফেলেছে। এই ফ্ল্যাটে এখন অন্য লোকেরা থাকে। স্নিগ্ধর মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। জানভিকে না দেখার পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না। স্নিগ্ধ বাসায় ফিরে আসলো। ভার্সিটির যাকে যাকে চিনে সবাইকে কল মেসেজ করে জানভির সম্পর্কে জানতে চাইলো। অবাক করার বিষয় সবাই বলল তারা কেও জানভি কোথায় জানে না।
কেেটে গেল আরো ১ সপ্তাহ। স্নিগ্ধ বাইকের উপর বসে সিগারেট খাচ্ছে৷ এই কয়দিনে সে ভালো মতো টের পেয়েছে ভালোবাসা কি। জানভিকে সে এই জীবনে না পেলে কখনো কাওকে এই জীবনে জায়গা দিবে না। স্নিগ্ধর বন্ধু দৌড়ে আসলো। স্নিগ্ধ তার বন্ধুকে দেখে বলল-
“হয়েছে কাজ?”
“হ্যাঁ, রাহুলের নাম্বার পেয়েছি।”
“তারাতাড়ি দে, আমি জানি ও জানে জানভি কোথায়।”
বন্ধুর হাত থেকে স্নিগ্ধ নাম্বার নিয়ে রাহুলকে কল করলো। ৩ বার রিং বাজার পর রিসিভ হলো।
“হ্যালো নমস্কার, কে বলছেন?”
“আমি কি রাহুলের সাথে কথা বলছি?”
“জি, আপনি কে?”
“রাহুল আমি স্নিগ্ধ।”
রাহুল স্নিগ্ধর নাম শুনে রেগে আগুন হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল-
“সাহস কি করে হলো কল করার?”
“রাহুল প্লিজ আমি ঝগড়া করতে চাই না। আমি একটা কথা জানতে চাই প্লিজ।”
“যার কথা জানতে চাও সে আর নেই। অনেক দূরে চলে গিয়েছে অনেক।”
“রাহুল প্লিজ মজা করো না। বলো আমাকে জানভি কোথায়।”
“বললাম তো সে এখন অনেক দূরে চলে গিয়েছে।”
“রাহুল”
স্নিগ্ধ ধমকের স্বরে তার নাম ধরে ডাকলো। রাহুল একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল-
“এড্রেস মেসেজ করছি।”
মোবাইলে এড্রেসের মেসেজ আসতেই স্নিগ্ধ উঠে দাঁড়াল। তার হাত পা কাঁপছে। জানভি কি সত্যি এখানে আছে? গিয়ে সর্বপ্রথম মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাইবে সে। বড্ড বড়ো বোকামি করে ফেলেছে। স্নিগ্ধ বাবা মাকে বলে গাড়ি নিয়ে দ্রুত বাসা থেকে বের হলো। রাহুলের পাঠানো এড্রেসে গেল। এলাকা থেকে ভীষণ দূর এই জায়গা। স্নিগ্ধ গাড়ি থেকে নেমে চারপাশে চোখ বুলালো। এই কেমন জায়গায় এসে পরলো সে? রাহুল কি ইচ্ছে করে তাকে এই জায়গার এড্রেস দিয়েছে? স্নিগ্ধ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে গেল। চারপাশ থেকে স্নিগ্ধ অবাক হচ্ছে। এখানে অনেক মানুষ রয়েছে। স্নিগ্ধ পাশ কাটাতে কাটাতে এগিয়ে গেল। বরাবর দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তারা সামনে থেকে একটা ছেলেকে এগিয়ে আসতে দেখে কাছে ডাকলো। স্নিগ্ধ তাদের ডাকে এগিয়ে গেল।
“কাওকে খুঁজছেন?”
স্নিগ্ধ তাদের মধ্যে একজনের প্রশ্ন শুনে চারপাশে চোখ বুলিয়ে উনাদের দিকে তাকাল।
“আমি আসলে বুঝতে পারছি না কোথায় আসলাম। জানভি আই মিন দেবজানি সরকার কি এখানেই থাকেন?”
“দেবজানি? জানেন আজ প্রথমবার কেও দেবজানির সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। নাহলে তো তার বাবা মা আর একজন বন্ধু ছাড়া কেওই আসে না। আপনি কি হোন তার?”
“আমি?”
স্নিগ্ধ আমতা আমতা করছে। তারা দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবার স্নিগ্ধর দিকে তাকাল।
“আমরা অচেনা কাওকে এলোও করি না। আপনার পরিচয় বলুন।”
“আমি দেবজানির ভার্সিটির বন্ধু হই। দেশের বাহিরে ছিলাম কিছু মাস। এসে শুনি ও না-কি শিফট হয়ে গিয়েছে অন্য বাসায়। এড্রেস এই জায়গার পেলাম।”
“আসুন আমার সাথে।”
তাদের মধ্যে একজন স্নিগ্ধকে সাথে নিয়ে গেল। স্নিগ্ধ বোকার মতো চারপাশ দেখছে। এখানে ছোটো বড়ো বয়সী অনেকেই আছে। কিন্তু এইটা কোন জায়গা বুঝতে পারছে না। বাহিরের সাইনবোর্ডেও কিছু লিখা ছিল না।
“ওইযে দেবজানি সরকার।”
স্নিগ্ধ সাথে সাথে সেখানে তাকাল। একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে পেছনে ফিরে। ড্রইং করছে দাড়িয়ে। চুল দেখে স্নিগ্ধ শিওর হলো মেয়েটা সত্যি জানভি। স্নিগ্ধ সাথের লোকটার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই উনাকে কেও ডাকলো। উনি স্নিগ্ধকে এখানেই দাঁড়াতে বলে চলে গেলেন। স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে ছটফট করছে। তার যে জানভির সাথে কথা বলা খুব জরুরি। অবশেষে ধৈর্য হারিয়ে ফেলল। দৌড়ে গেল জানভির দিকে। জানভি ড্রইং করতে করতে হঠাৎ তার মনে হলো কেও দৌড়ে আসছে এখানে। সে জুতার শব্দ পাচ্ছে। জানভি পেছনে ফিরতেই হঠাৎ কেও তাকে জড়িয়ে ধরলো। জানভি পাথরের মতো জমে গেল পরিস্থিতি দেখে। স্নিগ্ধর চোখ বেয়ে পানি পরছে। জানভিকে ছেড়ে চোখের পানি মুছে জানভির দিকে হাসিমুখে তাকাল।
“ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। কত শাস্তি দেয়ার দিও কিন্তু এখন আর দূর করছি না নিজের থেকে।”
জানভির শরীর শিরশির করছে রাগে। স্নিগ্ধ জানভির কাঁধে হাত রাখলো।
“তুমি ঠিক আছো জেনে আমার কতটা আনন্দ হচ্ছে বলে বুঝাতে পারবো না।”
জানভি দাঁতে দাঁত চেপে সজোরে স্নিগ্ধর গালে চড় মেরে দিলো। স্নিগ্ধ গালে হাত দিয়ে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। সে বুঝতে পারলো জানভি রেগে আছে। গাল থেকে হাত সরিয়ে বলল-
“ঠিক আছে যত মারতে মন চায় মারো। আমি তোমাকে থামাবো না। কিন্তু জান..”
স্নিগ্ধ এক কদম আগাতেই জানভি স্নিগ্ধকে ধাক্কা মেরে বলল-
“সাহস কি করে হলো আমার টাচ করার? লজ্জা লাগে না অচেনা একটা মেয়েকে টাচ করতে?”
স্নিগ্ধ যেন আকাশ থেকে পরলো জানভির কথা শুনে। অচেনা মেয়ে?
চলবে…..
[নতুন গল্প নিয়ে হাজির হলাম। ভুল ক্রুটি ধরিয়ে দেয়ার অনুরোধ রইলো।]