#অবাধ্য_প্রেম
#পর্ব_৩৪,৩৫,৩৬
#নন্দিনী_নীলা
৩৪
নিবিড় কে রেখেই আমি চায়ের ট্রে হাতে বাইরে চলে এলাম। সবাইকে চা দিয়ে ট্রে হাতে কিচেনে আসলাম রাখতে। তখনো দেখি নিবিড় কফি হাতে দাঁড়িয়ে আছে রান্নাঘরে। তিনি হয়তো জানতে আমি আবার আসবো। তাই ইচ্ছে করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি নিবিড় কে ইগনোর করে ট্রে হাতে চলে গেলাম ভেতরে। ট্রে রেখে পেছনে ফিরতেই দেখি নিবিড় আমার দিকে কফির মগটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কুঁচকানো চোখে কফির মগ টার দিকে তাকিয়ে নিবিড়ের মুখে দেখে তাকালাম।
কিছু বলতে যাব তার আগে নিবিড় বলে উঠলো, ‘ আমার বানানো কফি খেয়ে দেখ। এই স্বাদ তোমার মুখে লেগে থাকবে। তুমি তো কিপটা আমাকে এক কাপ চা খাওয়ানোর ভয়ে দরজা আটকে বসেছিলে। আমি তোমার মত না। নাও ধরো।’
আমি দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, ‘ হ্যাঁ আমি কিপটা। আমি কার ও টা খাইও না কাউকে দেয় ও না। এবার সরুন আপনার কফি নিয়ে। আমাকে জ্বালাতে আসবেন না। আপনি এমন অদ্ভুত ব্যবহার কেন করছেন সেটা আমার মাথায় আসছে না। এত ভাল বিহেভ করছেন কেন? আপনার মতলব কি সত্যি করে বলেন? হুট করেই আলগা রাগ করা মানুষটা এমন শান্ত স্বভাবের হয় কি করে?’
নিবিড় ঠোঁটে রহস্যময় হাসি এনে বলল,, ‘মগ টা ধরো, খেতে খেতে নয় চিন্তাভাবনা করে বের করো।’
আমি অবজ্ঞা স্বরে বললাম, ‘ আমার তো খেয়ে দেয়ে কাজ নাই আপনাকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে সময় নষ্ট করব।’
নিবিড় জোর করে আমার হাত টেনে কফির মগ ধরিয়ে চলে গেল। আমি হাঁ করে নিবিড়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। লোকটা এত জেদি উফফ কি বলবে জোর করে কফি আমাকে দিয়ে গেল ফাজিল লোক।
কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে আছি কি করবে এখন এই কফি। এটা ফেলে দেব? ধুর ভাল্লাগে না। যতই হোক এটা খাবার তো এটা নষ্ট করব। নিবিড়ের জিনিস আমি কেন খেতে যাব? নিবিড় এটা আমাকে কেন দিল।
আকাশ পাতাল ভেবে কোন দিশা না পেয়ে কফি মগ ঠোঁটের কাছে এগিয়ে নিলাম। অস্বস্তি নিয়েই এক চুমুক দিলাম মগে। মুখে দিয়ে এর স্বাদ পেলাম আসলেই ভালো হয়েছে। আমার মুখ থেকে তৃপ্তি স্বরে বেরিয়ে এলো…. – বাহ দারুন তো। নিবিড় দেখছি ভালোই এক্সপার্ট কফি করতে।
আমি আরেক চুমুক দিতে মগটা মুখের কাছাকাছি নেব তখনি ঝড়ের বেগে ছুটে এলো নিবিড় আর আমার হাত থেকে এক প্রকার কেড়ে নিল মগটা। আচমকা কান্ড দেখে আমি চমকে উঠলাম। বিহ্বল চোখে নিবিড়ের দিকে তাকালাম। এটা কি হলো? আমার বোধগম্য হচ্ছে না। নিজে সেধে দিল আবার নিজেই কেড়ে নিল এটা কেমন ভদ্রতা?
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ‘ আপনি কফি কেড়ে নিলেন কেন?’
নিবিড় বলল, ‘ সো সরি এটা আমার। আমি ভুলে আমার টা তোমাকে আর তোমার টা আমি নিয়ে গেছিলাম। তাই চেঞ্জ করতে আসছি।’
আমি রাগ সংবরণ করে বললাম, ‘ তাই বলে এমন করে কেড়ে নিবেন। এজন্য আমি নিচে চাইনি আপনার জিনিস। জোর করে দিয়ে এখন কেড়ে নিচ্ছেন।’
‘ তুমি ভুল বুঝছো। এমনটা না।’
‘ আচ্ছা মানলাম তাই বলে চেঞ্জ করতে এসে কাড়াকাড়ি করবেন। আম–
আমার কথা থেমে গেল নিবিড় আমার চুমুক দেওয়া কফিতে অনবরত চুমুক দিচ্ছে। আমি যে পাশ দিয়ে চুমুক দিয়েছি সেই পাশ দিয়েই দিচ্ছে। আমার গলা শুকিয়ে এলো। বুক ধুকপুক করছে।
নিবিড় শান্ত গলায় বলল, ‘ কেড়ে নিয়েছিল কারণ তুমি চুমুক দিতে চেয়েছিলে। কেড়ে নেওয়ায় দিতে পারো নি।’
বলে নিজের হাতের কফি আমার হাতে দিয়ে আমার খাওয়া কফি খেতে খেতে চলে গেল নিবিড়।
আমি হতবুদ্ধি চোখে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। এই কফি আর আমি খাব না। মস্করা পেয়েছে নাকি। আমি কফি ফেলে দিলাম। তারপর গাল ফুলিয়ে বেরিয়ে এলাম। তাহমিনা আপু আমাকে টেনে নিজের রুমে নিয়ে গেল। আর আমার হাতে একটা ব্যাগ দিয়ে বলল, ‘ এটা তোর জন্য। রাফসান এনেছে।’
আমি অবাক গলায় বললাম, ‘ কি আছে?’
‘তোর জন্য দুইটা শাড়ি। রাফসান নিজে পছন্দ করে এনেছে।’ বলেই মিষ্টি করে হাসলো।
‘আমি এটা নিতে পারব না। আমার হলুদ শাড়ি আছে। আমি সেটাই পরব। এসব আমাকে দিও না।’ আমি নিতে না চেয়ে বললাম।
তখন রাফসান কাকা এলো রুমে আর আমার কথা শুনে বলল, ‘ ছোঁয়া তোমার জন্য আজ আমি তাহু কে পাচ্ছি। তুমি হেল্প না করলে তাহু কে আমি মানাতে পারতাম না। আজ আমাদের বিয়েটা হচ্ছে তোমার জন্যেই। আমি অনেক ভালোবেসে এই সামান্য জিনিস তোমার জন্য এনেছে। এটা না নিলে আমি খুব কষ্ট পাব।’
‘ আমি আবার কি করলাম। আপু আপনাকে ভালোবাসে তাই ফিরে এসেছে। এই সব কিছু আপনাদের ভালোবাসার জন্য হচ্ছে।’
‘ তোমাকে এটা নিতেই হবে।’
আমি পরলাম মুসিবতে। কাকা আমাকে না দিয়ে ছাড়বেই না। এটা নিতেও ইচ্ছে করছে না, আবার এমন কথা বলছে না নিয়েও পারছি না। রীতিমতো ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করেছে। অবশেষে আমি হার মানলাম।
ব্যাগ উপরে রেখে এসে ব্রেকফাস্ট করলাম সবাই এক সাথে। মাহিকে দেখলাম সেই মেয়েটার সাথে বসে খাচ্ছে। ওই মেয়েটার নাম এখনো আমি জানি না। মেয়ে আমার দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে আছে। এই রাগের কারণ আমি জানি নিবিড় আমার পক্ষ নিয়েছিল বলে। মেয়েটা মাহিকে আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন জিজ্ঞেস করছে। আমি নিশ্চিত আমার সম্পর্কে জানছে।
লিহান ফট করে আমার পাশে বসে বলল, ‘ গতকাল রাতে তুমি নিবিড়ের সাথে রুমের ভেতরে কি করছিলে?’
আমি চমকে উঠে বললাম, ‘ নিবিড় আমার রুমে থাকবে কেন? কি বলছো?’
লিহান বলল, ‘ আমাকে তাড়িয়ে দিলে মিথ্যা বলে। আমি তো আগে দেখেছি রুমে তুমি আর নিবিড় কি যেন গল্প করছিলে। কিন্তু আমাকে যেতে দিলে না।’
আমি শুকনো ঢোক গিলে কাঁচুমাচু মুখে করে লিহানের দিকে তাকিয়ে আছি। কি বলব বুঝতে পারছি না। লিহান নিবিড় কে আমার রুমে দেখে নিয়েছে আমি তো বুঝতেই পারি নি। কি সর্বনাশ! ও তো রঙ কিছু ভাববে এখন। সব দোষ ওই নিবিড়ের।
আমি আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাব তখন নিবিড় আর আবির আমার টেবিলে এসে বসল চেয়ার টেনে। আমি রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি নিবিড়ের দিকে।
আবির বসেই লিহান কে বলল, ‘ ব্রো তোমার প্লেট কই। খাবার ছাড়া খাবার টেবিলে বসে আছো কেন?’
লিহান বলল, ‘ আমি খাওয়া শেষ করে এসেছি।’
‘ ওহ তা ভাবির সাথে কি কথা বলছিলে ব্রো?’
আমি ও লিহান দুজনেই চোখ কপালে তুলে আবিরের দিকে তাকালাম। আবির আমাকে ভাবি বলে ইশারা করে জিজ্ঞেস করেছে। আমি তো বিষ্ময় এ হতভম্ব। এই পোলা বলে কি?… আমি ওর কোন কালের ভাবি?
আমি রাগে গজগজ করতে করতে বললাম, ‘ এই আমি তোমার কোন কালের ভাবি? আমাকে ভাবি বলছো কেন?’
লিহানের মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না ও নিবিড়ের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে। নিবিড় আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তা দেখে লিহান কিছু সন্দেহ করছে। আর আমি আবিরের সাথে তর্ক বিতর্ক করছি।
এইদিকে মাহি আর ওই মেয়েটাও আমাদের কাছে এসে দাঁড়ালো।
মাহি এসেই বলল, ‘ সবাই এখানে কি করছো?’
নিবিড় বলল, ‘ খাচ্ছি চোখে দেখিস না।’
মাহি বলল, ‘ ভাইয়া রত্না আপু বলল তোমার সাথে নাকি কি কথা বলবে।’
নিবিড় রত্না মানে যে মেয়ে আমার সাথে ঝগড়া করেছিল তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ বল’
রত্না বলল, ‘ ব্রো এদিকে আয়। ওদের সামনে বলব না।’
নিবিড় বলল, ‘ তাহলে পরে বলিস। এখন কোথাও যেতে পারব না।’
রত্না অভিমানী গলায় বলল, ‘ এই মেয়ের সাথে বসে খাচ্ছো কেন? আমাদের টেবিলে এসে বসো।’
নিবিড় রেগে গিয়ে বলল, ‘ তুই এখান থেকে যাবি?’
ধমক খেয়ে রত্না আর মাহি দৌড়ে পালিয়েছে।
আমি এতজন আসা যাওয়া আর রং ঢং দেখতে দেখতে খেতেই পারলাম না। এতো গুলো ছেলের সামনে বসে কি খাওয়া যায় আমি প্লেট হাতে উঠে দাঁড়ালাম তারা দেখে আবির বলল , ‘ কই যাও আপু?’
আমি বললাম, ‘ খেতে যাই’
আবির বলল, ‘ এখানে বসেই খাও। কোথায় যাও?’
‘তোমাদের যন্ত্রণায় কি আমি খেতে পারব? আমাকে না জ্বালিয়ে তো তোমরা দুই ভাই স্বস্তি নেবে না। তোমরাই থাকো আমি যাই।’ দাঁতে দাঁত চেপে বলে চলে এলাম বিরক্তিকর মুখে।
#চলবে…..
#অবাধ্য_প্রেম
#পর্ব_৩৫
#নন্দিনী_নীলা
আমি নিজেই লিহানকে চারপাশে খুজছি। সকালের পর আর ওর দেখা পেলাম না। তখন আমি লিহান কে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না ও কেন গিয়েছিল। নিবিড় আর আবির কে দেখে তো আমি রেগেই সেখান থেকে চলে এসেছিলাম।
তারপর বাকিটা সময় আমার কেটেছে তাহমিনা আপুর সাথেই আপু আমাকে তার রুমে নিয়ে রেখেছিল। এত আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে আপুর নাকি খুব আনইজি লাগে। এজন্য বলছিল তুই বাসার কি কাজ ধরেছিস। এগুলো রেখে আমার সাথে থাকতো এই এত মানুষের দৃষ্টি আর এত মানুষের কথাবার্তা আমার ভালো লাগেনা। আমি সব সহ্য করছি সব করছি তো আপুর জন্য ই। তাহমিন আপুকে আমি নিজের বড় বোনের মত ভাবি। নিজে বোনের বিয়ে এজন্য আমি সবকিছু নিজে হাতে করার চেষ্টা করছি। যাকে হ্যাপি রাখার জন্য এসব করছি সেই যদি এসব হ্যাপি না থাকে তাহলে আর এসব করে আমার লাভ কি। সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে আমি আপুর সাথে বসে গল্প করছিলাম আর আপুর মন ভালো করার চেষ্টা করছিলাম। আপুর মনটা ভালো নেই আমি জানি আপু মনে মনে খুব দুশ্চিন্তায় আছে। অনেকে আপুকে নিয়ে রং কথা বলছে। এই বিয়েটা নিয়ে। আপুকে ডিপ্রেশন থেকে বের করে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করলাম। অনেক মজার মজার গল্প বললাম। আপুকে হাসিয়ে তারপরেই তাকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে আমি রুম থেকে বেরিয়ে লিহানকে খুঁজছি।
এই দুপুরবেলা কোথায় গেছে কে জানে। আমিও উপরে এসে গোসল করে নিলাম। খোলা চুলে আমি রুম থেকে বেরিয়ে ছাদের একখান দাঁড়িয়ে আছি। আকাশ মেঘলা সকাল থেকে আর বৃষ্টি হয়নি মনে হচ্ছে বিকেলে বৃষ্টিটা নামবে। গরম ছেড়েছে খুব। আকাশে মেঘের ছোটা ছুটি চলছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। মেঘ ঘুরুম ঘুরুম করছে। ছাদে এখন কেউ নেই বাগানে কয়েকজন বসে আছে প্যান্ডেলে বাচ্চারা। আর সবাই চলে গেছে গোসল করতে গোসল করে সবাই সাজগোজ করবে। পার্লারের লোক চলে এসেছে আপুর গোসল শেষ হলেই সাজানো শুরু হবে। আমি চুল হালকা শুকিয়ে খোপা করে নিচে আসলাম তখনই আমার লিহানের সাথে দেখা হলো।
আমি লিহান কে দেখেই ডেকে উঠলাম, ‘ এই লিহান! কোথায় ছিলে? সেই কখন থেকে তোমায় খুজতেছি?’
লিহান দাঁড়িয়ে পরে বলল, ‘ বাবা মাকে আনতে গেছিলাম। নিয়ে আসলাম এখন। কেন খুঁজছিলে কেন?’
আমি কাছে এসে বললাম, ‘ ও আচ্ছা! কোথায় তোমার বাবা-মা?’
‘ তাহু আন্টির রুমে।’ তাহমিনা আপুর রুমে দেখিয়ে বলল।
‘ ওহ শোনো যেখানে আমি তোমাকে খুজছিলাম। তুমি গতকাল রাতে আমার কাছে কেন গিয়েছিলে?’
‘গিয়েছিলাম একটা দরকারে। ‘
আমি বললাম, ‘কি দরকার সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি! বলো..!!’
‘ এখন আর প্রয়োজন নাই সেটা বলার। কাজ হয়ে গেছে তোমাকে যে জন্য খুঁজছিলাম। তুমি তো মিথ্যা বলে আমার কথাটাই শুনলে না।’
আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, ‘ আসলে নিবিড় এর সাথে আমি না বিয়ে নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছিলাম। নিবিড় বলেছিল এখন যাতে কেউ না আসে। এজন্য তুমি যখন গেলে ও তোমাকে আলোচনা নিতে চাইনি। এজন্য আমি তোমাকে মিথ্যা বলেছিলাম সরি।’
লিহান বলল, ‘ ইটস ওকে। আমি গোসল করব বাই।’
আমি নিচ তলায় এসে দেখি নিবিড়ের দুই মামি ফল, মিষ্টি নিয়ে বসে আছে। হলুদের জন্য যে ফল দিয়ে নানান জিনিস বানিয়ে সাজানো হয় সেইগুলো বানাচ্ছে। কিন্তু সুন্দর হচ্ছে না আমি তাদের পাশে গিয়ে সোফায় বসে দেখতে লাগলাম তাদের বানানো। তরমুজ কেটে ফল দানি বানানোর চেষ্টা করছে পারছে না। কেটেকুটে একটা তরমুজি নষ্ট করে ফেলল তা দেখে আমি বললাম, ‘আপনাদের সমস্যা না থাকলে আমি বানিয়ে দিতে পারি। আমি প্রায়ই সবই বানাতে পারি।’
এদের বলতে দেরি দুজনের সবকিছু ছেড়ে ছেড়ে উঠতে দেরি হলো না। খুশিতে গদগদ হয়ে দুজনেই সরে বসে আমাকে বসতে বললাম আমি বসলাম। দুই অকর্মা কিছু পারে না সবকিছু আমাকে বানাতে হলো। ঠিক দুই ঘণ্টা বসিয়ে আমাকে দিয়ে ইনারা ১০ রকমের আইটেম বানালো। বসে বানাতে বানাতে আমার কোমর ব্যথা হয়ে গেছে। আমি কাঁদো কাঁদো মুখ করে বসে আছি। তারা কখন আমাকে ফেলে চলে গেছে তাদের নাকি এখন শাড়ি পড়তে হবে অনুষ্ঠানের জন্য সাজতে হবে। পাঁচটা বেজে গেছে বানাতে বানাতে আমি এখানে এসেছিলাম তিনটায়।
কোথা থেকে নিবিড় এসে ঠাস করে আমার বসে পরল। আর আমার সামনে থাকা আনারসের গায়ে লাগানো মিষ্টি টান দিয়ে নিজের মুখে পড়ে নিয়ে সব কিছুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ বাহ সুন্দর হয়েছে তো। এই সব কি তুমি একা সাজিয়েছ?’
আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, ‘আমি ছাড়া কি এখানে আর কাউকে দেখতে পাচ্ছেন? আমি বানিয়েছি বলেই তো আমার এই অবস্থা দেখতে পাচ্ছেন না এখন আমি উঠতে পারছি না হাত পা আমার ব্যথা হয়ে গেছে। এত মায়া দয়া হীন মানুষ হয় আগে জানতাম না। কি সুযোগ সন্ধানী আপনার দুই মামী আমাকে ফাঁসিয়ে রেখে দুজনেই ভেঙ্গেছে। এত মানুষের এলো গেল একটু সাহায্য করল না। এত ফল আমাকে দিয়ে কাটালো, সাজালো। কি নির্দয় ফ্যামিলিরে বাবা! ঠিক আপনার মতো! আপনার মনটাও যেমন নির্দয়। আর এই ফ্যামিলির সব মানুষের মন ও আপনার মত পাষাণ। খালি কাউকে পেলে হয়েছে সব কাজ তার মাথার উপর ছেড়ে সবাই পালিয়ে যায়।’
নিবিড় আমার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে এবং আমার কথাগুলো খুব মনোযোগ সহকারে শুনছে। আমি নিবিড় কে অদ্ভুত চাহনিতে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে দেখে বিরক্ত হলাম।
আমার বিরক্তি আর রাগটা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিবিড়ের এই কাজটা যথেষ্ট ছিল।
নিবিড় একটা আঙ্গুর তুলে আমার দিকে ধরে বলল,’আঙ্গুর খেয়ে মাথা ঠান্ডা করো।’
প্রচন্ড রাগ হচ্ছে আমার মন চাচ্ছে নিবিড়ের মাথায় এই আনারস দিয়ে একটা বাড়ি মারি। আমি জ্বলন্ত চোখে তাকালাম নিবিড়ের দিকে।
নিবিড় আমার চোখের দিকে দৃষ্টি ফেলে বলল, ‘ রাগলে তো তোমায় দারুন লাগে, আই এ্যাম ক্রাশিত। রাগী রাগী চোখ দিয়ে আমায় ইমপ্রেস করার চেষ্টা, তাই না? ধরো আঙ্গুর খাও রাগ কমাও।’
আমি নিবিড়ে দুই আঙুলের ভেতর থেকে আঙ্গুরটা টেনে নিজের হাতে নিলাম। তারপর সেইটা নিবিড়ের মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম।
‘আপনি বসে বসে খান। আজকে আপনার ও গায়ে হলুদ হবে। এগুলো আপনাকে ও সবাই মিলে খাওয়াবো।’
নিবিড় আমার দিকে চেয়ে অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘ তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে আজকেই হলুদ সন্ধ্যা করে ফেলব।’
‘ দেখুন এমনিতে আমার মেজাজটা গরম আছে। আপনি আমার সাথে এখন ইয়ার্কি করতে আসবেন না। যান তো এখান থেকে আমাকে বিরক্ত করবেন না।’
নিবিড় উঠে আমাকে ও টেনে উঠিয়ে বলল, ‘ যাও সাজগোজ করে রেডি হয়ে নাও। সবাই তো অলরেডি রেডি হয়ে গেছে মনে হয়। তোমার ভাব সাব দেখে মনে হচ্ছে এখানে বসে থাকবা আজকে।’
আমি নিবিড় কে কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। চলে এলাম তাহমিনা আপু রুমে তাকে দেখে তো আমি গালে হাত দিয়ে তাকে সুন্দর লাগছে। হলদে রঙের কাতান গোলাপি পাড় এর শাড়ি পড়েছে সুন্দর করে সাজিয়েছে আপুকে দারুন লাগছে। আমি দরজার কাছে থেকে আপুর দিকে তাকিয়ে আছি। ভেতরে আপুর সাথে ছবি তুলছে অনেকেই। সব মেয়েরাই শাড়ি পড়ে একদম সাজুগুজু করে আছে। আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখছিলাম তখনই মাইশা এসে আমার পেছনে দাঁড়ায় আর বলে ওঠে,, ‘ এক্সকিউজ মি! সাইড প্লিজ।’
আমি চমকে পেছনে তাকাতেই দেখলাম মাইশা শাড়ি পড়ে গর্জিয়াস লুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই মাইশা এক প্রকার নাক সিটকালো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল, ‘ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছো কেন সরো। তোমার যন্ত্রণায় দেখি রুমের ভেতরেও ঢুকতে পারবো না।’
আমি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম মাইশা আমাকে ভেংচি কেটে ভেতরে চলে গেল।
#চলবে….
#অবাধ্য_প্রেম
#পর্ব_৩৬
#নন্দিনী_নীলা
আমি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম মাইশা আমাকে ভেংচি কেটে ভেতরে চলে গেল।
সবার মাঝে নিজেকে কেমন তুচ্ছ লাগতেছে। সবাই একদম ফিটফাট। সবাই আমার দিকে এমন নজরে তাকাচ্ছে মনে হয় আমি এলিয়েন। তাই আমি সেখান থেকে চলে এলাম উপরে। এখানে এসে আমি আরো মানুষ দেখতে পেলাম। ছেলে মেয়েরা ছাদে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন এঙ্গেলে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। এক ছেলে এক মেয়ে একদম জরাজরি করে ছবি তুলছে। আমি হা করে কতক্ষণ সবার ভাব ভঙ্গি দেখে রুমে চলে গেলাম। মন চাচ্ছে রুমের ভেতরেই বসে থাকি ।
আপু যে ব্যাগ টা দিয়েছিল সেই ব্যাগটা এখনো খুলে দেখিনি। দুইটা শাড়ি বলেছিল এখন ব্যাগটা খুলে একটা হলুদ সিল্ক জামদানি শাড়ি আরেকটা মেরুন কালারের কাতান শাড়ি। এত আশা করে দিয়েছে না পারলে তাদের অপমান করা হবে। নিচে যেহেতু আমাকে যেতেই হবে তাই শাড়িটা পড়ে নিলাম। শাড়িটা পরে চুল কিভাবে বাধবো সেটা ভাবনা চিন্তা করতে করতে চুল খোলাই রাখলাম। সবাই কতো সাজগোজ করেছে তাদের মাঝে আমাকেই বেমানান লাগবে। আমি চাইলেও এতো সাজতে পারব না। অত সাজগোজের জিনিস আমার আছে নাকি। তাও নিজের যা আছে সেই দিয়েই কাজ চালিয়ে নিলাম। আমার কাছে পিংক কালার একটা লিপস্টিক ছিল ওইটাই দিলাম, কপালে কালো টিপ, কানে গোল্ডেন কালার ঝুমকা গলায় কিছু দিলাম না। যাইহোক চুড়ি পরলাম এক হাতে গোল্ডেন কালারের। আমার একটা ছোট আয়না আছে সেটাতেই নিজেকে দেখছি। হলুদ কালারে আমাকে মোটেই ভালো লাগছে না। আমার গায়ের রং শ্যামলা বর্ণের, আমাকে এই কালারটাই আরো কালো দেখা যাচ্ছে।
মন চাই এখন শাড়ি খুলে বসে থাকি। বাইরে যারা এসেছি সবাই যে ফর্সা তা কিন্তু নয় আমার থেকে অনেক কালো আছে, আমার মতনও আছে আবার অনেকে সুন্দরও আছে। কিন্তু তাদের সবাইকে একই রকম দেখা যাচ্ছে। কারণ সবাই এতো এতো মেকআপ করেছে যে সবাইকেই ফর্সা লাগছে।
আমি চুল কানের পেছনে গুজতে গুজতে বেরিয়ে এলাম। ছাদে যারা ছিল সবাই আমার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। আমি নিচে চলে এলাম অনুষ্ঠান শুরু হবে এবার। নিচে এসে তো আমি নিবিড়ের মাকে আর নিবিড়ের চাচীকে দেখেছি চোখ কপালের তুললাম। তাদের সাজ দেখে আমার অবস্থা কাহিল। নিবিড়ের আম্মুকে এখন এই পোশাক দেখে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না যে তার দুইটা ইয়া বড়ো বড়ো ছেলে আছে। মাহি দেখতে পেলাম শাড়ি পড়ে নাই। হলুদের সাথে সবুজ মিক্সড করা লেহেঙ্গা পরেছে একদম পুতুলের মত লাগছে। দুজন মেয়ে তাহমিন আপুকে ধরে নিয়ে আসছিল স্টেজে নিয়ে যাবার জন্য আপু আমাকে দেখে কাছে ডাকলো আমি যেতেই বলল, ‘ কই ছিলি সে কখন থেকে তোকে খুজছি। সবাই এমন ভাবে জেঁকে ছিল যে জন্য আমি বেরিয়ে দেখতেও পারলাম না তোকে। বলেছিলাম না আমার সাথে এসে সাজবি।’
আমি হাসিমুখে বললাম, ‘আমি একা সেজেছি। ওখানে গিয়ে তোমার ঝামেলা বাড়ায়নি। দেখতো আমাকে কেমন লাগছে!’
‘ খুব মিষ্টি লাগছে। আমাকে নিয়ে চল এবার।’
‘আছে তো লোক অনেকে তাদের সাথে যাও। আমি তো আছি আশেপাশে সমস্যা নাই।’
‘ কিন্তু…
নিবিড়ের আম্মু এসে আপুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
আমি তাকে দেখেই সেখানে থেকে চলে গেলাম। উনি আমাকে ফাঁসিয়েছেন তাই উনাকে আমার একটুও পছন্দ হয়না। আমি বিরবির করে বাগানের দিকে যাচ্ছিলাম। ঠাস করে ধাক্কা খেলাম কারো সাথে তাকিয়ে দেখি এক পোলা ঘাসের উপর বসে দাঁত কেলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছি এতো জোরেই কি ধাক্কা লেগেছে নাকি যে লোকটা নিচেই বসে পরেছে ?
আমি সরি বলতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু লোকটার দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে থাকা আমার একদম পছন্দ হলো না। আমি সরি বলা বন্ধ করে বিরক্তিকর কন্ঠে বললাম, ‘ সমস্যা কি? এমন ছাগলের মতো দাঁত কেলিয়ে আছেন কেন?’
লোকটা কোন কথাই বলল না। হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । মন চাচ্ছে চোখ দুটো গালিয়ে দিতে।
আমি আরো হাই হ্যালো দুই একটা কথা বলে সেটা সামনে থেকে চলে এলাম পাগল ছাগল কোথা থেকে এসেছে কে জানে। না উওর দিল আর না বসা থেকে উঠল। ওইভাবেই বসে হা করে তাকিয়ে আছে।
.
এদিকে নিবিড় ওর কাকার পাশেই ছিল। নিচু হয়ে কানে কানে কাকাকে বলল, ‘ কাকা জানো এই সব কিছু ছোঁয়া একা নিজের হাতে সাজিয়েছে।’
কাকা বলল, ‘ বাহ মেয়েটার অনেক গুণের তাই নারে।’
নিবিড় কে হঠাৎ আবির টেনে নিচে নামিয়ে নিয়ে এলো। নিবিড় আবিরকে ধমক দিয়ে বলল, ‘ থাপ্পর খাবি কিন্তু এখন আমাকে জ্বালালে।’
‘ উফফ ভাইয়া আসো তো তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।’ নিবিড়ের হাত টেনে ধরে বলল।
‘ হাত ছাড় তো। আমি এখন কোথাও যেতে পারবো না। আর কিসের সারপ্রাইজ, দেখছিস না! আমি কাকার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিলাম!’
‘সেটা থেকেও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আমি তোমাকে দেখাবো। একটু পরে তো হা করে তাকিয়ে থাকবে আর আমাকে থ্যাংক ইউ বলবে।’
আবির টেনে এনে নিবিড় কে ছোঁয়ার দিকে ইশারা করলো। নিবিড় ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে থমকে যায়। আচমকা ওর হেঁচকি উঠে যায়।
আবির ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘ কি হলো ভাইয়া? ভাবির এই রূপ দেখে কি হেঁচকি উঠে গেল।’
নিবিড় মাথা নেড়ে স্বীকার করল। আর পানি চাইল।
আবির পানি এনে দিল। নিবিড় পানি খেয়ে বলল, ‘ এই মেয়ে দেখি আমারে মেরে ফেলতে চায়।’
আবির চলে গেল। নিবিড় ছোঁয়া মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। এখানে উপস্থিত সব মেয়েদের তুলনায় ছোঁয়া সাধারণ হলেও ওর দৃষ্টিতে ছোঁয়া সব চেয়ে সুন্দরী নারী। যার এই রুপ দেখে নিবিড় থমকে গেছে। ওর কপালে ঘাম জমে উঠেছে, কেমন এলোমেলো লাগছে। শাড়ি ওকে কে পরতে বলেছে? নিবিড় তো নিজের দৃষ্টি সরাতেই পারছেনা এইভাবে পাগল করতে চায় নাকি ওকে।
ছোঁয়া সবার থেকে দূরে আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আশার সাথে। নিবিড় চেয়ে রইল কতোক্ষণ তারপর চোখ সরিয়ে অন্য দিকে চলে গেল মা ডাকছে হলুদ দিতে। নিবিড়ের আসতে মন চাইল না। ওর মন চাইছে শুধু ছোঁয়ার দিকে চেয়ে থাকতে।
কাকা আর কাকিকে হলুদ লাগিয়ে ও হাতে একটু হলুদ নিয়েই চলে এলো স্টেজ ছেড়ে।
সবার দেওয়া হতে আমি সবার শেষেই হলুদ ছোঁয়াতে গেলাম। আমার দিকে তো আপু চোখ রাঙিয়ে তাকালো আমি তার কাছে একবার আসে নি এজন্য। আর আমি আসতাম কি করে নিবিড়ের ছোট চাচী তো আমাকে এখানে আসার পরেই বলেছে তোমার কি জন্য স্টেজের আশেপাশে না দেখি। খুব যে একটা আসার ইচ্ছা ছিল তা না কিন্তু উনার কথাই খুব কষ্ট পেয়েছি এজন্য আর আসি নাই।
স্টেজ থেকে নামতে কে যেন আমার হাত ধরে টেনে এক পাশে নিয়ে এলো। আলো ছেড়ে অন্ধকারে চলে এসেছি। আমি অন্ধকারেও নিবিড়কে চিনে ফেললাম।
‘কি অসভ্যতামি হচ্ছে আপনি আমাকে টেনে এখানে নিয়ে আসলেন কেন?’
‘তোমাকে একটা জিনিস দিতে নিয়ে আসলাম। এখানে অসভ্যতামির কি পেলে? আসো একটু অসভ্যতামি করে না হয় এটা শুনি!’
‘কি দিতে?’ অবাক গলায় বললাম। এই অন্ধকারে টেনে আমাকে কি দেওয়ার জন্য নিয়ে আসলো। কোন শয়তানি মতলব আঁকছে না তো এই নিবিড়।
আমার বলতে দেরি হলো আর নিবিড়ের ফট করেই নিজের হাত উঁচু করে ভেজা ভেজা কিছু আমার দু গালে লাগিয়ে দিতে দেরি হলো না। আমি তো গালে হাত দিয়ে হা।
অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না কি। আমি রাগী গলায় বললাম, ‘আমার গালে কি দিলেন?’
‘তোমার গালেই তো আছে আয়নার সামনে গিয়ে না হয় দেখো।’
আমি আন্দাজ করে নিলাম এটা হলুদ ই হবে আমি নিজের গালে থেকে নিয়ে নিবিড়ের গালেও লাগিয়ে দিলাম।
‘যান আপনাকেও লাগিয়ে দিলাম এবার আপনি আয়নায় গিয়ে দেখুন। অসভ্য বেহায়া লোক।’
রাগে গজগজ করতে করতে আমি নিবিড়ের সামনে থেকে চলে এলাম।
নিবিড়….
#চলবে….