অবাধ্য_মন,পর্ব_১০ (শেষ পর্ব)

0
1631

#অবাধ্য_মন,পর্ব_১০ (শেষ পর্ব)
#শোভা_আক্তার(লাভলী)

উদ্ধারের কাজ ২ ঘন্টা ধরে চলছে৷ আশে পাশে শুধু কান্নার শব্দ ভাসছে। যারা আহত হয়েছে তাদের অবস্থা খুব খারাপ। অর্পিতাদের বাসার সকলে এসেছে খবর পেয়ে। পাশের হাসপাতালে সব আহত ব্যক্তিদের রাখা হয়েছে। রঞ্জন মাটিতে বসে আছে। তার চোখের সামনে বার বার বাস ও ট্রাকের এক্সিডেন্টের মুহূর্ত ভাসছে। জানভির অবস্থাও তেমন ভালো না। যখন এক্সিডেন্ট হয়েছে জানভি বাস থেকে কিছুটা দূর ছিলো। লোকজনের ধাক্কায় জানভি ছিটকে পড়েছিল৷ শুধু তাই না ট্রাকের চাকা ভেঙে এসে জানভির মাথায় এসে লেগেছিল। স্নিগ্ধকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। তার চিকিৎসা চলছে এখন৷ সবার সাহায্য করতে গিয়ে রঞ্জনও ব্যাথা পেয়েছে হাতে। কিছুক্ষণের মধ্যে জানভির বাবা মা আসলেন। রঞ্জনকে মাটিতে বসে থাকতে দেখে উনারা দৌড়ে এসে রঞ্জনের সামনে দাঁড়াল। রঞ্জন উনাদের পা দেখে মাথা তুলে তাকাল। রঞ্জনের চোখ ভর্তি জল দেখে জানভির বাবা ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসলেন। রঞ্জন মাথা নিচু করে বলল-
“ক্ষমা করবেন আংকেল। পারি নি আপনার মেয়ের রক্ষা করতে। সে খুব ব্যাথা পেয়েছে।”
“রঞ্জন, নিজেকে দোষারোপ করো না। আমি জানি তুমি কেমন। বাহিরে দেখলাম স্নিগ্ধর বাবা মা-ও এসেছে। সে কেমন আছে?”
রঞ্জন জানভির বাবার দিকে তাকিয়ে বলল- “সে ভালো নেই। নিজের প্রাণের পরোয়া না করে সে আপনার মেয়েকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে। আংকেল, আপনি বলেছিলেন স্নিগ্ধ দেবজানির জীবনে থাকলে দেবজানির ক্ষতি হবে। কিন্তু না, স্নিগ্ধ দেবজানির সাথে ছিল বলে দেবজানির ভয়ংকর ক্ষতি হতে হতে বেঁচেছে।”
জানভির বাবা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তখনই স্নিগ্ধর বাবা মা দৌড়ে আসলেন। জানভির বাবা দাড়িয়ে গেলেন তাদের দেখে। স্নিগ্ধর বাবা এক নজর তাদের দেখে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। রঞ্জন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। স্নিগ্ধর বাবা রঞ্জনের দিকে দ্রুত হেটে এসে বললেন- “তুমি রঞ্জন তাই না?”। রঞ্জন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। মা কান্না জড়িত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন- “স্নিগ্ধ এখন কেমন আছে?”
“ভালো নেই। ডক্টর বলেছেন স্নিগ্ধর খুব বেশী রক্ত ঝরেছে।”
স্নিগ্ধর বাবা রাগে গজগজ করতে করতে বললেন- “এসব হয়েছে সেই মেয়েটার জন্য। স্নিগ্ধ তার পেছনেই গিয়েছিল।”
জানভির বাবা রাগে ফুসে উঠলেন। স্নিগ্ধর বাবার সামনে এসে চোখে চোখ রেখে বললেন- “আমার মেয়েকে দোষারোপ করার আগে নিজের ছেলের দিকে তাকান। আমার মেয়ে বলেছিল তাকে তার পেছনে যেতে? না, তো আপনার ছেলে গিয়েছে কেন?”
একবার জানভির বাবা আর একবার স্নিগ্ধর বাবার দিকে তাকিয়ে রঞ্জন বলল- “আমি জানি না তারা বেঁচে ফিরবে কিনা৷ কিন্তু আমি আপনাদের একটা কথা জানিয়ে রাখি। স্নিগ্ধ ও দেবজানি একে অপরকে খুব বেশী ভালোবাসে। তারা একে অপরকে ছাড়া ভালো নেই। আপনারা তাদের বাবা মা হোন৷ আপনারা যদি তাদের না বুঝেন তাহলে তারা বাঁচবে কার আশায়?”
জানভির বাবা ভ্রু কুঁচকে বলল- “এসব কী বলছো রঞ্জন? তুমি ভালো মতো জানো আমি তোমার হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিতে চাই।”
“আপনার মেয়ে আমার সাথে কখনো সুখে থাকবে না আংকেল। তার মনে অন্য কেও দখল করে বসে আছে।”
জানভির বাবা রাগে হাতমুঠ করে ফেললেন। স্নিগ্ধর মা কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন- “এখন এসব বলার সময় না। স্নিগ্ধ কোথায় রঞ্জন?”
“আন্টি ওর অপারেশন চলছে।”
জানভির বাবা বললেন- “রঞ্জন, আমার মেয়ে কোথায়?”
“ওকে একটা কেবিনে রাখা হয়েছে। আসুন আমার সাথে।”
জানভির বাবা মাকে রঞ্জন কেবিনের দিকে নিয়ে গেল। জানভির মাথা, কান ও হাতে ব্যাথা পেয়েছে। তার মাথায় ব্যান্ডেজ করা। মা দৌড়ে গিয়ে জানভির পাশে বসলেন। বাবা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। রঞ্জন বাবার কাঁধে হাত রেখে বলল- “ডাক্তার বলেছে ওর বাম কানে আঘাত লেগেছে। বাম কানে কম শোনার সম্ভাবনা বেশী।”
বাবা মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কেঁদে উঠলেন। কলিজা মোচড় দিচ্ছে উনার মেয়ের অবস্থা দেখে। তখনই একটা নার্স আসলো। রঞ্জনকে উদ্দেশ্য করে বলল- “স্যার পেশেন্টের সাথে ১ জনকে থাকার পারমিশন দেয়া হয়েছে।”
“জি আমরা যাচ্ছি। দেবজানির সাথে তার মা থাকবে।”
“ওকে স্যার, আর হ্যাঁ স্নিগ্ধ রায়ের অপারেশন শেষ। ডাক্তার আপনাকে ডাকছে।”
রঞ্জন শোনার সাথে সাথে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। ডাক্তাররা দাঁড়িয়ে কথা বলছে। রঞ্জন এগিয়ে গেল তাদের দিকে। ডাক্তার রঞ্জনকে দেখে বললেন-
“আমরা অপারেশন করেছি। উনার ব্রেইনে আঘাত লেগেছে। ২৪ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে কোমায় যাওয়ার সম্ভবনা আছে।”
“ডাক্তার প্লিজ এভাবে বলবেন না। স্নিগ্ধ ওর মা বাবার একমাত্র সন্তান। ও সুস্থ না হলে আমি ওর মা বাবাকে কিভাবে সামলাবো।”
“এখন তো সব উপরওয়ালার হাতে। আপনারা প্রাথনা করুন। আমরাও আমাদের যথেষ্ট চেষ্টা করবো।”
বলেই ডাক্তাররা চলে গেলেন। রঞ্জন ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধর বাবা মা হয় তো এখনো দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। উনাদের তো জানাতে হবে স্নিগ্ধর অবস্থার সম্পর্কে। রঞ্জন ধীরপায়ে হেটে এগিয়ে গেল। অর্পিতার বাবার সাথে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধর বাবা। আর অর্পিতার মা ও পূজারীনি স্নিগ্ধর মায়ের সাথে বসে আছে। স্নিগ্ধর মায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ছেলের অবস্থার কথা ভেবে। এখন তো উনাকে জানানো যাবে না। পূজারীনি হঠাৎ রঞ্জনকে দেখতে পেল। আসার পর থেকে তার দেখা পায়নি পূজারীনি। সে দাঁড়িয়ে ধীরপায়ে হেটে রঞ্জনের বরাবর দাঁড়াল। চিন্তায় রঞ্জনের চেহারা শুকিয়ে গিয়েছে। রঞ্জন নিচু স্বরে বলল- “পূজা, স্নিগ্ধর বাবাকে বলো আমি উনাকে ডেকেছি। সাবধান স্নিগ্ধর মা যাতে টের না পায়।”
“স্নিগ্ধদা ঠিক আছে তো?”
“ঠিক আছে আবার নেই-ও। আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“ভগবানের উপর বিশ্বাস রাখুন। কিছু হবে না স্নিগ্ধদার। আমি আংকেলকে ডাকছি।”
রঞ্জন মাথা নাড়াল। পূজারীনি গিয়ে স্নিগ্ধর বাবাকে বলল রঞ্জন ডাকছে উনাকে। উনি চুপচাপ হেটে রঞ্জনের সাথে চলে গেলেন। পূজারীনি আবার স্নিগ্ধর মায়ের পাশে বসে পরলো।

“কী? কী বলতে চাও বুঝলাম না।”
“স্নিগ্ধর জ্ঞান ২৪ ঘন্টার মধ্যে না ফিরলে সে কোমায় চলে যাবে।”
“ডাক্তাররা কী আমার ছেলের ভালো মতো চিকিৎসা করছে না? আমার ছেলে কেন কোমায় যাবে?”
“আংকেল শান্ত হোন। আমি অনুরোধ করছি আন্টিকে কিছু বলবেন না এখন। উনার অবস্থা বেশ খারাপ। আপনি নিজেকে সামলাতে পারবেন বলে আপনাকে জানালাম।”
বাবা নিজের চুল টেনে ধরে মাথা নিচু করে ফেললেন। চিন্তা, রাগ, কষ্টে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে উনার। রঞ্জন উনার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলল- “আংকেল, স্নিগ্ধর কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। আর সে সুস্থ হয়ে গেলে আমি নিজের হাতে তার ভালোবাসাকে তার হাতে তুলে দেবো যাতে সে সারাজীবন সুখে থাকতে পারে।”
রঞ্জন তুমি জানো না দেবজানির বাবা কী কী বলেছিল। আর দেবজানি? সে তো আমার ছেলেকে সহ্য-ও করতে পারতো না। ভার্সিটিতে কী কী ঘটবো আমি সব জানি। ছেলের জন্য চুপ ছিলাম শুধু।”
“ক্ষমা করবেন আংকেল। আমারও অনেক দোষ রয়েছে এসবে। আমার উচিত ছিল মাথা ঠান্ডা রাখা। দেবজানিকে আমি-ই স্নিগ্ধর সম্পর্কে যা মাথায় এসেছে বলেছি।”
“এখন পুরানো কথা টানতে হবে না। স্নিগ্ধ কোথায়? আমি ওকে একবার দেখতে চাই৷”
“আচ্ছা, আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসি। উনি যদি পারমিশন দেন আমি আপনাকে বলছি।”
স্নিগ্ধর বাবা মাথা নাড়াল। রঞ্জন হেটে চলে গেল। ডাক্তারের সাথে কথা বলে খুব কষ্টে ৫ মিনিটের পারমিশন নিয়ে দিলো রঞ্জন। স্নিগ্ধকে আইসিইউ-তে রাখা হয়েছে। আর আইসিইউ-তে পেশেন্টের সাথে দেখা করার পারমিশন নেই। রঞ্জন খুব বেশী রিকুয়েষ্ট করায় ডাক্তার রাজি হয়েছে। স্নিগ্ধর অবস্থা ভালো না-কি খারাপ কেও বুঝতে পারছে না। তার জ্ঞান ফিরলে বুঝা যাবে কতটুকু সুস্থ আছে সে। স্নিগ্ধর বাবা মা একজন নার্সের সাথে আইসিইউর ভেতরে গেলেন। রঞ্জন কিছুক্ষণ আইসিইউর সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ঘুরে ধীরপায়ে হাঁটা ধরলো। হসপিটালের করিডোরের এসে দাঁড়াল। কাঁচের জানালা দিয়ে বাহির দেখা যাচ্ছে। রঞ্জন তার মাকে কল দিয়ে কথা বলে নিলো। মা ভীষণ টেনশন করছিলো তার জন্য। রঞ্জন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে তখনই পাশে কারো উপস্থির টের পেল সে। পাশে তাকিয়ে দেখে পূজারীনি দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি জানালার ওপারের দৃশ্যর দিকে৷ রঞ্জন পূজারীনির দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটাকে এত কাছ থেকে সে কখনো দেখেনি। আজ প্রথম দেখছে তা-ও একপাশ থেকে। রঞ্জনের ইচ্ছে হলো একবার মেয়েটাকে ছুঁয়ে দেখতে। প্রথম দেখায় পূজারীনিকে তার ভালো লেগেছে। ইচ্ছে আছে তার সাথে জীবন কাটানোর। কিন্তু এটা আদৌও সম্ভব কী না রঞ্জন জানে না। পূজারীনি হঠাৎ রঞ্জনের দিকে তাকাল। রঞ্জনের চাহনি দেখে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো-
“কিছু বলবেন রঞ্জনদা?”
রঞ্জন তারাতাড়ি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। না সূচক মাথা নাড়িয়ে মাথা নিচু করে ফেলল।
“সবার খেয়াল রাখছেন কিন্তু নিজের খবর রাখছেন না। আপনার যে ক্ষুধায় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে তা কী জানেন?”
রঞ্জন অবাক দৃষ্টিতে পূজারীনির দিকে তাকিয়ে বলল- “তুমি কী করে জানলে?”
“ম্যাজিক, আচ্ছা চলুন কেন্টিন যাওয়া যাক। আর চিন্তা করবেন না। না স্নিগ্ধদার না জানভিদির। কারো কিছু হবে না।”
“তাই যেন হয়।”

জানভি দৌড়াচ্ছে। এত মানুষের ভীরে সে দৌড়াতে পারছে না। হঠাৎ করে পেছন থেকে খুব জোরে শব্দ আসলো। সাথে সাথে খুব জোরে ধাক্কা লেগে সে মাটিতে পড়ে গেল। সে সাথে সাথে হাঁটু ভেঙে উঠে বসলো। অনেকেই তাকে ধাক্কা মেরে যাচ্ছে। জানভি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকাল। বাস ও ট্রাকে আগুন জ্বলতে দাউদাউ করে। হঠাৎ ট্রাকে বিস্ফোরণ ঘটলো। জানভি তার চেহারা ঢেকে ফেলল গরম ভাব লাগার কারণে। অনেকে ছিটকে পরলো মাটিতে। একটা চাকা উড়ে এসে জানভির উপর পড়ে গেল। আঘাত তার মাথার বাম পাশে লেগেছে যার ফলে বাম কান দিয়ে রক্ত বেরিয়ে গিয়েছে। হঠাৎ চারপাশে ঘোলাটে লাগতে লাগলো। জানভি উঠতে চাইলো। তার স্নিগ্ধ তো বাসের ভেতর। স্নিগ্ধকে নিতে যেতে হবে। জানভি আর শক্তি পেল না লুটিয়ে পরলো মাটিতে।

হঠাৎ জানভির চোখ খুললো। ধরফরিয়ে উঠে বসে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। তার বুকের বা পাশ ধরফর করছে। জানভির মাথায় স্নিগ্ধর চিন্তা আসতেই দ্রুত বিছানা ছেড়ে নামতে নিলো। তারাহুরো করে নামতে যেয়ে তার মাথায় যেন কারেন্ট শক লাগলো। মাথা ধরে ধপ করে বসে পরলো। বাম কান ব্যাথায় সে যেন টিকতে পারছে না। জানভি “আহ” বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো। মা কেবিন থেকে বেরিয়ে ছিলেন জানভির বাবার সাথে কথা বলার জন্য। হঠাৎ মেয়ের চিৎকার শুনে বাবা মা দুজনই দ্রুত কেবিনে গেল। জানভি মাথা চেপে ধরে রেখেছে। মা দৌড়ে গিয়ে মেয়ের পাশে বসলেন। জানভি মাথা ধরে কাঁদছে। মা জানভিকে সাথে সাথে জড়িয়ে ধরলেন৷ মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে। এখন উনার মন শান্ত হলো। জানভি হঠাৎ বলে উঠলো- “স্নিগ্ধ কোথায় মা?”
মা জানভিকে দেখে তার দিকে তাকাল। জানভির চোখে পানি টলমল করছে। মায়ের কাছ থেকে জবাব না পেয়ে জানভি বিছানা ছেড়ে দাঁড়াল। কিন্তু তার মাথা ঘুরাচ্ছে। পড়ে যেতে নিলো মা সাথে সাথে উঠে তাকে ধরলো- “মারে তুই এখন অসুস্থ। বিশ্রাম নে মা।”
“মা আমি আগে স্নিগ্ধকে দেখতে চাই।”
তখনই দরজার পাশ থেকে বাবার শব্দ ভেসে আসলো- “স্নিগ্ধকে আইসিইউ-তে রাখা হয়েছে।”
জানভি বাবার দিকে তাকাল। তার মাথা ঝিমঝিম করছে বাবার কথা শুনে। বাবা ধীরপায়ে জানভির দিকে এগিয়ে আসলেন। জানভির অবস্থা দেখে বাবা অপরাধীর স্বরে বললেন- “আমি অনেকক্ষণ ভাবলাম, যদি সেদিন রাগের মাথায় স্নিগ্ধর বাবাকে না ফিরিয়ে দিতাম তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না।”
জানভি এগিয়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। বাবার বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বাবা জানভির মাথায় হাত রেখে বললেন- “তোর কাছ থেকে কিছু লুকাতে চাই না। স্নিগ্ধর অবস্থা ভালো না। ২৪ ঘন্টার মধ্যে তার জ্ঞান না ফিরলে কোমায় চলে যেতে পারে।”
জানভি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকাল। বাবার জানভিরকে ধরে বিছানায় বসিয়ে বললেন- “কিন্তু তুই চিন্তা করিস না। আমি আমার বন্ধুকে কল দিয়ে স্পেশালিষ্টকে ডাকিয়েছি। সে এসে পরবে এক দুই ঘন্টার মধ্যে। আর স্নিগ্ধর বাবা-ও আর্জেন্ট উনার পরিচিত ডাক্তার ডাকিয়েছেন। কিছু হবে না স্নিগ্ধর।”
জানভি কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ভয়ে তার কলিজার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে৷ বাবা মাকে জানভির খেয়াল রাখতে বলে চলে গেলেন। মা জানভিকে জোর করে শুইয়ে দিয়ে পাশে বসলেন৷ জানভি হঠাৎ বলল-
“মা, ভগবান না করুক যদি স্নিগ্ধর কখনো জ্ঞান না ফিরে তখন আমি কী করবো?”
“অমঙ্গল কথা বার্তা কেন বলিস?”
“আমার মাথায় যে অনেক উল্টা পাল্টা কথা আসছে।”
“কারো কিছু হবে না।”
“কিন্তু আমার যে উত্তরটা খুব প্রয়োজন।”
মা তাকিয়ে রইলো জানভির দিকে৷ জানভি মায়ের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

রাত ৩ টা, করিডোরে রঞ্জন হাঁটছে। চিন্তায় তার দুচোখ ঘুম আসছে না। স্নিগ্ধর মাকে খুব কষ্টে বাসায় পাঠানো হয়েছে। স্নিগ্ধর বাবা শুধু আছেন হসপিটালে। জানভির পাশে তার বাবা মা দুজনই আছেন। অর্পিতার বাবা ও পূজারীনি স্নিগ্ধর বাবার সাথে আছে। রঞ্জন সবাইকে চিন্তামুক্ত হতে বলছে কিন্তু নিজে চিন্তামুক্ত হতে পারছে না। সে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। খুব ভয় করছে তার। স্নিগ্ধর সাথে অনেকবার খারাপ ব্যবহার করেছে একবারো ক্ষমা চায় নি৷ ছেলেটার কিছু হয়ে গেলে তার নিজেকে অপরাধী মনে হবে। হঠাৎ হেঁটে আসার শব্দ আসলো। রঞ্জন পাশে তাকিয়ে দেখে পূজারীনি আসছে। মেয়েটা পাশে থাকলে তার শান্তি লাগে। পূজারীনি হেটে এসে তার বরাবর দাঁড়িয়ে বলল- “ঘুমাবেন না?”
ঘুম আসছে না। তুমি জেগে আছো কেন?”
“ঘুমানোর জায়গার বড্ড অভাব। যদিও কেবিনে সোফার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমার এখন ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না।”
রঞ্জন নিঃশব্দে হাসলো। পূজারীনি আর এক কদম হেটে এসে অবাক স্বরে বলল-
“আমি আগে খেয়াল করি নি আপনি হাসলে আপনার গালে গর্ত হয়ে যায়।”
রঞ্জন আবার হাসলো পূজারীনির কথা শুনে। পূজারীনি মুচকি হেসে আবার বলল- “সবসময় হাসিখুশি থাকবেন ওকে?”
“কেন?”
“হাসলে আপনাকে কিউট দেখায়।”
“তুমি হাসো বা কাঁদো বা রাগ করো। তোমাকে সবসময় কিউট দেখায়।”
“হ্যাঁ সেটা আমি জানি।”
রঞ্জন এখন শব্দ করে হাসলো। পূজারীনিও হাসলো তার হাসি দেখে। তখনই আইসিইউর সামনে থেকে চিৎকার চেচামেচির শব্দ আসলো। রঞ্জন আর পূজারীনি শব্দ পেয়ে দৌড়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখে স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে পাগলের মতো এখান সেখান দেখছে। ডাক্তার নার্স তার বাবা অর্পিতার বাবা কেও তাকে ধরে রাখছে পারছে না। সে সবাইকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। তার মুখে শুধু জানভির নাম। রঞ্জন দৌড়ে গিয়ে স্নিগ্ধর সামনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলল- “স্নিগ্ধ শান্ত হও, স্নিগ্ধ আমি বলছি তো দেবজানির কিছু হয়নি৷”
স্নিগ্ধ রঞ্জনকে ধাক্কা দিয়ে বলল- “না ও ব্যাথা পেয়েছে। আমি দেখেছি ও ভালো নেই।”

চিৎকার চেচামেচির শব্দ কানে আসতেই জানভি ধরফরিয়ে উঠলো। বাবা মা সোফায় বসে ছিলেন। উনারাও দাঁড়ালেন। জানভি ভালো মতো শোনার চেষ্টা করলো। কন্ঠটা স্নিগ্ধর বুঝতে পেরেই বিছানা ছেড়ে নেমে দৌড়ে গেল। তার পিছু পিছু বাবা মা-ও গেলেন। জানভির হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠলো। দেয়ালে এক হাত রেখে আর এক হাত দিয়ে মাথা ধরলো৷ চেপে ধরলো দু চোখ। তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে। মা দ্রুত এসে জানভিকে ধরলেন- “কী করছিস তুই? ডাক্তার তোকে বিশ্রাম করতে বলেছে।”
জানভি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল- “স্নিগ্ধ ডাকছে আমাকে।”
বাবা জানভির কথা শুনে দৌড়ে গেল আইসিইউর দিকে। মা কিছু বলতে যাবে তার আগেই খেয়াল করলো জানভির বাম কান থেকে রক্ত বের হচ্ছে। মা চমকে উঠলেন। চিৎকার করে ডাক্তারকে ডাকলেন। দুজন নার্স দৌড়ে আসলো। হসপিটালে এত চিৎকার চেচামেচি হচ্ছে আজ উনারা কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না। এসে দেখে জানভির অবস্থাও ভালো নেই৷ জানভিকে কেবিনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে নিলো তারা। কিন্তু জানভি জেদ ধরেছে যাবে না। সে এখন স্নিগ্ধর কাছে যেতে চায়। হঠাৎ স্নিগ্ধর কন্ঠ ভেসে আসলো। জানভি পাশে তাকিয়ে দেখে স্নিগ্ধ দৌড়ে আসছে। জানভি স্নিগ্ধকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। দেয়াল ধরে ধরে সে এগিয়ে গেল সামনে৷ স্নিগ্ধ কাছে এসে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো জানভিকে৷ স্নিগ্ধর প্রতিটি হৃদয়ের স্পন্দন জানভির কানে এসে বারি লাগছে৷ জানভি চোখ বন্ধ করে স্নিগ্ধর বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠলো৷ আশে পাশের সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধর বাবা জানভির বাবার দিকে তাকাল। জানভির বাবা নিচু স্বরে বললেন-
“ক্ষমা করে দিয়েন। তাদের সুখ একে অপরের সাথে আমি এটা ভাবি নি।”
স্নিগ্ধর বাবা মুচকি হেসে জানভির বাবার কাঁধে হাত রাখলো। স্নিগ্ধ জানভিকে ছেড়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল- “জানু তুমি তুমি ঠিক আছো তো?”
“হুম”
জানভি স্নিগ্ধর গালে হাত রাখলো- “এত দেরি কেন করলে? তুমি জানো আমার কী অবস্থা হচ্ছিল তোমার কথা ভেবে।”
স্নিগ্ধ ফুপাচ্ছে। সে মাথা নিচু করে তার দু কান ধরে বলল- “সরি আর এমন করবো না।”
জানভি বিরক্ত হয়ে স্নিগ্ধর হাত ধরে বলল- “তুমি আসলেও পাগল।”
“রাগ করেছো?”
স্নিগ্ধ কান্না থামানোর চেষ্টা করছে৷ কিন্তু পারছে না। তার চোখ নাক বেয়ে পানি পরছে। জানভির বেশ মায়া হলো। স্নিগ্ধর গালে হাত রেখে না সূচক মাথা নাড়াল। স্নিগ্ধ আবার জড়িয়ে ধরলো জানভিকে। হঠাৎ স্নিগ্ধ ঘোলা ঘোলা দেখা শুরু করলো। এক হাত দিয়ে চোখ ডলে আবার তাকাল। এখনো ঘোলা লাগছে। জানভি স্নিগ্ধর কানের সাথে ঠোঁট ঠেকিয়ে বলল- “আই লাভ ইউ।” স্নিগ্ধর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। হঠাৎ চারপাশে তার অন্ধকার হয়ে গেল তার। স্নিগ্ধ জানভির উপর ঢোলে পরলো। জানভি ভয় পেয়ে গেল। হাঁটু গেড়ে বসে তারাতাড়ি স্নিগ্ধকে ধরলো। সবাই দৌড়ে গেল তাদের কাছে৷ জানভির স্নিগ্ধর চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখে স্নিগ্ধর ঠোঁটে হাসি লেগে আছে। ডাক্তার চেক করে বলল- “ভয়ের কারণ নেই সে শুধু অজ্ঞান হয়েছে।”
পূজারীনি ভ্রু কুঁচকে বলল-
“অজ্ঞান হয়েছে তাও হাসিমুখে। বিষয়টা অবাক করার মতো। জানভিদি আমি খেয়াল করেছি তুমি কী যেন বলছিলে স্নিগ্ধদাকে। কী এমন বললে যে দাদা অজ্ঞান হয়ে গেল?”
সবাই জানভির দিকে তাকাল। জানভি দুবার চোখের পলক ফেলে সবার দিকে চোখ বুলালো। সবার চাহনি দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। পূজারীনি আবার জিজ্ঞেস করতে নিলো কিন্তু রঞ্জন ইশারায় বলল চুপ থাকতে। পূজারীনি মাথা নাড়াল। জানভি চোখ তুলে পূজারীনির দিকে তাকাতেই পূজারীনি ফিক করে হেসে দিলো। জানভির আবার ইচ্ছে করছে মাটি ভাগ করে ভেতরে ঢুকে যেতে।

৬ মাস পর……
আজ স্নিগ্ধর ঘর ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। চারপাশে ফুলের সুগন্ধ ভাসছে। জানভি চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। ঘর এতটাই সুন্দর লাগছে সে চোখ ফেরাতে পারছে না। তখনই দরজা খোলার শব্দ আসলো। জানভি নড়েচড়ে বসলো। স্নিগ্ধ ভেতরে প্রবেশ করে গলা থেকে মালা বের করে চেয়ারের উপর রাখলো। শেরওয়ানির উপরের বোতাম খুলতে খুলতে এগিয়ে আসলো৷ জানভির পাশে বসে ভ্রু কুঁচকে বলল- “তোমার কী শরম লাগে না? এসি বন্ধ করে বসে আছো কেন?”
জানভি চোখ তুলে স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে আহত স্বরে বলল- “যবে থেকে এক্সিডেন্ট হয়েছে তুমি উল্টা পাল্টা কথা বলো শুধু। শরম না গরম হবে।”
স্নিগ্ধ নাক মুখ কুঁচকালো। জানভি হেসে স্নিগ্ধর ঘাড়ে দুহাত পেঁচিয়ে বলল- “আচ্ছা এখন রাগ করো না। আসতে দেরি হলো কেন? আমি অনেকক্ষণ ধরে তোমার অপেক্ষা করছিলাম।”
“আমার খুব শয্যা থুক্কু আই মিন লজ্জা লাগছিল।”
“আমি তোমার বউ পরনারী না।”
“বউ, এই আমাদের কী সত্যি বিয়ে হয়েছে?”
“কি মনে হয় তোমার?”
“স্বপ্ন মনে হচ্ছে।”
“সত্যি বলতে আমারো।”
“আচ্ছা তুমি তো খুব সুন্দর কবিতা লিখো। একটা কবিতা বলে শোনাও।”
জানভি কিছুক্ষণ স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে বলল-
“চেয়েছিলাম তোমায়,
কিন্তু বাঁধা দিয়েছিল মন।
মনের বিরুদ্ধে গিয়ে, করেছিলাম প্রার্থনা।
কিন্তু হয়নি প্রার্থনা পূরণ।
ভেবে নিয়েছিলাম ভগবান মূর্তি ছাড়া আর কিছুই না।
কিন্তু উনি করেননি আমায় নিরাশ।
তোমাকে আমার করে দিয়ে,
উনি আছেন, করে দিলেন প্রমাণ।
হাত ধরে কখনো ছেড়ো না প্রিয়
শত টুকরোয় ভাগ হয়ে যাবে আমার এই #অবাধ্য_মন ।”
জানভি হাতে ছোঁয়া অনুভব করলো৷ ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখে স্নিগ্ধ তার দিকে মুচকি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে। জানভি স্নিগ্ধর হাতের উপর হাত রাখলো। স্নিগ্ধ হাত তুলে জানভির গালে রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। জানভি একটা ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে নিলো। তখনই তার ঠোঁটে নরম স্পর্শ পরলো। দুজনেরই কানে শুধুই তাদের হৃৎস্পন্দন শোনা যাচ্ছে। এরপর স্নিগ্ধ জানভির….. কী হলো গল্প শেষ তো ?‍♀️?‍♀️ এখন আমি যাই টাটা?‍♀️?‍♀️

❤️❤️সমাপ্ত❤️❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here