#অবাধ্য_মন,পর্ব_৩
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
স্নিগ্ধ এক কদম এগিয়ে যেতেই জানভি ছুরি দিয়ে স্ট্যাচুর কপালে ঢুকিয়ে দিলো। স্নিগ্ধ জমে গেল জানভির কান্ড দেখে। তার মনে হচ্ছে ছুরিটা সত্যি তার কপালে ঢুকেছে। জানভি ছুরি বের করে গালে ঢুকিয়ে দিলো। স্নিগ্ধ নিজের গাল ধরে আহত দৃষ্টিতে ডক্টরের দিকে তাকাল। ডক্টর কপালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জানভি ইচ্ছে মতো ছুরি দিয়ে স্ট্যাচুর চেহারা নষ্ট করে দিলো। পরিবেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে জানভির কান্ডে। শেষে জানভি ছুরি স্ট্যাচুর মাথার ভেতর ঢুকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল-
“এটা নিউ টেকনিক ডক্টর। এখন আমার অনেক শান্তি লাগছে। জামা নষ্ট হয়ে গিয়েছে আমি স্নান করে আসি।”
বলেই জানভি গুনগুন করতে করতে চলে গেল। স্নিগ্ধ তাকিয়ে আছে তার ভয়ংকর চেহারা ওয়ালা স্ট্যাচুর দিকে। হঠাৎ তার চোখের সামনে তার চেহারা ভেসে উঠলো। ঠিক তেমন যেমন স্ট্যাচুর অবস্থা হয়েছে। স্নিগ্ধ ভয়ে ডক্টরের দিকে গিয়ে বলল-
“ডক্টর ডু সামথিং”
“সব দোষ তোমার। এখন সহ্যও তোমাকেই করতে হবে।”
বলেই ডক্টর চলে গেল। স্নিগ্ধ একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। তাকে আর কি কি সহ্য করতে হবে কে জানে। চোখ তুলে সামনের দিকে তাকাল। জানভি একটা বাচ্চার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার মুখে থাকা হাসি দেখে স্নিগ্ধ মুচকি হাসলো।
বিকাল বেলা, জানভির এই সময়টা একদম পছন্দ না। কি কারণে পছন্দ না সে জানে না। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে জানভি তাকিয়ে আছে বাহিরের দিকে। আকাশে সাদা মেঘ দেখা যাচ্ছে না। আকাশটা দেখে মনে হচ্ছে নীল চাদরে ঢাকা। কিছুক্ষণ পর পর বিভিন্ন পাখি উড়ে যাচ্ছে। অনেকদিন হলো বাহিরের পরিবেশ দেখে না। তার অনেক ইচ্ছে করছে আবার বাহিরে যেতে। কিন্তু ডক্টর শামসুর নাহার যেতে দিবেন না। জানভি মন খারাপ করে জানালা ছেড়ে এসে নিজের বিছানায় বসলো৷ তখনই দরজা ঠকঠক করার শব্দ আসলো। ভেতরে আসার পারমিশন দিতেই একজন নার্স আসলেন হাতে মোবাইল নিয়ে। জানভির মন ভালো হয়ে গেল। নিশ্চয়ই বাসা থেকে কল এসেছে। তার ধারণা ঠিক ছিল। মা কল দিয়েছে। জানভি মায়ের সাথে অনেকক্ষণ গল্প করলো মোবাইলে। উনারা আগামীকাল আসবেন তার সাথে দেখা করতে। জানভি ভীষণ খুশী হলো। মায়ের সাথে কথা বললে তার মন ভালো হয়ে যায়। মন ভালো হতেই সে নিজের ঘর থেকে বের হলো। আজ তিনজন পেশেন্ট ডিসচার্জ পাবে। জানভি তাদের সাথে দেখা করে নিলো। তার মন চাচ্ছে তাদের সাথে চলে যেতে। তারা চলে যেতেই জানভি হেটে বাগানে আসলো। এখন তার পেইন্ট করতেও ইচ্ছে করছে না। বেঞ্চে বসে মাথা নিচু করে রাখলো। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ তার মনে হলো কেও তার পাশে এসে বসেছে। জানভি মাথা তুলে পাশে ফিরতেই দেখে স্নিগ্ধ বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। জানভির বিরক্ত হতেও ইচ্ছে করছে না। আবার মাথা নিচু করে ফেলল। স্নিগ্ধ অবাক না হয়ে পারলো না। একটুখানি জানভির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল-
“দেবজানি সরকার জানভি আমাকে দেখে বিরক্ত হলো না কেন?”
“কারণ আপনি আমার বিরক্তের কারণ হওয়ার যোগ্যতাও রাখেন না।”
স্নিগ্ধ নাক মুখ কুঁচকালো। এত অপমান সে কখনো হয় নি। কিন্তু তার এখন সহ্য করতেই হবে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-
“তো আপনার বিরক্তের কারণ হওয়ার যোগ্যতা হওয়ার জন্য আমার কি কি করতে হবে?”
জানভি স্নিগ্ধর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
“আপাতত আমার পিছা ছেড়ে দিন। আমি আপনাকে চিনি না। যদি আমাদের মাঝে ভালো সম্পর্কও থেকে থাকে আমার মনে নেই।”
“আমি আছি তো জানু, তোমাকে সব মনে করিয়ে দিবো আমি। কিন্তু আমি ভাবছি তোমার সব মনে এসে পরলে কি হবে। কারণ আমি এমন একজন মানুষ যাকে তুমি ঘৃণা করো।”
“হয় তো, আপনাকে দেখলে আমার অনেক রাগ হয়। আপনার চেহারা আপনার কন্ঠ আমাকে ভেতরে ভেতরে পুড়িয়ে ফেলে। এমনটা কেন হয় বলুন তো।”
স্নিগ্ধর কাছে জানভির প্রশ্নের উত্তর নেই। জানভি উত্তর না পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল-
“যাকগে এসব কথা বাদ দেয়া যাক। আমার মন এখন প্রচুর খারাপ। তাই আরো খারাপ করতে চাচ্ছি না।”
“কি হয়েছে বলো আমায়।”
“কিছু না”
“জানু, আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। বলো তোমার মন খারাপ কেন?”
জানভি স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল-
“আপনি আমাকে কথায় কথায় জানু ডাকা বন্ধ করবেন?”
“তুমি বলেছিলে আমার মুখে জানু ডাক শুনতে তোমার ভালো লাগে। তাই তো তোমাকে আমি জানু ডাকি।”
“যেহেতু আমার কিছু মনে নেই তাই আমাকে জানু বলে আর ডাকবেন না।”
“আমি তো ডাকবোই, কেও আমাকে থামাতে পারবে না কেও না। এখন বলো তোমার মন খারাপ কেন?”
জানভি লম্বা নিশ্বাস ফেলল। ছেলেটা বড্ড জেদি। মাথা নিচু করে বলল-
“আমার অনেক ইচ্ছে বাহিরে যাওয়ার। কিন্তু ডক্টর শামসুর নাহার পারমিশন দেন না। আমার যতদিন ট্রিটমেন্ট চলবে ততদিন এইখানেই থাকতে হবে।”
“বাহিরে যেতে চাও?”
জানভি স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। স্নিগ্ধ মুচকি হেসে বলল-
“যদি আমি তোমাকে বাহিরে নিয়ে যাই যাবে?”
“আপনি সত্যি আমাকে বাহিরে নিয়ে যাবেন?”
“হ্যাঁ কিন্তু একটা শর্ত আছে।”
“কি শর্ত?”
“আমাকে তুমি করে ডাকতে হবে। আপনি শব্দটা পর পর মনে হয়। কিন্তু জানু, আমি তোমার আপন মানুষ।”
জানভি কিছু বলল না। তাকিয়ে রইলো স্নিগ্ধর দিকে। একবার রাগ হয় ছেলেটার উপর আর একবার খুব মায়া হয়। জানভি বুঝতে পারছে না তার হচ্ছেটা কি। স্নিগ্ধ বেঞ্চ ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল-
“তোমার হয়ে পারমিশন আমি নিবো। আর আমি শিওর ডক্টর পারমিশন দিবেন তাই তুমি গিয়ে তৈরী হয়ে আসো।”
“তৈরী? আপনি আই মিন তুমি কি চাও আমি জামদানী শাড়ি পড়ে আসবো?”
“শাড়ি পড়লে মন্দ হয় না। তোমাকে শাড়িতে খুব সুন্দর দেখায়।”
“তুমি কি করে জানলে?”
স্নিগ্ধ জবাব দিলো না। জানভির দিকে রহস্যময় হাসি ছুঁড়ে মেরে চলে গেল। জানভি থতমত খেয়ে বসে আছে। ছেলেটা তার দেখা সবচেয়ে আজব মানুষ। স্নিগ্ধ কিছুক্ষণ পর ফিরে আসলো৷
“চলো পারমিশন পেয়ে গিয়েছি।”
“সত্যি?”
“একদম, তোমার বিশ্বাস না হলে ডক্টরকে জিজ্ঞেস করতে পারো।”
স্নিগ্ধর কথা শুনে জানভি সত্যি সত্যি ডক্টরকে জিজ্ঞেস করতে গেল। স্নিগ্ধ বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এত অবিশ্বাস করে তাকে মেয়েটা? জানভি কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে বলল-
“উনি হঠাৎ রাজি হলেন যে?”
“জানু, ইটস কল ম্যাজিক।”
“ক্যান ইউ প্লিজ স্টপ ইওর ননসেন্স ওয়ার্ডস?”
স্নিগ্ধর মুখের হাসি উড়ে গেল। মেয়েটা তাকে অতিরিক্ত অপমান করছে। ভেংচি কেটে বলল-
“চলো এখন, আর হ্যাঁ আমার সাথেই থাকবে ওকে?”
জানভি হেসে মাথা নাড়াল। তার বিশ্বাস হচ্ছে না সে এখন বাহিরে যাচ্ছে। স্নিগ্ধ আর জানভু হেটে দিয়ে মেইন গেইট দিয়ে বের হলো। বের হয়ে জানভি অবাক হয়ে চারপাশে দেখছে। তার মনে হচ্ছে সে জীবনে প্রথম এত সুন্দর দৃশ্য দেখছে। সবকিছু তার কাছে নতুন মনে হচ্ছে। স্নিগ্ধ জানভির দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল-
“চাইলে হাত ধরে হাঁটতে পারো। এতে তুমি হারাবে না।”
জানভি এক নজর স্নিগ্ধর হাতের দিকে তাকিয়ে আবার স্নিগ্ধর দিকে তাকাল। তার মন চাচ্ছে স্নিগ্ধর উপর বিশ্বাস করতে৷ ছেলেটার হাসি তার খুব আপন মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে হাত এগিয়ে নিয়ে স্নিগ্ধর হাতের উপর রাখলো। স্নিগ্ধর মনে হচ্ছে তার হাতের মুঠোয় আকাশের চাঁদ এসে পরেছে। শক্ত করে ধরলো জানভির হাত। দুজন পাশাপাশি হাঁটছে। জানভির হৃদয়ের স্পন্দন ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে। এতটাই বেড়েছে মনে হচ্ছে হৃদয়ে বিস্ফোরণ ঘটবে৷ স্নিগ্ধ জানভিকে সবকিছু চেনাচ্ছে। পুরো রাস্তা ঘুরে নানা জিনিসের সাথে পরিচয় করাচ্ছে। রাস্তায় এসে জানভির খুব ভালো লাগছে। আর সবচেয়ে বেশী তার পছন্দ হয়েছে স্নিগ্ধর হাতে হাত রাখা। কিছুদূর হাঁটার পর স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে জানভির দিকে তাকিয়ে বলল-
“তোমার আইসক্রিম খুব পছন্দ। খাবে আইসক্রিম?”
“তুমি খাওয়াবে?”
“তো আর কে এসেছে আমাদের সাথে শুনি?”
“তুমি তো পেশেন্ট, তো তোমার কাছে টাকা আসলো কিভাবে?”
“আমি ডক্টরের স্পেশাল পেশেন্ট। আমার কাছে সব আছে।”
“স্নিগ্ধ, তুমি কি সত্যি পেশেন্ট?”
স্নিগ্ধ তাকিয়ে রইলো জানভির দিকে। আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হাঁটা ধরলো। জবাব না পেয়ে জানভি বিরক্ত হলো। ছেলেটার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে সে বার বার বিরক্ত হচ্ছে। স্নিগ্ধ দোকান থেকে তার আর জানভির জন্য আইসক্রিম কিনে নিলো। জানভির দিকে আইসক্রিম এগিয়ে দিয়ে বলল-
“যাবে এক জায়গায়?”
“কোথায়?”
“তোমার অতি প্রিয় জায়গায়। যেখানে গেলে তুমি অনেক আনন্দ পাও।”
“আমার প্রিয় জায়গা?”
স্নিগ্ধ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।
“চলো তাহলে যাওয়া যাক। আমিও দেখতে চাই আমার কোন প্রিয় জায়গাকে আমি ভুলে গিয়েছি।”
“চলো তাহলে যাওয়া যাক”
জানভি সম্মতি জানালো। দুজন আবার হাতে হাত রেখে হাঁটা ধরলো। স্নিগ্ধ জানভিকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছে জানভি চুপচাপ সেখানে হেটে চলেছে। কিছুক্ষণ পর স্নিগ্ধ একটা পার্কে নিয়ে আসলে জানভিকে। জানভি জায়গাটা চিনলো না। সে আজ প্রথমবার দেখছে এই জায়গা। স্নিগ্ধ জানভিকে দাঁড়াতে বলে কোথায় জানি চলে গেল। জানভি দাঁড়িয়ে ডান বাম দেখছে। এখানে অনেক অপরিচিত চেহারা আছে। সবার৷ মাঝে তার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর স্নিগ্ধ এলো। তার হাতে ২ টা বিস্কুটের প্যাকেট। জানভি শুধু দেখলো। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলো না। স্নিগ্ধ জানভিকে ইশারায় বলল তার সাথে আসতে। জানভি চুপচাপ স্নিগ্ধর পেছনে হাঁটছে। হঠাৎ কুকুরের ঘেউ ঘেউ করার শব্দ হলো। জানভি চমকে উঠল হঠাৎ চিৎকার শুনে। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে তার দিকে ১ টা বড়ো কুকুর আর ৩টে বাচ্চা কুকুর এগিয়ে আসছে। কুকুরগুলো দৌড়ে এসে স্নিগ্ধকে ঘিরে ধরেছে। জানভি দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে চুপচাপ তাদের দেখছে। স্নিগ্ধ হাঁটু গেড়ে বসে একটা কুকুরের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে জানভির দিকে তাকাল।
“চিনলে তাকে? আমরা তাকে অসুস্থ উদ্ধার করেছিলাম। আজ সে তিনটে বাচ্চার মা। তুমি ওর নাম জুলিয়েট রেখেছিলে।”
জানভি কিছুই বুঝতে পারলো না স্নিগ্ধর কথা। স্নিগ্ধ জানভির দিকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল-
“চলো আবার আগের মতো তাদের সাথে খেলাধুলা করা যাক।”
“আগের মতো?”
স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে জানভির চোখে চোখ রেখে বলল-
“আমি কুকুর ভয় পেতাম আর তুমি বার বার জুলিয়েটকে বলতে আমাকে তাড়া করতে। আর জুলিয়েট আমাকে পুরো পার্ক দৌড়ে তাড়া করতো।”
বলেই স্নিগ্ধ শব্দ করে হাসলো। তার হাসি দেখে জানভিও হেসে দিলো। জুলিয়েট এগিয়ে এসে জানভির হাত চাটছে। স্নিগ্ধ তাকে দেখে বলল-
“তোমাকে অনেক মিস করছিলো সে। এখন ওকে মন ভরে আদর করে দাও।”
জানভি মুচকি হেসে হাঁটু গেড়ে বসে বিস্কুটের প্যাকেট ছিঁড়ে জুলিয়েটকে খাইয়ে দিতে লাগলো। স্নিগ্ধ মাটিতে বসে জুলিয়েটের তিন বাবুকে কোলে নিয়ে বিস্কুট ভেঙে খাইয়ে দিচ্ছে। জানভি আড়চোখে স্নিগ্ধকে দেখলো। তার হৃদয়ের স্পন্দন সে শুনতে পাচ্ছে। স্নিগ্ধ তার দিকে তাকাতেই জানভি চোখ সরিয়ে নিলো৷
বেশ কিছুক্ষণ পার্কে ঘুরাঘুরি করে তারা বের হলো পার্ক থেকে। জানভির অনেক ভালো লাগছে যা বলে সে বুঝাতে পারবে না। স্নিগ্ধ পকেটে হাত দিয়ে হাঁটছে আর বার বার জানভিকে দেখছে। জানভি হঠাৎ স্নিগ্ধর দিকে তাকাতেই স্নিগ্ধ মুচকি হাসি দিলো। জানভি চোখ ফিরিয়ে নিলো তার হাসি দেখে।
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
স্নিগ্ধর প্রশ্ন শুনে জানভি তার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াল।
“আমাকে দেখলে তোমার রাগ হয় বলেছিলে। তবুও আমাকে বিশ্বাস করে আমার সাথে আসলে কেন? আমি তো তোমার ক্ষতিও করতে পারতাম।”
“করো তো নি।”
“তোমার জন্য আমি অচেনা। একজন অচেনা মানুষের সাথে আসার আগে একবারো ভাবলে না যে?”
“ভেবেছিলাম, কিন্তু মন চাচ্ছিল তোমার উপর বিশ্বাস করতে। আর আমি আমার মনকে খুব বিশ্বাস করি। সে কখনো আমাকে ভুল পথে নিয়ে যাবে না।”
স্নিগ্ধ জানভির দিকে তাকিয়ে রইলো। জানভি মুচকি হেসে সামনের দিকে তাকাল। স্নিগ্ধ পকেট থেকে বাম হাত বের করে জানভির ডান হাত ধরলো। হঠাৎ ছোঁয়া পেতেই জানভি দাঁড়িয়ে পরলো। তাকে দাঁড়াতে দেখে স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকাল। জানভি হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধ বলল-
“যত পর্যন্ত তোমার স্মৃতি ফিরে না আসবে আমাকে তোমার পাশে পাবে।”
জানভি স্নিগ্ধর দিকে তাকাল। কেন যে ছেলেটার উপর তার খুব বিশ্বাস হচ্ছে বুঝতে পারছে না।
রাতেরবেলা……
হসপিটালের পেশেন্টদের খাবার স্নিগ্ধ খেতে পারবে না। স্যুপ দেখেই সে নাক মুখ কুচকাচ্ছে বার বার। জানভি স্নিগ্ধর চেহারা দেখে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। স্নিগ্ধ বিরক্ত হয়ে বলল-
“এতে হাসার কি আছে?”
“তোমার চেহারা একদম রাগী ষাঁড়ের মতো দেখাচ্ছে। আর একটু মোটু হলে পুরো ষাঁড় লাগতো তোমাকে।”
বলেই জানভি আবার হাসতে লাগলো। স্নিগ্ধ চোখ ছোটো ছোটো করে বলল-
“এই খাবার খাও কিভাবে? মনে হচ্ছে পানি গরম করে দিয়ে রেখেছে।”
“এই স্যুপে যথেষ্ট পরিমানের প্রোটিন আছে। তুমি একবার ট্রাই করতে পারো।”
“নো নিড, আমি বাহিরে গিয়ে কিছু খেয়ে আসি। হসপিটালের খাবার খেতে খেতে আমি অসুস্থ হয়ে যাব।”
বলেই স্নিগ্ধ উঠে চলে গেল। জানভি হাসছে এখনো। জানভি না খেয়েই উঠে পরলো। স্নিগ্ধ এত রাতে নিজের জন্য খাবার কোথায় পাবে? জানভি বাহিরে গেল। স্নিগ্ধ মোবাইলে কার সাথে যেন কথা বলছে। জানভি দ্রুত গিয়ে স্নিগ্ধর সামনে দাঁড়াল।
“তুমি মোবাইল ব্যবহার করো? জানো না পেশেন্টদের মোবাইল ব্যবহার করার পারমিশন নেই?”
স্নিগ্ধ কথা বলে কল কেটে জানভির দিকে তাকাল। এক ভ্রু উঁচু করে শার্টের কলার ঠিক করে বলল-
“বলেছিলাম না আমি স্পেশাল পেশেন্ট?”
“স্পেশাল বা ছাই। তুমি নিশ্চয়ই কিছু লুকাচ্ছো।”
“আমি চোর নই যে কিছু লুকাবো। আর তুমি এখানে কি করছো? যাও গিয়ে খেয়ে নাও একটু পর ঔষধ খাবে আবার।”
“আমি তো তোমার জন্য আসলাম। তুমি না খেয়ে রাতে ঘুমাবে কিভাবে?”
“কে বলল আমি না খেয়ে ঘুমাবো? আই লাভ ফুডস, আমি না খেয়ে থাকতে পারি না।”
“হ্যাঁ সেটা দেখেই বুঝা যায়।”
“আমার সিক্স প্যাকের দিকে নজর দিও না।”
“এটাকে সিক্স প্যাক না ফ্যামিলি প্যাক ডাকা হয়।”
স্নিগ্ধ মুখ কুঁচকালো। আবার অপমান করলো মেয়েটা টাকে। তখনই স্নিগ্ধর কল আসলো। রিসিভ করে কথা বলতে বলতে মেইন গেইটের দিকে এগিয়ে গেল। জানভি হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর স্নিগ্ধ আসলো। তার হাতে প্রায় ৫ টা প্যাকেট। জানভি ভ্রু কুঁচকে বলল-
“এগুলো কি?”
“আমার খাবার।”
জানভি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল-
“এত গুলো?”
“দেখো মেয়ে এভাবে নজর দিতে নেই। আমি আসার পর থেকে আইসক্রিম ছাড়া কিছু খাই নি। প্রচুর ক্ষুধা পেয়েছে এখন আমি আমার কেবিনে যাই টাটা গুড নাইট।”
বলেই স্নিগ্ধ চলে গেল। জানভি কিছুক্ষণ হা হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ফিক করে হেসে দিলো।
পরেরদিন…..
স্নিগ্ধর ঘুম আজ তারাতাড়ি ভেঙে গেল। সে সিংগেল খাটে ঘুমাতে পারে না। ঠিক মতো খাটে গড়াগড়ি করতে না পারলে তার ঘুম হয় না। এমন বদঅভ্যেসের শিকার সে ছোটোবেলা থেকে। কিন্তু বাহির থেকে খুব উঁচু গলায় কথা বলার শব্দ আসছে যার কারণে ঘুম ভেঙে গিয়েছে। বিছানা ছেড়ে নেমে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। দাঁড়ি বেশী বড়ো হয়ে গিয়েছে।দাঁড়ি সুন্দর মতো শেভ করে নিলো। এখন সে নিজেকে হিরো মনে করছে। জামা বদলে কেবিন থেকে বের হলো। অনেকেই উঠেছে। বাগানে বয়স্ক ব্যক্তিরা এক্সারসাইজ করছে। স্নিগ্ধ মুচকি হাসলো উনাদের দেখে। হঠাৎ সামনে তাকাতেই দেখে জানভির কেবিন থেকে একটা নার্স দৌড়ে বের হলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু হয়েছে সেই কেবিনে। স্নিগ্ধ দ্রুত গিয়ে নার্সের সামনে দাঁড়িয়ে বলল-
“কি হয়েছে?”
“পরে বলছি আমার এখন দ্রুত রক্তের ব্যবস্থা করতে হবে।”
বলেই নার্স দৌড়ে চলে গেল। স্নিগ্ধ কলিজা মোচড় মারছে নার্সের কথা শুনে। দৌড়ে জানভির কেবিনে গেল। ডক্টর শামসুর নাহার এবং আরে দুজন ডক্টর দাঁড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধ ভেতরে ঢুকে দেখে জানভি তার বিছানা শুয়ে আছে নাকে অক্সিজেন মাস্ক পড়ানো। তার জামার কাঁধে পাশ রক্তে ভিজে আছে। স্নিগ্ধ ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। ডক্টর তাকে দেখে বলল-
“স্নিগ্ধ তুমি এখন বাহিরে যাও চিন্তা করো না জানভির কিছু হবে না।”
স্নিগ্ধ এক কদম এগিয়ে এসে বলল-
“ওর কি হয়েছে ডক্টর?”
“ব্রেইন স্ট্রক করতে করতে বেঁচেছে। কান দিয়ে রক্ত বের হয়ে গিয়েছে প্যানিক অ্যাটাক হওয়ায়।”
স্নিগ্ধর মনে হলো কেও তার বুকে খুব জোরে ধাক্কা মেরেছে৷ সে দ্রুত গিয়ে জানভির পাশে বসে তার হাত ধরলো।
“স্নিগ্ধ প্লিজ তুমি যাও এখন। ওর চিকিৎসা করতে হবে। নাহলে বাঁচানো যাবে না।”
স্নিগ্ধ ভয়ংকর রাগী দৃষ্টিতে ডক্টরের দিকে তাকাল। ডক্টর একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল-
“যা সত্য আমি তা বললাম। তার বাবা মা আসলে উনাদের বলবো অন্য হসপিটালে শিফট করে দিতে। কারণ এটা আমাদের হসপিটাল না। আমরা এখানে রোগীদের রাখি থেরাপির জন্য। দেবজানির এখন ভালো চিকিৎসার প্রয়োজন। যা এখানে আমরা তাকে দিতে পারবো না ভালে মতো।”
স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে ডক্টরের চোখে চোখ রেখে উঁচু স্বরে বলল-
“আপনারা চিকিৎসা করতে পারবেন না তো জানভিকে এখানে কেন রেখেছেন?”
“তুমি শান্ত হও। তোমার মাথা এখন বিগড়ে আছে বলে আমার কথা বুঝতে পারো নি। মেন্ট্যাল হসপিটাল চেনো? এটা কিছুটা তেমনই। আমরা এখানে পেশেন্টদের নানা ধরণের থেরাপি দেই। যাতে তারা স্মৃতি শক্তি না হারায়।”
“জানভির প্যানিক অ্যাটাক কেন হলো?”
“সেটা জানি না, নার্স তাকে সকালের ঔষধ দিতে এসেছিল। এসে দেখে সে ছটফট করছে বিছানায় শুয়ে। ভাগ্যিস আমরা সময়ের মতো এসেছি নাহলে অঘটন ঘটে যেত।”
“আমার জানভির কিছু হলে আপনাকে এবং আপনার হসপিটালকে আমি ধ্বংস দিবো।”
“এই হুমকি অন্য কাওকে গিয়ে দাও। সবসময় আবেগে ভেসে গেলে হয় না।”
তাদের তর্ক দেখে সাথে একজন ডক্টর বলল-
“থামবেন আপনারা? আমরা এখানে চিকিৎসা করতে এসেছি ঝগড়া করতে না। প্লিজ দুজনই চুপ থাকুন। আর মিস্টার স্নিগ্ধ আপনি প্লিজ বের হোন আমাদের আমাদের কাজ করতে দিন।”
স্নিগ্ধ রাগী দৃষ্টিতে ডক্টর শামসুর নাহারের দিকে তাকিয়ে থেকে কেবিন থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেল। তখনই নার্স আসলো। ভেতরে ঢুকে কেবিনের দরজা বন্ধ করে দিলো। স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে রাগে কটমট করছে। হঠাৎ সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে জানভির মা বাবা এবং রঞ্জন এগিয়ে আসছে। উনারা স্নিগ্ধকে চিনে। স্নিগ্ধকে দেখে জানভির বাবা দাঁড়িয়ে পরলেন। স্নিগ্ধ দ্রুত গিয়ে জানভির বাবার সামনে দাঁড়াল। কিছু বলতে যাবে তখনই জানভির সজোরে স্নিগ্ধর গালে চড় মেরে দিলো।
চলবে……