অবাধ্য_মন,পর্ব_৪

0
706

#অবাধ্য_মন,পর্ব_৪
#শোভা_আক্তার(লাভলী)

স্নিগ্ধ দ্রুত গিয়ে জানভির বাবার সামনে দাঁড়াল। কিছু বলতে যাবে তখনই জানভির সজোরে স্নিগ্ধর গালে চড় মেরে দিলো। স্নিগ্ধ অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে জানভির বাবার দিকে তাকাল। জানভির বাবা স্নিগ্ধর কলার ধরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বলল-
“তোর সাহস কি করে হলো আবার আমার মেয়ের জীবনে আসার?”
স্নিগ্ধ চোখ ঘুরিয়ে রঞ্জনের দিকে তাকাল। রঞ্জন পকেটে হাত রেখে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধ বুঝেছে রঞ্জন নিশ্চয়ই জানভির বাবাকে সব বলেছে। স্নিগ্ধ চোখ ফিরিয়ে আবার বাবার দিকে তাকাল। বাবা রাগে ফুসছে।
“আমার মেয়ের যদি কিছু কয় তোকে জীবিত জ্বালিয়ে ফেলবো।”
“আমি জানি, অতীতে যা করেছি তা মোটেও ঠিক হয় নি। আমার কারণে আজ আপনার মেয়ের এই অবস্থা। আমি সবকিছু ঠিক করতেই ফিরে এসেছি।”
“লাগবে না, কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা আছি আমাদের মেয়ের পাশে। চলে যা স্নিগ্ধ, নাহলে আমি কি করে বসবো নিজেও জানি না।”
বলেই জানভির বাবা স্নিগ্ধকে ছেড়ে হনহন করে এগিয়ে গেল। রঞ্জন ধীরপায়ে হেটে এসে স্নিগ্ধর বরাবর দাঁড়াল।
“বলেছিলাম না যা করবে ভেবে করো। সেদিন দেবজানির সাথে অমন না করলে আজ তোমরা একসাথে থাকতে।”
“একটা কথার উত্তর চাই, দেবে?”
“কি?”
“জানভিকে ভালোবাসো?”
“সব সম্পর্কে ভালোবাসা নামক অনুভূতি থাকে। আমার আর দেবজানির সম্পর্ক কেমন আমি জানি না। কিন্তু এইটুকু বলতে পারি, ওর ক্ষতি হলে আমি কষ্ট পাই।”
বলেই রঞ্জন চলে গেল। স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। সে এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। জানভির বাবা তাকে সহ্য করতে পারে না। স্নিগ্ধর ভয় বেড়ে গেল। জানভিকে হারানোর পথে সে এসে পরেছে। স্নিগ্ধ এলোমেলো পায়ে হেটে হসপিটাল থেকে বের হলো। মাথায় নানা ধরণের কথা ঘুরছে তার। সিএনজি নিয়ে সে বাসায় চলে আসলো। কলিংবেল বাজিয়ে স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। কপাল বেয়ে ঘাম পরছে তার৷ কিছুক্ষণের মধ্যে মা এসে দরজা খুললো। স্নিগ্ধকে দেখে উনি প্রথম খুশী হলেন কিন্তু স্নিগ্ধর অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। স্নিগ্ধ কাঁপা কাঁপা পা এগিয়ে নিতেই পড়ো যেতে নিলো। মা সাথে সাথে স্নিগ্ধকে ধরে উঁচু স্বরে স্নিগ্ধর বাবাকে ডাকলেন। বাবা দৌড়ে এসে স্নিগ্ধকে দেখে চমকে উঠলেন। দুজন মিলে স্নিগ্ধকে ধরে তার ঘরে নিয়ে গেলেন। স্নিগ্ধ বিছানায় হেলান দিয়ে বসে তারাতাড়ি শরীরের শার্ট খুলে ফেলল। প্রচন্ড ঘামছে সে। বাবা স্নিগ্ধর অবস্থা দেখে দ্রুত ডাক্তারকে কল করলেন।

মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে জানভি ধীরে ধীরে চোখ খুলল। চোখ মেলে দেখে মা বসে আছে তার পাশে। জানভি মাকে দেখে হাসিমুখে উঠতে নিলো। রঞ্জন সাথে সাথে পাশ থেকে বলল-
“খবরদার উঠবে না। স্যালাইন চলছে হাতে শুয়ে থাকো।”
রঞ্জনের কথা শুনে জানভি শুয়ে পরলো আবার। মা আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে জানভির কপালে চুমু দিয়ে গালে হাত রাখলো। জানভি চোখ ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকাল। বাবা ডাক্তার শামসুর নাহারের সাথে কথা বলছে দাঁড়িয়ে। জানভি রঞ্জনের দিকে তাকালো। রঞ্জন মুচকি হেসে বলল-
“কিছু বলবে?”
“স্নিগ্ধ কোথায়?”
জানভির মুখে স্নিগ্ধর নাম শুনে বাবা দ্রুত এগিয়ে আসলেন।
“বলেছিলাম না সেই ছেলেটার সাথে যোগাযোগ রাখতে না?”
“কেন বাবা?”
“তোমার সাথে সে কি করেছিলো ভুলে গেলে?”
“আমি জানি না বাবা। স্নিগ্ধ বলেছিলো আমি তাকে চিনি। গতকাল রাত থেকে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু একটুও মনে করতে পারছি না আমার সাথে তার সম্পর্ক কি।”
“যেহেতু মনে করতে পারছো না আর ভেবো না। ডাক্তার বলেছে তুমি অতিরিক্ত ব্রেইনে প্রেশার দিয়েছিল যার কারণে ব্রেইন স্ট্রোক হয়ে যেত।”
“আমি কি করবো বাবা? আমার যে অনেক ইচ্ছে করছে জানতে যে তার সাথে আমার কেমন সম্পর্ক।”
রঞ্জন বলল-
“ঘৃণার”
জানভি রঞ্জনের দিকে তাকাল। রঞ্জন ধীরপায়ে হেটে এসে জানভির মাথায় হাত দিয়ে বলল-
“সে তোমার সাথে যা করেছিল তা মনে করলেই আমার ইচ্ছে করে ওকে মেরে ফেলি।”
“কি করেছিলো? প্লিজ বলো আমাকে।”
“প্রতারণা, নাটক। সে তোমার মন নিয়ে খেলা করেছে। এর বেশী কিছু জানতে চেও না দেবজানি।”
“কিন্তু রঞ্জন, তাকে দেখলে আমার মনে হয় সে আমার অনেক আপন কেও।”
রঞ্জন জানভির দিকে ঝুঁকে মুচকি হেসে বলল-
“আপন মানুষদের মাঝেই কালসাপ লুকিয়ে থাকে যা আমরা ধরতে পারি না। যেদিন তোমার স্মৃতি ফিরবে সেদিন বুঝবে।”
বলেই রঞ্জন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জানভির বাবার দিকে এগিয়ে গেল।
“তাকে আর কিছু বলতে হবে না আংকেল। খুব কষ্টে তাকে ডিপ্রেশন থেকে বের করেছি আমরা।”
বাবা রঞ্জনের কাঁধে হাত রেখে বললেন-
“সেদিন থেকে এখন পর্যন্ত যা যা করেছো আমাদের জন্য এর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ দিবো না। তুমি আমার ছেলের মতো রঞ্জন। আমি সারাজীবনের জন্য ঋণী হয়ে থাকবো।”
“ছেলেও বলছেন আবার নিজেকে ঋণীও বলছেন। ছেলে যদি বাবার সাহায্য করে বাবা ঋণী হয়ে যায়?”
জানভির বাবা হেসে রঞ্জনকে জড়িয়ে ধরলো। জানভি তাকিয়ে আছে বাবা আর রঞ্জনের দিকে।

“প্রেশার লো হয়ে গিয়েছিল তার। হয় তো বেশ চিন্তাভাবনা করেছিল।”
ডাক্তারের কথা শুনে স্নিগ্ধর বাবা মা একে অপরের দিকে তাকালেন। ডাক্তার একটা কাগজের টুকরা বাবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-
“এই ঔষধটা খাওয়ালেই হবে। আর ওট ঘুমানো প্রয়োজন। পুষ্টিকর খাবার খাইয়ে দিন সুস্থ হয়ে যাবে।”
স্নিগ্ধর মা মাথা নাড়ালেন। ডাক্তার উঠে দাঁড়াল যাওয়ার জন্য। বাবা সাথে গেলেন দরজা পর্যন্ত ডাক্তারের সাথে। স্নিগ্ধ চোখ বন্ধ করে রেখেছে। মা স্নিগ্ধর হাত ধরতেই স্নিগ্ধ ধীরে ধীরে চোখ খুলল। তখনই বাবা আসলেন। ছেলের এই অবস্থা দেখে দুজনই বেশ ভয়ে আছে। মা কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন-
“ছেলে-মেয়ের জীবনে কষ্ট আসলে তারা বাবা মায়ের সাথে শেয়ার করে। কিন্তু তুমি সেটা করো না। কোথায় গিয়েছিলে সেটাও বলে যাও নি। আর হ্যাঁ ফিরলে এই অবস্থায়?”
বাবা এগিয়ে এসে বললেন-
“তোমাকে সব বলতে হবে স্নিগ্ধ। কি হয়েছে বাবা বলো আমাদের।”
স্নিগ্ধ হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ছেলের কান্না দেখে বাবা মা চমকে উঠলেন। দুজনই স্নিগ্ধর পাশে বসে স্নিগ্ধকে মানাতে লাগলেন। স্নিগ্ধ সোজা হয়ে বসে মাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কান্না করছে। বাবা মা অনেক জোর করায় স্নিগ্ধ উনাদের সব বলল। মা কপালে হাত দিয়ে বসে আছে। বাবা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধর দিকে। স্নিগ্ধ বাবা মাকে দেখে বলল-
“আমি জানি আমি অনেক খারাপ করেছিল তার সাথে। কিন্তু বাবা, এখন আমি বুঝতে পেরেছি আমার ভুল।”
“এখন ভুল বুঝে কি লাভ? হারিয়ে তো ফেললে তাকে।”
“না বাবা, আমি হারাই নি তাকে। তার স্মৃতি ফিরে আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মা বললেন-
“স্মৃতি ফিরলে সে তোমাকে মাফ করে দিবে সেটার গ্যারান্টি কি? আমিও একজন মেয়ে মানুষ। এত বড়ো প্রতারণার শিকার করে আমি কখনো একজন প্রতারককে মাফ করতাম না।”
মায়ের কথা শুনে স্নিগ্ধ মাথা নিচু করে ফেলল। বাবা বললেন-
“তুমি তো আমার ছেলে। তো কিভাবে পারলে একটা মেয়েকে এভাবে কষ্ট দিতে? একবারো ভাবলে না এটা বাবা মা জানলে কতটুকু কষ্ট পাবে?”
“আই এম সরি বাবা। আমি বুঝতে পারি নি আমার একটা ডেয়ার এত বড়ো ক্ষতি করবে মেয়েটার।”
“এখন তুমি কি চাও?”
“আমি তাকে আমার জীবনে ফিরে চাই।”
মা স্নিগ্ধর বাবার দিকে তাকালেন। কি বলবে কেও কিছু বুঝতে পারছে না। স্নিগ্ধ চোখ মুছে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। প্রচুর ঘুম আসছে তার। চোখ বন্ধ করে ফেলল ঘুমের রাজ্যে হারানোর জন্য।

জানভিকে অন্য হসপিটালে শিফট করার পরামর্শ দিলেন ডাক্তার শামসুর নাহার। তার ট্রিটমেন্ট কন্টিনিউ রাখা খুব প্রয়োজন। কিন্তু বাবা বললেন উনি জানভিকে হসপিটালে রেখে চিকিৎসা করাতে চান না। উনারা বাসায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। ডাক্তার পারমিশন দিলেও এতে কিছুটা রিস্ক আছে সেটা বলে সতর্ক করে দিলেন। জানভি বেশী ভাবনাচিন্তা করলে তার প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে। তাই তাকে সবসময় হাসিখুশি ও চোখের সামনে রাখতে বলেছে। বাবা রাজি হলেন। আজ রাতেই জানভিকে বাসায় নিয়ে চলে যাবে ডিসাইড করেছে। জানভি হেলান দিয়ে বসে রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে আছে। রঞ্জন আর মা মিলে তার জামা কাপড় গুছিয়ে দিচ্ছে৷ জানভি রঞ্জনকে একজন ভালো বন্ধুর চোখে দেখে। রঞ্জনের মনে যদি তার প্রতি অনুভূতি থাকে? জানভির অকারণে ভয় করছে। সে রঞ্জনকে বন্ধু ছাড়া অন্য কোনো রূপে দেখতে চায় না।রঞ্জনের দৃষ্টি হঠাৎ জানভির দিকে গেল। তার চাহনি দেখে হেসে বলল-
“কি ভাবছো এভাবে তাকিয়ে থেকে?”
রঞ্জনের কথা শুনে জানভি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। মা তাদের দুজনকে দেখে বলল-
“যদি ব্যক্তিগত কথা বলতে চাও আমি যেতে পারি।”
জানভি বলল-
“না মা, কোনো কথা নেই। একটু তারাতাড়ি কাজ করো আমি বাসায় যেতে চাই।”
মা জবাবে হাসলেন। জানভি লম্বা নিশ্বাস ফেলে জানালার দিকে তাকাল। তার খুব ইচ্ছে করছে স্নিগ্ধকে দেখার৷ কিন্তু এখন হয় তো আর সম্ভব না। সে চলে গেলে স্নিগ্ধর দেখা আর পাবে না। কারণ সে বাসায় চলে যাচ্ছে আর স্নিগ্ধ বাসায় গেলে বাবা তাকে মেরে ফেলবে রাগের বশে। জামা কাপড় গুছিয়ে হসপিটালের ফর্মালিটি পূরণ করে তারা জানভিকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। জানভির দৃষ্টি রাস্তার দু পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদি একবার স্নিগ্ধর দেখা মিলে যায়? কিন্তু জানভি হতাশ হলো। বাসায় পৌঁছে গেল তারা কিন্তু রাস্তায় কোথাও স্নিগ্ধর দেখা পেল না। রঞ্জন জানভিকে নিয়ে তার ঘরে গেল। জানভিকে খাটে বসিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে ঘরের লাইট ফ্যান অন করে দিলো। অনেকদিন পর বাসায় এসে জানভির ভালো লাগছে। রঞ্জন খাটের এক পাশে বসে জানভির দিকে তাকিয়ে বলল-
“কি বলতে চাও বলো।”
রঞ্জনের কথা শুনে জানভি তার দিকে তাকাল। রঞ্জন উত্তরের অপেক্ষা করছে। জানভি অন্যদিকে তাকিয়ে বলল-
“স্নিগ্ধ আর আমার সম্পর্ক কি সত্যি করে বলো।”
“ভার্সিটিতে তুমি আর আমি ছিলাম সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আমাদের দেখে সবাই বলতো আমরা বেস্টফ্রেন্ড থেকে বেশী কিছু।”
জানভি রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমি আমাদের না, আমার আর স্নিগ্ধর সম্পর্কে জানতে চাই।”
“সেটাই বলছি, সে যেভাবে আমাদের মাঝে এসেছে শুনবে না?”
“আমাদের মাঝে?”
রঞ্জন তালিচ্ছ্যেস হাসি দিয়ে বলল-
“একদিন স্নিগ্ধ রায় ভার্সিটিতে আসেন। কলকাতা থেকে অর্ধেক পড়াশোনা শেষ করে বাংলাদেশে এসে এডমিশন নেন। তার দৃষ্টি কতটুকু বাজে সেটা আমরা ভালো মতোই জানতাম। জুনিয়র এক মেয়ের সাথে বেয়াদবি করেছিল বলে তুমি সবার সামনে তাকে অপমান করেছিলে। এটাই তার প্রেস্টিজকে আঘাত করেছিল। তারপর শুরু হলো তার নাটক, প্রতারণা করার চক্র। তুমি ধীরে ধীরে তার নাটকের জালে ফেঁসে গেলে। আমি তোমার বেস্টফ্রেন্ড, তবুও আমার কথা বিশ্বাস করতে না। একদিন সে তোমাকে প্রপোজ করে। আমার চোখের সামনে। তার কলার ধরায় আমাকে সবার সামনে তুমি যা নয় তা বলেছিলে। কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলি নি। ভেবেছিলাম তার বিরুদ্ধে প্রমাণ পেলে তারপর তোমার সামনে যাব। কিন্তু মজাদার বিষয় কি জানো? তুমি স্নিগ্ধর প্রেমে এমনভাবে অন্ধ হলে সেই প্রমাণ গুলোর উপর বিশ্বাসই করলে না।”
জানভির চোখে পানি টলমল করছে। রঞ্জন দৃষ্টি ফিরিয়ে চোখের পানি মুছে আবার বলল-
“ওই অমানুষটাকে তুমি যখন তোমার মনের কথা বললে সে তোমার সামনে নিজের আসল চেহারা দেখিয়ে দিলো। এতদিন সে নাটক করছিল তোমার সাথে। তুমি তবুও বিশ্বাস করতে চাইছিলে না। ভার্সিটি থেকে চলে আসার পর আমি তোমার পেছনে আসি। ঘরে নিজেকে বন্ধ করে রেখেছিলে। অনেকক্ষণ পর তোমার সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা ভাঙতে হয়েছিল। তোমাকে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে। ভয় পেয়েছিলাম আমরা তোমার অবস্থা দেখে। ভেবেছিলাম হয় তো আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলে। কিন্তু না, ডাক্তার বলেছে তুমি এখন ট্রমায় আছো। কিন্তু ধীরে ধীরে তুমি ডিপ্রেশন চলে যাও। এই ডিপ্রেশন তোমার ভেতর রোগ সৃষ্টি করে ফেলেছে। এখন তুমি কিছুই মনে রাখতে পারো না।”
জানভির চোখ গড়িয়ে পানি পরতেই সাথে সাথে মুছে নিলো। রাগে শরীর জ্বলছে তার। তার কিছু মনে নেই কিন্তু রঞ্জন যা যা বলছে তার মনে হচ্ছে সব সত্য। জানভি দাঁড়িয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। রঞ্জন দাঁড়িয়ে দ্রুত তার সামনে এসে খাটে বসিয়ে বলল-
“তুমি স্ট্রেস নিও না দেবজানি৷ বিশ্রাম করো এখন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“রঞ্জন, আমি আর এভাবে বাঁচতে চাই না। এই কেমন রোগ আমার মধ্যে জন্ম হলো? কার উপর বিশ্বাস করবো কার উপর না কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“তুমি আমাকে অবিশ্বাস করতে পারো আমার এতে সমস্যা নেই। কিন্তু দেবজানি একটা অনুরোধ করছি। কখনো স্নিগ্ধ রায় এর কথায় বিশ্বাস করো না। সে আবার তোমাকে কষ্ট দিতে চায় আমার মন বলছে।”
জানভি মাথা নাড়াল। তখনই বাবা আর মা আসলেন ঘরে। রঞ্জন কিছুটা দূর সরে দাঁড়াল। বাবা এসে জানভির পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-
“আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে যাবে। শুধু তাকে বিশ্রাম করতে হবে।”
“বাবা, আমি একটা অনুরোধ করি? রাখবে আমার কথা?”
“কি? আমার মেয়ের জন্য তো আমি সব করতে পারি।”
“ঘরে বন্দী থেকে আমি সুস্থ হতে চাই না। আমি আমার আগের জীবন ফিরে চাই। প্লিজ আমাকে ভার্সিটি যাওয়ার পারমিশন দাও।”
বাবা জানভির মাথা থেকে হাত সরিয়ে ফেললেন। জানভি তারাতাড়ি বাবার হাত ধরে বলল-
“আমি ওয়াদা করছি আর এমন কোনো ঘটনা ঘটাবো না যাতে তোমার কষ্ট হবে। আমি নিজের পুরো খেয়াল রাখবো। আর কারো ফাঁদে পা দিবো না।”
বাবা জানভির মায়ের দিকে তাকালেন। মা কি বলবেন নিজেও বুঝতে পারছে না। রঞ্জন বাবার কাঁধে হাত রেখে বলল-
“দেবজানি যতক্ষন ভার্সিটি থাকবে তার দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দিন আংকেল।”
বাবা রঞ্জনের দিকে তাকালেন। একমাত্র এই ছেলেটার উপরই উনি ভরসা করতে পারছেন। জানভির দিকে তাকিয়ে বললেন-
“নিজের ওয়াদা ভুলবে না তো?”
জানভি না সূচক মাথা নাড়িয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে কান্না থামালো।

পরেরদিন…..
কল টনের শব্দে স্নিগ্ধর ঘুম ভাঙলো। উঠে বসে চোখ ডলে ঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে ৭ টা বেজে গিয়েছে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে বন্ধুর কল এসেছে। রিসিভ করে কানে ধরলো। অপরপাশ থেকে এমন কিছু শুনলো যা শুনে সে আর বসে থাকতে পারলো না। দ্রুত বিছানা ছেড়ে নেমে স্নান করে তৈরী হয়ে নিলো। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে দ্রুত বের হলো বাসা থেকে। বাবা মা ঘুম তাই দেখা করতে পারলো না। বাইক ফুল স্পিডে চালিয়ে ভার্সিটি আসলো। পার্কিং প্লেসে বাইক পার্ক করছিলো তখনই তার বন্ধুরা দৌড়ে আসলো। স্নিগ্ধ তাদের দেখে জিজ্ঞেস করলো-
“কোথায় তোদের বৌদি?”
একজন বলল-
“ক্লাসে, কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো বৌদি রঞ্জনের সাথে এক বেঞ্চে বসেছে।”
স্নিগ্ধর মাথা গরম হয়ে গেল সাথে সাথে। বাইক পার্ক করে দ্রুত হেটে ক্লাসে আসলো। জানভি আর রঞ্জন একসাথে বসে কথা বলছে হেসে হেসে। স্নিগ্ধ দ্রুত এসে জানভির সামনে দাঁড়াল। রঞ্জন আর জানভি স্নিগ্ধর দিকে তাকাল। রঞ্জন দাঁড়াতে নিলো কিন্তু জানভি তার হাত ধরে চোখের ইশারায় চুপচাপ বসতে বলল। স্নিগ্ধ পুরো ক্লাসে চোখ বুলাল। সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের তিনজনের ঝগড়া দেখতে পুরো ভার্সিটির মানুষরা পছন্দ করে। স্নিগ্ধ জানভির দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল-
“তুমি অসুস্থ, কেন আসলে ভার্সিটি?”
“আমার লাইফ, আমার অসুস্থ, আমার ইচ্ছা আপনার এত চিন্তা কিসের?”
স্নিগ্ধ রাগী দৃষ্টিতে রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল-
“করে দিলে ওর ব্রেইন ওয়াশ।”
রঞ্জন জবাব দিলো না। জানভি ধমকের গলায় বলল-
“স্টপ ইট স্নিগ্ধ, আমি ছোটো বাচ্চা নই যে কারো কথায় এসে পরবো। আমার সব মনে পড়ে গিয়েছে। তুমি আমার সাথে যা করেছো আমি কিভাবে ভুলে গিয়েছিলাম বুঝতে পারছি না। তোমার মতো অমানুষ আমি আর কোথাও দেখি নি।”
স্নিগ্ধ জানভির হাতে হাত রাখতেই জানভি এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল-
“সাহস কি করে হলো আমাকে টাচ করার?”
স্নিগ্ধ চারপাশে চোখ বুলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল-
“তোমার সামনে তামাশা করো না।”
“কেন? খারাপ লাগছে? ইগো হার্ট হলো তোমার তাই না? তো ভাবো সেদিন আমার কেমন লেগেছিল যখন তুমি সবার সামনে আমাকে হাসির পাত্র বানিয়ে ফেলেছিলে।”
স্নিগ্ধ লজ্জিত হলো জানভির কথা শুনে। রঞ্জন দাঁড়িয়ে জানভির কাঁধে হাত রেখে বলল-
“দেবজানি ভুলে যাও যা হয়েছে। সে তোমার সাথে যা করেছে তুমিও তাই করলে তোমার আর ওর মধ্যে পার্থক্য কোথায় রবে?”
“ঠিক বললে রঞ্জন, আমি ওর মতো অমানুষ না। যা হয়েছে ভুলে গেলাম। মাফ করে দিলাম ওকে আমি। কিন্তু ও যদি আমার আশে পাশে না আসে। আমি ওর চেহারা আর দেখতে চাই না।”
স্নিগ্ধর প্রচুর খারাপ লাগছে জানভির কথা শুনে। জানভি বসে রঞ্জনকে ইশারায় বসতে বলে স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল-
“এখন আপনি যেতে পারেন স্যার আসবেন এখন।”
স্নিগ্ধ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। এলোমেলো পায়ে হেটে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গেল। জানভি চুপচাপ বসে আছে। তার কলিজা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে স্নিগ্ধর চেহারা দেখে। ছেলেটার কষ্ট সে মোটেও সহ্য করতে পারছে না। স্নিগ্ধ পিলারের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে ঘন কালো মেঘ জমে আছে। রাগে তার শরীর জ্বলছে। রঞ্জনকে একা পেলে মাটিতে পুঁতে ফেলবে। স্নিগ্ধর বন্ধুরা এসে তার পাশে দাঁড়াল। স্নিগ্ধ দাঁতে দাঁত চেপে বলল-
“আমি এমন প্রেমিক না যে নিজে দেবদাস হয়ে নিজের ভালোবাসা ত্যাগ করবো। আমার ভালোবাসা আমার না হলে তাকে অন্য কারোও হতে দিবো না। উঁহু, আমি আমার জানুর কোনো ক্ষতি করবো না। যে যে তার জীবনে আসার চেষ্টা করবে ওকে শেষ করে দিবো। না, আমি কাওকে খুনও করবো না। এমনভাবে শাস্তি দেবো যাতে সারাজীবনের জন্য বিছানায় গা ঘেষিয়ে রাখে। রঞ্জনকে একা কোথাও পেলে সাথে সাথে যেন আমার মোবাইলে কল আসে।”
“ওকে”
স্নিগ্ধ হনহন করে হাঁটা ধরলো। মনে আগুন নিয়ে হেটে যাচ্ছে সে। জানভির ব্যবহার তাকে আজ খুব কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু প্রচন্ড খারাপও লাগছে তার। সেদিন তার ব্যবহারও জানভিকে কষ্ট দিয়েছিল৷ স্নিগ্ধ নিচে যেতেই মেঘ ফেটে বৃষ্টি ঝরতে লাগলো। স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। চোখের জল লুকানোর জন্য এই বৃষ্টি খুব প্রয়োজন ছিল তার৷ বৃষ্টি নেমে স্নিগ্ধকে ভিজিয়ে ফেলল। দাঁতে দাঁত চেপে কান্না থামানোর যথেষ্ট চেষ্টা করছে। কিন্তু চোখের সামনে জানভির চেহারা ভাসছে বলে পারছে না। চোখ বেয়ে পানি ঝরা কমছে না। স্নিগ্ধ মাথা নিচু করে নিজের চুল চেপে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো। ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। উপর থেকে রেলিং-এ হাত রেখে স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে আছে আরেক অবাধ্য মনের অধিকারী। যে চেয়েও পারছে না নিজের কান্না থামাতে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here