অবাধ্য_মন,পর্ব_৭

0
885

#অবাধ্য_মন,পর্ব_৭
#শোভা_আক্তার(লাভলী)

অর্পিতাদের বাসায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা হলো।রাস্তায় জ্যামে বসে থাকার কারণে স্নিগ্ধর মেজাজ প্রচন্ড মাত্রায় খারাপ হয়ে আছে। জানভি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধর পাশে। এখন কিছু বললে ছেলেটা তাকে ইচ্ছে মতো কথা শোনাবে জানভি জানে। জানভি আর স্নিগ্ধর আসার খবর পেয়ে অর্পিতা দৌড়ে বাহিরে আসলে। জানভি অর্পিতাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। প্রায় ২ বছর পর তাদের দেখা। স্নিগ্ধ বিরক্ত হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আর একটা কথা সে বুঝতে পারছে না। জানভির যেহেতু ভুলে যাওয়ার রোগ হয়েছে তো সে অর্পিতাকে কিভাবে মনে রেখেছে। অর্পিতা জানভিকে ছেড়ে স্নিগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো। স্নিগ্ধ চোখ ঘুরিয়ে জানভির দিকে তাকাল। জানভি স্বাভাবিক দৃষ্টি বানিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। অর্পিতা স্নিগ্ধকে ছেড়ে তাদের দুজনের উদ্দেশ্যে বলল-
“এত লেইট? আমি সকাল থেকে অপেক্ষা করছিলাম। আর আমি ভাবতেও পারি নি তোমরা একসাথে আসবে।”
স্নিগ্ধ বলল-
“আমি একাই আসতাম৷ ও আমার পিছু নিয়েছে।”
জানভি রেগে উঠলো। স্নিগ্ধর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
“কী বলতে চাও তুমি?”
“এটাই যে তুমি আমার সাথে এসেছো আমি তোমার সাথে না।”
“এক্সকিউজ মি, আমরা একই বাসায় এসেছি তো এখানে কে কার সাথে এসেছে এটা ভেবে কী লাভ?”
স্নিগ্ধ কিছু বলার আগে অর্পিতা বলল-
“ওকে ওকে রিলাক্স, প্লিজ তোমরা ঝগড়া করে না। আমার বিয়ে হতে চলেছে। বিদায়ের আগে আমি কারো ঝগড়া দেখতে চাই না।”
জানভি বলল-
“আমার এখন ঝগড়া করার একদমই মুড নেই। আর যদি আমাদের মাঝে ঝগড়া হয় ভেবে নিও ওর কারণে হচ্ছে সব।”
স্নিগ্ধ ভেংচি কাটলো। অর্পিতা হেসে ওদের দুজনকে নিয়ে ভিতরে গেল। সবার সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিলো। অর্পিতার ভাই স্নিগ্ধকে নিয়ে গেল তার ঘরে। স্নিগ্ধ অর্পিতার ভাইয়ের ঘরে থাকবে। আর জানভি অর্পিতার সাথে থাকবে তার ঘরে। জানভি খাটে বসে গা এলিয়ে দিলো। বসে থাকতে থাকতে তার কোমড়, পিঠ ব্যাথা হয়ে গিয়েছে। অর্পিতা তার পাশে শুয়ে বলল-
“তোমাদের দুজনকে একসাথে খুব মানায়।”
জানভি অর্পিতার দিকে তাকাল। সে কি জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। অর্পিতা আবার বলল-
“আমি শহরে না থাকলেও তোমাদের সব খবর রাখি৷ জানভি, স্নিগ্ধকে কী মাফ করা যায় না?”
জানভি অর্পিতার প্রশ্ন শুনে উঠে বসলো। সে এখনো জবাব খুঁজে পেল না৷ অর্পিতা ঘড়ির সময় দেখে বলল-
“তুমি এখন নাহয় রেস্ট নাও৷ চাইলে স্নান করতে পারো। আমি স্নিগ্ধকে দেখে আসি। আর তোমার সাথে এই বিষয়ে পরে কথা হবে।”
বলেই অর্পিতা চলে গেল। জানভি তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। সে এখন নিজেও বুঝতে পারে না তার মন কী চায়। এক সময় মনে হয় স্নিগ্ধকে ছাড়া বেঁচে থাকা কষ্টকর। আর এক সময় ভাবে স্নিগ্ধ থাকলে সে শান্তি মতো বাঁচতে পারবে না।

স্নিগ্ধ ভ্রু কুঁচকে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে৷ অর্পিতার ভাই বিছানা পরিষ্কার করে বলল-
“দাদা এখন বসুন। আসলে মেহমান ছিলো আমার ঘরে তাই নোংরা লাগছে। আমি কাজের মানুষকে বলে পরিষ্কার করিয়ে দিচ্ছি।”
“তোমার ঘরে এসি নেই?”
“আপনি এতক্ষণ এসি খুঁজছিলেন?”
স্নিগ্ধ অর্পিতার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। দরজার সামনে থেকে অর্পিতা হাসতে হাসতে এগিয়ে আসতে আসতে বলল-
“বড়োলোক মানুষদের গরম বেশী। যতদিন আছেন আপনার খুব কষ্ট করতে হবে কিন্তু।”
“সমস্যা নেই, একদিন দেখবো। ভালো না লাগলে আশে পাশে থাকার জন্য হোটেল খুঁজে নিবো।”
“আহা কত সুখ। বাসা থেকে এক পা বের করলে পা ভেঙে ফেলবো।”
“হুমকি দিয়ে লাভ নেই আমি ভয় পাই না।”
“ভয় কে দেখাচ্ছে? আমি সত্যি বললাম।”
স্নিগ্ধ বিছানায় বসে হেলান দিলো। এখন পিঠ শান্তি পেয়েছে তার। অর্পিতা স্নিগ্ধর পাশে বসে বলল-
“আমি রঞ্জনকেও দাওয়াত দিয়েছিলাম। সে বলল আসলে একেবারে বিয়ের দিন আসবে।”
“কেমন হবু স্বামী দেখলে? নিজের হবু স্ত্রীকে কিভাবে একা আসতে দিলো? জানভি আমার হবু স্ত্রী হলে চোখেহারা করতাম না।”
“সবাই কী আর স্নিগ্ধ রায় এর মতো পাগল প্রেমিক হয়? কিন্তু স্নিগ্ধ আমার মনে হয় রঞ্জন চায় জানভি তোমাকে মাফ করে তোমার সাথে জীবন শুরু করুক।”
“তোমার এমনটা কেন মনে হলো?”
“জানভি জানতো না আমি তোমাকেও ডেকেছি। কিন্তু রঞ্জন জানতো। তবুও সে জানভিকে বলে নি। আর তুমিই বলো তুমি যেহেতু আসবে তো রঞ্জন কেন জানভিকে তোমার ভরসায় একা আসতে দিলো?”
অর্পিতার কথা শুনে স্নিগ্ধ হেলান ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। এখন তার মনে হচ্ছে পুরো দুনিয়া ঘুরছে। অর্পিতার মায়ের ডাক আসলো। সে স্নিগ্ধকে রেস্ট করতে বলে চলে গেল। স্নিগ্ধ ঠাঁই বসে আছে। অর্পিতার কথা যদি সত্যি হয় রঞ্জনের সাথে তার কথা বলা জরুরি।

রাতের খাওয়া দাওয়ার সময় হতেই অর্পিতার মা সবাইকে ডাকলো৷ অর্পিতা ও জানভি বসে গল্প করছিলো। মায়ের ডাক শুনে দুজন ঘর থেকে বের হলো। জানভি বের হতেই স্নিগ্ধর সাথে মুখোমুখি হলো। জানভি স্নিগ্ধকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। স্নিগ্ধ রাত করে হঠাৎ পাঞ্জাবি পড়লো কেন?জানভি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই স্নিগ্ধ ভাব দেখিয়ে চলে গেল। জানভি থতমত খেয়ে গেল স্নিগ্ধর ব্যবহার দেখে। স্নিগ্ধ গিয়ে বসলো। ছেলেরা এক পাশে আর মেয়েরা আর এক পাশে বসবে। অর্পিতার ডাকে জানভি গিয়ে তার পাশে বসলো। বাসা ভর্তি মানুষ। তবুও যেন আরো অনেক মানুষ আসলে জায়গা কম পরবে না। জানভি হলরুমে চোখ বুলিয়ে বলল-
“অর্পিতা, তোদের বাসা খুব সুন্দর। আর খুব বড়ো-ও।”
“আমি সবসময় ঠাম্মিকে বলি বাসা একদম সুন্দর না। উনি তো রেগে আগুন হয়ে যান। তুই উনার সামনে বাড়ির প্রশংসা করিস। দেখবি এমন খুশী হয়েছে বাড়িটাই তোর নামে করে দেবে।”
সবাই হেসে উঠলো জানভির কথা শুনে। তখনই একটা মেয়ে দৌড়ে এসে জানভির পাশে বসলো।
“সরি সরি লেইট হয়ে গেলাম।”
অর্পিতা মেয়েটাকে দেখে হেসে বলল-
“একদম না, আমরাও মাত্র আসলাম। জানভি তোর সাথে তো পরিচয় হয় নি। ওর নাম পূজারীনি আমার মামাতো বোন।”
জানভি তার সাথে কথা বলে পরিচয় হয়ে নিলো। কথা বলতে বলতে তারা খাওয়া দাওয়া করে উঠলো। স্নিগ্ধ সোফায় বসে চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে জানভিকে খুঁজছে। হঠাৎ মাথার কাছ থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসলো।
“আমার মতো সুন্দরীকে রেখে আপনার দৃষ্টি কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে?”
স্নিগ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে পূজারীনি দাঁড়িয়ে আছে। পূজারীনি ঘুরে এসে স্নিগ্ধর পাশে বসে তাকিয়ে রইলো। স্নিগ্ধ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে বলল-
“জানভি কী আন্টির সাথে রান্নাঘরে?”
“অর্পিতা দি জানভি দি পিসি তিনজনই রান্নাঘরে। আপনার মুখে হঠাৎ জানভি দির নাম শুনলাম যে। কী ব্যাপার?”
“খাবার খাওয়ার সময় ওর খুব ঝাল লাগছিলো। তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি।”
“বাব্বাহ এত কেয়ার। নিশ্চয়ই মনে তার নামের ঘর বাড়ি করে রেখেছেন।”
স্নিগ্ধ হেসে বলল-
“না, তেমন কিছু না।”
তখনই জানভি বের হলো রান্নাঘর থেকে। স্নিগ্ধ মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পূজারীনির দিকে তাকিয়ে হাসলো। জানভি তাদের একসাথে দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। অর্পিতা বের হয়ে জানভির দিকে তাকিয়ে আবার স্নিগ্ধর দিকে তাকাল। পাশে কারো উপস্থির টের পেয়ে জানভি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। হেটে চলে আসলো ঘরে। অর্পিতা জানভির পিছন আসলো। জানভি খাটে বসে লম্বা নিশ্বাস ফেলতেই অর্পিতার কন্ঠ শুনতে পেল।
“বলে দে ভালোবাসিস।”
জানভি মাথা তুলে অর্পিতাকে দেখে বলল-
“আমি তোমার বিয়ে এনজয় করতে এসেছি। প্লিজ এসব বলো না। আর কিছুদিন পর তোমার বিয়ে। তোমার উচিত এখন নিজের কথা ভাবা।”
“জানভি, দুনিয়ায় অনেক কম মানুষ আছে যে নিজের ভালোবাসা মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পায়। তোর কাছে সুযোগের অভাব নেই।”
“আমার বিয়ে ঠিক অর্পিতা।”
“বিয়ে? আমার মনে হয় না তোমার বিয়ে হবে রঞ্জনের সাথে। ঘুরে ফিরে যখন স্নিগ্ধর কাঁধে পরবে তখন কথা বলবো ঠিক আছে?”
জানভি জবাব দিলো না৷ স্নিগ্ধকে আজ অন্য কারো সাথে দেখে এখন তার সত্যি মনে হচ্ছে রঞ্জনের সাথে বিয়েতে রাজি হওয়া তার ভুল সিধান্ত ছিল।

পরেরদিন…..
স্নিগ্ধ ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে ঘর থেকে বের হলো। বাড়ির সব মহিলারা কাজে ব্যস্ত। পরিবারের বড়ো মেয়ের বিয়ে হলে এমনই হয় বুঝি। অর্পিতার ভাই এসে স্নিগ্ধকে নাস্তার কথা জিজ্ঞেস করলো। স্নিগ্ধ করে খাবে বলে জানভির কথা জিজ্ঞেস করলো। অর্পিতার ভাই বলল জানভি অনেক আগেই উঠে গিয়েছে। সে এখন পূজারীনির সাথে পুকুরপাড়ে। স্নিগ্ধ দ্রুত ঘরে গিয়ে স্নান করে তৈরী হয়ে বের হলো৷ জানতে পারলো জানভি এখনো পুকুরপাড়ে। স্নিগ্ধ অর্পিতার ভাইকে নিয়ে পুকুরপাড়ে গেল৷ গিয়ে দেখে জানভি প্রকৃতির ছবি তুলতে ব্যস্ত৷ পূজারীনি পুকুরের সিঁড়িতে বসে ছিল পা ভিজিয়ে। স্নিগ্ধকে দেখে দ্রুত উঠে এগিয়ে আসলো।
“গুড মর্নিং, ঘুম ভেঙেছে আপনার?”
জানভি পূজারীনির কথা শুনে সেদিকে তাকাল। স্নিগ্ধর চোখে চোখ পরতেই চোখ ফিরিয়ে আবার ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে গেল। স্নিগ্ধ বলল-
“হ্যাঁ, ভাবলাম গ্রামের সকাল অনুভব করতে আসি। কিন্তু পারলাম না।”
“পারলেন না, কিন্তু কেন?”
“প্রকৃতি থেকেও সুন্দর কিছু চোখের সামনে এসে পরলো তাই।”
“প্রকৃতি থেকেও সুন্দর আবার কী হতে পারে?”
“আমি তোমার কথা বলছি।”
পূজারীনি হেসে উঠলো। তখনই জানভি উঁচু স্বরে বলল-
“মাখন”
স্নিগ্ধ আর পূজারীনি জানভির দিকে তাকাল। জানভি এক নজর স্নিগ্ধকে দেখে আবার পূজারীনির দিকে তাকিয়ে বলল-
“মাখনের ঘ্রাণ পাচ্ছি আমি।”
অর্পিতার ভাই বলল-
“হ্যাঁ কিছুটা দূরেই তো আমাদের এক মাসি থাকেন। উনি প্রতিদিন মাখন বানান। উনার মাখন খুব মজা হয়। যাবে দিদি?”
“সেই পিসির বাসায়?”
“হ্যাঁ, উনি খুব ভালো। আমরা যখনই যাই উনি পাউরুটি মাখন খেতে দেন।”
“চলো তাহলে যাই।”
স্নিগ্ধ নাক মুখ কুঁচকে বলল-
“চেনা নেই জানা নেই উনি যাবেন মাখন পাউরুটি খেতে। আজব পাবলিকের দলে আমি নেই।”
“কিন্তু আমরা তো তোমাকে জিজ্ঞেস করি নি তুমি যাবে কিনা। তুমি নাহয় প্রকৃতি দেখো আমরা যাই। পূজারীনি তুমি যাবে?”
“স্নিগ্ধদাকে একা রেখে? থাক তোমরা তাহলে যাও আমি এখানেই থাকি।”
“ওকে”
জানভি অর্পিতার ভাইকে নিয়ে হাঁটা ধরলো। জানভি মিটিমিটি হাসছে। সে জানে স্নিগ্ধ নিশ্চয়ই আসবে।

কুঁড়েঘর, গ্রামে সব থেকে সুন্দর দৃশ্য হচ্ছে পুকুর বা নদীর পাশে কুঁড়েঘর। আর সেই ঘরের চারপাশে ছোটো ছোটো ঘাসের জমিন। জানভি মুগ্ধ হয়ে চারপাশে দেখছে। সে অনেকবার আত্মীয় স্বজনদের গ্রাম ঘুরেছে। কিন্তু এই গ্রামের কথা-ই আলাদা। অর্পিতার ভাই পিসি বলে ডাকতে ডাকতে ভেতরে গেল। পিসি খাটে বসে পান সাজাচ্ছেন। অর্পিতার ভাই বিজয় পিসির পা ধরে প্রণাম করে বলল-
“কেমন আছো পিসি?”
“আমি তো ভালো, তুই হঠাৎ এনে? অর্পার না বিয়া?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি তোমার সাথে দেখা করতে আসলাম। তুমি যাবে না বিয়েতে?”
“হা যামু, অর্পা কই?”
“দিদিকে মা বাসা থেকে বের হতে না করেছেন। ঠাম্মি বলেছে কুনজরের ব্যাপার স্যাপার আছে। কিন্তু অর্পা দিদির বদলে আমার আর এক দিদি এসেছে।”
“কই কই আরে ঘরে নিয়া আয়।”
বিজয় হেসে ঘর থেকে বের হয়ে জানভিকে বলল ভেতরে আসতে। জানভি ভেতরে ঢুকে পিসির দিকে তাকাল। সামনে গিয়ে পিসিকে প্রণাম করে পাশে বসলো। পিসি জানভির মাথায় হাত রেখে হাসি মুখে বললেন-
“তোর নাম কী?”
“দেবজানি সরকার, তুমি আমাকে জানভি বলে ডাকতে পারো পিসি।”
“বাহ, নামটা খুব সুন্দর। কিরে বিজয়, কী হয় ওই তোর?”
“দিদির বান্ধবী, ঢাকা থেকে এসেছে বিয়ের জন্য।”
“ওওও, তুই কী বিবাহিতা?”
পিসির প্রশ্নে জানভি না সূচক মাথা নাড়াল।
“বিশ্বাস হয় না, এত সুন্দরী মাইয়ার বিয়া হয় নাই?”
“ভাগ্যে হয় তো এত তারাতাড়ি বিয়ে লিখা নেই। আমি এখন পড়াশোনা করছি তো তাই বিয়ে হয় নি।”
তখনই স্নিগ্ধ ঘরে আসলো। পিসি স্নিগ্ধকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল-
“এই ছোকরা কে তুই?”
জানভি আর বিজয় দরজার দিকে তাকাল। স্নিগ্ধ জিন্সের পকেটে হাত রেখে এদিক সেদিক দেখছে। জানভি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সে যা ভেবেছিল তাই হলো। পিসি জবাব না পেয়ে বলল-
“তুই কী কানে শুনতে পাস না?”
স্নিগ্ধ পিসির দিকে তাকিয়ে বলল-
“কানে তো তোমার মেশিন লাগানো আমার না। তার মানে আমি কানে শুনতে পাই তুমি পাও না।”
পিসি রেগে উঠলেন। জানভি পিসির হাতের উপর হাত রেখে বলল-
“রাগ করো না পিসি ও একটা পাগল। কোথায় কি বলতে হয় জানে না। সবসময় উল্টা পাল্টা কথা বলে।”
স্নিগ্ধ জানভির দিকে তেড়ে এসে বলল-
“এই এই কে পাগল?”
“স্নিগ্ধ, অকারণে চেঁচাবে না।”
“আমি তো চেঁচাবই। তুমি পাবলিক প্লেসে আমাকে বার বার ইনসাল্ট করার সাহস কোথা থেকে পাও?”
জানভি দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বলল-
“তোমার কী হয়েছে স্নিগ্ধ? আজকাল তোমার ব্যবহারে অনেক পরিবর্তন এসে পরেছে।”
“এটার দায়ী তুমি নিজে।”
জানভি আর কিছু বলল না। অচেনা মানুষের সামনে ঝগড়া করা বেমানান। জানভি আবার বসে পিসিকে বলল-
“ওর নাম স্নিগ্ধ। আমি অর্পিতা ও স্নিগ্ধ একই ভার্সিটিতে পড়াশোনা করি।”
“এমন পাগলারে কেও বন্ধু বানায়?”
স্নিগ্ধ এক ভ্রু উঁচু করে বলল-
“এই পিসি তুমি জানো কত মেয়েরা আমার জন্য পাগল। আর তুমি আমাকে পাগল বলছো?”
“এহ আইসে মাইয়ারা ওর জন্যে পাগল। মাইয়াগুলা আসলেও পাগল যে তোর জন্যে পাগল।”
জানভি আর বিজয় হাসি থামিয়ে রাখতে পারলো না৷ দুজনই উঁচু স্বরে হেসে দিলো। স্নিগ্ধ বুঝতে পারে না সবাই তাকে অপমানই কেন করে। পূজারীনি এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল-
“স্নিগ্ধদা, তুমি আমাকে পানি নিয়ে আসতে বলে এখানে এসে পরলে? আমি তোমাকে না পেয়ে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম।”
স্নিগ্ধ বাঁকা হেসে বলল-
“দেখলে পিসি মেয়েরা আমাকে না পেলে কিভাবে পাগল হয়?”
“যা তো সর এখান থেকা। পূজারীনির লেগা কী ছোকরাগো অভাব? গ্রামে অর্ধেক ভাগ ছোকরারা ওরে বিয়া করতে চায়।”
পূজারীনি চোখ ছোটো ছোটো করে বলল-
“পিসি বাড়তি কথা বলো না তো। আমার ক্ষুধা পেয়ে খাবার দাও।”
“খাবারের কথা আইলেই পিসির কথা মনে পড়ে সবার।”
পূজারীনি গিয়ে বসে পিসিকে জড়িয়ে ধরলো। জানভি পিসি আর পূজারীনির এই দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দী করে নিলো। বাসায় ফিরে গেলে খুব মনে পরবে তার তাদের কথা।

ভরপেট খেয়ে তারা পিসির বাসা থেকে বের হলো। স্নিগ্ধ একটু বেশীই খেয়ে ফেলেছে। রোবটের মতো হাঁটছে সে। জানভির ইচ্ছে করছে শব্দ করে হাসতে। কিন্তু সম্ভব না, স্নিগ্ধ রেগে তাকে গাছের সাথে লটকিয়ে দেবে। তারা বাসায় ফিরে দেখে ছোটোখাটো ঝগড়া হচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে তার। পূজারীনি দৌড়ে গিয়ে তার মাকে জিজ্ঞেস করায় জানতে পারলো আসল কারণ। পূজারীনি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধ ও জানভি পূজারীনির সামনে গেল।
“কী হলো পূজা?”
পূজারীনি জানভির দিকে তাকিয়ে ভেজা কন্ঠে বলল-
“দিদির বিয়ের গহনা খুঁজে পাচ্ছে না। সবার সন্দেহ চুরি হয়ে গিয়েছে। এই নিয়ে পিসিমা আর পিসুমশাইয়ের ঝগড়া হচ্ছে। গহনা গুলো দিদির শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছে। সেগুলো না পেলে দিদির বিয়ে ভেঙ্গে যাবে।”
বিয়ে ভাঙ্গার কথা শুনে জানভি ও স্নিগ্ধ চমকে উঠল। তারা একে অপরের দিকে তাকাল। দুজনই ভয় করছে অর্পিতাকে নিয়ে। স্নিগ্ধ জানভিকে ইশারায় বলল তার সাথে আসতে। দুজন দৌড়ে অর্পিতার ঘরে গেল। অর্পিতা তার আলমারির সব জামা কাপড় বের করে গহনা খুঁজছে। জানভি দ্রুত গিয়ে অর্পিতার পাশে দাঁড়িয়ে বলল-
“অর্পা রিলাক্স হও, গহনা তোমার ঘরে ছিলো না। তাই এখানে পাওয়া অসম্ভব।”
অর্পিতা জানভির দিকে তাকাল। চোখ ভিজে আছে তার। জানভি অর্পিতার কাঁধে হাত রাখলো। ভয়ে কাঁপছে সে।
“শান্ত, একদম শান্ত। কিছু হবে না। তুমি এত চিন্তা করছো কেন?”
“জীবন তো আমার জানভি। জানো তো একটা মেয়ের বিয়ে ভাঙ্গলে কী হয়?”
স্নিগ্ধ এগিয়ে এসে বলল-
“কী আবল তাবল বলছো? বিয়ে ভাঙ্গবে না। সামান্য ক’টা গহনার জন্য বিয়ে ভেঙ্গে দেবে?”
“তোমরা জানো না গহনাগুলো আমার জীবন থেকেও বেশী জরুরি।”
স্নিগ্ধ বিরক্ত হয়ে জানভির দিকে তাকিয়ে বলল-
“এই মেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছে। জানু তুমি ওকে সামলাও আমি বাহিরের পরিস্থিতি দেখে আসি। ঝগড়া তো বেড়েই চলেছে।”
জানভি মাথা নাড়াল। স্নিগ্ধ দ্রুত হেটে বাহিরে গেল। জানভি অর্পিতাকে ধরে খাটে বসালো। অর্পিতা সব জামা ঠিকঠাক গুছিয়ে আলমারিতে যত্ন করে রাখলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা অচেনা পুরুষের কন্ঠ ভেসে আসলো। অর্পিতা চমকে দাঁড়িয়ে গেল। জানভি অর্পিতার সামনে এসে বলল-
“কী হলো? তোমাকে বসতে বলেছি।”
“আমার শ্বশুর মশাইয়ের কন্ঠ। জানভি এটা আমার শ্বশুর মশাইয়ের কন্ঠ।”
“উনাকে এত তারাতাড়ি খবর কে দিলো?”
“আছে আমাদের পরিবারে একজন। উনি ছাড়া আর কেও হতে পারে না।”
“কার কথা বলছো?”
“আমার ছোটো মাসি। উনি কখনো কোনো কথা গোপনে রাখেন না। আমার বিষয় হলে তো ঢোল পিটিয়ে পুরো গ্রামের মানুষকে শোনায়। তারা নিশ্চয়ই বিয়ে ভাঙ্গতে এসেছে।”
“অর্পিতা তুমি অকারণে টেনশন করছো। একটা মানুষের মন এতটা পাষাণ হতে পারে না।
“জানভি তুমি বুঝতে পারছো না পরিস্থিতি কতটা ভয়ংকর হয়ে গিয়েছে। আমার বাহিরে যেতে হবে। প্লিজ নিয়ে চলো।”
“আচ্ছা চলো বাহিরে যাই।”
জানভি আর অর্পিতা বাহিরে গেল। পরিস্থিতি আসলেও খুব ভয়াবহ হয়ে গিয়েছে। অর্পিতার বাবা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। অর্পিতা মুখ চেপে ধরে কেঁদে উঠলো। জানভি অর্পিতাকে ধরে বলল-
“সামলাও নিজেকে কিছু হবে না।”
অর্পিতা নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে বাবার সামনে গিয়ে বলল-
“খবর নিজেকে কারো সামনে ছোটো করবে না।”
সবাই অর্পিতার দিকে তাকাল।
“তুমি না একদিন বলেছিলে তোমার মেয়ে সস্তা না। তো আজ মাথা নত করছো কেন?”
“অর্পা যাও এখান থেকে।”
“না আমি যাব না। আমার বাবা কারো সামনে মাথা নত করবে আমি কল্পনাও করি নি। গহনা আমার জীবন থেকেও বেশী জরুরি আমি জানি। কিন্তু তুমি আর তোমার সম্মান তার থেকেও বেশী জরুরি।”
বাবা জানভির দিকে তাকিয়ে বলল-
“দেবজানি অর্পাকে ভেতরে নিয়ে যাও। বের হতে দেবে না ঘর থেকে।”
“বাবা আমার বিয়ে ভেঙ্গে গেলেও তুমি মাথা নত করবে না। নাহলে কিন্তু আমাকে হারাবে আমি সত্যি বলছি।”
জানভি দ্রুত গিয়ে অর্পিতাকে টানতে টানতে নিয়ে আসলো। অর্পিতাকে খাটে বসিয়ে জানভি তার জন্য পানি নিয়ে এসে পাশে বসলো। অর্পিতা থরথর করে কাঁপছে। সে আবার দাঁড়িয়ে বলল-
“বিয়ে ভাঙ্গা নিয়ে এখন আমার টেনশন হচ্ছে না। কিন্তু আমার বাবা, জানভি আমার বাবা অসম্মান সহ্য করতে পারবে না।”
“অর্পিতা, তুমি ভেঙ্গে পরছো কেন? তোমার নিজেকে সামলাতে হবে।”
“বাবার প্রতি আমি খুব দুর্বল জানভি। আমার খুব বেশী খারাপ লাগছে।”
জানভি অর্পিতাকে বসিয়ে বলল-
“আমি এখনই আসছি তুমি চুপচাপ বসো।”
জানভি দ্রুত বাহিরে আসলো। অর্পিতার শ্বশুর মশাই চলে যাচ্ছেন। জানভি পূজারীনির সামনে গিয়ে বলল-
“কী হলো?”
“পিসুমশাই যত পর্যন্ত সব গহনা ফিরিয়ে না আনবে বিয়ে হবে না। কিন্তু এত গহনা এক বা দুই দিনে কিনে নিয়ে আসা সম্ভব না। প্রায় ৬ মাস লেগে যাবে টাকা জোগাড় করতে।”
জানভি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বান্ধবীর জন্য কলিজা ছিঁড়ে কান্না আসছে তার। অর্পিতার বাবা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে ধীরপায়ে হেটে এগিয়ে গেল ঘরের দিকে। স্নিগ্ধ হাতমুঠো শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। সে চোখ ঘুরিয়ে জানভির দিকে তাকাল। জানভির চোখে পানি দেখে স্নিগ্ধ বুকে যেন ধাক্কা অনুভব করলো। সে অর্পিতার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল- “আঙ্কেল দাঁড়ান, গহনার সব টাকা আমি দেবো।”

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here