#অবাধ্য_মন,পর্ব_৮
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
“আঙ্কেল দাঁড়ান, গহনার সব টাকা আমি দেবো।”
সবাই অবাক হয়ে স্নিগ্ধর দিকে তাকাল। অর্পিতার বাবা পেছনে ফিরে স্নিগ্ধকে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন। স্নিগ্ধ ধীরপায়ে হেটে অর্পিতার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিভাবে কথা শুরু করবে সে বুঝতে পারছে না। জানভি দু কদম এগিয়ে এসে দাঁড়াল। স্নিগ্ধ চারপাশে চোখ বুলিয়ে অর্পিতার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল- “সামান্য গহনার কারণে অর্পিতার বিয়ে পিছাবে না। চলুন জুয়েলার্স শপ যাওয়া যাক। যা যা লাগবে এখনই কিনে নিয়ে আসি।”
“তুমি অর্পিতার বন্ধু হও। আর আমি তার বাবা। আমি যথেষ্ট পরিশ্রম করতে জানি। হতে পারে কিছু মাস সময় লাগবে। কিন্তু আমি আমার টাকা দিয়েই আমার মেয়ের গহনা কিনবো।”
“আংকেল, গহনা অবশ্যই আপনার টাকা দিয়েই কেনা হবে। আমি জানি আপনি কখনো আমার কাছ থেকে টাকা নিবেন না। আপনি ধার ভাবতে পারেন। ধীরে ধীরে শোধ করে দিয়েন। কিন্তু এখন অর্পিতা ও এই পরিবারের সম্মান বাঁচানো খুব জরুরি।”
“আমি ব্যাংকে কল দিবো। রাতের মধ্যে লোনের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
“আংকেল, আপনি কি আমার উপর বিশ্বাস করছেন না? না-কি লজ্জা পাচ্ছেন?”
অর্পিতার বাবা জবাব দিলো না। স্নিগ্ধ বুঝতে পারলো উনি লজ্জিত। সে লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল-
“আংকেল, আমার আর অর্পিতার বন্ধুত্ব মাত্র ১ বছরের। তাকে আমি জানু আই মিন জানভির দ্বারা চিনেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি ওকে সবসময় নিজের বোনের মতো দেখেছি। আমার ছোটো বোনের বিয়েতে এমন বাঁধা আমি মানতে পারছি না। আংকেল, অর্পিতা যখন ঢাকা থেকে পড়াশোনা করছিল আপনি জানতে পারলেন সে একটা ছেলের সাথে সম্পর্কে আছে। আপনি তাকে গ্রামে নিয়ে এসে ঘরবন্দী করে ফেললেন। তার পড়াশোনা বন্ধ হওয়ায় সে কিছু বলে নি৷ শুধু তাই না, সে যে ছেলেকে ভালোবাসতো। অর্থাৎ আমার বেস্টফ্রেন্ড। তাকে পর্যন্ত অর্পিতার থেকে দূর করে ফেলেছেন। সেটাও অর্পিতা চুপচাপ সহ্য করে নিয়েছে। কিন্তু আজ তার সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে গিয়েছে যখন সে দেখেছে তার বাবা মাথা নত করছে। কোথায় পাওয়া যায় আজকাল এমন মেয়ে? আপনার তো গর্ব হওয়া উচিত এমন মেয়ে নিয়ে।”
অর্পিতার মা স্নিগ্ধর পুরো কথা শুনে শাড়ির আঁচল নিয়ে মুখ চেপে কেঁদে উঠলেন। অর্পিতার বাবা মাথা নিচু করে রেখেছেন। মেয়ের ব্যাপারে ভেবে উনার প্রচন্ড খারাপ লাগছে। স্নিগ্ধ আবার বলল- “প্লিজ আংকেল, অর্পিতার জন্য হলেও রাজি হয়ে যান।” বাবা মাথা তুলে স্নিগ্ধর দিকে তাকাল। স্নিগ্ধকে দেখে উনি যেন চিন্তামুক্ত হলেন। ছেলেটা আজ না থাকলে উনি কী করতেন বুঝতে পারছে না। স্নিগ্ধ উনার কাছ থেকে জবাব না পেয়ে আবার বলল-
“আপনি বলবেন না-কি আমি একা চলে যাব গহনা কিনতে? আমার চয়েস কিন্তু খুব বাজে পরে কিছু বলতে পারবেন না।”
“আমি তোমার থেকে টাকা নিতে রাজি।”
বাবার কথা শুনে স্নিগ্ধ খুশী হয়ে গেল।
“কিন্তু তুমি যেমন বলেছো তেমনই হবে। আমি প্রতিমাসে একটু করে হলেও টাকা শোধ করে দিবো।”
“আপনার যেভাবে মন চায় শোধ করে দিয়েন৷ এখন নাহয় তারাতাড়ি গিয়ে গহনা নিয়ে আসা যাক।”
অর্পিতার বাবা উনার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন-
“গহনা গুলোর ছবি আছে তোমার কাছে?”
“হ্যাঁ আছে”
“চলো আর্জেন্ট বানাতে দিয়ে আসি। আগামীকাল সকালের মধ্যে পেয়ে যাব।”
“আচ্ছা”
স্নিগ্ধ দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। জানভি দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধর যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে। জানভি চেয়েও স্নিগ্ধকে ঘৃণা করতে পারছে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জানভি ঘুরে দাঁড়াল। তার ঠিক বরাবর অর্পিতা দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি দরজার দিকে৷ জানভি দ্রুত গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল। অর্পিতা ঘাড় ঘুরিয়ে জানভির দিকে তাকিয়ে ভেজা কন্ঠে বলল- “এই ছেলে বড়ো হবে না? কী দরকার ছিলো আগের কথা তোলার?”
“স্নিগ্ধ আংকেলকে বোঝাতে চাচ্ছিল। তাই মাথায় যা এসেছে তাই বলে বুঝিয়ে দিলো। আংকেল বুঝেছে তার কথা। এখন কান্না বন্ধ করো। আর ঘরে গিয়ে তুমি বিশ্রাম নাও।”
“স্নিগ্ধ কোথায় গেল?”
“তা জানি না, হয় তো টাকা নিতে গিয়েছে।”
অর্পিতা জবাব দিলো না। জানভি তাকে নিয়ে ঘরে চলে আসলো। অর্পিতা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। জানভির দৃষ্টি দরজার দিকে। স্নিগ্ধ কখন আসবে কখন স্নিগ্ধকে দেখবে। তার ছটফট করছে এক নজর স্নিগ্ধকে দেখার জন্য।
সারাদিন কেটে গেল কিন্তু স্নিগ্ধর দেখা পেল না৷ অর্পিতার বাবা মা কিছুক্ষণ আগে জুয়েলার্স শপ থেকে ফিরলো৷ জানভি পুরো বাড়ি খুঁজেও স্নিগ্ধকে পেলো না৷ কাওকে জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা করছে তার। স্নিগ্ধ যেভাবে জানু বলেছিল অনেকেই বুঝে গিয়েছে তার আর স্নিগ্ধর সম্পর্ক। জানভি দাঁড়িয়ে নখ কামড়াচ্ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে কেও বলল-
“জানু?”
জানভি চমকে পেছনে ফিরলো। পূজারীনি দাঁত বের করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। জানভি জোরপূর্বক হাসলো তাকে দেখে। পূজারীনি জানভির দিকে আর এক কদম এগিয়ে গিয়ে বলল- “নামটা খুব সুন্দর।” জানভি কী জবাব দিবে বুঝতে পারছে না। তখনই অর্পিতা ঘর থেকে বের হলো। জানভি আর পূজারীনিকে দেখে তাদের দিকে এগিয়ে আসলো। পূজারীনি অর্পিতাকে দেখে বলল-
“দিদি, কথা হয়েছে জিজুর সাথে?”
“হ্যাঁ, সে বলল সে কাজ থেকে ফিরে এসব শুনে তার বাবার সাথে না-কি খুব ঝগড়া করেছে।”
“তার মানে জিজু কিছু জানতো না?”
অর্পিতা না সূচক মাথা নাড়াল। জানভি চারপাশে চোখ বুলাচ্ছিলো। হঠাৎ বিজয়কে দেখতে পেয়ে দৌড়ে তার সামনে গেল। সে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বিজয় হেসে বলল- “স্নিগ্ধ দাদা ছাদে। কিছুক্ষণ একা থাকতে চেয়েছিল তাই ছাদ খুলে দিয়েছি।” জানভি জবাবে মুচকি হেসে বিজয়ের চুলে হাত বুলালো। বিজয় চলে গেল। জানভি অর্পিতা আর পূজারীনিকে এক নজর দেখে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে উপরে উঠলো। ছাদে গিয়ে এদিক সেদিক দেখছে। ছাদের এক কোণায় স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। জানভি ভালো মতো স্নিগ্ধকে দেখে চোখ কুঁচকালো। হনহন করে এগিয়ে গিয়ে বলল- “তুমি সিগারেট খাচ্ছো?”। স্নিগ্ধ শান্ত দৃষ্টিতে জানভির দিকে তাকাল। জানভি রাগে কটমট করছে। স্নিগ্ধ ঘুরে রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে বলল-
“আজ কী প্রথম দেখলে? এর আগেও তো অনেকবার দেখেছো।”
“আগের কোনো কথা আমার মনে নেই। আর মনে করতেও চাই না। সিগারেট ফেলে দাও আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না।”
স্নিগ্ধ সিগারেটে আর একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সিগারেটের বাকি অংশ মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলল। জানভি হাড আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে রেলিং এর সাথে হেলান দিলো। স্নিগ্ধ বলল-
“যা বলতে চাও বলে দাও জানু।”
“ধন্যবাদ”
“সাহায্য তো তোমার করি নি।”
“আমার বেস্টফ্রেন্ডের তো করেছো। আমার মনে হচ্ছে আমারো করেছো তাই ধন্যবাদ দিলাম।”
“তোমার বিয়ের সময়ও যদি এমন বাঁধা আসে শুধুমাত্র একবার কল দিলেই হবে। দৌড়াতে দৌড়াতে আসবো তোমার সাহায্য করার জন্য।”
বলেই স্নিগ্ধ শব্দ করে হাসলো। জানভি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আসার পর থেকে সে ভুলেই গিয়েছিল একজনের সাথে তার বিয়ের কথা চলছে। বাবা আসার সময় বলেছিলেন জানভি ফিরে গিয়ে দেখবে তার বিয়ের সব আয়োজন হয়ে গিয়েছে। এক্সাম শেষ হলেই তার বিয়ে রঞ্জনের সাথে। হাসতে হাসতে হঠাৎ স্নিগ্ধ থেমে গেল। বুক ভারী হয়ে আসছে তার। সবার সামনে হাসিখুশি থাকলেও দিন শেষে নিজেকে একা পায়। ভালোবাসার মানুষ সামনে থাকার শর্তেও মন খুলে একবার কথা বলতে পারে না। তখনই অর্পিতা আর পূজারীনি আসলো।জানভি আর স্নিগ্ধ সোজা হয়ে দাঁড়াল তাদের দেখে। অর্পিতা দৌড়ে এসে স্নিগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো। স্নিগ্ধ অবাক হয়ে বলল- “কান্না করছো কেন তুমি?”
অর্পিতা হেসে বলল- “তুমি জানো আমার কত বড়ো উপকার করেছো?” স্নিগ্ধ অর্পিতাকে ছাড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল- “ঠিক এই কারণেই আমি কারো সাহায্য করতাম না আর সবাই আমাকে পাষাণ ভাবতো।”
অর্পিতা ফিক করে হেসে দিলো। চোখের পানি মুছে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল-
“যদি শুধু সাহায্য করতে ধন্যবাদ দিতাম না৷ তুমি আমাকে পরিবারের মান সন্মান রক্ষা করেছে।”
“সেটা ভগবানের কাজ। আমি তো শুধু তার হুকুম মেনেছি।”
“বাহ, এখন দেখছি বড়ো বড়ো কথা বলছো। তখন বাবাকে কী বলছিলে?”
“কী বলছিলাম?”
“আগের কথা কেন তুললে? আমার আগের কথা মনে আসলেই দম বন্ধ হয়ে আসে।”
“আমি জানতাম না তুমি আশে পাশে ছিলে নাহলে বলতাম না। কিন্তু অর্পিতা, আমি তো ভুল বলি নি তখন। ভালোবাসা হারানোর কষ্ট আমি বুঝি৷ আমি প্রতিদিন ভেতরে ভেতরে পুড়ে ছাই হয়ে যাই। আর তুমি ১ বছর সহ্য করেছো। কিভাবে পারলে?”
অর্পিতা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলালো। হাসিমুখে বলল-
“আমি আমার ভাগ্য মেনে নিয়েছিলাম।”
“ভাগ্য কিভাবে মেনে নেয়?”
“তোমার সাথে যা যা ঘটবে ভেবে নিবে সব আগে থেকে লিখা ছিল। যা আগে থেকে আমাদের ভাগ্যে লিখা থাকে কেও পরিবর্তন করতে পারে না৷ দেখবে, ধীরে ধীরে নিজেকে সামলাতে পারবে।”
“ঠিক বললে তো। আমি এমনটা ভেবে দেখেনি। আজকের পর থেকে তোমার প্রত্যেক কথা আমি মনে রাখবো।”
জানভি ভেজা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধর দিকে। স্নিগ্ধ হঠাৎ চমকে জানভির দিকে তাকাল। সে তো ভুলেই গিয়েছিল জানভি তার সাথে দাঁড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধ যথেষ্ট চেষ্টা করেছে জানভির সামনে নিজেকে শক্ত দেখানো। জানভি অন্যদিকে ফিরে চোখ মুছে নিলো। তখনই বিজয় এসে বলল সবাইকে খাওয়া দাওয়ার জন্য ডাকছে। সবাই বিজয়ের কথা শুনে নিচে গেল। পুরোটা সময় স্নিগ্ধ জানভির দিকে তাকায় নি৷ পূজারীনি আর বিজয়ের সাথে দুষ্টুমি কথা বার্তা বলে সময় কাটিয়েছে। জানভির দৃষ্টি বার বার স্নিগ্ধর দিকে যাচ্ছে। স্নিগ্ধর বলা প্রতি যেন তার বুকে গিয়ে আঘাত করছে। আগামীকাল অর্পিতার হলুদ সন্ধ্যা। সবাই তারাতাড়ি ঘুমাতে চলে গিয়েছে। সারারাত জানভি দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি। স্নিগ্ধ এবং তার কথা গুলো মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে।
পরেরদিন…..
স্নিগ্ধ ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে বাহিরে আসলো। চোখ থেকে হাত সরাতেই চমকে উঠলো। তার বরাবর জানভি দাঁড়িয়ে পূজারীনির সাথে কথা বলছে। চমকানোর কারণ হচ্ছে জানভি শাড়ি পড়েছে। লাল, সোনালী, সাদা রং এর শাড়িতে মেয়েটা অপরুপ লাগছে। পূজারীনি যেতেই জানভি সামনের দিকে তাকাল। স্নিগ্ধকে দেখে চোখের সামনের ছোটো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে ধীরপায়ে এগিয়ে আসলো। স্নিগ্ধ এখনো পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে জানভির দিকে৷ জানভি শাড়ির আঁচল আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বলল-
“কেমন লাগছে বলবে না?”
স্নিগ্ধ জানভির কথা শুনে আশে পাশে দেখে বলল- “ক্ষুধা পেয়েছে, ব্রাশ করে এসে নাস্তা করি।” বলেই স্নিগ্ধ ঘুরে হাঁটা ধরলো। জানভি বিরক্ত হয়ে বলল-
“স্নিগ্ধ, খবরদার ইগনর করবে না।”
স্নিগ্ধ পেছনে ফিরে বলল-
“ইগনর করছি না। তোমাকে দেখার, ছোঁয়ার অধিকার আমার নেই। যার উপর অধিকার নেই তার প্রশংসা আমি ভুলেও করবো না।”
জানভির চোখে পানি জমে গেল। স্নিগ্ধর দিকে এগিয়ে এসে চোখে চোখ রেখে বলল-
“তো বদনাম-ই করে দাও। মনে যত রাগ আছে সব বের করে দাও স্নিগ্ধ।”
“আমি তোমার উপর রেগে নেই।”
বলেই স্নিগ্ধ দ্রুত হেটে ঘরে চলে গেল। জানভি দাঁতে দাঁত চেপে কাঁদছে। পূজারীনির ডাকে চোখের পানি মুছলো তারাতাড়ি। হাসিমুখে পূজারীনির দিকে তাকাল। দূর থেকে অর্পিতা তাদের দেখেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মোবাইলের লক খুললো। কনট্যাক্টস লিস্টে গিয়ে রঞ্জনের নাম এক নজর দেখে আবার জানভির দিকে তাকাল।
অর্পিতা, পূজারীনি ও জানভি গাড়িতে বসে আছে। তিনজন পার্লার থেকে ফিরছে৷ স্নিগ্ধ-ই তাদের নিয়ে যাওয়ার ও নিয়ে আসার দায়িত্ব নিয়েছে। নাহলে অর্পিতার বাবা পার্লার যাওয়ার পারমিশন দেন নি। পূজারীনি স্নিগ্ধকে রিকুয়েষ্ট করে অর্পিতার বাবাকে মানিয়েছে। স্নিগ্ধ ড্রাইভ করতে করতে লুকিং গ্লাস দিয়ে অর্পিতার দিকে তাকাল। অর্পিতা স্নিগ্ধকে দেখে হেসে বলল-
“তুমি এভাবে টুকি টুকি করে বার বার আমাকে কেন দেখছো?”
“খারাপ ভেবো না আমাকে। আমি আসলে ভাবছি মেকআপ কম হয়েছে। আর একটু দিলে আরো সুন্দর দেখাতো।”
“সত্যি?”
স্নিগ্ধ ফিক করে হেসে দিলো। জানভি ভ্রু কুঁচকে বলল-
“অর্পা, ও তোমার মেকআপ নিয়ে মজা করছে। আর তুমি সিরিয়াস মনে করলে?”
“কী?, স্নিগ্ধ তুমি বাসায় চলো তারপর কথা হবে।”
স্নিগ্ধ শব্দ করে হেসে উঠলো। পূজারীনি স্নিগ্ধর পাশের সিটে বসা। সে বলল-
“আমাকে কেমন লাগছে সত্যি করে বলো।”
“খুব সুন্দর, তোমাদের তিনজনকেই সুন্দর লাগছে৷ আমি মজা করছিলাম।”
বাসায় পৌঁছে অর্পিতাকে জানভি তার ঘরে নিয়ে গেল। স্নিগ্ধ চলে গেল তৈরী হতে। পূজারীনি, জানভি ও অর্পিতা কথা বলছে। কিছুক্ষণ পর দরজায় টোকা পরলো। পূজারীনি গিয়ে দরজা খুলে হেসে উঠলো। অর্পিতা ও জানভি দরজার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
“কী হলো হাসছিস কেন?”
অর্পিতার প্রশ্নে পূজারীনি সরে দাঁড়াল। স্নিগ্ধ হনহন করে হেটে আসলো। পরনে সেন্ডো গেঞ্জি আর সাদা পায়জামা। জানভি আর অর্পিতা খুব কষ্টে হাসি থামিয়ে রেখেছে। স্নিগ্ধ বলল-
“ধুতি কিভাবে পড়ে?”
অর্পিতা আর পারলো না হাসি থামাতে। পেট ধরে সে হেসে উঠলো। জানভি দাঁড়িয়ে বলল-
“এখন কী আমরা তোমাকে ধুতি পড়িয়ে দিবো?”
“এহহ ছি ছি আমি এটা বলি নি৷ আমি বলছি যে ধুতি পাঞ্জাবী পড়া কী খুব জরুরি? আমি পায়জামা দিয়ে পড়ি?”
“সবাই ধুতি পাঞ্জাবী পড়বে তুমি কেন পায়জামা পড়বে?”
“ধুতি পড়লে যদি খুলে যায়?”
পূজারীনি হাসতে হাসতে বসে পরলো মাটিতে। জানভি এইবার হাসি থামিয়ে রাখতে পারলো না। সেও হেসে দিলো। স্নিগ্ধ বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে তাদের হাসি দেখে৷ অর্পিতা খুব কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল-
“দাঁড়াও দাঁড়াও তোমার ধুতি পড়ানোর ব্যবস্থা আমি করছি।”
অর্পিতা গিয়ে বাবাকে ডেকে নিয়ে আসলো। স্নিগ্ধ বাবাকে দেখে বলল-
“আংকেল পড়িয়ে দিবে?”
“হ্যাঁ, বিজয়কেও বাবা পড়িয়ে দেয়। বাবা ওকে এমনভাবে ধুতি পড়াবে যাতে খুলে না যায়। ও খুব টেনশনে আছে।”
বাবা হেসে স্নিগ্ধর হাত ধরে নিয়ে গেল। স্নিগ্ধ যেতেই পূজারীনি বলল-
“জানিস দিদি আমার মন বলছে স্নিগ্ধ দাদা জানভিদির কাছে ধুতি পড়তে চাচ্ছিল। আহারে বেচারা।”
জানভি থতমত খেয়ে গেল পূজারীনির কথা শুনে৷ অর্পিতা আর পূজারীনি ঘর কাঁপিয়ে হাসছে। জানভির লজ্জায় মন চাচ্ছে মাটি দুভাগ করে ভেতরে ঢুকে যেতে। তাদের জবাব দেয়ার মতো শব্দ এখন তার কাছে নেই।
কিছুক্ষণের মধ্যে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো। স্নিগ্ধ দর্শকের মতো একপাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। তার দৃষ্টি জানভির উপর থেকে সরছে না। সে এমনভাবে সবার যত্ন নিচ্ছে যেন তার অনেক আপন কারো বিয়ে। মেয়েটা সবাইকে কিভাবে এত তারাতাড়ি আপন করে ফেলে স্নিগ্ধ বুঝতে পারে না৷ পূজারীনি এসে স্নিগ্ধর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। জানভি অর্পিতার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কোমড়ে এক হাত রেখে। স্নিগ্ধকে দেখে হাত ছেড়ে দিলো। অর্পিতা এক ভ্রু উঁচু করে বলল- “আসতে মন চাইলো আপনার?” পূজারীনি বলল- “আপু আমি নিয়ে এসেছি। উনি এমনভাবে লুকিয়ে ছিলেন যেন বিয়ে উনার লজ্জায় এমন করছে।”
“ইশশ আসছে লজ্জাবতা। নিন হলুদ দিন আমাকে।”
স্নিগ্ধ হেসে অর্পিতার সামনপ হাঁটু গেড়ে বসে বলল- “লজ্জাবতা? আমি তো ভীষণ নির্লজ্জ।”
“কে বলল?”
স্নিগ্ধ এক ভ্রু উঁচু করে তাকাল। অর্পিতার মনে আসলো সে-ই একবার স্নিগ্ধকে নির্লজ্জ বলেছিল। তখন স্নিগ্ধ প্রচুর দুষ্টুমি করতো। ভার্সিটিতে নতুন মেয়ে দেখলেই র্যাগিং করতো। অর্পিতাও তার র্যাগিং এর শিকার হয়েছিল। অর্পিতা হেসে উঠলো- “ভুলেই গিয়েছিলাম আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ফাজিল ছেলে তুমি।”
স্নিগ্ধ দাঁত বের করে হেসে দু হাতের বেশী করে হলুদ নিয়ে অর্পিতার দু গাল ভরে দিলো। অর্পিতা হা হয়ে বসে আছে। স্নিগ্ধ উঠেই দৌড়ে পালালো। অর্পিতা “তবে রে” বলেই হাতে হলুদ নিয়ে স্নিগ্ধর পেছনে দৌড়ে গেল। আশে পাশের সবাই হাসছে তাদের দেখে। জানভি হাত আড়াআড়িভাবে ভাজ করে তাদের দেখছে আর হাসছে। অর্পিতা ধীরে ধীরে হেটে এসে নিজের জায়গায় বসে পরলো। চারপাশে হাসির শব্দ ভাসছে স্নিগ্ধকে দেখে। স্নিগ্ধ হনহন করে হেটে এসে পূজারীনির বরাবর দাঁড়াল। পূজারীনি হাসি থামিয়ে রেখেছে। কিন্তু স্নিগ্ধ হঠাৎ তার সামনে কেন আসলো সে বুঝতে পারছে না। স্নিগ্ধ উঁচু স্বরে বলল-
“আমি একা কেন সবাই আজ হলুদ দিয়ে ভূত হবে।” বলেই স্নিগ্ধ পূজারীনির চেহারায় হলুদ দিয়ে ভরে ফেলল। শুরু হলো হলুদ দিয়ে হোলিখেলা। ছোটো বড়ো সবাই হলুদ দিয়ে হোলি খেলছে। স্নিগ্ধর হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। অনেকক্ষণ হলো জানভির দেখা পাচ্ছে না। স্নিগ্ধ হাতে হলুদ নিয়ে জানভিকে খুঁজছে। জানভি দরজার আড়াল থেকে উঁকি মারলো। সে জানে স্নিগ্ধ তাকেই খুঁজছে। স্নিগ্ধ এদিকে ঘুরতেই জানভি ইচ্ছে করে দরজায় শব্দ করে বাহিরের দিকে দৌড়ে গেল। স্নিগ্ধ জানভিকে দেখে ফেলেছে। সেও দৌড়ে গেল জানভির দিকে। জানভি ইচ্ছে করে স্নিগ্ধকে সবার আড়ালে নিয়ে আসলো। মেইন দরজার দিকে কেও নেই। উঠান পুরো খালি। সবাই ভেতরে হলুদ সন্ধ্যা মানাচ্ছে। জানভি ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধ এসে বলল-
“আমার থেকে লুকানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। শত ভীরের মধ্যেও খুঁজতে পারবো তোমায়।”
জানভি স্নিগ্ধর দিকে ঘুরে বলল-
“আমাকে খোঁজার কারণ জানতে পারি?”
“সবাই হলুদে গোসল করলো তুমি বাদ যাবে কেন? তাই আসলাম তোমাকে হলুদ মাখিয়ে দিতে।”
“তাই? আসলে কাছে আসো। মাখিয়ে দাও আমাকে হলুদ।”
স্নিগ্ধ হাসিমুখে এগিয়ে আসলো জানভির দিকে। জানভির বরাবর দাঁড়িয়ে আলতো করে জানভির দু গালে হাত রাখলো। জানভি ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে নিলো। স্নিগ্ধর ছোঁয়ায় তার হৃদয়ের স্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। জানভি চেহারার দিকে তাকাতেই স্নিগ্ধ থমকে গেল। মাথা শূন্য হয়ে গিয়েছে তার। জানভিকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না। স্নিগ্ধর চোখ জানভির ঠোঁটের দিকে গেল। হৃদয়ে কম্পন অনুভব করছে সে। জানভি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল। স্নিগ্ধ ধীরে ধীরে জানভির ঠোঁটের দিকে মুখ এগিয়ে নিলো। জানভি চমকে উঠল। দ্রুত সে হাত তুলে স্নিগ্ধর ঠোঁটের উপর রেখে দিলো। স্নিগ্ধর কান্ডে সে ভয় পেয়ে গিয়েছে। স্নিগ্ধ জানভির বাঁধা মানলো না। জানভির হাত ধরে সরিয়ে ফেলল। জানভি ভয়ে ঢোক গিলছে। সে তো এমনটা ভাবে নি। স্নিগ্ধ আবার এগিয়ে নিতেই জানভি মুখ ঘুরিয়ে নিলো। “স্নিগ্ধ প্লিজ” জানভি কথা শুনে স্নিগ্ধ দাঁতে দাঁত চেপে বলল- “বাঁধা দিচ্ছো কেন?”। জানভি জবাব দিলো না। স্নিগ্ধ আরো রেগে গেল। জানভিকে এক ঝটকায় ছেড়ে দিয়ে নিজের থেকে দূর করে বলল-
“তুমি সবসময় আমার মনে ভালোবাসা জাগিয়ে পালিয়ে যাও। না আমাকে মাফ করছো না ভালোবাসার অধিকার দিচ্ছো।”
স্নিগ্ধর গলা কাঁপছে। খুব কষ্টে কান্না থামিয়ে রেখেছে। জানভি কিছু বলার আগে স্নিগ্ধ আবার বলল-
“দেবজানি সরকার, আমাকে মুক্ত করে দাও প্লিজ। আমি আর পারবো না এভাবে থাকতে, পারবো না।”
বলেই স্নিগ্ধ ভেতরের দিকে হাঁটা ধরলো। জানভি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধর যাওয়ার পথে এক নজর দেখে স্নিগ্ধকে ডাকতে নিলো তখনই মেইন দরজা খোলার শব্দ আসলো। জানভি পেছনে ফিরতেই থমকে গেল। তার ঠিক বরাবর রঞ্জন দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে……