অবাধ (০২)

0
1719

#অবাধ (০২)

মেয়েটা সত্যিই অনেক ফর্সা হয়ে গেছে। তাকে ভালোই সুন্দর দেখাচ্ছে, কিন্তু নিহিত সেদিনের ভালো লাগাটা আজকে কেন জানি পাচ্ছেনা! মেয়েটার কান্নার তীব্রতা এতো বেশি যে তার সারা মুখমণ্ডল লাল হয়ে গেছে।
ওয়েটার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলছে,
‘ প্লিজ ম্যাম, আপনি শান্ত হউন, আশেপাশের মানুষদের সমস্যা হচ্ছে। এগুলোর জন্য আমাদেরকে জবাবদিহিতা করতে হবে।

নিহিত এবার এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার কাছে হাঁটু গেড়ে বসলো, আর ধীর কণ্ঠে বললো,
‘ আচ্ছা আপনি কার ভালোবাসার জন্য কাঁদছেন? যে আপনার ভালোবাসাকে পা দিয়ে পিষে এখনি চলে গেলো? আর কার জন্যই নিজেকে পরিবর্তন করলেন? যে আপনাকে আপনার মতো ভালোবাসতেই জানেনি? আর আপনি ভাবলেন কীভাবে আপনাকে যার মন মেনে নেয়নি, আপনি চাইলেই তার মনের মতো হতে পারবেন?

মেয়েটা নিহিতের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালো। নিহিতের কথার কোনো জবাব না দিয়ে ওয়েটারকে বললো,
‘ সবকিছুর জন্য আমি খুবই লজ্জিত এবং দুঃখিত। আমাকে একটু অনুগ্রহ করুন। আমি চলে যাচ্ছি।

ওয়েটার মাথা হেলিয়ে চলে গেলেও, এবার নিহিত আর মেয়েকে হাতছাড়া কর‍তে দিলোনা। সে বিল আসার পরোয়া না করে, একটা ৫০০ টাকার নোট টেবিলে রেখে দৌঁড়ে বেড়িয়ে গেলো। মেয়েটার সামনে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললো,
‘ হেই আমি নিহিত।

মেয়েটা কেবল কাঁদছে আর চোখই মুছতেছে, এর মধ্যে মনে হয় একটা রিকশাকে ইশারা করে ডেকেছিলো, সেটা ইতোমধ্যে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিহিত দেখলো মেয়েটা কোনো কিছু না বলেই রিকশার দিকে চলে যাচ্ছে। সে এবার জোর গলায় বললো,
‘ দয়া করে একটু কথা বলুন, আমি আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি।

মেয়েটা রিকশায় পা বাড়িয়েও আবার নামিয়ে ফেললো। ফিরে তাকিয়ে জবাব দিলো,
‘ আমাকে খুঁজছেন কেন?বিশেষ কোনো দরকার?

নিহিত কপালের মৃদু ঘাম মুছতে মুছতে জবাব দিলো, আমি কি আপনার সাথে রিকশায় যেতে পারি। তারপর সবকিছু বলছি।

সাথে সাথেই কর্কশ গলায় আওয়াজ এলো,
‘ আরেহ, আমি আপনাকে চিনিই না৷ সেখানে আমাকে আপনার সাথে নিবো, ভাবলেন কি করে?

রিকশাওয়ালা ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘ আপা যাবেন নাকি যাবেন না?

মেয়েটা দেখলো, নিহিত কিছু বলার জন্য কেমন আকুল চোখে তাকিয়ে আছে, অন্যদিকে রিকশার ড্রাইভার দেরি হওয়ার জন্য রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। কিছু না ভেবে রিকশায় উঠে বামে চেপে গিয়ে বললো,

‘ আসুন আপনি। আর হ্যাঁ আমার নাম বর্ণা।

নিহিত এবার বিশ্বজয়ের হাসিতে রিকশায় উঠে পড়লো। তারপর তার অফিসে একটা টেক্সট করলো, তার ফিরতে একটু দেরি হবে।
এরই মধ্যে বর্ণা চুপচাপ হয়ে গেলো। অন্যমনস্ক হয়ে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছে। নিহিত গলা খাঁকরে বললো,
‘ প্লিজ আপনি কান্না করবেন না, আমার ভালো লাগছেনা, মানুষটা সঠিক হলে আপনি যত ইচ্ছে কাঁদতেন, কিন্তু এভাবে ভুল মানুষের জন্য আপনার চোখের মূল্যবান অশ্রুর বিসর্জন দেওয়া অনুচিত! আপনি আমাকে ভুল ভাব্বেন না। আর সত্যি বলতে আমি আপনাক ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। শুধু দুইমাস আগে একবার…

বর্ণা নিহিতের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ মনে আছে আমার। বলতে হবে না, এবার বলুন পিছু নিয়েছেন কেন? কি এমন জরুরী তলব?

নিহিত সাথে সাথে উত্তর দিলো,
‘ আপনাকে জানার কৌতূহল থেকে। কেন এবং কার জন্য নিজের পরিবর্তন চাচ্ছিলেন সেটা জানতেই আমার যত আগ্রহ ছিলো! যদিও আজকে অনেকটাই জেনে গেছি তবে এখনো অনেককিছু জানার বাকি। সেসব আজকে আপনার থেকে জানতে চাইবোনা, শুধু আমি কেন আপনাকে খুঁজছি সেটা বলতে চাই, জানিনা এই সুযোগটা আর পাবো কিনা!

বর্ণা আস্তে আস্তে বললো,
‘ হ্যাঁ বলুন, তারপর নেমে যান।

নিহিত হেসে বললো,
‘ আমি আপনার আগের চেহেরাটা ভুলতে পারছিনা। ওই সেদিনের দোকানে যেভাবে আপনাকে দেখেছিলাম! প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টা, প্রতি মূহুর্তে আপনার সেই গম্ভীর শ্যামবর্ণের মুখ আমাকে কেমন এলোমেলো করে দেয়, আমি অন্য কোথাও, অন্য সৌন্দর্যে নিজের মনস্থির করতে পারিনা৷ বাসায় আমাকে বিয়ের জন্য প্রচুর চাপ দিচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার পক্ষে আপনার সেই মুখখানার পরিবর্তে আমার পাশে অন্য কাউকে ভাবাটাই অসম্ভব লাগছে।

মেয়েটা এবার রুক্ষমূর্তি হয়ে উঠলো, রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ মামা আপনি থামেন।

নিহিত ভয়ে ভয়ে বর্ণার দিকে তাকাতেই, বর্ণা আঙুল উঁচু করে বললো,
‘ এক্ষুনি রিকশা থেকে নামুন নয়তো আমি চিৎকার দিয়ে মানুষ জড়ো করবো।

নিহিত ভয় পেয়ে গেলো। সে থতমত করতে করতে নেমে গেলো। নেমে কিছু বলার আগেই বর্ণা জোরে জোরে বললো,
‘ নেক্সট টাইম আমি আপনাকে আর দেখতে চাইনা।

নিহিত কিছু না ভেবে বলে উঠলো,
‘ কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের আরো অনেকবার দেখা হবে।

নিহিত জানেনা বর্ণা এই কথা স্পষ্ট শুনেছে কিনা, কেননা ততক্ষণে রিকশা চলে যাচ্ছিলো। তবে নিহিত এটা জানে, বর্ণা কেন হঠাৎ রেগে গেছে। রাগ দেখানোর যথেষ্ট কারণও আছে। এভাবে হুট সব মনের কথা বলে দেওয়া উচিত হয়নি বোধহয়। তার উপর বর্ণার অসময় চলছে, যাকে সে এতো ভালোবাসে, সে তাকে ঠকিয়েছে, বর্ণার মনের অবস্থা নিঃসন্দেহে অন্তত করুণ। আর সেটা ভালো করেই নিহিত আঁচ করতে পারছে। কিন্তু পাগলের মতো সে কেন নিজের কথাগুলো তখন বলতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, সে উত্তর তার অজানা।

নিহিত বেশ খানিক্ষণ পায়চারী করেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলোনা, আজকে কোনোভাবে ভুলভাল বলে অফিস কামাই করবে নাকি করবেনা। এদিকে তার বাড়িতে যেতে খুব ইচ্ছে করছে, তার মাকে বলতে ইচ্ছে করছে যে, সে ওই মেয়েটাকে আজকে দেখতে পেয়েছিলো, কথাও হয়েছে।
অনেক্ষণ ভেবে সে বাড়ির উদ্দেশ্যেই রওয়ানা দিলো, একটু অসুস্থতার ভান করে বিকেলের আওয়ার মিস দিলো।

বাড়িতে এসে কলিংবেল বাজাতেই তার মা দরজা খুলে তাকে দেখে চকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
‘ আজকে এসময়? শরীর খারাপ?

নিহিত হেসে বললো,
‘ জ্বী না আম্মা। আমি একদম সুস্থ। আজকে ওই মেয়েটাকে দেখেছিলাম।

তার মা চোখ বাঁকিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘ কোন মেয়েটা?

নিহিতের সহজ উত্তর,
‘ আরে আম্মা বর্ণার কথা বলছি।

এবার নিহিতের মা তার কাঁধে জোরে ধাক্কা দিয়ে বললো,
‘ তুই কবে বর্ণা নামক কোনো মেয়ের কথা বলেছিলি আমাকে? আচ্ছা ওই কোনো এক দোকানে দেখা একটা মেয়ের কথা যে বলিস, তার নাম কি বর্ণা?

নিহিত এবার মাথা দুলিয়ে হাসতে হাসতে জবাব দিলো,
‘ জ্বী ওটাই তো। আমার তো মনেই নেই যে আপনি নাম জানেন না। আপনি জানবেন কি করে? আমিই তো আজকে জানলাম।

তার মা সোফার দিকে অগ্রসর হয়েও আবার ছেলের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘ কিছু খাবি? লেবুর শরবত?

নিহিত হ্যাঁ সম্মতি দিয়েই সোফায় বসে পড়লো। সে বসতেই তার মার মোবাইলে ইমু থেকে একটা নোটিফিকেশন আসলো। একটা পুরুষ মানুষের আইডি থেকে ছবি আসছে। নিহিত দেখলো নামটা অনেক অচেনা, এই নামে তার মায়ের কোনো পরিচিত মানুষকে নিহিত চিনেনা, তার বাবার সব বন্ধুদেরই নিহিত চিনে। এদিকে তার বাবাও ছেলের বিয়ের সময় দেশে আসবেন বলে ছুটি পেয়েও বসে আছেন, কিন্তু নিহিত বিয়েতেই সায় দিচ্ছেনা।
নিহিত অপরিচিত ব্যক্তির সম্পর্কে ভাবতে ভাবতেই তার মা শরবত হাতে এসে বসলো। নিহিত গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়াতেই ছবি পাঠানো লোকটার আইডি থেকে ফোনের রিং বেজে ওঠলো, তার মা তার দিকে তাকিয়ে ফোন রিসিভ করলো।
কেমন যেন ভীত একটা চেহেরা। হ্যালো বলে পরক্ষণেই বলে উঠলেন,
‘ তাতো বুঝলাম, কিন্তু আমার ছেলের সিদ্ধান্তও তো দেখতে হবে আমাকে। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছি।

বলেই ফোন কেটে নিহিতের মা সোফায় বসলো। নিহিত গম্ভীর মুখে বললো,
‘ ঘটক ছিলো? এর আগে কি যেন ছবিও পাঠিয়েছে মনে হয়। আমি তো ভেবেছিলাম আপনি পাত্রী দেখা ছেড়ে দিয়েছেন!

তার মা চুপ করে এবার ছবিটা গিয়ে দেখে বললো,
‘ নিহিত এই মেয়েটার কথাই বলছিলাম, এতদিন নাকি মেয়েটা রাজী ছিল না, বলছিলো অন্তত স্নাতক শেষ করে বিয়ে নিয়ে ভাব্বে। তুই যেমন চেয়েছিলি মেয়েটা ঠিক তেমনি। তাই আসলে কথা বলছিলাম, এদিকে বিয়ে করবেনা করবেনা করেও ওই মেয়ে এখন হুট করে নাকি বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেছে।

নিহিত গ্লাসের শেষ শরবতটুকুও হা করে খেয়ে একটা ঢেঁকুর তুললো, আর মুচকি হেসে বললো,
‘ কিন্তু আম্মা আমি বিয়ে করবোনা এই মেয়েকে। আমাকে সময় দিন, আমি বর্ণাকেই বিয়ে করবো। আমি জানি আমাদের আবার দেখা হবে।

বলেই নিহিত উঠে যাবে, তখনি তার মা সামনের টি টেবিলে তার ফোনটা রাখলো, ব্রাইটনেস কিছুটা কমে গেছে, তার মধ্যেই নিহিত ফোনে তাকিয়ে চমকে উঠেছে। সে ভালো করে তাকানোর আগেই ফোনের আলোটা পুরোপুরি নিভে গেছে।
নিহিত বিস্মিত চোখে তার মা দিকে একবার তাকিয়ে বললো,
‘ মা তোমার ফোনের মেয়েটা তো বর্ণা ছিলো বলে মনে হচ্ছে।

এটা শুনতেই তার মা তাড়াহুড়ো করে ফোন হাতে নিয়েই বললো,
‘ কি বলিস? সত্যি নাকি?

চলবে….

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here