#অবাধ (০৩)
নিহিতের মা সাথে সাথেই স্ক্রিন অন করে নিহিতের সামনে ধরে বললো,
‘ এই মেয়ে? দেখ দেখ, ভালো করে দেখ!
নিহিত তার মাকে আচমকা জড়িয়ে ধরে উৎফুল্লতার সহিত হাসতে হাসতে বলে উঠলো,
‘ ভালো করে দেখতে হবে না, এটাই বর্ণা আম্মা।
এবার দুজনের মনেই খুশিতে লাড্ডু ফুটছে। এদিকে তাদের কান্ডের মধ্যে নিপুণ এসে দাঁড়ালো, কিন্তু দুজনের এই প্রফুল্লচিত্তের কারণ বুঝলোনা। তারই মধ্যে নিহিতের মা ঘটককে ফোন দিয়ে বলতে লাগলো,
‘ আমরা আগামীকালই মেয়ে দেখতে আসবো। আমার ছেলেও রাজী হয়েছে। সবকিছু যেন এবার ভালো হয়।
এরপরই নিহিতের মা নিহিতের বাবাকে ফোন করে বলে দিলো, নিহিতের পছন্দ করা মেয়েকেই তারা পাত্রী হিসেবে পেয়ে গেছে, উনি যেন তাড়াতাড়ি ভিসা রেডি করে দেশে চলে আসে।
নিহিত এবার অনেক খুশি, সবকিছু এতো সহজ হবে সে কল্পনাও করতে পারেনি। অনেক প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, তবুও সে ভেতরে ভেতরে ভীষণ আনন্দ অনূভব করছে। সে প্রতিজ্ঞা করছে, বর্ণাকে সে এতো ভালোবাসবে আর এতো ভালো রাখবে যে বর্ণা কোনোদিন ভুল করেও তার প্রাক্তনকে মনে করার সময় পর্যন্ত পাবেনা।
পরেরদিন কীভাবে ছুটি নিবে সেই চিন্তা করতে করতে তার রুমে চলে গেলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে কল্পনা করছে তার এই রুমে বর্ণার উপস্থিতি ঠিক কতটা সুন্দর হতে পারে! আশেপাশে বর্ণা যখন শাড়ী পরে ঘুরে বেড়াবে, তখন তো তাকে এক মূহুর্তও চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে হবে না, তাহলে তার অফিস? তখন আবার এমন না হয় প্রতিদিন সে কোনো না কোন অজুহাতে অফিস কামাই করছে, আর অফিসের সবচেয়ে ফাঁকিবাজ লোকটা সে হয়ে গেছে!
তার অদ্ভুত চিন্তা ভাবনার মধ্যে নিপুণ এলো, এসেই দুম করে বসে বললো,
‘ এটা কি হলো? তুমি এভাবে হুট করে পাত্রী দেখার তারিখ করলে কেন? জানো কালকে আমাদের স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আর আমি তিনটাতে অংশ নিয়েছি। আমি কি করে আমার ভাবিকে দেখতে যাবো?
নিহিত মুখ চেপে নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণ করলো, কারণ জানে উল্টা পাল্টা কিছু বললেই নিপুণ কেঁদে ফেলবে৷ সে তার বোনের মাথায় হাত রেখে বললো,
‘ তাহলে তোকে নিয়ে আমি আবারও মেয়ের সাথে দেখা করবো, বাইরে কোথাও। বিয়ের আগে অবশ্যই তুই তোর ভাবিকে দেখবি।
নিপুণ এবার হাসলো, আর খুশিমনেই নিহিতের রুম পরিত্যাগ করলো।
সেদিনের সময়গুলো নিহিতের কাটছিলোই না যেন। যার ভেতরকার একটাই চিন্তা, কবে সকাল হবে, তার চোখের একমাত্র আক্ষেপ কবে বর্ণাকে দেখবে, আর তার বুকে প্রতিধ্বনি তুলছে একটা সুক্ষ্ম আওয়াজ, ‘ বর্ণা তুমি ভুল মানুষের থেকে সরে এসে আমার কেবল একটা সুযোগ দিও, দেখো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটা তুমি হবে। ‘
সারারাত কোনোভাবে ছটফট করে কাটিয়ে দিলেও সকাল যেন তার কাটছেনা। ওরা বলেছে তারা যেন তাদের ওখানে গিয়ে দুপুরের খাবার খায়। তাই নাকি দুপুরের দিকেই যেতে হবে। এদিকে নিহিত শুধু পায়চারী করছে, কিন্তু তার মা তাকে তৈরি হওয়ার কথা বলছেইনা। সেও বারবার সময় দেখছে, কিন্তু আজ আর ১০ টা বাজছেনা। রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়নি, সে দিকেও তার ভ্রুক্ষেপ নেই। বর্ণাকে নিয়ে তার ভেতরে চরম উত্তেজনা কাজ করছে, বর্ণা যখন তাকে পাত্র হিসেবে দেখবে, না জানি কেমন রিয়েক্ট করে!
এদিকে কোনোভাবে ১০ টা বাজতেই নিহিত গোসল করতে গেলো, তার ভাবনা ছিল অনেক সময় নিয়ে গোসল করবে, তাহলেই সময় কেটে যাবে। যা ভাবলো তাই করলো, বিরাট সময় নিয়ে গোসল করে এসে ঘড়ি তাকিয়ে চমকে গেলো। মেজাজ বিগড়ে গেলো মূহুর্তেই, কেননা তখন মাত্র ১০ঃ২০ বাজে!
কলেজ, ইউনিভার্সিটি জীবনের সব বন্ধুবান্ধবকে একে একে ফোন দিতে লাগলো, অস্থিরতার সময়গুলো তাও কেটে যাক।
অবশেষে তারা বারোটা বাজে রওয়ানা দিলো।
নিহিত পুরো গাড়ীতে তার বুকের ঢিপঢিপ আওয়াজ স্পষ্ট শুনছিলো, অদ্ভুত এক অনূভুতি সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। হাত পা বারবার তার অবশ হয়ে আসছিলো। বর্ণাকে সত্যিই পাবে তো? কোনো ঝামেলা পাকাবে তো আবার?
নিহিত যখন বর্ণাদের ড্রয়িং রুমে গিয়ে সোফায় বসলো, সে দেখলো তার হাঁটু কাঁপছে। সে জীবনেও এমনটা শুনেনি বা দেখেনি, একটা ছেলে পাত্রী দেখতে আসলে এমন নার্ভাস থাকে।
এদিকে নিহিতকে রেখে তার মা আগে আগেই মেয়েকে দেখতে ভেতরে চলে গেলো। মিনিট দশেক পরে ফিরে এসে বললো,
‘ কিরে মেয়ে তো অনেক সুন্দর। ভালোই ফর্সা!
নিহিত ফিসফিস করে বললো,
‘ একদমই না, এটা কৃত্রিম। ওর আসল গায়ের রঙ আমি দেখেছিলাম। আমার বিশ্বাস সে শীগ্রই আগের মতো হয়ে যাবে, আর আমার তার সেই আগের রূপটাই চাই আম্মা। আপনি দেখেননা আজকেই বিয়ে নিয়ে আগাতে পারেন কিনা।
নিহিতের মা নিহিতের এমন পাগলামি কথা শুনে ওর হাত চেপে ধরলো। আর চুপ থাকার ইশারা করলো। এরই মধ্যে বর্ণার বাবা এসে গল্প করতে বসলো। বসে নিহিতের পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করতে লাগলো। এর মধ্যে নিহিতের মা বলে উঠলো,
‘ মেয়েকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে, এখন নিহিত দেখার পর আপনারা চাইলে..
এতটুকু বলার আগেই বর্ণার বাবা বলে উঠলো,
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ আপনারা চাইলে আংটি পরিয়ে দিয়ে যেতে পারেন৷ আমার মেয়ে তো একদম রাজী, আর আমরাও আপনাদের পরিবার সম্পর্কে জানি। তাহলে ছেলের পছন্দের পরে না বলার কোনো প্রশ্নই আসেনা।
নিহিতের মা হেসে নিহিতের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আমার ছেলেরেও পছন্দ হবে ইনশাআল্লাহ।
লাজুক হাসিতে নিহিত মাথা নুইয়ে ফেলতে চাইলেই দেখলো সামনে একটা ছায়া, সে আস্তে আস্তে চোখ উঁচু করতেই দেখলো গোলাপি রঙের শাড়ী পরে ধীর পায়ে এদিকে একজন এগিয়ে আসছে। মাথার আঁচল কপাল ছুঁই ছুঁই, কিন্তু সেই দৃষ্টি মেঝেতে ৷ নিহিত দেখছে সেই গোলাপি আঁচল বাতাসে হেলদোল খেয়েও ভেতরে থাকা গোলাপটাকে আড়াল করতে পারছেনা। তার হাঁটু কাঁপা, ভেতরকার ধুকপুক কেবলই তীব্র হচ্ছে, কিন্তু সেটাতে এক বিন্দুও মনোযোগ নেই, তার চোখ মন যে একটা জায়গাতেই স্থির হয়ে গেছে, একটা গোলাপে!
বর্ণা কখন ওখান থেকে হেঁটে এসে বসলো, নিহিত বুঝতেই পারেনি। কিন্তু বুঝলো তখন, যখন বর্ণা নিচের দিকে তাকিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিলো।
তার মা যখন তাকে সালামের উত্তর দিতে ইশারা করলো, সে থতমত করে কি যেন বিরবির করে জবাব দিলো, বোধহয় সামনের কেউ শুনেইনি।
তারপর বর্ণার মা বর্ণার মুখ পুরোপুরি দেখানোর জন্য মাথার কাপড়টা অর্ধেক সরিয়ে ফেললো, নিহিত উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলো,
‘ মাশাল্লাহ!
এই আওয়াজ শুনতেই বর্ণা তার নিচু করে রাখা চোখ দুটো হুট করে উপরে তুলে ফেললো। নিহিতের দিকে তাকিয়ে একটা বড়সড় ঢোক গিললো, নিহিত বুঝতে পারলো বর্ণা তাকে দেখে চমকে গেছে।
এদিকে নিহিতের মা নিহিতকে বললো,
‘ মেয়েকে কোনো প্রশ্ন করার থাকলে করতে পারিস৷
নিহিত মুচকি হেসে বললো,
‘ আমার কোনো প্রশ্ন নেই, আমার মেয়ে পছন্দ হয়েছে। উনাদের প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই করতে পারে।
বর্ণার মা হেসে বললো,
‘ না না আমাদেরও প্রশ্ন নেই।
বর্ণা গম্ভীর স্বরে বললো,
‘ মা আমার প্রশ্ন আছে। আমি কিছু বলতে চাই, একটু আলাদা।
বর্ণার মা তার বাবার দিকে তাকালো, বর্ণার বাবাও বর্ণার মার দিকে তাকালো। তারা দুজনেই ইশারাই কিছু বলছিলো। এদিকে নিহিত গলা খাঁকরে বললো,
‘ আরে আরে সমস্যা নাই তো। কথা থাকতেই পারে, বিয়ে তো সহজ কোনো ব্যপার নয়, দুটো জীবনের সম্মিলন। তাই দুজনের বুঝাপড়াটাও জরুরী।
এই কথাগুলো নিহিত জোর গলায় বললেও, তার গলা শুকিয়ে কাঠ, ভেতর যেন ফেটে চৌচির প্রায়, না জানি বর্ণা তাকে কি বলতে যাচ্ছে।
চলবে…..
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার