অবাধ (১ম পর্ব)

0
2706

#অবাধ (১ম পর্ব)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

১০ দিনের মধ্যে আমার ত্বকটাকে ফর্সা করে ফেলতে পারবে এমন কোনো ক্রিম আছে আপনার কাছে?
এমন কথা শুনে দোকানদার স্বাভাবিকভাবেই তার সেই মেয়ে কাস্টমারের দিকে তাকালো, তার অপরপ্রান্তে থাকা আরেকজন খরিদ্দারও মেয়েটার দিকে তাকালো। দুজনের দৃষ্টি প্রথমে স্বাভাবিক থাকলেও মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সেটার কিছুটা ব্যতিক্রম হলো। দুজনের দৃষ্টিতেই একটু বিষ্ময়! বিক্রেতা তার প্রোডাক্ট সম্পর্কে জানাতে মুখ খুললেও পাশের কাস্টমার হাতে সাবান আর শ্যাম্পুর বোতল নিয়ে মেয়েটার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছেনা,মেয়েটার গায়ের রঙ এতো মিষ্টি হওয়া সত্ত্বেও সে কেন ফর্সা হওয়ার জন্য ক্ষতিকারক ক্রিমের সন্ধান করছে। এদিকে দোকানদার হেসে বললো,

‘ অবশ্যই আছে আপু, কয়েক রকমের আছে। এই যে এটা দেখেন, এটা নতুন এসেছে, একদম অরিজিনাল চায়না৷ আর এটাও দেখতে পারেন, ভালো তবে আপনার জন্য ওইটাই ভালো হবে। আমাদের কাছে এই প্রোডাক্টগুলো খুবই ভালো মানের, আপনাকে ১০ দিন নয়, ৭ দিনেই পরিবর্তন করে দিবে। কোনটা দিবো বলুন?

মেয়েটা থতমত করে বললো,
‘ যেটাতে ক্ষতির সম্ভাবনা কম।

মেয়েটার দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে থাকা ছেলেটা পাশ থেকে বলে উঠলো,
‘ বিষ কিনতে এসে কেউ কি বলে যে, সেটাতে যেন বিষের প্রভাব কম হয়?

মেয়েটা আড়চোখে ছেলেটার দিকে একবার তাকিয়ে আবার বিক্রেতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ এটার দাম কতো?

বিক্রেতা প্যাক করতে করতে বললো,
‘ ১২৫০ টাকা আপু, আপনি ৫০ টাকা কম দিয়েন!

মেয়েটা চুপচাপ টাকা দিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে গেলো। এদিকে ছেলেটা দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ ভাইয়া আপনি দেখেছিলেন মেয়েটা কতো মায়াবী? গায়ের রঙ চাপা হলেও দারুণ লাগছিলো কিন্তু।

দোকানী হেসে জবাব দিলো,
‘ ভাইয়া এমন দেখে দেখে আমি অভ্যস্ত, যদিও প্রথম মেয়ের দিকে তাকিয়ে আমারও মনে হয়েছিল যে মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে ডুবে যাওয়ার মতো যথেষ্ট সৌন্দর্য্য বিদ্দমান আছে, তার আর কিছু ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। কিন্তু পরবর্তীতে নিজের ব্যবসার কথা ভেবে কিছু বলতে পারিনি।

ছেলেটা নিজের কেনা জিনিসগুলো বুঝে নিয়ে দৌঁড়ে দোকান থেকে বের হয়ে গেলো। উদ্দেশ্য মেয়েটার সাথে একটু কথা বলবে, এই প্রসঙ্গে না হোক, শুধু বাক বিনিময়ের জন্য হলেও! কেননা ইতোমধ্যে তার চোখ মেয়েটার অমায়িক চাহনি ভুলতে পারছেনা। মেয়েটার মুখে কোনো হাসি ছিলোনা, আর না ছিল কোনো সজীবতা! তাও চেহেরায় এতো টান, এতো মায়া যে সে পেছনে ছুটে আসতে বাধ্য হয়েছে৷
কিন্তু সে বাইরে গিয়ে আর কাউকে পেলোনা। সে আশপাশে যতদূর সম্ভব দেখে নিলো, কিন্তু ওই মেয়ের আর হদিস নেই।

তার মধ্যেই তার কাঁধে হাত রেখে তার মার কণ্ঠে আওয়াজ আসলো,
‘ কিরে নিহিত, নিপুণ না তোকে কি কি কিনতে বলছিলো, কিনেছিস তো?

মাথা দুলিয়ে জবাব আসলো,
‘ হ্যাঁ নিলাম, আপনার সব কাজ শেষ?

নিহিতের মা বললো,
‘ হুম শেষ, রিকশা ডাক একটা।

বাড়ি এসে নিহিত তার বোনকে ডেকে বললো,
‘ এই নে তোর এগুলো। পরবর্তীতে কোনো কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে বলবি। এভাবে নাকেমুখে লাগিয়ে প্রয়োজনের কথা বললে খবর আছে তোর। নয়তো নিজের জিনিস স্কুল থেকে আসার পথে নিজেই কিনে আনবি, আমি টাকা দিয়ে দিবো।

নিপুণ চাপা হাসিতে বললো,
‘ আচ্ছা এরপর আগে আগে বলবো, কিন্তু তুমিই এনো। আর শুনো নিজের চেহেরা ভালো করে দেখো, সারাদিন কাজ কাজ করে কি অবস্থা বানিয়েছো, আম্মা কিন্তু তোমার জন্য পাত্রী দেখছে, মেয়ে অনেক সুন্দরী। তোমাকে যদি পছন্দ না করে, আমাদেরকে কি লজ্জায় না পড়তে হবে!

নিহিত অন্য সময় হলে তার বোনের এইসব নিত্যদিনের অদ্ভুত কথাকে এড়িয়ে যেতো। কিন্তু এখন সে বসে গেছে। বসে আস্তে আস্তে বললো,
‘ তুই কি বলছিস পাত্রীপক্ষের পছন্দ অপছন্দ আমার বাইরের আবরণের উপর নির্ভর করছে? তাইলে আমি যে এতো বছর, এতো কষ্ট করে এই পর্যন্ত এসেছি, ভালো একটা চাকরি করছি এসব কিছুই না?

নিপুণ কাপড় হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে গোসলখানায় চলে গেলো, যাওয়ার আগে উচ্চস্বরে বলে গেলো..
‘ সবই লাগে ভাইয়া, সবই লাগে, নিজের যত্ন নাও, দরকার হলে আঠা ময়দা লাগাতে পারো।

নিহিত চুপ করে বসে আছে। তার মাথায় ঘুরছে ওই মেয়েটা কি তাহলে গায়ের রঙের জন্য কোনো সমন্ধে রিজেক্ট হয়েছে? বা ১০ দিন পরে এমন কিছু হতে চলেছে যার জন্য তাকে আরো সুন্দর হতে হবে?
হ্যাঁ সে তার ক্ষেত্রেও খেয়াল করছে, তার মা পাত্রী দেখতে গেলে আগেই জেনে নেয়, মেয়ের গায়ের রঙ ফর্সা কিনা, হাইট পাঁচ ফিট তিনের উপরে কিনা, শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক শেষ কিংবা তার মাঝামাঝি কিনা, তারপর আবার পরিবার, চরিত্র, স্বভাব সবকিছু ভালো কিনা। বলা চলে নিখুঁত কোনো মেয়ে মানুষ তার ঘরে আনতেই যত চেষ্টা!

নিহিত ভেতরে ভেতরে অনেকগুলো হিসাব মিলালো। তারপর রুমে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলো। পরেরদিনটাও সে অনেক ভাবলো।
তারপর রাতে ডিনারে বসে সে তার মাকে সামনে রেখে বললো,
‘ আম্মা আপনি আমার জন্য যে মেয়েটাকে দেখছেন, সে অনেক সুন্দর তাইনা?

তার মা হেসে বললো,
‘ মাশাল্লাহ মেয়ে তো অনেক সুন্দর। আমাদের পাশের বাড়ির নোরা আছে না? ওর মতো ফর্সা, চোখ নাক এগুলো আরো সুন্দর। একদিন ছুটি নে না? তোকে নিয়ে গিয়ে দেখে আসবো। এভাবে আমার উপরে সব ছেড়ে দিলে কি হবে? নিজের বউ নিজে দেখে নেওয়া উচিত না?

নিহিত আস্তে আস্তে বললো,
‘ দেখবো আম্মা। তবে আপনি এই মেয়েটাকে বাদ দিয়ে দিন। আমার এতো সুন্দর মেয়ের দরকার নেই। আপনি বরং আমার জন্য শ্যাম বর্ণের, মায়া মায়া চেহেরার একটা মেয়ে খুঁজো। এতো সুন্দর হওয়া লাগবেনা, আমার এতো সুন্দর শুনতে শুনতে সুন্দরের প্রতি কেমন যেন তিক্ততা লাগছে। দেখেন সুন্দর মেয়ে বিয়ে করে নিলেই কি সব শেষ? তার কাছে তো আমাকে সুন্দর লাগতে হবে তাইনা?

নিহিতের মা চশমার উপর থেকে তার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। তারপর হুট করেই বলে উঠলো,
‘ রোহেনার মেয়েকে দেখতে পারি। ভারী লক্ষী জানিস? শুধু গায়ের রঙটা চাপা, তবে দেখতে কিন্তু মিষ্টিই লাগে। আচ্ছা নিহিত তোর কোনো পছন্দই কি নেই? কাউকেই কি ভালো লাগে না?

নিহিত খাওয়া ছেড়ে তার মার দিকে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললো,
‘ কাল একটা মেয়েকে আমার ভালো লেগেছে। একটা ভয়ংকর ভালো লাগা আম্মা। তারপর থেকে আমার তাকে বারবার দেখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু বিশ্বাস করেন সে এতটাও ফর্সা কিংবা সুন্দরী না, কিন্তু আমি একবার দেখেই আটকে ছিলাম। আমার মনে হচ্ছিলো ঠিক এই মেয়েটাই, যাকে দেখে আমি অনেক সময় স্থির হয়ে থাকতে পারবো, আমার আর কিছুর দরকার হবেনা। জানেন আম্মা, প্রথমবারের মতো কোনো মানুষ দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছি, কি করবো না করবো ভুলে গেছি। এমনকি তাকে বেরসিক একটা কথাও বলে ফেলেছি, কারণ মেয়েটা ফর্সা হওয়ার জন্য ক্রিমের সন্ধান করছিলো। বিশ্বাস করেন, সে তার প্রকৃত গায়ের রঙটাতেই এতো সুন্দর যে, আমরা অতিমাত্রায় যেই রঙে আকৃষ্ট হই সেটা তার কাছে কিছুইনা।

তার মা বিরবির করে জবাব দিলো,
‘ তাহলে মেয়েটা এমন কেন করছিলো?

নিহিত বললো,
‘ আমি জানিনা আম্মা। তবে আমি জানতে চাই। আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে।

নিহিতের মা কোনো উত্তর দিলোনা। তিনি মনে মনে ভাবছেন ছেলের মধ্যে এই সময় এমন পাগলামি জড়ো হলো কেন? যে বয়সে হওয়ার কথা ছিলো, তখন তো হয়নি। আবার এটাও ভাবছেন, যেখানে ছেলের জন্য পাত্রী দেখছেন, সেখানে তিনি কীভাবে মানা করবেন!


চলে গেলো বেশ কয়েকদিন।
নিহিত প্রায়ই বিভিন্ন কিছু কেনার ছলে ওই দোকানটাতে যায়। কিন্তু কখনো মেয়েটার সন্ধান পায়না, ওই দোকানীও মেয়েটাকে চিনেনা। নিহিত দোকানীকে এও বলে দিয়েছে মেয়েটা কখনো দেখলে যেন কোনোভাবে হলেও তার ঠিকানা সংগ্রহ করে।
এদিকে তার বিয়ে সংক্রান্ত যাবতীয় কথাবার্তাও বন্ধ হয়ে গেছে। সে যেখানেই যায় সেই মুখটাকে পাগলের মতো খুঁজে চলে।

দুইমাস কেটে গেলো।

সেদিন নিহিত লাঞ্চের জন্য বাসা থেকে কোনো খাবার নিয়ে আসেনি। রেস্টুরেন্টে মুরগ পোলাও অর্ডার দিয়ে বসে আছে। হাতে ফোন, একটু নিউজফিড স্ক্রল করছে। এর মধ্যেই সে শুনছে পেছনের টেবিলে একটা মেয়ে একটু জোরে জোরে কথা বলছে। প্রসঙ্গটা বিচ্ছেদের, ছেলেটাকে বোধহয় অন্য মেয়ে নিয়ে বসে থাকতে দেখেছে, যার জন্য তার অন্য প্রেমিকা এখানেই চিল্লাচিল্লি করছে। নিহিত দেখলো দুজন ওয়েটারও মেয়েটাকে শান্ত করতে পারছেনা। নিহিত এবার কানে ইয়ারফোন গুঁজতে পকেটে হাত দিতে শুনলো মেয়েটা হঠাৎ তার সুর বদলে ফেলেছে, এখন বিনয় আর কান্নায় জর্জরিত স্বরে বলছে,

‘ আগে নাহয় আমি এই মেয়ের থেকে কালো ছিলাম, এখন তো ফর্সা হয়েছি! তাহলে কেন আমাকে দূরে সরাবে? তুমিই না একসময় আমাকে বলতে তোমার চোখে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সুন্দর? এরপরও আমার অগোচরে বলেছো যে আমার গায়ের রঙের জন্য তোমার পরিবার আমাকে মানবেনা, আমি কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছি, দেখো এখন আগের থেকে অনেক ফর্সা হয়ে গেছি, তুমি বলেছিলে দেশে এসেই তোমার মা-বাবাকে নিয়ে আমাকে দেখতে যাবে, দুইমাস হয়ে গেছে এখনো যাওনি। শুনো, আমি এই মেয়ে আর তোমার এই সম্পর্ক সব ভুলে যাবো, তুমি আরেকটাবার আমাকে ভালোবাসো প্লিজ, একটা সুযোগ দাও!

নিহিত তাড়াতাড়ি করে উঠে দাঁড়ালো। সে মেয়েটার মুখ দেখার আগেই দেখলো, মেয়েটা ছেলেটার পায়ে পড়ে গেছে। আর এই আকস্মিক পায়ে পড়ার বিষয়টাকে ছেলেটা খুবই বিশ্রীভাবে নিয়েছে, মেয়েটাকে হাঁটুর ধাক্কায় কিছুটা দূরে সরিয়ে তার নতুন প্রেমিকার হাত ধরে ইতোমধ্যে বেড়িয়ে যাচ্ছে। ওই মেয়েটা ছেলেটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদছে, আর নিহিত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আবার স্থির হয়ে গেছে, যেমনটা হয়েছিল সেইদিন ওই দোকানটায়!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here