অবেলায় কেন বসন্ত নিয়ে এলে?পর্ব-২

0
1037

‘অবেলায় কেন বসন্ত নিয়ে এলে?’

মাধবীলতা মেসেজ সিন করে রেখে দিল। কোনো রিপ্লাই দিল না। হাই,হ্যালো,কেমন আছেন? কি করেন? আপনি অনেক সুন্দর,অনেক ভালো লেখেন আপনি। আপনার লেখার একজন ভক্ত আমি। অনেক পছন্দ করি আপনার লেখা। লেখার ভক্ত হলে ম্যাসেনঞ্জারে কেন? পোস্টে লেখা পড়ে সরাসরি পোস্টে কমেন্ট করলেই তো হয়। লেখার প্রশংসা সেটা আবার আড়ালে আবডালে কেন? লেখার সাথে মন্তব্য থাকলে লেখক যেমন প্রেরণা পায় তেমনি অন্য পাঠকদের পড়ার ইচ্ছে জাগে,আগ্রহ জাগে। এই সাধারণ বোধটুকু থাকলে ম্যাসেনঞ্জারটা একটু স্বস্তিতে থাকতো। মাঝেমাঝে এসব আজাইরা
প্রশংসা মাধবীলতার একেবারে অপছন্দ লাগে। আর প্রত্যেকের মেসেজের রিপ্লাই দেওয়ার মতো এত সময় কোথায়?

মাধবীলতা আবার এফবিতে চোখ রাখলো। কিছু সময় পর এফবি থেকে অফলাইন হলো। বালিশের কাছে মোবাইল রেখে ‘প্রেম নেই’ উপন্যাস পড়ছে। এর মধ্যে রমিজা বানু মগভর্তি চা নিয়ে এল। লেবু মিশ্রিত চা। ধোঁয়ার সাথে সুন্দর একটা গন্ধ প্রভার নাক ছুঁয়ে গেল।
‘কাগজী লেবুর চা আনছো?’
‘হ্যাঁ।’
‘ঠিক এই সময়টা চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। তুমি বুঝলে কি করে?’এতদিন ধরে তোর সাথে আছি তোকে বুঝবো না। তুই জানিস কিনা জানি না। ছোটবেলায় তোর মায়ের সাথে আমার খুব মাখামাখি ছিল। আমাকে খুব আদর করতো। তোর মাকে আমি নাহার ‘বু’ বলে ডাকতাম। কখনও কামরুন্নাহার ডাকতে পারতাম না। কারমুন্নাহার মুখ থেকে বেরিয়ে যেত। এই নিয়ে সবাই খুব হাসাহাসি করতো। রাগে তোর মায়ের মুখ লাল হয়ে যেত।
রাগে বলতো,’রমিজা ভুলেও তুই আমার নাম উচ্চারণ করবি না। যদি করিস আর ভুল উচ্চারণ করিস তাহলে তোরে পুকুরে চোবাবো।মনে রাখিস!’ ভয়ে আর নাম ডাকিনি। নাহার বু ডাকতাম। আমার দেখাদেখি অন্যরাও নাহার বু বলে ডাকতো। তোর মা খুব মজা করে আম ভর্তা বানাতো। আহা! এখনও জিভে লেগে আছে। আমি আর এক বোন গাছ থেকে আম পেড়ে দিতাম তোর মা কুচি করে শুকনো মরিচ,চিনি মিশিয়ে চটকে সবাইকে কলাপাতায় খেতে দিতো।
মাধবীলতা চা শেষ করে বলল,
‘শুধু আম ভর্তা না। মায়ের হাতে সব ভর্তাই খুব স্বাদের ছিল। কতদিন হয় মায়ের হাতে রান্না খাই না। খুব মনে পড়ে মা’কে।
‘তোর মায়ের কাছে আমি ঋণী। আমাকে অনেকভাবে উপকার করেছে। নাহার বু’র জন্য নামাজে দোয়া করি। আল্লাহ তাকে বেহেশতের মেহমান হিসেবে কবুল করে নিক।’
মাগরিবের আযান শুনে রমিজা বানু ওযু করতে চলে গেল।
মাধবীলতা বারান্দায় আসলো। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অস্তগামী সূর্য পশ্চিমকোণে আড়াল হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। বাসার সামনে বিশাল মাঠ। মাঠ দেখেই মায়ের জন্য কলাবাগান বাসা নিয়েছিলাম। মা আমাকে একা করে চলে গেলেন। উদাসমনে মাঠের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছে,
মা এখন বিমূর্ত
হৃদয়টা যে আর্ত
মা আকাশের তারা
যায় না তাঁকে ধরা,,
ছেলেরা খেলা শেষে বাসায় ফিরছে। মাধবীলতা নিজের রুমে আসে। মায়ের কথা মনে করে মাধবীলতার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যায়। কপালে হাত রেখে চুপচাপ খাটে শুয়ে থাকে।
মোবাইল ভাইব্রেট করা। মোবাইল বাজছে টের পেয়ে বালিশের কাছ থেকে মোবাইল হাতে নিল,
স্কিনে দেখে ছোট বোন লতার নাম্বার। রিসিভ করলো,
‘লতা বল্’
‘লতা না। আমি তোমার মা’
মাধবীলতা হেসে বলল,
ওওও আম্মিজান বলেন।
তুমি আসো না কেন ‘বড় মা’?
‘সময় পাই না যে সোনা’
মা,বাবা সময় পায় না। সারাক্ষণ,চেম্বার,হসপিটাল নিয়ে ব্যস্ত। তুমিও সময় পাও না। আমি কার সাথে কথা বলবো বড় মা?’
‘মা’কে বলবে বড় মার কাছে দিয়ে আসো। তুমি আসলে তোমাকে নিয়ে বইমেলায় যাবো। তোমার পছন্দের সব বই কিনে দেব। দু’জনে মেলায় ঘুরবো। পছন্দের খাবার খাবো। এবার খুশি তো?
তিতলি খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠে।
‘ইউ আর গ্রেট বিগ মম। লাভ ইউ সো মাচ।
‘ওকে ডিয়ার মাই চাইল্ড। এখন মন দিয়ে লেখাপড়া করো। পরীক্ষায় ভালো করতে হবে কিন্তু।’
মাধবীলতা ফোন রাখলো। তিতলি ক্লাস ফাইভে পড়ে। মাধবীলতার ছোট বোনের মেয়ে। দুই বোনের তিনটে ছেলেমেয়েই মাধবীলতাকে বড় মা বলে ডাকে। মাধবীলতার প্রাণ তিনটে বাচ্চা। মাঝেমধ্যে তিতলি বড় মায়ের কাছে চলে আসে।
তিতলিকে কাছে পেয়ে মাধবীলতাও শান্তি পায়।

আবারও ফোন বেজে উঠলো। আননোন নাম্বার।
তিনবার রিং হতেই রিসিভ করলো,
‘ঠাণ্ডা কমেছে?’
‘কিছুটা কমেছে।’
‘আপনি কে বলছেন?’
‘সবুজ’
‘ভালো আছেন? আচ্ছা নাম্বার কোথায় পেলেন?’ ‘ভালো আছি। নাম্বার সংগ্রহ করতে ইচ্ছে হলো তাই করেছি।’
‘আচ্ছা আপনি পারফিউম গিফট করেছেন কেন?
‘ইচ্ছে হয়েছে তাই। এই নিয়ে আর কোনো কথা না। আপনার প্রতিটি লেখা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি। মন ছুঁয়ে যায় আপনার লেখা। আপনার লেখা যখন পড়ি তখন নিজেকে একা লাগে না।
সুস্থ থাকবেন,আর অনেক অনেক লিখবেন।’
মাধবীলতা মৃদু হাসলো। লেখার প্রশংসা পেলে খুব ভালো লাগে। লেখার শক্তি বেড়ে যায়।
মাধবীলতা বলল,
‘দোয়া করবেন আমার জন্য।’
‘আপনার উপন্যাস ‘তাকে দেখিনি’ পড়া শুরু করেছি। পুরোটা পড়ে রিভিউ দেব ইনশাআল্লাহ।’
‘রিভিউ শোনার অপেক্ষায় রইলাম।’
‘জি,ধন্যবাদ।’

দুইদিন পর তিতলিকে তার বাবা মাধবীলতার বাসায় নামিয়ে দিয়ে যায়। তিতলি মা,বাবার সাথে ধানমন্ডি ৪/এ থাকে। মাধবীলতা আধঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে তিতলিকে নিয়ে বইমেলায় আসলো। মেলায় তেমন ভিড় নেই। মাধবীলতা ভাবছে, তিতলিকে নিয়ে বন্ধের দিন না এসে খুব ভালো হয়েছে। এত ভিড়ের মধ্যে মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে যেতো। তিতলিকে নিয়ে কথামালা স্টলে কিছু সময় বসে। স্টলের সবার সাথে তিতলিকে পরিচয় করিয়ে দিল। তিতলিকে নিয়ে বেশ কিছু ছবি তুললো। ঘুরে ঘুরে তিতলির পছন্দের বই রাবেয়া হাসানের ‘কাকতাড়ুয়ার বিয়ে’ ভুতের বই ‘অভিশপ্ত ট্রেন’
‘শয়তানের রাজত্ব’ জাফর ইকবালের দুটো সাইন্স ফিকশন কিনে। আইসক্রিম,চটপটি খেয়ে সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে আসে।

বাসায় এসে দেখে রমিজা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। বেশি কথা বলছে না। মাধবীলতা জিজ্ঞেস করলো,

‘খালা কি হয়েছে?’
‘শরীরটা ভালো লাগছে না।’
মাধবীলতা কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।
‘হায় আল্লাহ ! গায়ে তো অনেক জ্বর।’
রমিজা বানু ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
‘একবার বমি হয়েছে।’
মাধবীলতা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রমিজা বানুর কাছে আসে। তোয়ালে ভিজিয়ে জ্বরের মুখ,গাল মুছে দিল। কাপালে জলপট্রি দিয়ে আস্তে করে বলল,
‘খালা লেবু শরবত বানায়ে আনছি। একটু ধৈর্য ধরো। ভালো হয়ে যাবে।’
মাধবীলতা লেবু চিপে গ্লাসে চিনি মিশাতে মিশাতে ছোটবোন বনলতাকে ফোন দিল,
লতা, সাজিদকে পাঠিয়ে দে! তিতলিকে নিয়ে যাক। রমিজা খালার খুব জ্বর আসছে। আল্লাই জানে ডেঙ্গু জ্বরই নাকি। চারদিকে যেমন ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বাড়ছে। সাবধানে থাকিস।
‘বড় আপু আমি এখনি তিতলির বাবাকে পাঠাচ্ছি। রাখছি।’

মাধবীলতা রাতে রমিজা বানুর জ্বর মেপে দেখে একশো দুই। সারা শরীর ব্যাথা। রমিজা বানু জ্বরে আবোলতাবোল বকছে। মাধবীলতা ভয় পেয়ে যায়। কি করবে এখন? এতরাতে কোথায় যাবে? ঘরে জ্বরের কোনো ঔষধ পেল না। এত রাতে সাজিদকে ফোন করা ঠিক হবে না। হঠাৎ মনে হলো মাঝেমাঝে কলেজ ব্যাগের সাইট পকেটে ঔষধ রাখে। মাথায় পেইন হলে খেয়ে নেয়। দ্রুত ব্যাগে হাত ঢুকালো। একটা নাপা এক্সট্রা পেয়েও গেল। রমিজা বানুকে ঔষধ খাইয়ে নিজে ঘুমিয়ে গেল।

জ্বর বাড়ছে,কমছে এভাবে তিনদিন চলছে।
চোখ লাল হয়ে আছে। শরীরের গিটে গিটে ব্যথা। রমিজা বানু কিছুই খেতে পারছে না। ডাক্তার ব্লাড টেস্ট দিলেন। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার খুব দ্রুত হসপিটালে ভর্তি করতে বললেন। ডেঙ্গু জ্বরের কারণে রক্তের প্লাটিলেট পঞ্চাশ হাজারের নীচে চলে আসে। সব শুনে মাধবীলতা ঘাবড়ে যায়। সাজিদকে নিয়ে ইবনে সিনা হসপিটালে ভর্তি করালো রমিজা বানুকে।

মাধবীলতা কলেজ থেকে সাতদিনের ছুটি নিয়েছে। রাত দিনে রমিজা বানুর পাশে থেকে এই ক’টা দিনে একদম ক্লান্ত হয়ে গেছে । কেবিনের করিডোরে হঠাৎ সবুজ মাধবীলতাকে দেখতে পায়। মাধবীলতাকে দেখে সবুজ অনেকটা আকাশ থেকে পড়ে। মনে মনে খুব করে চাইছিল আর একটিবার যদি মাধবীলতার সাথে দেখা হতো। প্রাণভরে দেখে নিতাম। কথা নাই হতো। কোনো সমস্যা ছিল না। কাছ থেকে দেখতে তো পেতাম। এটাই অনেক সুখের ছিল। ভাবতে ভাবতে সবুজ আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে। মাধবীলতার চোখ মুখে ক্লান্তির ছাপ। সবুজকে দেখে মৃদু হাসলো। সবুজ বলল,
‘কে ভর্তি আছে?’
‘খালা’
‘আপনি কেন এখানে?’
‘এক আত্মীয়কে দেখতে আসছি।’
দু’জনে হেঁটে হেঁটে হসপিটাল থেকে বের হয়।
মাধবীলতা রিকশা নিবে এমন সময় সবুজ বলল,
‘একটা ছোট্ট রিকোয়েস্ট ছিল। রাখবেন?
মাধবীলতা কিছুটা চুপ থেকে বলল,
‘রাখার মতো হলে রাখবো।’
————————-
——–চলবে
পর্ব-২

#মাকসুদা খাতুন দোলন

https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1621363265045361/?mibextid=Nif5oz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here