অবেলায় কেন বসন্ত নিলে এলে? (পর্ব-৪,অন্তিম পর্ব )

0
1199

‘অবেলায় কেন বসন্ত নিলে এলে?’

(পর্ব-৪,অন্তিম পর্ব )

মাধবীলতা নেট থেকে বের হয়ে সরাসরি কল দিল। একবার ফোন বাজতেই সবুজ রিসিভ করে ফোন কানে ধরে চুপ করে আছে। মাধবীলতা অনেকটা রাগেই বললো,
‘একবার আবদার রক্ষা করে ভুল করেছি তাই না? এখন মনে হচ্ছে যা শুরু করেছেন সবটাই অতিরিক্ত। সবটাই বাড়াবাড়ি। এসব আমার একদম পছন্দ হচ্ছে না। আপনার দেওয়া শাড়িটা কেন পরবো বলুন? আর কাঠ গোলাপ খোঁপায় জড়িয়ে কেনই বা আপনাকে ছবি পাঠাবো। আপনি আমার কি হন?
সবুজ চুপ করে আছে। কোনো কথা বলছে না।
মাধবীলতা আবার বলল,
‘কি হলো? কথা হারিয়ে গেছে?’
সবুজের মনটা মলিন হয়ে গেল। ভেবেছিল জন্মদিনের গিফট,শুভেচ্ছা পেয়ে মাধবীলতার ভালো লাগবে। ভালো লাগার আবেশ তাকে জড়িয়ে রাখবে।
‘আপনার প্রতি সম্মান,শ্রদ্ধাবোধ,ভালোবাসা রেখেই জন্মদিনের উপহারস্বরূপ শাড়িটা পাঠিয়েছি। আমার মনে হয়েছে আপনি যথেষ্ট রুচিশীল,মার্জিত এবং মায়াবী,শান্তিপ্রিয় একজন মানুষ। যেহেতু শাড়ি আপনার নিয়মিত পরা হয়। ভেবেছি,শাড়ি আপনার পছন্দের পোশাক। তাই আমার পছন্দের অ্যাশ রঙের জামদানিটা পাঠিয়েছি। আমি আপনার কিছু না হলেও আপনি আমার কাছে অনেককিছু।’
‘প্লিজ,আপনি আর কখনোই এমন করবেন না। আমাকে আর ঋণী করবেন না।’
সবুজ মৃদু হেসে বলল,
‘অসুবিধা নেই। যখন ঋণ শোধ করার সময় আসবে তখন শোধ করে দিলেই হবে। আর ঋণ শোধ করতে না পারলেও কোনো সমস্যা নেই।
আপনার জন্য কি এমন করেছি বলুন? জন্মদিনের শুভেচ্ছাস্বরূপ ছোট্ট গিফট।
পছন্দের মানুষের জন্য জীবন দিয়ে দিলেও মনে হবে আমি কিছুই করতে পারিনি। শুনুন,ইচ্ছে হলেই আমার পছন্দের জিনিস গিফট করবোই। আর আপনাকে ওটা নিতেই হবে। নিষেধ করবেন না।’
‘ঠিক আছে,আসলে আসুক। যেভাবে আসবে ঠিক সে-ভাবেই ফেরতে যাবে।’
সবুজ উচ্চস্বরে হাসলো। মাধবীলতা ফোন রাখলো।

রমিজা বানু এশার নামাজ পড়ে খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লো। মাধবীলতার খাবার ঢাকনা দেওয়া। খেতে ইচ্ছে করছে না। শাড়িটা হাতে নিয়ে বেশ কয়েকবার দেখলো। ইচ্ছে করলেই কি মন যা চায় তা করা যায়? আবেগ,কল্পনা জীবনের অংশ কিন্তু আবেগ দিয়ে কি জীবন চলে? জীবন বাস্তবঘেঁষা। আবেগ ক্ষণস্থায়ী। বাস্তবতার কাছে আবেগ খুবই অসহায়।

রাত বেড়ে প্রায় বারোটা। মাধবীলতা অল্প খেয়ে বিছানায় আসে। চোখের পাতা বন্ধ করে। নানা
এলোমেলো ভাবনায় এপাশ ওপাশ করে। ঘুম নেই চোখে। বিছানা ছেড়ে বারান্দায় আসে। নীরব,নিস্তব্ধ রাত। আকাশটা আঁধারে ঢাকা। মৃদু হিমেল বাতাস বইছে। মাধবীলতা মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। মাঠটা এখন ঠিক আমার মতোই নিঃসঙ্গ। দিনের বেলায় মাঠের বুক মাড়িয়ে কত ছেলেরা বল খেলে,ক্রিকেট খেলে। কতজন হাঁটতে আসে খোলা আকাশের নীচে প্রকৃতির নির্মল বাতাসে। ভাবনা ছেড়ে মাধবীলতা ঘরে ফিরে গল্প ‘বদলে গেছ তুমি’ লিখতে বসে।

‘দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পার্কের পথ ধরে হাঁটছে সজল,তনিমা। টুকটাক কথা বলে হেঁটে যাচ্ছে সামনের দিকে। গাছের ছায়া দেখে পথের পাশেই দু’জনে বসলো। সজল প্রায়ই তনিমাকে ‘তনু’ বলে ডাকে। তনিমা নামের শেষ অক্ষরে ‘মা’ শব্দটি আছে। ‘মা’শব্দের বিশালতা,গভীরতা ব্যাপক। সবাইকে ডাকা যায় না। সেই বোধ থেকেই সজল ‘তনু’ বলে ডাকে। ‘তনু’ ছোট্ট নাম। তনিমার খুবই পছন্দ হয়েছে। তনিমার চেয়ে সজল খুব কম কথা বলে। সজল গাছের দিকে তাকিয়ে আছে। একদৃষ্টিতে গাছের ডালে কাঠবেড়ালির ছোটাছুটি দেখছে।
হঠাৎ তনিমা বলল,
‘সজল ভাই, তুমি আমাকে আরও বেশি ভালোবাসতে পারো না? আমরা দূরত্ব কমিয়ে দু’জনে কি আরও কাছে আসতে পারি না?
ঐ যে দেখ প্রেমিকজুগল কড়ই গাছের ছায়াতলে কত সুন্দর প্রেম করছে। ভাইয়াটা আপুর কোলে শুয়ে আছে। আপু আলতো করে ভাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ভাইয়া একটু পর পর আপুর হাতে চুমু খাচ্ছে। দু’জনের প্রেমটা কত মধুর! আর আমরা??’ সজল এবার দৃষ্টি ফেরাল তনিমার দিকে। তারপর বলল,
”তনু তুমি আমার বৌ হবে এটা পারিবারিকভাবে ঠিক হয়ে আছে অনেক আগে থেকে। এটা যেমন তুমিও জান আমিও জানি। আমরা দেখা না করলেও আমাদের বিয়ে হবে। তুমি আমার প্রেমিকা না। তুমি আমার জীবন সঙ্গী,তুমি আমার ঘরের বৌ হবে। তোমার সম্মান রাখার দায়িত্ব আমার। মনে রেখো,বিয়ের আগে যে সম্পর্কে স্পর্শ থাকে সেখানে প্রেম থাকে না। সেখানে নোংরামী থাকে। প্রেম,ভালোবাসার নামে চাহিদা থাকে। প্রেমটা করতে হয় বিয়ের পর। আমিও বিয়ের পর প্রতিদিন শুধু তোমার প্রেমেই পড়বো। বুঝছো বালিকা?’
তনিমা রেগেমেগে বলল,
‘কি আমি বালিকা? আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি এখনও আমাকে ছোট মনে হয়?’
সজল হেসে বলল,
‘জি,আপনি আমার চেয়ে সাত বছরের ছোট। বয়সে ছোট,বুদ্ধিতে ছোট,লেখাপড়ায় ছোট।’
‘ঠিক আছে, আমি চললাম এই বালিকার সাথে আর কোনোদিন দেখা করতে আসবে না। মনে থাকে যেন।’
তনিমা রাগে দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সামনের দিকে হাঁটছে……..
ঘুমে মাধবীলতার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। লেখা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে বিছানায় শুতে যায়।
পরদিন কলেজ থেকে বাসায় এসে দেখে ছোট দুই বোন চারুলতা আর বনলতা বাচ্চাদের নিয়ে
বাসায় হাজির। টেবিলে কেক,পুডিং,পায়েস, পোলাও,রোস্ট নানা পদের খাবার দিয়ে টেবিল সাজানো। খুশিতে মাধবীলতার চোখের কোণ চিকচিক করছে।
‘তোরা আসবি আমাকে একটিবার ফোন দিলি না কেন?’
তিতলি বলল,
‘তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে মা’কে বারণ করেছি ফোন করতে। তুমি তোমার জন্মদিন ভুলে গেলেও আমরা ভুলিনি। কোনোদিন ভুলবো না।’
মাধবীলতা বোনের তিনটে বাচ্চাকে বুকে টেনে নিল। মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে,গালে আদর দিল।
‘তোদের জন্যই আমি খুব ভালো থাকি রে। চল্ সোনারা এখন খেয়ে নিতে হবে।’

অনেক রাত পর্যন্ত সবাই হাসি,গল্প করে। পরদিন সকালে দুই বোন নাস্তা করে মেয়েদের নিয়ে চলে গেল। ঐদিন মাধবীলতা আর কলেজে যায়নি। বিকেল থেকে প্রচন্ড মাথা ব্যথা। সন্ধ্যা থেকে গা গরম হতে থাকে। রাত থেকে একশো দুই জ্বর। রমিজা বানু মাথায় পানি দিয়ে জলপট্রি দিয়ে দিল। চারদিন ধরে জ্বর কমে বাড়ে। ইচ্ছে করেই ডাক্তার দেখাচ্ছে না। সবুজ মাধবীলতাকে নেটে না পেয়ে অস্থির হতে থাকে। নেটে একটিভ থাকলেও সবুজ কখনো কল দেয় না তবুও মাধবীলতার নামের পাশে সবুজ সার্কেল দেখে শান্তি পায়। দুইবার ফোনে ট্রাই করলো মোবাইল বন্ধ। পরদিন কলেজে চলে আসলো আড়াল থেকে মাধবীলতাকে দেখবে।
সারাদিন অপেক্ষা করলো মাধবীলতাকে দেখতে পেলো না। সবুজ আরও অস্থির হতে থাকে। যাওয়ার আগে গেইটের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে। দারোয়ান বললো,’ম্যাডাম অসুস্থ। ছুটিতে আছেন।’ সবুজ মন খারাপ নিয়ে বাসায় আসে।
কোনো কিছুতেই মনকে স্থির রাখতে পারছে না।
এফবিতে ঢুকে মাধবীলতার প্রোফাইলের ছবিতে চোখ বুলায়। পরদিন গ্রামের বাড়ি সাভার নবীনগর চলে আসে। বাড়িতে আসে শুধু মায়ের টানে। মা যে ঘরে থাকতেন সে ঘরে ঘুমিয়ে শান্তি পায়। রাতে ঘুমের মাঝে মা’কে স্বপ্ন দেখলে মসজিদে মায়ের নামে দোয়ার ব্যবস্থা করে। এতিমখানায় এতিম বাচ্চাদের খাবারের আয়োজন করে। আজও খাবার নিয়ে ছুটে গেল এতিমখানায়। মায়ের নামে,মাধবীলতার সুস্থতার জন্য দোয়ার ব্যবস্থা করলো।

এজেন্সি থেকে জানালো দুই তিন মাসের মধ্যে সবুজের আমেরিকার ভিসা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবুজ আস্তে আস্তে দেশের সব ব্যবসা গুটিয়ে আনে। যে ব্যবসায় যা ইনভেস্ট করেছিল সব গুছিয়ে টাকা ব্যাংকে সেভিংস একাউন্টে রাখে। মায়ের কিছু গহনা ছিল সেগুলো বিক্রি করে দিল। অনেকদিন ধরে মাধবীলতার সাথে কোনো কথা হয় না। ম্যাসেনঞ্জারেও কোনো বার্তা পাঠায় না। কথা না হলেও মাধবীলতাকে ভাবনা থেকে বাদ দিতে পারে না। সবুজের সকল ভাবনা মাধবীলতাকে নিয়ে। তার বর্তমান,ভবিষ্যত সব মাধবীলতাকে ঘিরে। হঠাৎ একদিন মাধবীলতা সবুজকে ফোন দিল। কল পেয়ে সবুজ যেন স্বর্গ হাতে পেয়ে যায়। খুশিতে আত্মহারা। দুইবার কল হতেই রিসিভ করে,
‘শরীর কেমন আছে?’
‘আছি ভালো’
‘আজ বিকেলে সময় হবে?’ মাধবীলতা বলল।
‘হবে। কোথায় আসতে হবে বলুন।’
‘আড়ং আসবেন বিকেল তিনটে ত্রিশে।
‘জি,ঠিক সময়ে থাকবো।’
মাধবীলতা রিকশা থেকে নেমেই সবুজকে দেখতে পেলো। গায়ে ব্ল্যাক কালারের পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা পায়ে চটি জুতা। বেশ মার্জিত লাগছে। মাধবীলতা লিফটে জিজ্ঞেস করলো,
‘শার্ট,পাঞ্জাবি নাকি টি-শার্ট কোনটা পছন্দ?’
সবুজ থতমত খেয়ে যায়। কি বলবে বুঝতে পারছে না। সব গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। টি-শার্ট পছন্দ বলে ফেলল পাঞ্জাবি। মাধবীলতা একটু
তাকালো সবুজের দিকে। সবুজের আজ খুব নার্ভাস লাগছে। মাধবীলতা আগে আগে হাঁটছে। সবুজ পিছন পিছন। ঘুরে ঘুরে পাঞ্জাবি দেখছে।
দেখতে দেখতে মাধবীলতা চোখ গেল ছাই রঙের পাঞ্জাবির দিকে। পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে সবুজকে বলল,
‘এটা কেমন?’
‘খুব সুন্দর?’
‘ট্রায়াল দিন।’
সবুজ অবাকের সুরে জিজ্ঞেস করলো,
আমি??
‘নয় তো আর কে? সবুজ ছাড়া আমার সাথে কেউ আছে?’
সবুজ মুচকি হেসে পাঞ্জাবি নিয়ে ট্রায়াল রুমে গেল। দু’মিনিট পরেই বের হলো। সেলসম্যানকে বলল,
‘এটার ছেচল্লিশ দেবেন।’
মাধবীলতা পাঞ্জাবি, মধু,লাবাং,দই আর চার প্যাকেট হেয়ার প্যাকের বিল পে করে সবুজকে নিয়ে চলে আসলো। রিকশা ঠিক করে বলল,

‘চলুন,আজ আমি আপনাকে কফি খাওয়াবো।’
‘জি,চলুন।’

দু’জনে কফি শপে বসে আছে। সবুজ কি বলবে মাথায় আসছে না। অনেককিছু বলার আছে।
এক এক করে সব তাকে বলতেই হবে। সবুজ চুপচাপ মোবাইলের গ্যালারি থেকে একটা ভিডিও বের করে মাধবীলতার সামনে ধরলো,
এটা কি?
‘দেখলেই বুঝতে পারবেন’।
মাধবীলতা ভিডিও ওপেন করে দেখে সবুজের দিকে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে আছে।
‘মায়ের সাথে আমাকেও দোয়ায় সামিল রেখেছেন,আলহামদুলিল্লাহ। আমার অসুস্থতা নিয়ে এতটা চিন্তিত ছিলেন। সত্যিই আমি অভিভূত।’
‘আপনাকে দেখার জন্য কলেজে গিয়েছিলাম।
সারাদিন অপেক্ষা করে দেখা মিলেনি। পরে জানতে পারি আপনি অসুস্থতার জন্য ছুটিতে আছেন। তখনই বাড়ি চলে যাই। আপনার সুস্থতার জন্য দোয়ার আয়োজন করি।
‘আমাকে নিয়ে আপনার এত ভাবনা কেন? আমার সম্পর্কে কি জানেন?’
‘আমার এতকিছুর জানার প্রয়োজন নেই।’
মাধবীলতা শান্তস্বরে বলল,
‘প্রয়োজন আছে সবুজ। তোমাকে তুমি সম্বোধন করলাম। তুমি আমার চেয়ে ছোট হবে। তুমি একটা ঘোরের মধ্যে আছো। একটা মোহের মধ্যে আছো। তাই আমার সবকিছু তোমার ভালো লাগছে। মোহটা কেটে গেলে তোমার চোখ খুলে যাবে। তুমি সত্যিটা বুঝতে পারবে। আবেগতাড়িত হয়ে আমরা অনেক কিছুই বলে ফেলি। আমাদের অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করে। জীবনটা কিন্তু আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। জীবন বাস্তবনির্ভর।
সবুজ চুপচাপ কথাগুলো শুনছিল। কিছু সময় পর জিজ্ঞেস করলো,
‘শুধু একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?’
‘হুম’
‘নিজেকে কারো জীবনের সাথে জড়ান নি কেন?
‘সবই ঠিকঠাক ছিল। জীবনে যে আসার কথা ছিল হঠাৎ একদিন সে কার এক্সিডেন্টে না ফেরার দেশে…..। মায়ের দায়িত্ব,ছোট বোনদের দায়িত্ব আমার কাঁধে ছিল। মা মারা যাওয়ার আগে খুব বলেছিল বিয়ে করে যেন সংসারি হই। বোনেরা অনেক চেষ্টা করেছে। এখনও মাঝে মাঝে বলে।
‘ স্যরি। জানতে চেয়ে কষ্ট দিয়ে দিলাম। ‘
মাধবীলতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মাথা নীচু করে রাখে। কেউ কোনো কথা বলছে না। সবুজ আবার জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনার পাসপোর্ট করা আছে?’
‘হুম।’
কেন?
‘জানতে ইচ্ছে হলো। না করা থাকলে আমি আপনার পাসপোর্ট করে দিতাম। দুই তিন মাসের
মধ্যে আমার একটা সুখবর আসার সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যবসায় টাকা যা ছড়িয়ে ছিল আস্তে আস্তে সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি।’
‘অগ্রিম অভিনন্দন। এখন তাহলে উঠি।’
‘জি,চলুন আপনাকে এগিয়ে দেই।’
‘ধন্যবাদ। আমি একাই যেতে পারবো।’
মাধবীলতা পাঞ্জাবির প্যাকেট এগিয়ে দিল সবুজের হাতে।
সবুজ খুশিতে বলল,
‘ অসংখ্য ধন্যবাদ। আজ আমি খুব হেপি। এই দিনটি আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমি যা চাই সৃষ্টিকর্তা আমাকে দিয়ে দেন। দেরিতে হলেও পেয়ে যাই। অপেক্ষা করে যাবো।’
মাধবীলতা আস্তে আস্তে সামনের দিকে হেঁটে রিকশা নিল।

কলেজ,লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটায় মাধবীলতা। দুইদিন পর নেটে এসে এফবিতে চোখ রাখলো। হঠাৎ সবুজের পোস্ট সামনে এল। ছাই রঙের পাঞ্জাবি পরে দুটো ছবি পোস্ট করেছে। ক্যাপশনে লিখেছে,

”জীবনে যা পাইনি,সে আমায় পূর্ণ করে দিল
হারায়ে ফের যদি পাই বুঝে নেব আমারই ছিল,,

লাইনদুটো মাধবীলতার খুব পছন্দ হলো। দুইবার পড়লো। ম্যাসেনঞ্জারে এসে দেখে নতুন পাঞ্জাবি গায়ে অনেকগুলো ছবি সেন্ড করেছে। মাধবীলতা সবগুলো ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখছে। সাথে সাথেই সবুজ টেক্সট করলো,
‘সবকিছুকে বির্সজন দিয়ে আমরা মায়া,ভালোবাসার বন্ধনে জড়াতে পারি না?’
মাধবীলতা কোনো রিপ্লাই দিল না।

সময় যেতে লাগলো সময়ের নিয়মে। এক সন্ধ্যায় সবুজ ফোন করলো মাধবীলতাকে। মাধবীলতা সাথে সাথে রিসিভ করে কথা শুরু করে,
‘শরীর কেমন আছে?’
‘খুব ভালো আছি। বাসার ঠিকানাটা বলুন।’
মাধবীলতা ঠিকানা বলে দিল।
আধঘণ্টার মধ্যে সবুজ মাধবীলতার বাসায় আসলো। সাথে অনেকগুলি খাবারের প্যাকেট।
‘এত খাবার কেন? খাবার নিয়ে আসতে হবে কেন? অদ্ভুত ছেলে তুমি!’
সবুজের এখন আর আগের মতো জড়তা,ভয় কাজ করে না। মাধবীলতাকে তার খুব আপন মনে হয়। খুব কাছের মনে হয়। তার কাছে নিদ্বির্ধায় সব খুলে বলা যায়। সবুজ হেসে বলল,
‘ইচ্ছে হলো আজ রমিজা খালাকে নিয়ে একসাথে খাবার খাই। তাছাড়া সুখবরের টিট্র বাকি থেকে যাবে যে।’ মাধবীলতা মৃদু হাসলো। খাবারগুলো টেবিলে রেখে সবুজকে নিয়ে ড্রইং রুমে আসে। দু’জন মুখোমুখি বসেছে। মাধবীলতা বলল,
‘আজ কি কোনো বিশেষ দিন?
‘পরশু বিকেল চারটে আমার ফ্লাইট।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। খুব খুশি হয়েছি।’
সবুজ জড়ানো গলায় বলল,
‘আমি চলে গেলে আপনি বেঁচে যান তাই না?’
মাধবীলতা চুপচাপ মাথা নীচু করে আছে। মুখে কোনো কথা নেই।
সবুজ আস্তে করে বলল,’আপনাকে না দেখতে পেলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। জানি না আমার দিনগুলো কেমন যাবে।’ মাধবীলতা সবুজের দিকে তাকিয়ে বলল,’ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো।
তোমার জন্যই ভালো হবে। কারো জন্য কোনো কিছু থেমে থাকে না।’ সবুজ আবেগমাখা কন্ঠে বলল,’আমার থেমে যাবে। বাকিটা জীবন আমরা কি একসাথে কাটিয়ে দিতে পারি না? আমেরিকা যাওয়ার পর আমার একটাই চেষ্টা থাকবে কীভাবে আপনাকে আমার কাছে নিয়ে আসা যায়।’ মাধবীলতা অবাক চোখে বলল,
‘তুমি জানো কি বলছো?’ সবুজ বলল,’আমি জেনেশুনে সুস্থ মাথায় কথাগুলো বলছি। প্রত্যেকের জীবনে একজন সঙ্গী এবং সঙ্গীনির প্রয়োজন। আর সেটা জীবনের শেষ সময়টুকুতে বেশি প্রয়োজন। জানি,অসম সম্পর্ক নিয়ে সমালোচকদের আলোচনা থাকবেই। নিন্দুকেরা আমাদের ভালো থাকতে দেবে না। তারজন্যই সবার থেকে অনেক দূরে থাকবো।’ কথার মাঝে রমিজা বানু চা নিয়ে এল। দু’জনে গরম চায়ে চুমুক দিল। কিছু সময় কথা বলে রাতের খাবার খেয়ে সবুজ চলে গেল। বাসায় ফিরে সবুজ টেক্সট করলো,
‘তোমাকে ছাড়া আমি ভালো থাকবো না। আমার সব সুখ তোমাকে ঘিরে। যেদিন আমার ফ্লাইট তুমি জামদানিটা গায়ে জড়িয়ে আমাকে বিদায় জানাতে এসো। তোমার পথ চেয়ে রবো।’
মেসেজ সিন করে মাধবীলতার চোখ দুটো স্যাঁতস্যাতে হয়ে যায়।

আজ সবুজের ফ্লাইট। মাধবীলতা কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছে। গোসল করে খেয়ে সবুজের দেওয়া জামদানিটা পরে নিল। চোখে গাঢ় করে কাজল টানলো। কপালে ছোট্ট কালো রঙের টিপ। হাতে ম্যাচিং চারটে চুড়ি। খোঁপায় লাল গোলাপ গুঁজে দিল। অল্প সময়ে চলে আসলো এয়ারপোর্টে। এসেই সবুজের মুখোমুখি। সবুজ মুগ্ধ চোখে বারবার মাধবীলতাকে দেখছে।
মাধবীলতা আজ আর অন্য দিকে নিজের মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। নিজেও সবুজের চোখের গভীরে ডুব দিল। বেশ সময় চলে যায়। সবুজের সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসতে থাকে। যাওয়ার আগে শুধু বলল,
‘ মাধবী,আমার জীবনে তুমি যে কোনো সময়ে আসতে পারো। আমার পরিবর্তন হবে না। তোমাকে আমার জীবনের সাথে বেঁধে তোমার জীবনে পরিবর্তন আনতে চাই। দু’জনের ছোট্ট জীবনটা রাঙিয়ে দিতে চাই।’

মাধবীলতার চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সবুজ নিজের চোখ দুটোতে টিস্যু চেপে এগিয়ে যায়। মাধবীলতা আকাশের দিকে তাকিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো জীবনের দীর্ঘ পথটা তাকে একাই যেতে হবে। ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে সামনের দিকে…………….

————————-সমাপ্ত————————-

#মাকসুদা খাতুন দোলন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here