#অবেলার_পুষ্প,০৪,০৫
#পর্ব_৪
তৃতীয় পর্বের পরে…
কিছুটা সময় কারও মুখেই আর কথা নেই।
এই দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমার মনে নানারকম জল্পনা কল্পনা চলছিল। এমন তো হতেই পারে যে, রায়হানকে তার বাসায় হয়ত শাকিল নামে ডাকা হয়। রায়হান হয়ত আমার বন্ধুর পোশাকি নাম যা কাজিনদের কাছে তেমন একটা পরিচিত নয়। যদিও এই ভাবনা খুব বেশি ধোপে টেকে না, কিন্তু মনে মনে এমনটা ভেবে আশার আলো জাগছিল। এখন এই ছেলেকে দেখে এক মুহূর্তে বুঝে গেলাম, আমি ভুল জায়গায় এসেছি। অথচ আমাকে যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে সেটা এই বাড়িরই ঠিকানা!
একসময় নীরবতা ভাঙতে হলো। ছেলেটি সহ অন্যান্যরা অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। আমি একটু অপ্রস্তুতভাবে বললাম, ‘ইয়ে… একটা ঝামেলা হয়েছে মনে হচ্ছে। আমাকে যারা এখানে নিয়ে এসেছে তাদেরকে আমি বোঝাতে চেষ্টা করছি। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনল না। আমি ঢাকা থেকে আসছি। আমার নাম মাহমুদ…’
সংক্ষেপে নিজের পুরো বক্তব্য পেশ করলাম। ছেলেটা যথেষ্ট ধৈর্যশীল বলতে হবে। এই পুরো সময়ে সে কোনও কথা না বলে চুপচাপ আমার কথা শুনে গেল। আমার কথা শেষ হতেই বলল, ‘খুবই অদ্ভুত তো! আপনি আসছেন এই ঠিকানাতেই অথচ… আচ্ছা আপনি যে রায়হানের কথা বলছেন উনি কি আপনার সাথে ঢাকায় থাকে? মানে তার ব্যাপারে একটু বিস্তারিত জানা গেলে ভালো হতো। এমন টাইপের মজা কে করল বুঝতে তো পারছি না…’
শাকিল নামের ছেলেটি থেমে গেল একজনের কথা শুনে। পেছন থেকে একজন ভদ্রমহিলা কথা বলতে বলতে এদিকেই এগিয়ে আসছেন। ‘কার সাথে কথা বলছিস রে শাকিল? এভাবে দৌড়ে এলি যে!’
‘মা উনি এসেছেন ঢাকা থেকে…’ বলেই কী মনে হতেই আমাকে উদ্দেশ্য করে শাকিল বলল, ‘আরে! আমি আপনাকে বাইরেই দাড় করিয়ে রেখেছি। আপনি ভেতরে আসুন। ভেতরে বসে কথা বলি।’
আমি তখন চূড়ান্ত অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করছি।
সবকিছু ছাপিয়ে মাথা খারাপের মতো রাগ লাগছে রায়হানের ওপরে। ও কীভাবে পারল আমার সাথে এমন একটা ধাপ্পাবাজি করতে? অজানা অচেনা একটা জায়গায় কিছু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মানুষের সামনে নিজেকে পাক্কা আসামী বলে মনে হতে লাগল আমার। মনে মনে ফিরতি বাস ধরার কথা ভাবছি। নতুন জায়গায় কীভাবে চট করে বাসের টিকিট করব… এসবের একটা ভাবনাচিন্তা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। এরা আমাকে চেনে না জানে না। শুধু শুধু এদেরকে আর বিব্রত করতে ইচ্ছে করছে না।
আমি বিনয়ের সাথেই শাকিলের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে দিতে বললাম, ‘না না… থাক। আমি আসলে ওদের সাথে আসতে চাইছিলাম না। ওরা অনেকটা জোর করেই… যাকগে যা হওয়ার হয়েছে। ঢাকায় ফেরার বাস কখন পাওয়া যাবে, জানালে ভালো হতো। আর বাস কাউন্টারের ঠিকানাটা যদি দিতেন…’
‘না না তা কীভাবে হয়? আপনি ভুল করে এলেও এভাবে আপনাকে…’ শাকিল আন্তরিকভাবেই কথাগুলো বলল। তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে পেছনে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলা এবারে কথা বলে উঠলেন।
‘আরে কে কোথায় যাচ্ছে? বাবা তুমি ঢাকা থেকে আমাদের এই বাড়িতে এসেছ। বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। কত অতিথি অভ্যাগত এসেছেন। তোমাকে আমরা বাড়ির দরজা থেকে বিদায় করে দিব… এটা কীভাবে ভাবলে? তুমি এসো। ঘরে এসে বসো… একটু চা পানি খাও। এত দূর থেকে এসেছ নিশ্চয়ই ক্ষুধাও লেগেছে। এ্যাই শাকিল তুমি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালে তো ও ভেতরে আসবে! আর এ্যাই…তোমরা সব ভেতরে যাও। ওদিকে গিয়ে দেখো কী করতে হবে! এখানে সব ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’
আমি চিন্তিত মুখে একবার ঘড়ি দেখলাম।
বাস থেকে নেমেছি দেড়টার সময়। এখন বাজছে আড়াইটা। পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে সেটা এই এতক্ষণের ডামাডোলে ভুলতেই বসেছিলাম। ভদ্রমহিলার আন্তরিকতা মাখানো কথায় সেটার কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু এখন যদি বাস ধরতে রওয়ানা না দিই, তাহলে নির্ঘাত রাত হয়ে যাবে। অচেনা জায়গায় শুধু শুধু দেরী করে লাভ কী? এসব সাতপাঁচ ভেবে নিয়ে পেটের চিন্তাকে একপাশে সরিয়ে রেখেই বললাম, ‘আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমি যখন ভুল ঠিকানাতেই এসে পড়েছি, তখন আর শুধু শুধু দেরী করতে চাইছি না। এখনও রওয়ানা দিলে হয়ত তাড়াতাড়ি ঢাকায় গিয়ে পৌঁছাতে পারব!’
‘আরে! তুমি বয়স্ক মানুষের কথাকে গুরুত্ব দাও না! এত করে বুড়ো মানুষটা বলছি থাকতে! একদিন দেরী করে গেলে কি অন্য কোনও অসুবিধা হবে তোমার? এসেছ…আমাদের বাড়িতে না হয় একদিন মেহমান হয়েই থাকলে!’
ভদ্রমহিলা এবারে বেশ স্নেহমাখানো শাসনের সুরেই কথাগুলো বললেন। আমি কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে গেলাম। এভাবে স্নেহভরা কণ্ঠে কেউ কখনো আমাকে শাসন করেছে কী না ভালোমত মনেও করতে পারি না আর! আবেগতাড়িত হয়ে যাচ্ছি খুব দ্রুত। স্নেহ মায়া বিবর্জিত এই জীবনে এমন স্নেহের বারিধারা কেমন একটা শীতল আবেশ ছড়িয়ে দিলো আমার মনে। আমি আর কোনও প্রতিবাদ করার ভাষা খুঁজে পেলাম না। কৃতজ্ঞ চোখে চেয়ে রইলাম ভদ্রমহিলার মুখের দিকে।
আমার চাহনি দেখেই সেটাকে সম্মতি হিসেবে বুঝে নিতে দেরী হলো না কারও। ভদ্রমহিলা কাকে যেন হাঁক দিয়ে বললেন, ‘এ্যাই… কেউ এসে এই ব্যাগটা ওপরের রুমে রেখে আয় দেখি!’
শাকিল নামের ছেলেটাও বেশ আন্তরিকভাবেই স্বাগত জানালো আমাকে। আমি ওদের সাথে সাথে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম।
বাড়িটাতে ঢোকার পর থেকেই সেই পুরনো অনুভূতিটা ফিরে ফিরে আসতে লাগল… বাড়ির নামফলকটা দেখে যেমন অনুভূতি হচ্ছিল। কী এক অদ্ভুত মায়া আর আপনত্বের ইন্দ্রজাল যেন বিছানো আছে পুরো বাড়ি জুড়ে। ছড়ানো ছিটানো ঘর আর বারান্দাগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, যিনি বাড়িটা বানিয়েছেন তিনি প্রচণ্ড সৌখীন আর বেহিসাবি মানুষ ছিলেন। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন সবকিছুই যেন তার চেয়ে বেশি বেশি করে বরাদ্দ করা হয়েছে। ঘরগুলোর পাশ দিয়ে যেতে যেতে এক ঝলক নজর চলে যাচ্ছিল ভেতরে। ঘর তো নয়, যেন একেকটা ময়দান। বারান্দাগুলোর এমাথা থেকে ওমাথা দেখা যাচ্ছিল না।
প্রতিটা ঘরে বেশ অনেক লোকজন দেখতে পাচ্ছিলাম। উৎসবের আমেজ এখানে ভালোমতোই মিশে আছে। রানু মেয়েটার কথাই ঠিক। বাড়িটার সামনে থেকে এই শোরগোল টের পাওয়া যায়নি। এই পাশটাতে বেশ অন্যরকম চিত্র। পুরো বাড়ি সেজেছে নানারকম ফুল লতাপাতা দিয়ে। রঙ্গিন কাগজ দিয়ে বানানো ফুল পাখি এসবও দেখতে পেলাম। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি সবকিছু। খুব অন্যরকম লাগছে। ঢাকাতে যে কটি বিয়ে খেয়েছি, কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে শুধু খেয়েদেয়ে আর বর কনের সাথে ছবি তুলে চলে এসেছি। এখানে বিয়েতে আত্মীয় পরিজন আর বন্ধুবান্ধব মিলে এত চমৎকার একটা উৎসবের আবহ ফুটে উঠেছে যে আমার মুগ্ধতা কিছুতেই ফুরোতে চাইছে না যেন।
শাকিল আমাকে নিয়ে ড্রইংরুমে বসালো। তারপর নিজের দিকে তাকিয়ে বিব্রতমুখে বলল, ‘ইয়ে কিছু মনে করবেন না। আমি একটু চেঞ্জ করে আসছি। আজকে গায়ে হলুদ ছিল। তাই… আপনি একটু বসুন প্লিজ। আমি এক্ষুনি আসছি।’
আমি হাসিমুখে বললাম, ‘আপনি টেনশন নিবেন না। ঢুকেই যখন পড়েছি, তখন জমিয়েই বসে গেলাম। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।’
শাকিল চলে যাওয়ার পরে আমি গৃহসজ্জায় মন দিলাম। এতক্ষণ লক্ষই করিনি যে, আমাকে মোটামুটি একটা স্টেডিয়ামে এনে বসানো হয়েছে। চারপাশ দেখে ভড়কেই গেলাম রীতিমত। বাপরে বাপ! এরা কি জমিদারের বংশধর নাকি? এত বিশাল বাড়ি কে মেইনটেইন করে? বাড়িতে তো শুনলাম মাত্র কয়েকজন মানুষ থাকে। এদের জন্য এত বড় বাড়ি!
ঘরের চারপাশে নানারকম এণ্টিক জিনিসপাতি ছড়ানো ছিটানো। একপাশের দেওয়ালে কিছু ছবি ঝুলে থাকতে দেখলাম। ছবির প্যাটার্ন দেখে মনে হলো, হয়ত পূর্বপুরুষদের ছবি সারি ধরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যটিও জমিদারদের সাথেই মিলে যায়।
একটি ছবির দিকে তাকিয়ে আমার খুব অদ্ভুত লাগল। এটি সম্ভবত নিকটতম পূর্বপুরুষের ছবি হবে। ছবিটা দেখে কেন আমার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে সেটা চট করে ধরতে পারছি না। কিন্তু ছবির ব্যক্তির চোখ চুল নাক তাকানোর ভঙ্গি এসব যেন আমাকে কিছু একটা মনে করিয়ে দিতে চাইছে। কঠোর মুখভাব, লম্বা নাক আর চোখের দৃষ্টিতে কেমন জানি একটা অস্পষ্ট ছায়া। আমি মনে করতে পারছি না, এই ছায়া আমি আগে কোথায় দেখেছি!
আমি যখন একদৃষ্টে ছবির দিকে তাকিয়ে আছি, তখন রানু মেয়েটি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। তার চোখেমুখে একটু যেন অপ্রস্তুত ভাব। ঘরে ঢুকেই আমার দিকে তাকিয়ে একটু কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না। আমি মনে করেছিলাম আপনি হয়ত সত্যিই ভাইয়ার বন্ধু। কিছু একটা ভুল হচ্ছে হয়ত! কিন্তু ভাইয়া তো বলল, আপনি নাকি ওর বন্ধু না… আমরা আপনাকে ভুল করে নিয়ে এসেছি। কিন্তু আপনি তো এখানকার ঠিকানাই দিয়েছিলেন বাইক ওয়ালাকে! তাহলে ভুলটা কোথায় হলো বুঝতে পারলাম না তো!’
রানুর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো, সে ভুল কোথায় হলো এটা খুঁজে না পেয়ে হয়রান হয়ে আছে!
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘খুকি দেখলে তো! আমার কথা তো শুনতেই চাইছিলে না! একরকম ধরে বেধে নিয়ে এলে সবাই মিলে!’
রানুর মুখ নিমেষেই আবার গম্ভীর হয়ে গেল। খুব কঠোর একটা ভাব ফুটিয়ে তুলতে তুলতে সে বলল, ‘আপনি আমাকে খুকি খুকি করছেন কেন? এটা আবার কী? আমাকে দেখে কি আপনার খুকি বলে মনে হচ্ছে?’
‘এ্যাই রানু তোকে এখানে কী কাজে পাঠিয়েছি আর তুই এসে কী করছিস শুনি? তোকে না বললাম, মেহমানকে খাবার টেবিলে আসতে বল! এত ফাঁকিবাজ একটা মেয়ে! একটা কাজ যদি ঠিকমত হয় একে দিয়ে!’
বলতে বলতে নীচের সেই বয়স্কা ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকলেন। ভদ্রমহিলার বয়স ষাটের কাছাকাছি। মুখের আদলে এখনও লাবণ্যের ছিটেফোঁটা বেশ ভালভাবেই মিশে আছে। রানুর মুখের আদলের সাথে অনেক মিল। বুঝতে পারলাম, ইনি সম্ভবত রানু আর শাকিলের মা।
ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন, ‘বাবা সব কথা পরে শুনব। তুমি দূর থেকে এসেছ। দুপুর পড়তে চললো। উঠে আগে হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নাও। তোমার জিনিসপত্র সব ওপরের ঘরে রাখা হয়েছে। এ্যাই রানু উনাকে ঐ ঘরে নিয়ে যা। যাও বাবা… রানু তোমাকে ঘর দেখিয়ে দিবে। ঘরের সাথে এ্যাটাচড বাথ আছে। ফ্রেশ হয়ে এসে খাওয়াদাওয়া করে নাও আগে। তারপর শুনব সব কথা। আর যদি ভুলও কিছু হয়ে থাকে, না হয় হয়েছেই! আমাদের এই বিয়েবাড়িতে তোমার রিজিক লেখা ছিল বলেই এসেছ। মেহমান তো শুভ কিছু বয়ে আনে। তুমি হয়ত আমার শাকিলের বিয়ের জন্য শুভ কিছুই সাথে করে এনেছ।’
আমি এই কথা শুনে কেমন যেন বিমোহিত হয়ে পড়লাম। ভদ্রমহিলার আচার আচরণ কথাবার্তা সবকিছুতেই একটা রুচিশীল ব্যক্তিত্বের ছাপ সুস্পষ্ট। মাতৃময়ী ভদ্রমহিলাকে দেখে বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া মায়ের মুখটি মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো উঁকি দিয়ে গেল আমার মনে। আমার মা বেঁচে থাকলেও বুঝি এভাবেই স্নেহভরে আমাকে খেতে ডাকত।
চোখের সীমানায় অনাহুতের মতো ছুটে আসতে চাওয়া কিছু নোনাজলকে প্রাণপনে ঠেকাতে ঠেকাতে আমি নিঃশব্দে বিনা প্রতিবাদে রানুর পিছে পিছে রওয়ানা দিলাম।(ক্রমশ)
#ফাহ্মিদা_বারী
#বড়গল্প
#অবেলার_পুষ্প
#পর্ব_৫
চতুর্থ পর্বের পরে…
‘আচ্ছা ভাইয়া আপনার সেই বন্ধুটি কি আপনাকে টুপি পরালো?’
‘উ… হু তাই তো মনে হচ্ছে!’
‘কিন্তু উনি আমাদের এই বাড়ির ঠিকানা জানলেন কীভাবে? আর এখানে আপনাকে পাঠায়ে দিলেন কেন?’
‘উ… সেটা তো বুঝতে পারছি না!’
‘আপনার সাথে উনার কোনো শত্রুতা ছিল আগে থেকে?’
‘তা তো মনে হয় না!’
‘তাহলে হয়ত আপনার কাছে টাকা পেত। আপনি দ্যাননি দেখে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে প্রতিশোধ নিলো!’
‘তাহলে হয়ত তোমরাও জড়িত আছ এই প্রতিশোধে তাই না?’
‘আমরা! কেন আমরা কী জন্য প্রতিশোধ নিব আপনার ওপরে? এটা আপনার কেন মনে হচ্ছে?’
‘বাহ রে! যেভাবে ধরে পাকড়ে একরকম তুলে নিয়ে এলে আমাকে! জড়িত থাকতে পারো না?’
‘আরে আপনে তো ভাইয়া ভারী… ইয়ে …মানে খুব বেশি অন্যরকম! এইজন্যই আপনার বন্ধু আপনাকে টুপি পরাইছে এইবার বুঝছি!’
দিব্যি হাঁটতে হাঁটতে বকরবকর করছিল মুখরা রানু। নিজে নিজেই এটা সেটা কথা বলে এখন নিজের প্যাঁচেই আটকে বসে আছে বেচারি। আমিও মজা দেখার জন্য দিলাম আরেকটু রাগিয়ে! মনে হয় মেয়েটা অল্পতেই দুম করে রেগে যায়। এখন বেশ গাল ফুলিয়ে হনহন করে হাঁটছে। পেছনে যে আমি আছি সেই কথা বুঝি ভুলেই গেছে! এই বিশাল বাড়িতে এত এত দরজা জানালা ঘর আর লম্বা লম্বা বারান্দা যে কোন জায়গা দিয়ে ঢুকে কোথা দিয়ে যে বের হচ্ছি তার কিছুই বুঝতে পারছি না! এখন রানু যেভাবে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটছে ওকে হারিয়ে ফেললে তো মুশকিল হয়ে যাবে!
আমিও হাঁটার গতি বাড়াতে বাড়াতে বললাম, ‘রানু, তোমাদের পূর্বপুরুষেরা কি জমিদার ছিল?’
রানু ভ্রূ কুঁচকে পেছনে তাকাল। তার দৃষ্টির অর্থ হচ্ছে, ‘এইটা আবার কোথায় থেকে আবিষ্কার করলেন?’
ওর রাগত মুখটা দেখতে খুব মজা লাগছে। আমি হাসি চাপতে চাপতে বললাম, ‘না এত ঘরদোর তো সাধারণ লোকজনের থাকে না! তোমরা মাত্র কয়েকজন মানুষ। এত ঘর দিয়ে কী করো?’
রানু এবারে একটু স্বাভাবিক গলাতেই বলল, ‘অন্যসময় বেশিরভাগ ঘরদোর তালা মারা থাকে। আমরা থাকি দোতলায়। কোনও মেহমান এলে তাকেও দোতলাতেই থাকতে দেওয়া হয়। এখন তো বাড়িতে অনেক মানুষ। তাই আপনাকে তিনতলায় থাকাতে দেওয়া হচ্ছে।’
আমি কপট ভয়ার্ত গলায় বললাম, ‘সর্বনাশ! তিনতলায় একা একা থাকব! ভূতপ্রেত আসবে না তো আবার!’
‘বেশী ভয় লাগলে মাকে বলে আপনাকে নিচে থাকার ব্যবস্থা করে দিব, চলবে? আপনি ভাইয়ার বিয়ের সময়টা পুরোটা থাকবেন তো?’
‘দেখি তোমরা কেমন খাতিরদারি করো তার ওপরে সিদ্ধান্ত নিব!’
এসব হাল্কা চালের কথাবার্তার মধ্য দিয়েই তিনতলার নির্ধারিত ঘরে পৌছালাম। এটুকু আসতেই লম্বা এক করিডোর পার হতে হলো। বেশ কিছু ঘরকে তালাবন্ধ অবস্থায় দেখলাম। বাড়িটা যতই দেখছি, ততই যেন আমার কৌতুহলের পারদ সমানে চড়ছে। ঠিকই তো! মাত্র একটা পরিবারের জন্য এই বাড়ির আকার আকৃতি অতিশয় বিশাল। যিনি বানিয়েছিলেন তার হয়ত বড় পরিবার ছিল। পরে সেই পরিবার ভেঙে গেছে, এমন কিছু হতে পারে। তবে যাই হোক না কেন, এখন এত বিশাল বাড়ি এভাবে ফেলে রাখাটাকে আমার ভীষণরকম অপচয় বলে মনে হচ্ছে।
নিজের মনকে তিরস্কার জানালাম এই ভাবনার জন্য। দুইদিনের… না না… মাত্র একদিনের অতিথি আমি! অতিথির মনে এত ভাবনা শোভা পায় না!
আমার থাকার ঘর দেখিয়ে দিয়ে রানু বিদায় নিলো। সেই ঘর দেখে মনটা একেবারে ফুরফুরে হয়ে গেল আমার।
আকারে যে বেশ বড় তা তো বলে দিতে হয় না। কিন্তু যেটা বেশি ভালো লাগছে তা হলো, এর অন্দরসজ্জা। দেখে মনেই হচ্ছে না বাড়িটার অনেক বয়স। সম্ভবত বাড়িটাতে কিছু কিছু কাজ পরে করানো হয়েছে। নিচের তলায় বেশ কিছু জায়গায় কালো মোজাইকের মেঝে দেখেছি। এই ঘরের অনেকখানি জুড়ে টাইলসের মেঝে দেখলাম। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে দেওয়ালের গায়ে কিছু খুপুরি দেখে বোঝা যাচ্ছে এগুলো বাড়িটার সেই জন্মলগ্ন থেকেই সেখানে আছে।
অর্থাৎ পুরনো আমলের বনেদি আভিজাত্যের সাথে যুক্ত হয়েছে আধুনিক সাজসজ্জা আর আসবাব। এই ফিউশনটাই বেশি ভালো লাগছে। কেমন যেন দারুণভাবে মানিয়ে গেছে।
ঘরজুড়ে বিশাল এক খাট। এটাও আগের দিনের। একেবারে খাঁটি আবলুশ কাঠের ধাপযুক্ত খাট। একপাশে একটা ছিমছাম ড্রেসিং টেবিল, সেটাকে এই যুগীয় বলেই মনে হচ্ছে। তবে খাটের সাথে মিলিয়ে সেটার রঙও মিশকালো। একপাশের দেওয়ালের পুরোটা জুড়েই জানালা। সেখানে লম্বা ধুপছায়া রঙের পর্দা ঝুলছে। বিপরীত পাশের দেওয়ালে একটা জলরঙের বড় পেইন্টিং। ছবিটবি আমি বিশেষ একটা বুঝি না। তবু ছবির পেশিবহুল লোকগুলোকে দেখে মনে হলো, এটা সুলতানের আঁকা পেইন্টিং। সাধে কি আর বলেছি! অতীতের সাথে বর্তমানকে মিলিয়ে মিশিয়ে দুর্দান্ত ককটেল! কার মাথা থেকে যে এমন সব আইডিয়া এসেছে, কে জানে!
আমার ট্রলি ব্যাগটাকে এক কোণায় গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। সেটার পাশেই বাথরুম। দরজা খুলে উঁকি মেরে একেবারে টাশকি খাওয়ার জোগাড় হলো। আধুনিক টয়লেট্রিজের সব উপাদানই সেখানে মজুত। একটা চমৎকার ডিম্বাকৃতির বাথটাবকেও শুয়ে থাকতে দেখলাম। খুব আরাম পেলাম দেখে। শীত গ্রীষ্ম দুই সিজনেই আমি কুসুম গরমপানি ব্যবহার করি গোসলের জন্য। সেই ছাত্রজীবন থেকেই অভ্যাসটা হয়ে গেছে। বোর্ডিং স্কুলে পড়তাম। গরমপানি সংগ্রহের জন্য অনেক ঝামেলাঝক্কি পোহাতে হতো। তবু অভ্যাসটা ছাড়তে পারিনি।
বাইরে শীতের আগমনী সুর বাজছে। এই সময়ে গরমপানি না হলে তো চলতই না আমার। হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসা অতিথি আমি। এখানে নিশ্চয়ই আগ বাড়িয়ে গরমপানি চাইতে পারতাম না! ভীষণ লজ্জার ব্যাপার হতো সেটা। এখন এত পরিপাটি আধুনিক বাথরুম দেখে খুব খুশি হয়ে উঠলাম।
আরাম করে গোসল সেরে পরিপাটি হয়ে উশখুশ করছি। পেটের ছুঁচোগুলো দৌড়াদৌড়ি বন্ধ করে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। ভাবছি কেউ ডাকতে না এলে খেতে যাই কীভাবে? আমাকে ওপরতলায় উঠিয়ে দিয়ে ভুলে টুলে গেল না তো?
একটু পরেই সেই শঙ্কামুক্ত হলাম। হবু বর শাকিল স্বয়ং এলো আমার ঘরে। দরজায় মৃদু টোকা মেরে জানতে চাইল, ‘ভেতরে আসব?’
আমি অপ্রস্তুত। কুণ্ঠাভরে বললাম, ‘আরে আসুন আসুন! আপনাদেরই ঘর। আমি তো কোত্থেকে এসে জুড়ে বসে গেলাম!’
‘আপনি খুব অস্বস্তিতে ভুগছেন। ধরেই নিন না, আপনি সত্যি সত্যি আমার বিয়েতে গেস্ট হিসেবেই এসেছেন। আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো এখানে?’ শাকিল ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল।
আমি বললাম, ‘এত লাক্সারিয়াস এ্যারাঞ্জমেন্টেও অসুবিধা হবে! কিন্তু আপনার বন্ধু সজলের কী হলো? উনার না আসার কথা ছিল!’
‘কী জানি! সেটাই তো বুঝতে পারছি না! আমার আজকে হলুদের প্রোগ্রামটা হয়ে গেল। ভেবেছিলাম ও একটা প্রোগ্রামও মিস করবে না! অথচ…’
‘ফোনে পাচ্ছেন না?’
‘না … রিং হচ্ছে অথচ ধরছে না! প্রায় সপ্তাহখানেক আগে আমার সাথে লাস্ট কথা হয়েছে সজলের। বলেছিল, সময়মত চলে আসবে। অথচ না এসেছে, না ফোন ধরছে… আরে কী আশ্চর্য! আমি তো আপনার সাথে এখানেই গল্প করতে বসে গেলাম! মা রাগ করবে। নিচে আপনার খাবার দাবার রেডি করে বসে আছে।’
‘আপনাদের খুব অসুবিধায় ফেললাম। এমনিতেই বিয়েবাড়ির হাজার ঝামেলা। এর মাঝে আমি এসে নতুন ঝামেলা বাধিয়ে বসলাম।’
‘আপনি বার বার এটা বলেই অসুবিধায় ফেলছেন!’
‘আচ্ছা ঠিক আছে আর বলব না।’
নীচে বড় এক ডাইনিং রুমে সত্যি সত্যি আমার খাবারদাবার সাজিয়ে শাকিলের মা বসে আছেন। বিয়ে বাড়ির অতিথি অভ্যাগতদের কারও কারও খাওয়াদাওয়া তখনো চলছে। বিশাল ডাইনিং টেবিলের এক কোণায় আমার খাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ভদ্রমহিলা সাদরে খেতে বসালেন আমাকে। আমার সামনে একটা চেয়ারে শাকিল বসল। প্লেট টেনে নিতে বুঝলাম সে নিজেও এখনো খায়নি।
খাবারের আয়োজন কিন্তু খুব বেশি হুলুস্থূল ধরনের কিছু না। বিশাল বড় বাড়ি দেখে সেটাও খুব বিশাল কিছু হবে বলেই আশা করেছিলাম। অবশ্য বিয়েবাড়িতে একটানা এলাহি আয়োজন করা কঠিন, এটা অভিজ্ঞতা না থাকলেও বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।
একটা বড় গোল বোলে রুই বা কাতলা মাছের ঝোল জাতীয় তরকারি দেখতে পেলাম। বড় গোল একটা পাত্রে নানারকম ভর্তা, খুব সুন্দর করে সাজানো। আরেকটা বড় গভীর ডেকচিতে মুগের ডাল আর মাছের মাথা দিয়ে রান্না করা ঘণ্টজাতীয় একটা তরকারি দেখতে পেলাম। আমি এই জাতীয় রান্না তেমন একটা খাইনি। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে খুব মজার কিছু হবে। এর সঙ্গে ভাত সালাদ আর লেবু।
শাকিলের মা আমাকে দেখে বললেন, ‘বসো বাবা। অনেক দেরী হয়ে গেল। নিশ্চয়ই খুব ক্ষুধা পেয়েছে। বিয়েবাড়ির খানাপিনা তো শেষ হয় না। এক গ্রুপ যাচ্ছে আরেক গ্রুপ আসছে। তরকারি প্রায় ফুরায়ে গেছে। তোমাকে ভালো কিছু দিয়ে খেতেও দেওয়া গেল না!’
আমি ভদ্রতা সূচক কিছু একটু বলে মন দিয়ে খেতে বসলাম। কারণ পেটের অবস্থা সত্যিই ভয়াবহ। আর বেশিক্ষণ তাকে প্রবোধ দিয়ে বসিয়ে রাখা সম্ভব না।
ডাল আর মাছের মাথার ঘণ্ট দিয়েই প্রায় পুরো দেড় প্লেট ভাত সাবাড় করে দিলাম। এত সুস্বাদু জিনিস আমি জীবনে কখনও খেয়েছি বলে মনে করতে পারলাম না। চোখের মাথা খেয়ে চেয়েই নিলাম বার কয়েক। আমার এত মজা লেগেছে বুঝতে পেরে ভদ্রমহিলা সহজ গলাতে বললেন, ‘মা বুঝি মুড়িঘণ্ট নিয়মিত রান্না করে? তুমি এত পছন্দ করো!’
আমি চুপচাপ খেতে লাগলাম। এই কথার উত্তরে একটু স্মিত হাসলাম শুধু। মুখে কিছু বললাম না।
খাওয়াদাওয়ার পরে আবার গিয়ে ড্রইংরুমে বসলাম। শাকিল আর তার মাও আমার সাথে এলেন। পেট ঠাণ্ডা হওয়াতে খুব আরাম বোধ হচ্ছে। এত তৃপ্তি নিয়ে কতদিন পরে খেলাম মনে করতে পারলাম না।
ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা তোমার দেশের বাড়ি কোথায়? ঢাকাতে তোমার পরিবার থাকে বুঝি?’
আমি যথাসম্ভব সংক্ষেপে আমার ফ্যামিলি স্ট্যাটাস খুলে বললাম। মা-বাবা মারা গেছেন আমার সেই কোন শৈশবে! বাবার আগের বিয়ে… সৎ ভাইয়ের অভিভাবকত্বে বেড়ে ওঠা। তারপর আচমকা একদিন আমাকে দেশে রেখে সেই ভাইয়ের বিদেশ পাড়ি দেওয়া… সব কথাই উঠে এলো একে একে। মনেই হলো না, অপরিচিত দুজন মানুষের সামনে এভাবে নিজের কথা বলা আমার নিজেরই স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু এদের আন্তরিক আচরণে এটা একবারের জন্যও মাথায় এলো না আমার।
লক্ষ করলাম ভদ্রমহিলার স্নেহময় মুখ বিষাদময় হয়ে উঠল। ভারী গলায় বললেন, ‘খাবার টেবিলে তোমার মায়ের রান্না করার কথাটা বলাতে কিছু মনে করো না বাবা। আমি ভাবতেও পারি না…এই বয়সে তুমি সব হারিয়ে এভাবে একা একা…’
‘না না খালাম্মা, আমি কিছু মনে করিনি। আপনি তো জেনেশুনে কিছু বলেননি।’ সচরাচর বয়স্কা কাউকে দেখলে আন্টি বলেই ডাকি। কিন্তু নিজের অজান্তেই উনাকে খালাম্মা বলে ডেকে বসলাম। এই ডাকটার মধ্যে অনেক বেশি মমতা মিশে আছে বলে মনে হয় আমার।
উনি বললেন, ‘মা বাবার কথা মনে পড়ে না তোমার? তোমার অন্য কোনও আত্মীয়স্বজন কেউ কখনও দেখা করেনি তোমার সাথে?’
আমি মাথা নাড়ালাম। এই বিষয়টা নিয়ে আগে কখনো সেভাবে ভেবেছি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু আপনজনের অভাব হঠাৎ কখনও সখনও একেবারেই যে বোধ করিনি তা তো আর নয়! মাঝে মাঝে বন্ধু বান্ধবদের বাসায় গেলে এই জিনিসটা বেশি করে বোধ করি। একটা সময় শুধুমাত্র এই কারণেই অকারণে কারও বাসায় যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। অনেক জিজ্ঞেস করেও বন্ধুরা এর কারণ অনুসন্ধান করতে পারেনি। কাউকে কিছু বলিনি আমি। কষ্টগুলো ভীষণ নিজস্ব। কাউকে এর ভাগ দিতে ইচ্ছে করে না।
ভদ্রমহিলা হয়ত আরও কিছু জিজ্ঞেস করতেন। কিন্তু আমার এই প্রসঙ্গে আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। তাই আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম, ‘খালাম্মা আপনাদের এই বিশাল বাড়িটা কে বানিয়েছিলেন? কিছু মনে করবেন না। প্রশ্নটা না করে থাকতে পারলাম না। এই ছোট শহরে এত বড় আলিশান একটা বাড়ি, চারপাশে এত জায়গা! বাড়িটার তো বোঝা যাচ্ছে কিছু রিনোভেশনের কাজও হয়েছে। এসব কে করেছে? (ক্রমশ)
#ফাহ্মিদা_বারী