অবেলার_পুষ্প,০৬,০৭

0
475

#অবেলার_পুষ্প,০৬,০৭
ফাহ্‌মিদা_বারী
#পর্ব_৬

পঞ্চম পর্বের পরে…

ভদ্রমহিলা জমিয়ে বসলেন। বোঝাই যাচ্ছে উনি গল্প করতে ভালোবাসেন। তাছাড়া এত বিশাল বাড়ি দেখে আমার মতো আরও অনেকের মনেই হয়ত হাজার প্রশ্ন জমে। সেইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে উনার হয়ত ভালোরকম পূর্ব প্রস্তুতি আগে থেকেই নেওয়া আছে। শুধু একটু উস্কে দিলেই গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেন।

আমি দেখলাম উনি কাজের মেয়েকে দিয়ে একটা ছোট পানের ডিব্বা আনিয়ে নিয়েছেন। এক ঝলক তাকিয়ে দেখি, তাতে পাঁচ ছয়টি পানপাতা সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। ছোট্ট ছোট্ট খুপুরির মতো কয়েকটা জায়গায় পানমশলা, সুপুরি, জর্দা, চুন এসব সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এটুকু জিনিসের এত সুন্দর সজ্জা দেখে মনে হলো, হয়ত এই বাড়ির অন্দরসজ্জারও মূল কারিগর তিনি। এটা আমার অনুমান মাত্র। তবু জানি না কেন, অনুমানটিকে খুব জোরদার বলেই মনে হলো।

পানের ডিব্বা থেকে একটা পান হাতে নিয়ে তাতে চুন, সুপারি আর অল্প কী জানি একটা মশলা নিয়ে গোলা বানিয়ে মুখে পুরে দিলেন ভদ্রমহিলা। তারপর মুখটাতে খুশি খুশি একটা ভাব এনে গল্প বলতে শুরু করলেন।

‘এই বাড়ি বানিয়েছিল আমার শ্বশুরের বাবা। অনেকে এই বাড়ি দেখে জমিদার বাড়ি মনে করে। না, আমার শ্বশুরের বাবা অবশ্য জমিদার ছিল না। এই অঞ্চলের জমিদারের নায়েব ছিল। তার নিয়মনিষ্ঠা আর বিশ্বস্ততা দেখে জমিদার সাহেব খুব খুশি ছিলেন। তাই পুরষ্কার হিসেবেই এই বিশাল জায়গা তাকে উপহারস্বরূপ দিয়েছিলেন। জমিদারের নায়েব মশাই অর্থাৎ আমার শ্বশুরের বাবা ছিলেন ভীষণ শৌখীন মানুষ। তিনি নিজের মনের সাধ মিটিয়ে এই বাড়ি বানিয়েছিলেন। কিন্তু এটা বানাতে গিয়ে তাকে শেষজীবনে ভীষণ অর্থকষ্টে পড়তে হয়েছিল। এত বড় বাড়ি বানিয়ে প্রায় নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। জমিদারের বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন, কিন্তু জমিদারের মৃত্যুর পরে তার ছেলেরা বাবার নায়েবকে একেবারেই সহ্য করতে পারত না। জমিদারের ছেলেদের ধারণা হয়েছিল তাদের বাবার নায়েব তাকে ঠকিয়ে আর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক টাকাকড়ি গছিয়ে নিয়েছে। নইলে এত বড় বাড়ি কিছুতেই বানাতে পারত না।

আমার শ্বশুররা ছিল দশভাই তিনবোন। তাই এই বাড়ির এক কোনাও খালি পড়ে থাকতো না সেই সময়। পুরো বাড়ি গমগম করত সবসময়। বোনদের বিয়ের পরে তারা যার যার শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। ছেলেরা যার যার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কেউ কেউ এই এলাকার বাইরে পা বাড়ালো। বাড়ি ধীরে ধীরে খালি হতে শুরু করল। শেষজীবনে তাদের বাবা মারা গেল অনেকটা আত্মীয়পরিজন ছাড়াই। তিনি হয়ত জীবনে নিজের কাজ দিয়ে অনেক সুনাম কুড়িয়েছিলেন, কিন্তু ছেলেদের সেভাবে ভালোমানুষ করে বড় করতে পারেননি।

এসব কথা লোকমুখেই ছড়িয়ে পড়েছে দিনে দিনে। কারণ আমার স্বামী তো আর নিজের মুখে তার বাপ চাচাদের কুকীর্তির কথা বলতে যাবে না! তার জীবদ্দশাতেও এসব কথা আমরা কেউ নিজেদের মধ্যেও আলাপ করতে পারিনি। যদিও আমার স্বামী বা তার ভাইয়েরা কেউই নিজেদের বাবার প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাপ বলে কথা! মানুষের কাছে কি নিজের বাপের দুর্নাম করা যায়?

আমার শ্বশুরের ভাইয়েরা একে একে প্রায় সবাই এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে গেল। ব্যবসা বাণিজ্যের ধান্দাতেই তারা একে একে ঘর ছাড়ল। বিশাল বড় বাড়ি আঁকড়ে পড়ে না থেকে আয় রোজগার বাড়ানোর দিকেই মন দিলো সবাই। কারণ বিশাল বাড়ি বানিয়ে তাদের বাবার হাতে জমানো টাকাকড়ি আর ছিল না বললেই চলে। তাই শেষজীবনে নিজের বাপকে অবহেলা করতেও প্রাণে বাধা পায়নি কেউ।

আমার শ্বশুর কিন্তু এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও গেল না! ভাইয়েরা চলে যাওয়াতে তার মনে দুঃখও ছিল না তেমন একটা। তিনি এই বাড়ির একক দখল পেয়ে মহাখুশি হয়ে উঠলেন। মনে মনে পরিকল্পনা সাজাতে বসলেন কীভাবে এই বাড়িটাকে ঘিরেই নিজের আয় রোজগারের একটা উপায় খুঁজে নিতে পারবেন। শেষমেষ ভালোই একটা উপায় পেয়ে গিয়েছিলেন। অনেকটা মাছের তেলে মাছ ভাজার মতো উপায়। নিজের ছয়টা ছেলে, এত বড় বাড়ির দখলদারিত্ব … এটাকেই তিনি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আরও বাড়াতে লাগলেন।’

এই পর্যন্ত বলে ভদ্রমহিলা থামলেন।

আমি লক্ষ করলাম শাকিল একটু যেন উশখুশ করছে। আমার নিজেরও যে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল না তা নয়। আমি তো এত সবিস্তারে এদের পারিবারিক ইতিহাস জানতে চাইনি। আর তাছাড়া একেবারে অপরিচিত একজনের কাছে এতসব গোপন কথা বলে ফেলা কি ঠিক? আমার এত কিছু জেনে লাভটাই বা কী? বাড়িটা কে বানিয়েছিল, এত বড় বাড়িতে কে থাকত এসবই আমার জানার আগ্রহ ছিল। খুঁটিনাটি সব কিছু জেনে আমি কী করব?

আমি একটু গলা খাঁকারি দিয়ে সেই কথা বলেই ফেললাম উনাকে। ‘ইয়ে খালাম্মা, থাক এসব কথা। আপনাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি আসলে এত বড়বাড়ি দেখে একটু বেশি কৌতূহল দেখিয়ে ফেলেছি হয়ত। যা জানার ছিল জেনে গেলাম। আপনার শ্বশুরের ভাইবোনেরা সবাই থাকলে এই বাড়ি এত শুনশান থাকতো না নিশ্চয়ই। তারা চলে গেছে দেখেই বাড়িটা এমন নিঝুম হয়ে গেছে!’

ভদ্রমহিলা কিন্তু থামলেন না। উনাকে আজ সম্ভবত কথায় পেয়েছে। বেশ উষ্মাভরে গলায় বললেন,

‘চলে গেছে নাকি কাউকে আর উনি ভিড়তে দেননি সেটা আর কে জানতে পারছে বলো! এই বাড়ি তো আর উনার একার ভোগ করার কথা ছিল না! অথচ তিনি সারাজীবন সেটাই করে গেছেন। বাড়িটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে এক অংশ দিব্যি ভাড়া দিয়ে ফেললেন। শখের যাত্রাপালার দল এসে এখানে নিজেদের ডেরা বানিয়ে ফেললো। নিজের ছেলেদের কেউ কেউ বাপের এই কাজে বাগড়া দেওয়াতে তাদেরকে ত্যাজ্যপুত্র বানাতে দেরি করলেন না! যারা মেনে নিলো, তারা টিকে গেল। ইতিমধ্যে আমার শ্বশুরের বোনদের কেউ কেউ নিজেদের বাপের অংশ বুঝে নিতে চলে এসেছে। কিন্তু ততদিনে আমার শ্বশুর তো এই বিশাল বাড়ির একচ্ছত্র মালিক! নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে এটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে তুলেছেন। তখন আর বোনদের ন্যায্য দাবি তার ভালো লাগবে কেন? কাজেই তাদেরকেও একরকম ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হলো!…’

‘আহ মা! থাক না এসব কথা! যা গেছে তা তো গেছেই!’ শাকিল এবারে মৃদু আপত্তিই করে বসল। অথচ তারপরেও শাকিলের মা থামলেন না। উনি কীসের যেন এক অক্ষম আক্রোশে কথা থামাতে পারলেন না। বলেই চললেন,
‘তুই থাম শাকিল। এসব কথা লুকিয়ে আমাদের কী লাভ? প্রকৃতির অভিশাপ নামেও একটা ব্যাপার আছে জানিস সেটা? তোর বাবা বেঁচে থাকতে চুপ করেই তো কাটিয়ে দিয়েছি। স্বামীর বিরুদ্ধাচারণ করিনি। কিন্তু এখন ভয় লাগে আমার। কে জানে… কাকে বঞ্চিত করে এই বাড়ির দখল নিয়ে বসে আছি কে বলতে পারে! আমার সন্তানদের যদি কোনও ক্ষতি হয় সেটা আমি মা হয়ে কীভাবে সহ্য করব?’

আমার ইচ্ছে করছে এখান থেকে উঠেই চলে যাই। কী কুক্ষণে যে ভদ্রমহিলাকে এসব জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলাম আমি, কে বলতে পারে! শাকিলের দিকে তাকিয়ে নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল। বেচারার দুইদিন পর বিয়ে। এর মধ্যে আমি ওকে কী একটা ফ্যাসাদে বুঝি ফেলে দিলাম!

শেষমেষ প্রসঙ্গ ধামাচাপা দিতে মরিয়া হয়েই বলে ফেললাম, ‘খালাম্মা, আপনাদের এই শহরে কী কী জায়গা আছে দেখার মতো? আমি এর আগে মানিকগঞ্জে আসিনি কখনও। এই সুযোগে শহরটা দেখে গেলে মন্দ হয় না। এখনো তো বেলা আছে বেশ খানিকটা। আশেপাশে কোথাও থেকে চাইলে ঘুরে আসা যেতে পারে।’

ভদ্রমহিলা এই মুহূর্তে ঠিক যেন নিজের মধ্যে নেই। উনি তখন পাপ পূণ্যের জটিল হিসাবনিকাশে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন সম্ভবত। হয়ত উনার মন খুবই নরম, তাই উত্তরাধিকারীদের বঞ্চিত করে এই বিশাল অট্টালিকা ভোগ করতে তার মন সায় দিচ্ছে না। অথবা এমনও হতে পারে, উনি কোনও কারণে তার শ্বশুরের ওপরে ভয়ানক ক্ষুব্ধ। তাই একটু খোঁচা দিতেই সেই ক্ষোভ একেবারে গলগল করে বেরিয়ে এসেছে উত্তপ্ত লাভার মতো।

আমার প্রশ্ন শুনে অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলেন, ‘মানিকগঞ্জে ম্যালাকিছুই তো আছে দেখার মতো। বেতিলা, বালিয়াতি, তেওতা এসব জায়গাতে জমিদারবাড়ি আছে বিশাল জায়গা নিয়ে। ঘুরে দেখতে পারো। মত্তমাঠ নামে একটা ঐতিহাসিক জায়গা আছে সদরেই। এটাও ঘুরে আসতে পারো। আরও অনেক কিছুই আছে। এসেছ, দুইদিন থাকো আমাদের শহরে। শাকিলের বিয়েটা খেয়ে যাও।’

অন্যসময় হলে হয়ত প্রস্তাবটা ভেবে দেখলেও দেখা যেত। কিন্তু এখন এদের এই পারিবারিক ক্যাচালে খানিকটা ঢুকে পড়ার পরে মনে হচ্ছে, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি! বিনয়ের সাথেই তাই উনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে দিতে বললাম, ‘খালাম্মা, আবার আসব আপনাদের বাড়িতে। খুব ভালো লাগল সবকিছু। কিন্তু এবারে তো একটু কম সময় নিয়ে এসেছিলাম। তাছাড়া খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে বন্ধুর কী হলো!’

ঠিক এমন সময় শাকিলের ফোনটা বেজে উঠল। ‘এক্সকিউজ মি’ বলে উঠে গেল শাকিল। আমিও উঠে নিজের ঘরে চলে যাওয়ার ফাঁক খুঁজছি। উঠতে যাব এমন সময় ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, ‘বাবা, তোমার কাছে অনেকদিন পরে এসব কথা খুলে বলতে পেরে হাল্কা লাগছে নিজেকে। কাউকে বলতে পারি না সবকিছু। আমার ভেতরটা মাঝে মাঝে জ্বলে যায় একেবারে। কী হবে এসব ঘরবাড়ি ধন দৌলত দিয়ে? মানুষই তো একদিন নাই হয়ে যায়। আমাকেই কী না এই যক্ষপুরী আগলে বসে থাকতে হলো!’

আমার কী বলা উচিত এই পরিস্থিতিতে একেবারেই বুঝতে পারছি না। উঠে চলে যাওয়াটাও ভীষণরকম অসমীচীন। উশখুশ করতে করতে বসেই রইলাম। তিনি বলেই চলেছেন, ‘আমার বাপের টাকাকড়ি ছিল ভালো। এই অঞ্চলে ভালোমানুষ হিসেবেও নামডাক ছিল আমার বাবার। সৎ উপায়ে ব্যবসা করে অর্থকড়ি কামিয়েছেন জীবনে। অথচ আমার শ্বশুরের কী দেখে যে বাবা এত মুগ্ধ হয়েছিল আমি জানি না। হয়ত ভেবেছিল এই পুরো বাড়ি আমার শ্বশুরের একার। মেয়ে রাজত্ব করবে বাড়ি জুড়ে। সেই রাজত্বই তো করছি! কিন্তু নিজের রাজ্যের না, অন্যদের হক মেরে আদায় করা রাজ্যের রাণী হয়ে বসেছি আমি!

দিনে দিনে বুঝেছিলাম, আমার শ্বশুর বেছে বেছে শহরের নামীদামী পয়সাওয়ালা লোকদের মেয়েকে নিজের পুত্রবধূ হিসেবে নির্বাচন করেছিল। আমার এক ভাসুর বাপের অমতে দরিদ্রঘরে বিয়ে করেছিল। তিনি নিজের ছেলেকেও ঘাড়ধাক্কা দিতে দেরি করেননি। ……’ কথার মাঝখানে শাকিল চলে আসাতে ভদ্রমহিলা আবারও চুপ করে গেলেন।

আমি কিছু একটা বলে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে একটু হাল্কা করার তাল খুঁজছিলাম, এমন সময় আচমকাই আমার চোখ পড়ে গেল একটা ছবির দিকে। নিমেষেই আমার সারা শরীর ঝনঝন করে বেজে উঠল।

আরে! কী আশ্চর্য! এই ছবি এখানে কী করছে! (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

#বড়গল্প
#অবেলার_পুষ্প
#পর্ব_৭

ষষ্ঠ পর্বের পরে…

আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে শাকিল আর ওর মা দুজনেই তাকালেন দেওয়ালে সাজানো সারিবদ্ধ ছবিগুলোর এক কোনায় আলগোছে উঁকি মেরে থাকা একটা ছবির দিকে।

আজ সকালে এসে যখন এখানে বসেছিলাম, তখন এই ছবিটা আমার নজরে পড়েনি। এখন খেয়াল করতেই চমকে উঠলাম। ছবিতে আমি আর আর আমার সৎভাই। আমার বয়স বড়জোর আট নয় বছর। বড়ভাই তখন তরুণ যুবা।

হতবিহবল হয়ে ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছি আমি। মনের মধ্যে নানারকম হিসাব নিকাশ শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। আমার এখানে এভাবে হুট করে আসা, এই বাড়িতে পা দেওয়ার পর থেকেই চেনা চেনা একটা অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হওয়া, সবকিছুর মাঝে পরিচিত অথচ খুঁজে না পাওয়া অপরিচিত একটি সুর বাজতে থাকা… আমাকে যেন কিছু একটা মনে করিয়ে দিতে চাইছিল। এমনকি আমার বন্ধু রায়হানকে ফোনে না পাওয়ার মাঝেও আমার মনটা অন্যরকম একটা সম্ভাবনার আলোতে দুলছিল। রায়হান কি জেনেশুনেই আমাকে এই বাড়িতে পাঠিয়েছে? আমার সাথে তো ওর এমন করার কথা নয়! নিশ্চয়ই কিছু একটা ভেবেচিন্তেই সে আমাকে এখানে পাঠিয়েছে! কিন্তু কী সেই বিশেষ কারণ যে আমাকে একা পাঠানো এত জরুরি হয়ে পড়েছিল? ও নিজেও তো আমার সঙ্গে আসতে পারতো! নিজের বিয়ের কথা বলেই বা আমাকে পাঠানোর কী দরকার ছিল!

শত শত প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে চলছিলাম। কিন্তু কোনো উত্তরেই ঠিক যেন সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না।
এখন এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে।
এই ছবিটা যদি রায়হান দেখে থাকে, তাহলে তো অনেক রহস্যই খোলাসা হয়ে যায়। কারণ আমার কাছে রায়হান এই ছবি দেখেছে। আমার আপনজনবিহীন জীবনে এই ছবিটাই ছিল একসময় একমাত্র সম্ভব। মা-বাবার সাথে আমার খুব বেশি ছবি নেই। দুটো হলুদ হয়ে যাওয়া ছবির একটিতে দুই তিন বছরের আমি মায়ের কোলে। আরেকটি ছবিতে মা-বাবার সাথে বসে আছি তাদের মধ্যমণি হয়ে। সেটাতেও আমার বয়স দুই তিন বছরের বেশি না। আর দুটো ছবিই স্টুডিওতে গিয়ে তোলা।

শুধু আমার সৎভাইয়ের সাথে স্টুডিওর বাইরে কিছু ছবি তুলেছিলাম, সৌখীন বড়ভাইয়ের কেনা সাধের ইয়াশিকা ক্যামেরাতে। এখানে যে ছবিটা আছে, এটি সেগুলোরই একটি। কিন্তু কথা হচ্ছে এই ছবিটি এখানে কী করছে? এদের পারিবারিক ছবির সংগ্রহে আমি আর আমার ভাইয়ের স্থান কেন হয়েছে? তবে কী…!

শাকিল আর তার মায়ের চোখও ততক্ষণে ছবিটার দিকে পড়েছে। শাকিল ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে আবার আমার দিকে তাকাল। তারপর পরিষ্কার ভাবেই বলল, ‘আপনি কি এদেরকে চেনেন?’

আমার মনে কৌতুক জন্মাল। মজা করার জন্যই বললাম, ‘হ্যাঁ চেনা চেনাই তো লাগছে! কিন্তু আপনাদের পূর্বপুরুষদের মাঝে এই দুইজন কী করছে বুঝতে পারছি না! তারাও কি আপনাদের পূর্বপুরুষ?’

‘হ্যাঁ… না মানে পূর্বপুরুষ না। এরা আমার চাচাত ভাই। কিন্তু… আপনি এদের কীভাবে চিনলেন? আশ্চর্য তো!’

শাকিলের মাও তখন জিজ্ঞাসুমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি একটা অন্যরকম থ্রিল অনুভব করছি। যে কথা এদের কাছে বলতে যাচ্ছি, শোনার পরে কেমন প্রতিক্রিয়া হবে বুঝতে পারছি না। কিন্তু নিজের মুখে নিজের পরিচয় দেওয়ার আগে এদের কাছ থেকে আরেকটু কিছু শুনতে মন চাইছে। বুঝতে পারছি একটা কোনো গল্প আছে এখানে। সেই গল্পটা আগে সংগ্রহ করে নেওয়া যাক। নিজের পরিচয় দেওয়ার জন্য বাকি বেলা পড়ে আছে।

আমি দুজনের আগ্রহেই খানিকটা পানি ঢেলে দিয়ে খুব ঠাণ্ডামাথায় বললাম, ‘আমি তো চিনি এদেরকে। কিন্তু কিছু মনে করবেন না। এদের দুজনের গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে। আপনার এই দুজন চাচাত ভাই কি বেঁচে আছে? তারা কোথায়? দেখা সাক্ষাত হয় না আপনাদের?

শাকিল আমার উল্টো প্রশ্ন শুনে একটু অবাক হলো বুঝতে পারলাম। ভ্রুদুটো আরেকটু যেন বেশি কুঁচকে গেল। কিন্তু মনের বিরক্তি মনেই চেপে রেখে শাকিল বলল, ‘হয়ত আপনি এদের দুজনকে চেনেন, কিন্তু বলতে চাইছেন না। যাহোক, ইচ্ছে না করলে না বলবেন। আমাদের কাছে তো লুকানোর কিছু নেই। আপনি যখন চেনেন এদেরকে, তাহলে তো একদিক দিয়ে ভালোই হলো। বিষয়টা আপনারও জানা থাকল। এই দুজনের খোঁজখবর করার চেষ্টা আমরা একেবারে কম করিনি। কিন্তু সেই যে একদিন এসে এই ‘চৌধুরী ভিলা’ থেকে ঘুরে গেল তারপর আর একদিনও কেউ এলো না! যোগাযোগের যোগসূত্র রেখে যায়নি তারা। আমাদের আর কীই বা করার ছিল?’

আমি বললাম, ‘তারা এখানে এসেছিল? কবে?’

এবারে উত্তর দিলেন ভদ্রমহিলা, অর্থাৎ সম্পর্ক মোতাবেক যিনি আমার চাচী। চাচী বললেন, ‘ফাহাদ আর ওর ছোটভাই ম্যালাদিন আগে এসেছিল বাবা। আমার শাকিল নিজেও তখন এই ছোটজনের বয়সী হবে। শাকিলের বাবা আর আমি ওদের বসিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম মনে আছে। কিন্তু ফাহাদ এসেছিল নিজের অংশ বুঝে নিতে। ওর তখন গল্পগুজবে আগ্রহ ছিল না তেমন একটা। চাচা চাচীর প্রতি তো টান গড়ে ওঠার সময়ই পায়নি! আমার শ্বশুর তার আগের বছরই মারা গেছেন। অবশ্য শ্বশুর বেঁচে থাকতে তো এমনিতেই আসতে পারেনি। সেজন্যই তার মৃত্যুর পরেই ওরা এসেছিল।’

‘কেন? দাদা…মানে শাকিলের দাদা বেঁচে থাকতে কেন আসতে পারেননি?’

‘বাবা…সেটাই তো গল্প! জানি না তুমি এদেরকে কীভাবে চেনো। তবে কীভাবে চেনো জানতে পারলে হয়ত আমাদের জন্য ভালো হতো। গল্পটা বলতে সুবিধা হতো আর কী! কারণ গল্প করতে বসেছি ঠিকই, কিন্তু কিছু গল্প হয়ত পরিবারের একান্ত নিজস্ব অধ্যায়।’

আমি বুঝতে পারছি আমার চাচী গল্প বলার জন্য ভেতরে ভেতরে ছটফট করছেন, কিন্তু ছেলের উপস্থিতিতে কিছুটা হলেও আড়াল বজায় রাখতে হচ্ছে তাকে। আমি শাকিলের দিকে তাকালাম। ওর চোখেমুখে এবারে একটু যেন অন্য ছায়া ঘনাতে দেখলাম। সেখানে পরিষ্কার সন্দেহ আর অসন্তোষ। এবারেও স্পষ্টসুরে শাকিল আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘একটা কথা বলবেন? আপনাকে কি কেউ এখানে পাঠিয়েছে? এসব গল্পের মধ্য দিয়ে কি কাউকে কোনো কিছু জানাতে চাইছেন আপনি? আমার এই বড় চাচাত ভাই আপনাকে পাঠিয়েছে তাই না? উনি নিজে এলেই তো পারতেন! শুধু শুধু প্রতিনিধি পাঠানোর কী দরকার ছিল ওর?’

আমি শাকিলের গলার উষ্মা বেশ ভালোভাবেই টের পেলাম। মনে মনে অন্যরকম একটা মজা পাচ্ছি। দেখাই যাক না, এই গল্প আমাকে কোথায় নিয়ে যায়! এই বিশাল বাড়ির একচ্ছত্র আধিপত্য দখল করে বসে এরা কি সত্যি সত্যিই অন্তর্দহনে পুড়ে মরছে নাকি ভেতরের গল্পটা অন্যরকম?

শাকিলের কথা শুনে আমার চাচী এবারে বিব্রত মুখে ছেলের দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে ছেলেকে নিরস্ত করার একটা চেষ্টা দেখতে পেলাম। মুখেও মৃদু ভৎসনা করে বললেন, ‘আহ শাকিল! চুপ কর। ভালোভাবে না জেনেশুনে এভাবে কথা বলছিস কেন?’
তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘বাবা… জানি না তুমি কিছু না জেনেই এসেছ নাকি কেউ তোমাকে পাঠিয়েছে! তবে কেউ পাঠিয়ে থাকলে তাকে খোলাখুলি আমাদের সাথে কথা বলতে বললে ভালো হয় বাবা। আমরা কাউকে ঠকাইনি। আমার শ্বশুর বেঁচে থাকতে কী করেছেন, সেটা তার ব্যাপার। সেখানে আমাদের কথা বলার জো ছিল না। তার সম্পদ তিনি যেভাবে খুশি বণ্টন করেছেন। আমাদের আপত্তি তিনি কানে তুলবেন কেন? কিন্তু তার মৃত্যুর পরে আমি অথবা আমার স্বামী আমরা কেউই তার ভাইয়ের ছেলেদের বঞ্চিত করিনি। আর তাছাড়া আমরা ওদেরকে এখানে থাকতেও বলেছি। ওরা না থাকতে চাইলে আমরা কী করতে পারতাম!’

আমি চুপ করে শুনে চলেছি। এবারে একটু মাঝপথে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বললেন, আপনি আপনার স্বামীর ভাইয়ের ছেলেদের বঞ্চিত করেননি। কিন্তু কীভাবে তাদের অধিকার দিয়েছিলেন সেটা একটু বলবেন কি দয়া করে?’

শাকিল এবারে ক্ষুব্ধ বিদ্বেষে ফেটে পড়ল যেন। মনের সাথে ওর একটা বোঝাপড়া বুঝি অনেকক্ষণ ধরেই চলছিল। আর সেটাকে দমিয়ে রাখতে পারল না। একেবারে জলোচ্ছ্বাসের মতো ধেয়ে এলো। ক্রুদ্ধ গলায় শাকিল বলল, ‘সেটা কি আমরা আপনাকে জানাব? এই যে শুনুন… ভদ্রতাবশত অনেক খাতিরদারি করেছি আপনাকে। আপনি কে… কেন এসেছেন মানে কী মতলবে এসেছেন এসব ভালোভাবে খুলে না বললে আমরা আর একটি শব্দও উচ্চারণ করব না! ফাহাদ ভাই যদি আপনাকে পাঠিয়ে থাকে… ওহ না না শুধু ফাহাদ ভাইই বা বলছি কেন, ছবির এই ছোটজনও তো আপনাকে পাঠাতে পারে তাই না? যদি দুজনের কারও তরফ থেকে আপনি এসে থাকেন, তাহলে দয়া করে তাদেরকে সামনে আসতে বলবেন। উনাদের যদি মনে হয় আমরা তাদের বঞ্চিত করে সব জোরজবরদস্তি ভোগদখল করছি তাহলে এসে কড়ায়গণ্ডায় হিসাব নিয়ে যাক!’

কথা শেষ করে মায়ের দিকে ফিরে বলল, ‘এবারে বুঝলে তো কাউকে দেখলেই গল্পের ঝাঁপি খুলে বসতে হয় না! তুমি তো সরলমনে একেবারে চৌদ্দগুষ্টির গল্প শুরু করেছিলে! এখন থামলে কেন?’

আমি তখনো সকৌতুকে মজা দেখছি। বেশ বুঝতে পারছি, শাকিল আর রানু দুজনেই একটু রগচটা ধাঁচেরই হয়েছে। অল্পতেই দুই ভাইবোন রেগে যায়। হয়ত বংশের ধাঁচ। ভদ্রমহিলা নিজের শ্বশুরের নানারকম গল্প করছিলেন। নিজের ভাইবোনকে বঞ্চিত করা, পছন্দের মেয়েকে বিয়ে না করার দরুণ ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া… এসব তো রগচটা মানুষজনই করে থাকে! কাজেই বংশের ধাঁচ যাবে কোথায়?

কথাটা ভাবতেই নিজের কথাও মনে এলো। আমিও তো ঘটনাচক্রে এই বংশেরই একজন! তাহলে এই ধাঁচ তো আমারও ষোলআনা থাকার কথা! হয়ত আমি আমার মায়ের ধাঁচ পেয়েছি। তাই বেঁচে গেছি এই সর্বগ্রাসী রাগের কবল থেকে!

তবে খুব বেশি সময় আর এদের অন্ধকারে বসিয়ে রাখতে মন চাইল না। তাই মজাটাকে এখানেই থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আমাকে কেউ পাঠায়নি। আর আমিও পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক এখানে আসিনি। তবে এসবের পেছনে আমার বন্ধুটির হাত আছে কী না বুঝতে পারছি না! সেই তো নিজের বিয়ের কথা বলে আমাকে এই ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলো!
আর এখানে এসে এই ছবিটি দেখে বুঝতে পারলাম, আমি নিজেও এই বাড়ির একজন বংশধর! মানে এই ছবিতে যে ছোটজনকে দেখা যাচ্ছে, আমিই সেই জন। আমার নাম মাহমুদ। আর হ্যাঁ আমার সৎভাইয়ের নাম ফাহাদ।
এখানে আসার পর থেকেই খুব চেনা চেনা লাগছিল সবকিছু। বুঝতে পারলাম একদিন ভাইয়া আমাকে নিয়ে এসেছিল এই বাড়িতে। কিন্তু খুব ছোট ছিলাম আমি। তাই জানি না ভাইয়ার সাথে কার কী কথাবার্তা হয়েছে। তবে যা কিছুই হয়ে থাকুক না কেন, বিশ্বাস রাখতে পারেন সেইসবে আমার কোনোরকম ইন্টারেস্ট নেই। আমি এখানে কোনো কিছুই আদায় করতে আসিনি। বরং ফাঁকতালে আপনাদের সাথে দেখা হয়ে গেল! এটা তো আমার প্রত্যাশারও বাইরে ছিল!’

আমার মনে হলো, ঘরের মধ্যে বুঝি বাজ পড়েছে। মা ছেলে অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর একসময় সম্বিত ফিরতে আমার চাচী উঠে এসে আমাকে আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বাবা… তুমি এ কী বলছ! আমি তো ভাবতেও পারছি না! তুমি সত্যিই কিছু না জেনেশুনে এখানে এভাবে চলে এসেছ! এতদিন পরে মনে পড়ল আমাদের কথা! …’

চাচী হয়ত আবেগে আরও অনেককিছুই বলতেন। কিন্তু আমার সন্দেহপ্রবণ চাচাতো ভাই শাকিল গলার স্বর আগের চেয়ে কিছুটা নমনীয় করে প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু আপনার বন্ধুটি আপনাকে এখানে পাঠবে কেন? সে কে? তার কি কোনো ছবি আছে আপনার কাছে?’

এই ব্যাপারটা কেন এখন অব্দি আমার মাথায় আসেনি সেটা ভেবে নিজেকে তিরস্কার করলাম। তাই তো, আমার মোবাইলেই তো রায়হানের বেশ কয়েকটা ছবি আছে! আমাদের অফিসের পিকনিকে, কিংবা লাঞ্চের ব্রেকে দুই বন্ধু বেশ কিছু ছবি তুলেছি একসাথে!

মনে হতেই শশব্যস্ত হয়ে ছবি খুঁজতে বসে গেলাম। (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here