#অবেলার_পুষ্প
পর্ব_২
প্রথম পর্বের পর…
গাড়ির অবস্থা খুব যে আহামরি কিছু তা নয়। একটা পুরনো মডেলের টাটা ইন্ডীগো। হালও খুব বেহাল। এই গাড়িতে চাপাচাপি করে এরা চারজন এসেছে। এখন আমাকে বসালে জায়গা কোথায় হবে সেটা মাথায় এলো না। আমি জিজ্ঞাসু মুখে তাদের দিকে তাকালাম।
রানুর পরে যে ছেলেটি কথা বলতে এসেছিল, এবারেও সেই মুশকিল আসানের ভার নিলো। বলল, ‘আপনি ড্রাইভারের পাশে বসুন। আমরা পেছনে চারজন ম্যানেজ করে নিব।’
বললাম, ‘আর ইউ শিওর?’
‘জি জি নিশ্চয়ই!’
আমি আর চাপাচাপি করতে গেলাম না। ওরা যদি ম্যানেজ করে নিতে পারে তাহলে আমার সমস্যা কোথায়!
গাড়ি চলতে শুরু করার পরে অস্বস্তিকর নীরবতা গ্রাস করে থাকল কিছুক্ষণ। কোথায় যাচ্ছি জানি না, কাদের সাথে যাচ্ছি সেটাও অজানা। কী একটা অদ্ভুত অবস্থা! নিজেকে নিয়ে এমন জুয়া খেলা খুব বেশি একটা খেলিনি আমি। পেছনে না ফিরেও বুঝতে পারলাম, চারজন নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছে। চোখে চোখে কথাবার্তা চলছে। ড্রাইভারের মুখের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি, সে একেবারে পাথর মুখে গাড়ি চালাচ্ছে।
নিজের ভেতরের চাপা অস্বস্তিটাকে বিদায় করার জন্য আমাকেই মুখ খুলতে হলো। একবার পেছনে একটু চকিতে ফিরে সবার উদ্দেশ্যেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলাম,
‘আচ্ছা আমি তো তোমাদের সাথে রওয়ানাই দিয়ে দিলাম। এখন তোমাদের গন্তব্য আর আমার গন্তব্য একই জায়গায় এটা তোমরা বলছ। আমি তো কিছু চিনছি না। দেখা যাক, দুই গন্তব্য এক জায়গায় মেলে কী না!’
ওদের মধ্যকার ভিন্ন আরেকজন এবারে উত্তর দিলো, ‘এটা নিয়ে আপনি একদম চিন্তা করবেন না ভাইয়া। মানিকগঞ্জে বাহাদিয়া বাজার একটাই আছে। আর সেখানকার চৌধুরী ভিলাও এক নামে পরিচিত!’
রায়হানও আমাকে এমনটাই বলেছিল। যে কাউকে বললেই জায়গামত নিয়ে যাবে। কারণ জায়গাটা বেশ পরিচিত। রায়হানের কথা মনে হতেই আরেকবার ওর নাম্বারটাতে রিং করলাম। এরা যখন আমার ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠাচ্ছিল, তখনই একবার রিং করেছি ওকে। ওপাশ থেকে যান্ত্রিক আওয়াজ ভেসে এসেছে, ‘আপনি যে নাম্বারে কল করেছেন, তা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে!’
ভাবলাম বিয়ের ছুটিতে আছে। ফোন বন্ধ রেখে হয়ত ছুটি উপভোগ করছে। যদিও মোবাইল কোম্পানির একজন অফিসারের জন্য এটা একটু অস্বাভাবিক ব্যাপার। তবে মাঝে মাঝে এত ফোনের ধকল সামলাতে হয় যে কাজটা আমি নিজেও মাঝেমধ্যে করে থাকি। আর রায়হানের তো বিয়ে! কাজেই ওকে দোষ দেওয়া যায় না।
কিন্তু এই মুহূর্তে ওকে পাওয়াটা খুব দরকার। গাড়ি কোথায় ছুটে চলেছে জানি না। নিজের সাবধানতার জন্যও একটু চোখ কান খোলা রাখা দরকার।
ওপাশ থেকে একই রেকর্ডেড ভয়েস শুনতে পেলাম। আশ্চর্য! এই রায়হান ব্যাটা ফোন কেন খুলছে না?
আমি আবার আমার সহযাত্রীদের দিকেই মনোযোগ দিলাম। কথাবার্তা বললেও পরিস্থিতি বোঝা অনেক সময় সহজ হয়। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাদের নিজেদের মধ্যে রিলেশনটা কী? বন্ধু নাকি কাজিন?’
‘আমরা কাজিন। মামাতো ফুপাত ভাইবোন সবাই।’
‘আচ্ছা! তোমাদের বাসাতেও বিয়ে হচ্ছে? কার বিয়ে?’
‘আমাদের আরেকজন কাজিন শাকিল ভাইয়ের বিয়ে।’
আমি আবার একটা ধাক্কা খেলাম। কোন শাকিলের বিয়েতে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে এরা? আমি তো এসেছি আমার বন্ধু রায়হানের বিয়ের অনুষ্ঠানে! একই নামের জায়গাতে দুই ব্যক্তির বিয়ে! আর সেই বিয়েতে আসবে ঢাকা থেকে দুই নামের দুইজন ব্যক্তি! সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে! কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না!
‘তোমাদের এই শাকিল ভাই কি ঢাকায় চাকরি করে?’
‘হ্যাঁ ভাইয়া একটা কোম্পানিতে আছে। উনার বন্ধু সজল ভাইয়া প্রায় এক বছর আগে একবার এখানে এসেছিল, ভাইয়ার সাথেই। সেই সজল ভাইয়ারই তো আসার কথা আছে। এদিকে আপনি বলছেন আপনার নাম সজল না। আবার আপনি বাহাদিয়া বাজারের চৌধুরী ভিলারই খোঁজ করছেন!’
‘সজল নামের সেই ব্যক্তি তাহলে এখানে আগেই এসেছিল! তোমরা তো তাহলে দেখেছ তাকে! তাহলে আমাকে সেই সজল মনে করছ কেন?’
‘না আমরা কেউই সজল ভাইয়াকে দেখিনি। আমাদের মামা মামীর সাথে শুধু দেখা হয়েছিল উনার। আমরা তো কেউ এখানে থাকি না। মানে মানিকগঞ্জেই থাকি। কিন্তু অন্য জায়গায়। চৌধুরী ভিলাতে আমাদের মামা মামী, শাকিল ভাই আর রানু থাকে। রানু শাকিল ভাইয়ের বোন।’
আমি এতক্ষণে আমাকে পাকড়াও করা সেই রানু নামের মুখরা মেয়েটির দিকে তাকানোর সুযোগ পেলাম। মেয়েটি এই এত দীর্ঘ সময়ে একটাও কথা না বলে মুখ চুন করে বসে ছিল। চুপ করে থাকলে এই মেয়েকে বেশ মায়াবী দেখায়। মুখরা রমণী সর্বদাই ভয়াবহ। আমি বললাম, ‘বাহ তাহলে তো তোমাদের রানু আপা সেই সজল ভাইকে ভালমতোই চেনে। মানে দেখেছে তাকে। কিন্তু সে আমাকে দেখে সজল ভাই বলছে কেন? আমরা দুজনে কি দেখতেও একই রকম?’
সেই ছেলেটা কিছু বলার আগে এবারে রানুই মুখ খুলল। অনেকক্ষণ ধরে মুখবন্ধ করে রাখার কারণে তার হয়ত এতক্ষণে মুখ ব্যথা করছে। রানু বলল, ‘জি না আমিও উনাকে দেখিনি। উনি যে সময়ে এসেছিলেন আমি তখন বাসায় ছিলাম না। আমার নানুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফিরেছিলাম সাতদিন পরে। ততদিনে সজল ভাই আর ভাইয়া চলে গিয়েছিল।’
‘আচ্ছা তাই বলো!’ আমি ছোট করে উত্তর দিলাম। নিজের অজান্তেই কখন যে এই অল্প বয়সী ছেলেমেয়েগুলোকে তুমি তুমি করে বলতে শুরু করে দিয়েছি, নিজেও বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলাম রানুর ঝাঁঝালো মন্তব্যে।
‘আচ্ছা আপনি আমাদের তুমি করে বলছেন কেন? আমাদের দেখতে কি স্কুলের ছাত্রছাত্রী মনে হচ্ছে?’
রানুকে পাশ থেকে কেউ বুঝি খোঁচা মারল। মৃদু ভৎসনাও কানে এলো, ‘আহ রানু! চুপ কর! উনি আমাদের অতিথি!’
আমি সহাস্যে বললাম, ‘এখনো বলা যাচ্ছে না আমিই তোমাদের অতিথি কী না।‘ তারপর রানু মেয়েটার দিকে ফিরে বললাম, ‘আসলে স্কুলের ছেলেমেয়ে মনে না হলেও তোমরা আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। তাই আপনি আজ্ঞে করতে মন চাইল না। তবে তোমাদের আপত্তি থাকলে ভিন্ন কথা!’
‘না না আপনি তুমি করেই বলেন আমাদের। আমরা সবে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছি। রানু তো আরও ছোট। এবারে সবে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে। ভর্তি পরীক্ষার প্রিপারেশন নিচ্ছে।’
আমি ফিক করে হেসে দিয়ে বললাম, ‘এ মা! তাহলে তো একেবারে বাচ্চা মেয়ে! ওকে আমি কোন আক্কেলে আপনি করে বলি বলো তো?’
পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম, রানু আমার দিকে রাগত চোখে তাকিয়ে আছে। অন্যদের মুখ হাসি হাসি। ছেলেমেয়েগুলোর সাথে কথা বলতে বলতে মনের আশঙ্কা আর উদ্বেগ অনেকটাই কেটে গেছে। নাহ! এরা সম্ভবত চোর ডাকাত বাটপার শ্রেণীর কেউ নয়! হলে এত হেসেখেলে প্রাণবন্তভাবে গল্প করতে পারতো না।
দেখতে দেখতে আমাদের গন্তব্যও এসে গেল। গাড়ি এসে থামল একটা পুরনো বনেদি তেতলা বাড়ির সামনে। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন অনেক কথা ভেসে আসে মনের কোণে। এর চারপাশের প্রকৃতি আমার যেন খুব চেনা। খুব চেনা না হলেও একেবারে অচেনা হয়ত নয়। হয়ত বইয়ে পড়েছি। কিংবা গল্পে শুনেছি কারও কাছে। কে বলতে পারে?
বাড়িটার সামনে অনেকখানি জায়গা নিয়ে বেশ বড়সড় বাগান। নানারকম ফল ফলারির গাছ সেখানে। তার পেছনে তেতলা পুরনো বাড়িটা কেমন যেন আলগোছে উঁকি মারছে। একটা নামফলক দেখতে পেলাম বাড়িটার সামনে। বড় বড় হরফে সিমেন্টের গায়ে খোদাই করে লেখা, ‘চৌধুরী ভিলা’। আমি একদৃষ্টে অক্ষরগুলো দেখতে লাগলাম। এই লেখাটাকেও এত চেনা চেনা লাগছে কেন কে জানে!
আমি নিজের অজান্তেই আবার মোবাইলটা বের করে রায়হানের নাম্বারটাতে আরেকবার রিং করলাম। আশ্চর্য! এখনও বন্ধ!
জানি না কেন, এবারে আমার একটু অন্যরকম ভয় করতে লাগল। রায়হান আমার সাথে কোনোরকম গেম খেলল না তো! (ক্রমশ)
#ফাহ্মিদা_বারী