অবেলার_পুষ্প #পর্ব_৩

0
456

#অবেলার_পুষ্প
#পর্ব_৩

দ্বিতীয় পর্বের পরে…

আমি গাড়ি থেকে নামার আগেই আমার সহযাত্রীরা একে একে নেমে পড়েছে।

তারা আমার ট্রলি ব্যাগটাকেও সটান দাঁড় করিয়ে ফেলেছে কনক্রিটের রাস্তায়। আমি একটু বিভ্রান্তের মতো সামনে তাকিয়ে আছি। এগুবো নাকি এগুবো না বুঝতে পারছি না। আমি যে বাহাদিয়া বাজারেই এসেছি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ কিছু স্থানীয়ই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।

এদের প্রতি এতক্ষণে একটা বিশ্বাস জন্মে গেছে মনে। আর চোখের সামনে ‘চোধুরী ভিলা’ নামফলকটাকেও তো দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমি যে রায়হানের বিয়েতে এসেছি, এখানে তো সেই রায়হান থাকে না! এদের ভাষ্যমতে এখানে কোনো এক শাকিলের বিয়ে হচ্ছে। অথচ এই তেতলা বাড়িটাতে বিয়ের তেমন কোনো আবহ চোখে পড়ছে না। সব কেমন জানি নিঝুম হয়ে আছে। বাড়ির সামনে কোনো গাড়ি বা লোকজন কিছুই নেই। তাহলে আমার কি এগুনো ঠিক হবে?

আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওরা তাড়া দিলো। ‘এ কী ভাইয়া! আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আসুন ভেতরে আসুন! আপনি তো এই ঠিকানাতেই এসেছেন!’

আমার পা সরতে চাইছে না। এই প্রথমবারের মতো আমি একটু ভয় পাচ্ছি। এত অন্যরকম লাগছে কেন সবকিছু? স্বাভাবিকতার নামমাত্র কিছু নাই। বলছে বিয়েবাড়ি, অথচ মনে হচ্ছে যেন কোনো নিস্তব্ধপুরী। আমি এবারে ওদের কথামত সামনে না এগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইয়ে এই বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ ভাইয়া। এই বাড়িতেই তো বিয়ে হচ্ছে!’
‘বিয়ে বাড়ি এমন শুনশান হয় নাকি?’

মুখরা রানু এবারে এগিয়ে এলো। ‘অনেক বড় বাড়ি তো! সামনের দিকের অংশ তেমন ব্যবহার করা হয় না। অতিথিরা সবাই পেছনের দিকে ঘরগুলোতে আছে। তাই হৈচৈ কানে আসছে না। আপনি ভেতরে এলে তো বুঝতে পারবেন!’

‘না না দাঁড়াও। আমি তোমাদের কথামত এতদূর এসেছি কিন্তু এই বাড়ির ভেতরে ঢোকার আগে আমি আমার বন্ধুর সাথে একবার কথা বলে নিতে চাই। ওকে আমি ফোন দিচ্ছি।‘

আমি লাগাতার ফোন দিয়ে যেতে লাগলাম। ওপাশ থেকে কেউ ফোন রিসিভ করল না। এখনও নাম্বারটা বন্ধ হয়ে আছে।
এটা রীতিমত অসম্ভব। রায়হানও আমার মতো মোবাইল কোম্পানিতে চাকরি করে। ওর সাথে এই চাকরি করতে এসেই আমার পরিচয় হয়েছে। সেটি প্রায় বছর খানেক আগের কথা। বয়স আর চিন্তাভাবনার দিক থেকে মিল থাকায় দুজনের বন্ধুত্ব জমে উঠতে সময় লাগেনি। পদবীর দিক থেকে অবশ্য রায়হান আমার নিচে অবস্থান করছে। ও এর আগে অন্য একটা কোম্পানিতে ছিল। সেটা ভালো না লাগায় ছেড়ে দিয়ে টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরে এসেছে। চুপচাপ শান্ত গোছের একটা ছেলে। কারও সাতেপাঁচে থাকতে দেখিনি কখনো। মন দিয়ে নিজের কাজটা করে যায়।

আমার সাথে কখন কীভাবে বন্ধুত্ব জমে গেছে তা আর এখন ঠিকমতো মনে নেই। রায়হান মানিকগঞ্জের ছেলে। আমি ঢাকার। দুজনেই এখনো বিয়েশাদী কিছু করিনি। কেরিয়ার গড়তে গিয়ে মেয়েদের পেছনে তেমন একটা সময় দেওয়া হয়নি। কিন্তু মেঘে মেঘে বেলা বয়ে চলেছে। আমি মনে মনে একলা থেকে দোকলা হয়ে যাওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করেছি। রায়হানের মনে কী চলে খোঁজ নেওয়া হয়নি সেভাবে।
কিন্তু সেই খোজখবর করার আগেই এই গত সপ্তাহেই রায়হান জানিয়ে বসলো, সে বিয়ে করছে। মেয়ে তাদের মানিকগঞ্জেরই। আগামী সপ্তাহেই বিয়ে। আমাকে যে করেই হোক বিয়েতে উপস্থিত থাকতেই হবে। সে কিছুতেই না শুনতে পারবে না!

একে তো বন্ধুর বিয়ে, তার ওপরে নতুন একটা জায়গাতে একটু আউটিং করে আসার সুযোগ। আমি কেন এই সুযোগ হেলায় হারাব?

তাছাড়া আমি একেবারে একলা মানুষ। একটি এক্সিডেন্টে মা-বাবা দুজনকেই হারিয়েছি। তারা মারা গেছে আমার ভালোমত বুদ্ধি ফোটার আগেই। বাবা কিংবা মায়ের দিকের কোনো আত্মীয়স্বজনের সাথেও আমার জানাশোনা নেই। তারাও পরবর্তীতে কেউই আর আমার সাথে কোনোরকম যোগাযোগের চেষ্টা করেনি। কী সেই কারণ আমার জানা নেই। আমিও শুধু শুধু কাউকে বিরক্ত করার জন্য খুঁজে বের করিনি। তাছাড়া কাউকে খুঁজে পাওয়ার মতো কোনও সূত্রও আমার কাছে ছিল না।

আমার বাবার সাথে মায়ের বিয়ে হওয়ার আগে বাবার আরেকজনের সাথে বিয়ে হয়েছিল। সেই স্ত্রীর সাথে বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পরে বাবা আমার মাকে বিয়ে করে। বাবার সেই প্রথম সংসারে তাদের একটি ছেলে হয়েছিল। সেই সৎ বড়ভাইয়ের সাথে প্রায় বছর সতেরোর ব্যবধান ছিল আমার। এই বিশাল ব্যবধানের কারণে তাকে ভাই কম, অভিভাবক শ্রেণীয় বেশি মনে হতো। আমার যখন তের কী চৌদ্দ বছর বয়স, ভাই তখন আমাকে একটা বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে মিডলইস্টে চলে যায়। সেখান থেকে খুব বেশি আর আমার সাথে যোগাযোগ করেনি। হঠাৎ মাঝে মধ্যে দুই একটা চিঠি আসতো আমার নামে। তাতে গৎবাঁধা কিছু কথাবার্তা থাকত যা প্রতি চিঠিতেই একই রকম মনে হতো আমার কাছে। তাই শেষের দিকে চিঠিগুলো খুলে দেখারও আর দরকার মনে করতাম না। তবে নিয়ম করে টাকা পাঠাত সবসময়। সেজন্যই আমার পড়ালেখাটা থেমে থাকেনি।

খুব অল্প বয়সেই বুঝে গিয়েছিলাম যে, জীবনে যা করার নিজেকেই করতে হবে। কেউ হাতে ধরে করে দিবে না। স্বাবলম্বী হতে পেরেছি অবস্থার চাপে পড়ে। কিন্তু জীবনে প্রতিষ্ঠা এলেও বন্ধুবান্ধব আত্মীয় পরিজনের অভাব সবসময়ই বোধ করেছি। নিজের একটা ঘর আপনজন এসব আমাকে কেমন জানি হাতছানি দিয়ে ডাকে।

তাই রায়হানের বিয়ের কথা শুনে মন থেকে খুব খুশি হয়েছি। আর বন্ধুর আহবানে রাজি হতে দেরি করিনি। । সঙ্গে জুড়ে দিয়েছি, ‘কী বন্ধু! শেষমেশ লটকে গেলে? আমি তো এখনো গাছের ডাল ধরেই ঝুলে আছি। লটকে পড়ার আর চান্সই পাচ্ছি না!’

রায়হান হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘বিয়েতে আসো। দেখি তোমাকে আমার এলাকার জামাই বানাতে পারি কী না!’
সবকিছুই ঠিক ছিল এই পর্যন্ত। অথচ এখন বাহাদিয়া বাজারের চৌধুরী ভিলার সামনে এসে রায়হানকেই ফোন করে পাচ্ছি না…এটা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়?

আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওরা আবার তাড়া দিলো। ‘ভাইয়া ভেতরে আসবেন না?’
আমি আর দোনোমোনো করলাম না। যাকগে! এতদূর যখন এদের ভরসাতে চলেই এসেছি, ভেতরে ঢুকতে অসুবিধা কী!

পুরনো আমলের জমিদারবাড়ির আদলে বিশাল এক বাড়ি এই চৌধুরী ভিলা।

ঢুকতে ঢুকতে মনে হচ্ছিল পথ যেন আর ফুরোয় না! লাল খোয়া বিছানো রাস্তাটা চলে গেছে মূলবাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত। দেখে মনে হচ্ছিল বুঝি পুরো পথে কেউ লাল গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। দুপাশ থেকে বড় বড় বাগানবিলাস জারুল আর কাঁঠালিচাঁপার ফুল পড়ে সেই লাল গালিচা যেন একেবারে সুসজ্জিত। বাগানের মধ্যে একটা ফোয়ারাও নজরে এলো। স্বল্পবসনা এক তরুণী আলুথালু বেশে বসে আছে। তার মাথার কাছে দুটো ডলফিন মুখ দিয়ে পানি ফেলছে। পানি ফেলছে এটুকু অবশ্য আমি কল্পনা করে নিলাম। ফোয়ারাটা বন্ধ অবস্থায় আছে। চালু থাকলে ওই দুটো ডলফিন মুখ দিয়ে পানি ফেলে মেয়েটাকে গোসল করাতো।
বাগানের ভেতরটা একটু অগোছালো। মাটিতে প্রচুর ঝরাপাতা জমে আছে। সেগুলো ঝাড় দিয়ে ঝকঝকে তকতকে করে রাখলে চারপাশটা আরেকটু শোভনীয় মনে হতো।

আমি ছোট ছোট পা ফেলে সবকিছু দেখতে দেখতে এগুচ্ছিলাম। আমার সাথের এসকর্ট বাহিনীর তর সইছিল না। তারা লম্বা লম্বা পায়ে ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আমি যে পিছিয়ে গেছি, এটা শেষমেশ একজনের নজরে আসায় সে আবার ঘুরে এসে আমাকে তাড়া লাগাতে শুরু করে, ‘ভাইয়া তাড়াতাড়ি আসেন!’

এত কিসের তাড়া এদের আমি জানি না। হয়ত আমাকে নিয়ে আসার ভার পড়েছিল এদের ওপরে। সেই দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এরা যার যার কাজে চলে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে।
আমি এদের হুজুগে তাল না দিয়ে আমার গতিতেই ধীরে ধীরে প্রবেশ করলাম মূল বাড়িতে। প্রায় সাথে সাথেই কয়েকজন মহিলা আর কিশোরীর একটা দলকে কোত্থেকে যেন ছুটে আসতে দেখা গেল। আমি ভালোভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের মধ্যে একজন আমার কপালে আফসানের তিলক লাগিয়ে দিলো। কিশোরীরা হি হি করতে করতে ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে দিলো দুপাশ থেকে। একজন এসে মিষ্টি জাতীয় কিছু একটা খাওয়াতে যাচ্ছিল, আমি হাত তুলে বাধা দিলাম।

প্রবল প্রতিবাদ জানিয়ে বললাম, ‘আরে আরে! কী করছেন! এসব রাখুন। আমি ঢাকা থেকে আসছি, আমার বন্ধু রায়হানের বিয়েতে। আমার নাম মাহমুদ। রায়হান আমাকে এই বাড়িরই ঠিকানা দিয়েছিল। কিন্তু ওকে আমি ফোনে পাচ্ছি না। আমি কি ওর সাথে কথা বলতে পারি?’

আমার এই জোর প্রতিবাদে কাজ হলো। মেয়ে আর মহিলাদের দল একটু ক্ষান্ত দিলো নিজেদের কাজে। এর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে তারা চোখে চোখে কথাবার্তা বলতে লাগল।
আমি তাদের মুখ আর পাশ ছাপিয়ে অন্দরমহলে উঁকিঝুঁকি মারতে চাইছিলাম। প্রত্যাশিত জনকে দেখতে না পেয়ে আমার হতাশা আর বাধ মানছিল না। এ কী অদ্ভুত সমস্যায় পড়লাম আমি! আমাকে দাওয়াত করে নিয়ে এসে দাওয়াতদাতার নিজেরই দেখা নেই! এটা একটা কথা হলো!

মহিলাদের মধ্যে একজন বললেন, ‘বাবা, তোমার নাম সজল না? ঢাকা থেকে এসেছ… তুমি আমাদের শাকিলের বন্ধু না?’

আবার সেই একই প্রশ্ন! আমি স্পষ্টগলায় বললাম, ‘জি না। আমি শাকিল নামের কাউকে চিনি না। আর আমার নাম মাহমুদ, সজল না!’

পেছন থেকে একটি পুরুষকণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলাম। ‘কার সাথে কথা বলছেন ফুপি? রানুরা বলল সজল নাকি এসেছে! কই?’

আমি সাগ্রহে সামনে তাকালাম।
এক নিমেষেই আমার আশার সলিল সমাধি ঘটল। সামনে সৌম্য চেহারার একজন যুবক দাঁড়িয়ে। পরনে স্য্যাণ্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি। গায়ে একটা বড় টাওয়েল জড়ানো। টাওয়েলের গায়ে হলুদের ছোপছাপ। মুখেও এখানে সেখানে হলুদ লেগে আছে। যুবকের দুই হাতে রাখি বাঁধা। কেউ না বললেও বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, এই যুবকটিরই বিয়ে হচ্ছে। সম্ভবত আজ তার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান চলছে।

আমি প্রবল হতাশা নিয়ে দেখলাম, এ আমার বন্ধু রায়হান না। ছেলেটিও অবাক চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা। ভ্রূদুটো কুঞ্চিত হয়ে এসেছে। স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে সে প্রশ্ন করল, ‘আপনি? আপনাকে তো চিনতে পারলাম না!’ (ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here