অব্যক্ত প্রেমাসুখ❤️‍🔥 #আদ্রিতা নিশি ।১৫।

0
116

#অব্যক্ত প্রেমাসুখ❤️‍🔥
#আদ্রিতা নিশি
।১৫।
[কপি করা নিষিদ্ধ ❌]

তওহীদ সাহেব আজ রাত আটটার আগেই বাড়িতে চলে এসেছেন অফিস থেকে। শরীরটা আজ তেমন একটা ভালো নেই। বেশ কয়েকদিন যাবত শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। বয়স হয়েছে আর বাঁচবেই বা কয়দিন। প্রেশার আপ ডাউন করায় তিনি হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পরছেন। তিনি ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে বসে আছেন। সামনেই আরেক সোফায় বসে আছে মীরাত আর ফাবিহা। তওহীদ সাহেব বেশ ভালো মনের মানুষ। মীরাতের সাথে আজ পুরোপুরি ভাবে পরিচয় পর্ব নিয়ে খোলাসা করতে বসেছেন। ফাবিহা নিরব দর্শক হয়ে তা উপভোগ করছে।

তওহীদ সাহেব চশমা ঠেলে জিজ্ঞেস করলেন– মীরাত মা কোন ক্লাসে পড়াশোনা করছো?

কথাটা বড্ড আদুরে আর ভালোবাসাময় শোনালো।মীরাতের বেশ ভালো লাগলো।পরিচয়টা কম দিনের অথচ কতোটা আপন লাগছে বাবা সমতুল্য মানুষটিকে। তার বাবা থাকলেও প্রতিদিন হয়তো এমন আদুরে কন্ঠে তার সাথে কথা বলতো।ভাবতেই আবেগাপ্লুত হয়ে উঠলো।

মীরাত আবেগাভাব বজায় রেখেই বললো;
“অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে।”

“ ফাবিহা আর তুমি সমবয়সী প্রায়। কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করছো?”

“ কেমিস্ট্রি। ”

“ আরিশা আর তুমি সেইম সাবজেক্ট দেখছি।”

“ আরিশা আর আমি সেইম কলেজ আর সেইম সাবজেক্টে একই সাথে পড়াশোনা করছি।”

তওহীদ সাহেব ক্ষীণ হেসে বললেন ;
“ ভালোভাবে পড়াশোনা করো। দোয়া করি জীবনে বড় কিছু হও।”

“ সাথে আরেকটা দোয়াও করে দিন আংকেল। জীবনে যেনো মানুষ হতে পারি। আশেপাশে কতো মানুষ দেখি তাদের মাঝে মনুষ্যত্ব নেই।”

এতোটুকু কথা বলতেই মীরাতের কন্ঠস্বর নিভে এলো। হঠাৎ ই চক্ষু পটে ভেসে উঠলো গ্রামের সেই মহিলাগুলো আর ইফতির মুখ। এরা তো মানুষ নয়। আস্ত শয় তান।

তওহীদ সাহেব বোধ হয় বুঝলেন কথার মর্মার্থ। তিনি চমৎকার হেসে বললেন ;

“ দোয়া করি জীবনে আগে মানুষ হও তারপর নিজের স্বপ্ন পূরণ করো। তুমি একদম ঠিক বলেছো মানুষের রুপ নিয়ে থাকলেও মানুষ কজন হতে পারে?”

মীরাতের ওষ্ঠকোণেও ফুটে উঠলো হাসি। ফাবিহা আজ ভীষণ খুশি। কারণ আজ সে বাবার সাথে টাইম স্পেন্ড করতে পারছে। আজ আনন্দঘন পরিবেশ বাড়িতে।

সুরমা বেগম আজ নিজ হাতে রান্না করছেন। তাকে সাহায্য করছে ফুলি। নানা রকমের বাহারি খাবারের গন্ধে ডাইনিং রুম ম-ম করছে। লোভনীয় খাবারের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি ও হাত চালিয়ে দ্রুত রান্নার প্রয়াস চালাচ্ছেন। রান্নার মাঝে মাঝে দুই একবার ডাইনিং রুমে এসে কথা বলে যাচ্ছেন।

আহিয়াদ ঘুমো ঘুমো চোখে তওহীদ সাহেবের কাছে এসে ধপ করে বসে পড়লো। তার মাথা হালকা ব্যথায় ভারাক্রান্ত আর মাথার পেছনে অস্বস্তিকর টনটন অনুভূতি। চোখ দুটি রক্তাভ, ক্লান্তি ও অস্থিরতার ছাপ ফেলে গেছে। বিকেল থেকে বিরক্তিকর সময়ের মধ্যে বন্দী ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে মাথাব্যথার উৎপত্তি কেন, তা বুঝতে পারছে না।

মীরাত আহিয়াদের দিকে নজর দিলো। তার চেহারা দেখতে কিছুটা মলিন।যা দেখে মীরাতের মনে অবাক ভাব উঁকি দিয়েছে। হঠাৎ কেনো এমন লাগছে? অসুস্থ নয় তো? বিকেলে তো সে সুস্থ ছিল, অথচ এখন কেন এই পরিবর্তন? মীরাতের মনে উদ্বেগের অনুভূতি জাগ্রত হলো। আহিয়াদ কি কোনো অশান্তির মধ্যে আছে?

তওহীদ সাহেব আহিয়াদের দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় ডুব দিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতাগুলো বলছিলো , ছেলেটি কিছুটা অসুস্থ। উদ্বেগের ছাপ নিয় বললেন;
“তোমায় দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে।”

আহিয়াদ ধীর, ঝিমিয়ে যাওয়া কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“মাথা ব্যথা করছে একটু।”

তওহীদ সাহেবের চিন্তিত হলেন। উদ্বেগের তীব্রতা বাড়িয়ে তিনি জানতে চাইলেন,
“মেডিসিন নিয়েছো?”

আহিয়াদ অত্যন্ত ক্ষীণ আওয়াজে বললো,
“নিয়েছি।”

মীরাত শুকনো মুখে তাকিয়ে রইল আহিয়াদের দিকে। বিষন্ন হয়ে উঠেছে মন। বিকেলেও সুস্থ ছিলো অথচ এখন অসুস্থ। ফাবিহারও মন খারাপ হয়ে গেলো। সে ভেবেছিলো আগামীকাল শপিং মলে যাবে। কিন্তু তা বোধ হয় আর হবে না। আহিয়াদ যদি সুস্থ হয় তবে যাওয়া যেতো। সে খেয়াল করলো মীরাতের মুখশ্রী অস্বাভাবিক ভার। ফাবিহা আঁড়চোখে কি মনে করে আহিয়াদের দিকে তাকালো। দেখলো আহিয়াদ মীরাতের দিকে তাকিয়ে আছে।এটা,দেখে কপাল কুঁচকে গেলো। সে কাহিনী বুঝতে পারলো না।

সুরমা বেগম রান্না শেষ করে ফ্রেশ হয়ে এসে ফাবিহার পাশে বসলো। সকলে তখন গল্পে মগ্ন। শুধু চুপচাপ আছে মীরাত।

তওহীদ সাহেব সুরমা বেগমকে সামনে রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“বেগম সাহেবা, দ্রুত ছেলের বিয়ের ব্যবস্থা করা দরকার।”

সুরমা বেগম কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন,
“হঠাৎ বিয়ের কথা আসছে কেন?”

তওহীদ সাহেবের চোখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। তিনি বললেন,
“ছেলে অসুস্থ। বাবা-মার দায়িত্ব তো রয়েছেই। তাকে দেখাশোনা করার জন্য একটি জীবনসঙ্গিনী এনে দেওয়া প্রয়োজন।”

সুরমা বেগমের মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠলো। বললেন;

“একদম মনের কথা বলেছো। ছেলের বাবা, তুমি দ্রুত মেয়ে খোঁজো। আহিয়াদের বিয়ে নিয়ে আমিও ভাবছিলাম।”

মীরাতের মুখশ্রী মলিন হয়ে উঠলো। সামনে তার হাজবেন্ডের বিয়ের কথা হচ্ছে।এই চিন্তা করতেই যেনো তার চোখের পানি গড়িয়ে পরতে চাইছে। আহিয়াদ এখনো চুপ কেন, সে বুঝতে পারছে না। আদৌ কি তাদের বিয়ে হয়েছে, এই সত্যটি কি সকলের কাছে বলবে? অজানা আতঙ্কে তার বক্ষ কাঁপছে।

মীরাতের মনে শঙ্কার তরঙ্গ উঠতে লাগলো। তার হৃদয় তীব্র অস্থিরতায় জর্জরিত। তড়িৎ বেগে সে তাকালো আহিয়াদের দিকে। তার চাহনির মধ্যে উত্তর খুঁজছে। অপেক্ষায় রইলো।সেদিনের জন্য, যখন সমস্ত কিছু স্পষ্ট হবে, হৃদয়ের সব কষ্ট নিঃশ্বাসের সঙ্গে বের হয়ে যাবে। আহিয়াদ কি কোনো সিদ্ধান্ত নেবে? মীরাতের মনে একটি প্রবল আশা জাগছে, কিন্তু সেই আশা কি সত্যি হতে পারবে?

আহিয়াদ তাকায় মীরাতের মলিন মুখশ্রীতে। চোখের কোণে অশ্রু কণার ভীড়। তার দিকেই অজানা আতংক চেপে রেখে কেমন তাকিয়ে আছে। আহিয়াদ তওহীদ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো;
“ হঠাৎ আমার বিয়ে নিয়ে ভাবছো কেনো বলো তো”?

তওহীদ সাহেব অবাক হওয়ার ভাণ করে বললেন;
“ বিয়ের বয়স,হয়েছে তোমার।তাই তো বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছি।”

“ আমারও সারাদিন একা একা থাকতে ভালো লাগে না। বোবার মতো থাকতে হয়। একটা পুত্রবধু হলে কথা বলার মানুষ পেতাম।”

সুরমা বেগমের কন্ঠে হতাশার সুর। তওহীদ সাহেব বলেন ;
“ তোমার কথা বলার সঙ্গীর ব্যবস্থা করছি দ্রুত। জেনির বাবা কল দিয়েছিলেন। তিনি চাইছেন দ্রুত আহিয়াদের সাথে জেনিরো বিয়েটা দিয়ে দেই। ”

সুরমা বেগম অবাক হয়ে বললেন;
“ জেনির বাবা সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেছেন?”

তওহীদ সাহেব নিশ্চিন্ত কন্ঠে উত্তর দিলেন;
“ কিছুদিন আগে ফিরেছেন। জেনির বিয়ে দিয়ে আবারও ব্যাক করবেন সিঙ্গাপুরে। ”

মীরাত যেনো থমকে গেল তখনই। পুরো দুনিয়া উলোট পালোট হয়ে গেলো তার। জেনির বিয়ে আহিয়াদের সাথে? কীভাবে সম্ভব? তাহলে কি আগে থেকেই বিয়ে ঠিক ছিলো? সেকি তবে হঠাৎই উড়ে এসে জুড়ে বসেছে আহিয়াদের জীবনে। তবে কেনো আহিয়াদ তাকে আগে বললো না জেনির সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে? বক্ষে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে সে।শ্বাস আঁটকে আসছে। সে হাসফাস করতে লাগলো। আবারও সে ঠকে গেলো এই নিষ্ঠুর শহরে? সূচনার শুরুতেই পরিসমাপ্তি ঘটলো তবে!জীবনের এই অস্থিরতায়, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা বিভ্রান্তির অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা দুঃখ ও অসহায়ত্বের অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করে রাখছে—এখন সে কোথায় যাবে?

“ জেনি আপুর সাথে কি বিয়ে আগে থেকে ঠিক করা ছিলো?”

অতি কষ্টে কম্পনরত কন্ঠে আওড়ালো মীরাত। সেই কন্ঠে ছেয়ে ছিলো মলিনতা আর বিষাদের সুর। সুরমা বেগম উত্তর দিলেন ;
“ এক মাস আগে দুই পরিবারের সম্মতি আহিয়াদ আর জেনির বিয়ে ঠিক করা হয়। এই বিষয়ে আমরা ছাড়া আর কেউ জানে না। ”

মীরাত আহিয়াদের দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালো। আহিয়াদকে নির্লিপ্ত শান্তভাবে বসে থাকতে দেখে যেন তার ভেতরের বিষন্নতা আরও গভীর হতে লাগলো। সে অনুভব করলো, আহিয়াদের এই নির্লিপ্ততা তার হৃদয়ে এক অজানা যন্ত্রণা সৃষ্টি করছে।মনের ভারে জর্জরিত হয়ে, সে আর সেখান থেকে বসে থাকতে পারলো না। এক ধরনের অদ্ভুত তাড়নায়, ভারাক্রান্ত মনে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

আহিয়াদ অপলক চেয়ে রইল মীরাতের দিকে। পরিস্থিতির গ্যারাকলে পরে আজ সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেছে।

★★
রাত এগারোটা বেজে বিশ মিনিট। মীরাতের চোখে ঘুম নেই। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। মনের মাঝে অশান্তির তুফান বইছে। ডাইনিং রুম থেকে ফিরে ওয়াশরুমের দরজা আঁটকে রেখে বেশ অনেকটা সময় নিঃশব্দে কান্নাকাটি করেছে। কান্নার কারণে তার চোখ-মুখ ফুলে গেছে, চোখ লাল হয়ে উঠেছে।

রাতে সুরমা বেগম খাওয়ার টেবিলে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কি হয়েছে?” কিন্তু মীরাত মিথ্যা বলে বিষয়টি চেপে গেছে। অভিমান আর রাগের কারণে আহিয়াদের সাথে সুযোগ বুঝে কথা বলেনি। সে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।আগামীকালই সে তার গ্রামের বাড়ি চলে যাবে। আর এই শহর কিংবা আহিয়াদের জীবনে থাকবে না।

মনের গভীরে এই সংকল্প নিয়েই সে পাশে ফিরে তাকালো ফাবিহার দিকে। রুমের হালকা আলোয় দেখতে পেল ফাবিহা গভীর ঘুমে বিভোর। মীরাত নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। ভালোভাবে ওড়না জড়িয়ে নিলো শরীরে।ধীর পায়ে সে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। এখন তার প্রতিটি পদক্ষেপে নতুন শুরু এবং অশান্তির অবসান ঘটাতে পারে। দরজা খুলে সে রওনা দিল আহিয়াদের রুমের উদ্দেশ্যে।

ফাবিহার রুম থেকে বেরোতেই দেখলো আহিয়াদ মেইন দরজার দিকে যাচ্ছে সেও পিছু পিছু গেলো। আহিয়াদ মেইন দরজা ভিড়িয়ে ছাদের দিকে গেলো। মীরাত যাবে কি যাবে না ভাবতে লাগলো। দোটানায় পরে গেলো সে। আজ কথাটা বলেই ছাড়বে সে। তাই সাহস সঞ্চার করে দরজা খুলে ছাদের দিকে গেলো।

আহিয়াদ ছাদের একপাশে অবস্থিত তালাবদ্ধ রুমটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চাবি সে পকেট থেকে বের করে তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। রুমের ভিতর ঢুকতেই দরজা আঁটকে দেয়। ফ্যান অন করে দেয়ার পর ঘরটা একটু একটু করে প্রাণ ফিরে পেতে লাগল।
টেবিল থেকে এয়ারফ্রেশনার নিয়ে রুমে স্প্রে করলো। বেশ কয়েকদিন তার এই রুমে আসা হয়নি, ফলে বদ্ধ অবস্থায় থাকা কারণে ভেপসা গন্ধ নাকে এসে লাগছে।

রুমটি বেশ বড় নয়, মাঝারী আকারের হবে হয়তো। আহিয়াদ নিজ হাতে পরিকল্পনা করে এই রুমটি বানিয়েছে। এখানে বেশী কিছু নেই—একটি সিঙ্গেল বেড, টেবিল, চেয়ার এবং টেবিলে একটি পিসি ও গিটার। তবে এই সরল জিনিসগুলোর মধ্যেও তার সৃষ্টিশীলতার প্রতিফলন ধরা পড়ে।সে রুমটাকে সুন্দরভাবে সাজিয়েছে। যে কেউ এসে দেখলে ভালো লাগবে রুমটা। প্রতিটি কোণায় তার স্বপ্ন, আর আবেগ মিশে রয়েছে। রুমের দেয়ালগুলোতে প্রিয় ছবি, টেবিলে সাজানো বই এসবই আহিয়াদের নিজস্ব জগতের পরিচায়ক। ঘরটি তার চিন্তার প্রতীক, যেখানে সে একান্তে সময় কাটাতে পারে, নিজেকে খুঁজে পেতে পারে।আহিয়াদ মাঝে মাঝে এই রুমে এসে একাকী সময় কাটায়। এই নিরাপদ স্থানটি তার অন্তর্দ্বন্দ্বের রক্ষা কবচ। এখানে কারো আসা একেবারেই নিষিদ্ধ; সে কাউকে কখনো প্রবেশ করতে দেয়নি,এমনকি পরিবারের সদস্যদেরও না।

আহিয়াদ বিছানায় শুয়ে পড়লো।এখানে আসলে সময়ের পরিসীমা ভুলে যেতে পারে। চারপাশের শান্তিতে, দেয়ালের দিকে তাকিয়ে তার মনে এক ধরনের মুক্তির অনুভূতি জাগছে।আজ সে এখানেই কাটাতে চায়। বাইরে চলতে থাকা জীবন, মানুষের হাসি-কান্না, সকল কিছু দূরে চলে গেছে। রুমের নীরবতা তার হৃদয়ের গভীরে নেমে আসে আর সে নিজেকে খুঁজে পেতে চায় এই একাকীত্বের মাঝে। ঘরের মধ্যে গিটারটি তার পাশে।এটি তার সঙ্গী, যখন কেবল সুরের প্রয়োজন হয়।এখানে এসে তার মন শান্ত হয়; অনুভব করে, এই ছোট্ট জায়গাটি তার জীবনের কঠিন বাস্তবতার আশ্রয়স্থল।

রাতের আকাশে মেঘের আনাগোনা। ভরা অন্ধকারে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। আকাশের বুক চিরে ঝলক আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে আকাশের বুকে। হঠাৎ বাতাসের বেগও বৃদ্ধি পেয়েছে। শো শো করে বাতাসের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। প্রকৃতি আজ নিজেই মহাকাব্য রচনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই বেগবর্ধিত বাতাসের মধ্যে চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছে রাতের নীরবতা।
এর মাঝেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। প্রথমে কয়েকটি ফোঁটা তারপর একে একে ছড়িয়ে পড়লো বৃষ্টির পশলা। শহরের পিচঢালা রাস্তায় পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলো অশ্রুরোধ সমতুল্য।বৃষ্টির শোভা নিত্যনতুন গল্পের সূচনা করছে। শহরের জীবন, গাছপালা, সকলেই বৃষ্টির এই আগমনে আনন্দিত। মেঘলা আকাশের নীচে, এই বৃষ্টির মালা শহরকে স্নিগ্ধতার সুরে মোড়াতে শুরু করেছে, সব দুঃখ ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য অতিমানবীয় অভ্যর্থনা।

মীরাত মাত্রই আহিয়াদের ছাদের রুমটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎই আকাশের কালো মেঘগুলো একত্রিত হয়ে বৃষ্টি নামাতে শুরু করলো। বৃষ্টি রিমঝিম করে সমস্ত শহরকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। মীরাত হচকচিয়ে গেলো হঠাৎ বৃষ্টি আসায়।বৃষ্টির তির্যক ফোঁটাগুলো তার শরীরে পড়তে লাগলো। কোনো দিশা না পেয়ে সে হতাশায় দরজা ধাক্কাতে লাগলো।কিছুটা সময় পর দরজা খুলে গেলো। গর্জে ওঠা বজ্র আকাশও তার আহ্বান শুনে অনুমতি দিয়েছে। মীরাত আর দেরী না করে, তড়িঘড়ি আহিয়াদকে টপকে ভেতরে প্রবেশ করলো।

আহিয়াদ অবাক হয়ে গেলো মীরাতের এহেন কান্ডে। তার চোখে বিস্ময়ের চিত্র ফুটে উঠল। মুখাবয়বে গাম্ভীর্য ভাব ছড়িয়ে পড়লো।

“তুমি এখানে কি করছো?”

মীরাত আধভেজা অবস্থায় দাঁড়িয়ে। ভিজে ওড়না দিয়ে শরীর মুছতে মগ্ন হয়ে আছে।মনে হচ্ছে বৃষ্টির পানি থেকে মুক্তি পেতে চাইছে। আহিয়াদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো,
“তোয়ালে আছে?”

“তোয়ালে?”

মীরাত চরম বিরক্ত হলো। তার মুখাবয়বে অসহিষ্ণুতা ফুটে উঠলো। সশ্রদ্ধ কণ্ঠে বললো,

“আরে আমাকে খেয়াল করুন আগে! দেখুন আপনার বউ ভিজে গেছে। দ্রুত তোয়ালে দিন। নাকি এভাবেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবেন মশাই?”

আহিয়াদ হঠাৎ করে তার এহেন উত্তেজনার জন্য আশ্চর্য হয়ে বললো,
“এখানে তোয়ালে কোথায় পাবো?”

মীরাতের মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। কোনো উত্তর না দিয়ে সে দ্রুত ওড়না দিয়ে শরীর আর মাথা মুছতে লাগলো।। এভাবে থাকলে নিশ্চিত জ্বর আসবে এ চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে নিচেও নামতে পারবে না।হতাশা নিয়ে সে অবশেষে বেডে বসে পড়লো।

রুমের দরজা খোলা থাকায়, বৃষ্টির পানির ছিটেফোটা ভিতরে প্রবেশ করছে। আহিয়াদ ঠিক তখনই দরজা বন্ধ করে দিলো। সে চেয়ার টেনে সামনে বসলো, ভ্রূযুগল কুঁচকে মীরাতের দিকে তাকালো।তার মনে একটি প্রশ্ন ঘুরছে।মীরাত কি সত্যিই তার পিছু নিয়েছে? কি কারণে সে এখানে এসেছে? এই প্রশ্নগুলো আহিয়াদের মনে নানান ভাবনা সৃষ্টি করছে।

“আমার দিকে এমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কেনো মশাই?”

মীরাতের কণ্ঠে তীক্ষ্ণতা। তার চোখ দুটি ছোট ছোট হয়ে গিয়ে আহিয়াদের দিকে আক্রমণাত্মকভাবে তাকালো।

আহিয়াদের কোনো হেলদোল দেখা গেলো না; সে কেবল সন্দিহান কণ্ঠে বললো,
“আমাকে অনুসরণ করে এখানে কেনো এসেছো?”

মীরাত কিছুটা ব্যঙ্গাত্বক কন্ঠে বললো,
“আপনি রাতের বেলায় কোথায় যান, তা খেয়াল রাখবো না? ছেলেদের ওপর বিশ্বাস নেই। তাই আরকি, আপনাকে চোখে চোখে রাখছি।”

মীরাতের ব্যবহারে পরিবর্তন দেখে আহিয়াদ হতভম্ব হয়ে গেলো। এই মেয়ের আজ হলো টা কি? হঠাৎ এতো পরিবর্তন?

“ এসব কি বলছো?”

“ আপনার মতলবটা বলুন আগে।”

“ মানে?”

“ ঘরে বউ রেখে আরেকটা বিয়ের পায়তারা করছেন মশাই! একটা কথা শুনে রাখুন আমি থাকতে আপনাকে আমার সতীন আনতে দেবো না।”

“ হোয়াট? এসব কি বলছো তুমি?”

“ জেনি না ফেনি ওই মেয়েকে যদি বিয়ে করতে চান আমি কিন্তু চুপ থাকবো না। ভেবেছিলাম কাল একবারে গ্রামে চলে যাবো। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছি। নতুন করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওই জেনিকে বিয়ে করতে দেবো না। এই বিয়ে আটকাতে দরকার হয় আইনী ব্যবস্থা নেবো। যদি তাতেও কাজ না হয় শাহবাগে রাস্তায় বসে অনশন করবো।”

আহিয়াদের গম্ভীর মুখ হাস্যজ্জল হয়ে উঠলো।সে মীরাতের কথা শুনে হু হা করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। মীরাত বোকার মতো আহিয়াদের দিকে তাকিয়ে রইল।

[আজকের পর্বে সকলে সর্বোচ্চ রিয়েক্ট, কমেন্ট করবেন।]

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here