#অব্যক্ত প্রেমাসুখ❤️🔥
#আদ্রিতা নিশি
২৮.[ স্পেশাল পর্ব ]
[কপি করা নিষিদ্ধ ❌]
সন্ধ্যার পরে রিসেপশন এর কার্যক্রম শেষে সকলে আহিয়াদের ফ্ল্যাটে এসেছে। কিন্তু আজ কেউ থাকবে না। কারণ ছুটি নেই। আহিয়াদের বড় মামা,ছোট মামা, মীরাতের মা সহ সকলে রাতেই নিজেদের গন্তব্যে রওনা দিয়েছে। অতিথিদের মধ্যে শুধু জেহফিল, আরিশা আর নিহাল রয়েছে। কিছুক্ষণ আগেও ফ্ল্যাটটা মানুষে পরিপূর্ণ ছিল অথচ এখন নিরব আর শূন্য। আজ সারাদিন সকলের ওপর বেশ ধকল গিয়েছে। যে যার মতো রেস্ট নিতে ব্যস্ত। পুরো ফ্ল্যাটজুড়ে মরিচ বাতি দিয়ে লাইটিং করা হয়েছে। আর্টিফিশিয়াল ফুল দিয়ে প্রতিটি ফ্লোর সাজানো। দেখে মনে হচ্ছে সদ্য সাজানো বিয়ে বাড়ি।
আহিয়াদের রুম আজ ফুল দ্বারা পরিপূর্ণ। গোলাপ রজনীগন্ধা আর আর্টিফিশিয়াল ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো রুম। কাঁচা ফুলের গন্ধে পুরো রুম ম-ম করছে। বিছানা সংলগ্ন দেয়ালে বড় আকারের ফটোফ্রেম ঝুলছে। সেখানে মানব মানবী একে অপরকে দেখতে ব্যস্ত। লাল শাড়ি পরিহিতা নববধূ রুপে মানবী লজ্জামিশ্রিত হাসিতে মাতোয়ারা করে তুলেছে শেরওয়ানি পরিহিত মানবকে। মানবটি সেই হাসিতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। কমিউনিটি সেন্টারে সদ্য তোলা ছবিটি এক ঘন্টার মধ্যেই স্থান পেয়েছে কপোত কপোতীর রুমে। লক্ষণীয় বিষয় হলো ছবিটির এককোণে ইংরেজি অক্ষরে লেখা :❝Our forever starts here.❞ অসাধারণ সেই বাক্যটুকু। বিছানায় লাল খয়েরী মখমলে চাদর। বিছানার মাঝখানে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে হার্ট শেপ আঁকানো। তার মাঝখানে A &M forever লেখা। সেই লেখার পাশেই দুটো লাল গোলাপ আর একটি ছোট আকৃতির বক্স দৃশ্যমান। তার পাশেই ছোট সাদা ফুল আর গোলাপ দ্বারা তৈরী এক জোড়া গাজড়াও রয়েছে। বিছানার পাশে ছোট টেবিলটায় ক্যান্ডেল জ্বলছে বেশ কয়েকটি। রুমের জানালা খোলা থাকলেও পর্দা দিয়ে ঢাকা পুরোটা। সেই পর্দার সাথে ফেয়ারি লাইট জ্বলছে একটু থেমে থেমে। টিপটাপ বিভিন্ন রকমের আলো রুমের সৌন্দর্য দ্বিগুন বাড়িয়ে তুলেছে।
ফাবিহা মীরাতকে নিজ হাতে সাজিয়েছে। তবে বেশী সাজ নয় একদম হালকা সাজ। গোলাপী রঙের জামদানী শাড়ি আর হাতে, কানে, গলায় হালকা কারু কাজের গহনা পড়িয়েছে। আরিশা মীরাতের লম্বা ঘন চুলগুলো স্টাইল করে বেঁধে খোপা করে দিয়েছে আর কয়েকটা গোলাপও গুঁজে দিয়েছে সেই খোঁপায়। মীরাতের সাজসজ্জা শেষ হয়েছে। আরিশা মীরাতকে আয়না এনে দেখালো কেমন সাজিয়েছে। মীরাত শুধু হাসল দেখে কিন্তু কিছু বলল না। আরিশা আয়না রেখে দিল। তারপর সে আর ফাবিহা মিলে মীরাতকে নিয়ে আহিয়াদের রুমের দিকে গেল।প্রথমে ফাবিহা রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। তারপর মীরাত আর আরিশা ঢুকল। আচানক ফুলের গন্ধ পেয়ে মীরাত ভালোভাবে রুমের দিকে তাকাল। তাকাতেই বিস্ময়ে তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ফুল দিয়ে এতো সুন্দর করে রুম সাজানো দেখে সে হতবাক। মনে হচ্ছে কোনো ফুলের রাজ্যে চলে এসেছে।
মীরাত পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিলো একবার।তারপর বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠল ;
“ এতো সুন্দর করে রুম কে সাজিয়েছে? ”
ফাবিহা মীরাতের অবাক হওয়া মুখশ্রী দেখল। মুচকি হেসে বলল ;
“ ভাইয়া স্পেশালি তোমার জন্য ডেকোরেশন করিয়েছে। ওই দেখো তোমাদের দুজনের ছবি। ”
ফাবিহার কথামতো মীরাত দেয়ালের দিকে তাকায়। আহিয়াদ আর তার সুন্দর একটা ছবি ঝুলছে। এটা দেখে আরও বেশী অবাক হলো। মীরাতের মনে পড়ে আজকের বিকেলের কাহিনী। পুলিশ ইফতির বাবা আর জেনির বাবাকে গ্রেফতার করেছে। জেনিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য নিয়ে গেছে। কমিউনিটি সেন্টারের সকলে অবগত হয়েছে কেন তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রথম থেকে পুরো কাহিনী শুনেছে সেখানে উপস্থিত মেহমানগণ। সকলে সব শুনে হতভম্ব হয়ে গেছে। মীরাত ও অবাক হয়েছে। তখন জেনিকে চোখের সামনে দেখে তার রাগ লাগছিল। মনে হচ্ছিল একদম ঠিক করেছে আহিয়াদ জেনিকে বিয়ে না করে। সেই ওই ঠকবাজ মেয়ের জন্য কষ্ট পাচ্ছিল ভাবতেই রাগ হচ্ছিল। সেই সময় শুনতে পায় আহিয়াদ কাউকে ফোনে কোনো ছবির কথা বলছে। তাহলে এই ছবির কথাই বলছিল।
“ মীরাত তুই বিছানায় বস। আমরা বাহিরে যাচ্ছি। ”
আরিশার কথা শুনে মীরাতের ধ্যান ভাঙে। আরিশার দিকে তাকিয়ে বলে ;
“ আহিয়াদ না আসা পর্যন্ত এখানেই থাক। বসে বসে গল্প করি। ”
আরিশা ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল;
“ তোর কাছে থাকলে আমাদের বড় লস হয়ে যাবে। তুই থাক আমরা গেলাম। ”
আরিশা কথা সম্পূর্ণ করে ফাবিহাকে টেনে নিয়ে বাহিরে চলে গেল। সাথে সাথে দরজাও বন্ধ করে দিল। মীরাত চুপচাপ বিছানার কাছে এগিয়ে গেল। পা উঠিয়ে বসল বিছানার একপাশে। পাশে তাকাতেই চোখ পড়ল গোলাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে আঁকানো হার্ট শেপের ভেতরের লেখার দিকে।
:
ফাবিহা আর আরিশা আহিয়াদের রুমের সামনে পায়চারি করছে। অপেক্ষা করছে আহিয়াদ কখন আসবে তার জন্য। দুজন প্ল্যান করেছে টাকা না দিলে রুমে ঢুকতে দিবে না। প্রায় আধা ঘন্টা হয়ে গেল এখনও আহিয়াদের আসার নাম নেই। ফাবিহা আর আরিশা বেজায় বিরক্ত হলো। দুজনে আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে ধপ করে বসে পড়ল মেঝেতে। মন ভার করে অপেক্ষা করতে লাগল।
সময় দশটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট। আহিয়াদ বাহির হতে এসেছে। তার সাথে নিহাল আর জেহফিল রয়েছে। এতোটা দেরি হওয়ার কারণ কমিউনিটি সেন্টার থেকে সরাসরি তারা পুলিশ স্টেশনে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে কেস ফাইল করেছে। তারপর নানা ঝামেলা পুহিয়ে তারপর এসেছে। তারা তিনজনে বেশ ক্লান্ত। আহিয়াদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে এসে নিজের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ফাবিহা আর আরিশাকে নিচে বসে গল্প করতে দেখে কপাল কুঁচকে গেল। এরা তার রুমের সামনে বসে করছে কি?জেহফিল আর নিহালেরও একই অবস্থা হয় আরিশা আর ফাবিহাকে দেখে।
আহিয়াদ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল ;
“ তোরা দুজন মেঝেতে বসে কি করছিস?”
হঠাৎ কারো কন্ঠস্বর শুনে ফাবিহা আর আরিশা চুপ হয়ে। সামনে তাকাতেই আহিয়াদকে দেখতে পায়। দুজনে তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। ফাবিহা হেসে আহিয়াদের সামনে হাত মেলে ধরে বলে ;
“ তাড়াতাড়ি আমাদের পাওনা মেটাও।”
আহিয়াদ কপাল কুঁচকে শুধালো ;
“ কিসের পাওনা? ”
আরিশা আর ফাবিহা মিটিমিটিয়ে হেসে একসাথে বলল;
“ টাকা না দিলে রুমে যেতে দেব না। ”
আহিয়াদ ভ্রু বাঁকিয়ে বলল;
“ আরিশা তোকে গতবার পনেরো হাজার দিয়েছি। এবার আর দিতে পারব না। ”
ফাবিহা মুখ গোমড়া করে বলল;
“ আমাদের তো দাও নি। ”
“আমাদের? আর কার কথা বলছিস? ”
“ নিহাল ভাইয়া। ”
আহিয়াদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নিহালের দিকে। নিহাল কিছু শুনেনি এমন ভাব করে অন্যদিকে তাকিয়ে রয়। আহিয়াদ বুঝল টাকা না দিলে রুমে যেতে দেবে না। শরীর তার ক্লান্ত ভীষণ ফ্রেশ হতে হবে দ্রুত। অধৈর্য্যের সহিত বলল;
“ কত লাগবে?”
ফাবিহা উচ্ছসিত কন্ঠে বলল;
“ ত্রিশ হাজার হলেই হবে। ”
আহিয়াদ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল। ত্রিশটা হাজার টাকার নোট বের করে ফাবিহাকে ধরিয়ে দিল। ফাবিহা আর আরিশা খুশি হয়ে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। আহিয়াদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে ধপ করে দরজা বন্ধ করে দেয়।
ফাবিহা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল ;
“ গাইস আমার রুমে সবাই আসো। এখন টাকা ভাগাভাগি করব। ”
কথাটা বলেই ফাবিহা উচ্ছসিত হয়ে দৌড়ে নিজের রুমে গেল। আরিশা আর নিহালও গেল পিছু পিছু। জেহফিল আর যায় না। সে ছাঁদের দিকে রওনা হয়।
:
মীরাত পুরো রুম দেখতে ব্যস্ত থাকলেও অপেক্ষা করছিল আহিয়াদের জন্য। রাত দশটা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। হঠাৎ দরজা বন্ধ করার শব্দে মীরাত চমকে উঠে। আতংকিত হয়ে তাকায় দরজার দিকে। আহিয়াদকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে শান্ত হয় তার মন। আহিয়াদ এসে বিছানার পাশের ছোট টেবিলে ফোন আর মানিব্যাগ রাখে। তারপর আলমারি থেকে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। তবে ওয়াশরুমের দরজা লাগানোর আগে মীরাতকে বলে ;
“ আমি খেয়াল করেছি তুমি রুমে আছো। ফ্রেশ হয়ে এসে কথা বলছি। ”
আহিয়াদ দরজা আঁটকে দেয়। মীরাত হতভম্ব হয়ে শুধু দেখল। আজ আবারও মনে পড়ে গেল বিয়ের সেই রাতের কথা। আহিয়াদ তাকে রুমে দেখেও ইগনোর করেছিল। সেদিন তেমন কথাও বলেনি। কিছুক্ষণ পরেই আহিয়াদ ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসে। পরণে শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি আর টাউজার। চুলগুলো ভেজা, এলোমেলো হয়ে কপালে এসে পড়েছে। মীরাত অপলক চেয়ে রইল আহিয়াদের দিকে। শুভ্র পাঞ্জাবিতে মানুষটিকে মোটেও মন্দ লাগছে না। অদ্ভুত এক সৌন্দর্য যেন ঘিরে ধরেছে।
আহিয়াদ মীরাতের চাহনি লক্ষ্য করে। সে পা গলিয়ে বিছানায় বসা মীরাতের দিকে যায়। দু’হাতে চুল ঠেলে পেছনের দিকে দেয়। তারপর স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“ চলো একসাথে নামাজ পড়ি। ওযু করেছো?”
মীরাত তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে নেয়। লজ্জায় মুখ নিচু করে অস্পষ্ট স্বরে বলল;
“ হুম। ”
আহিয়াদ আর কিছু বলে না। দুটো জায়নামাজ বের করে। মীরাত বিছানা থেকে নেমে আসে। আহিয়াদ তার হাতে জায়নামাজ ধরিয়ে দেয়। মীরাত মাথায় আঁচল টেনে সুন্দর করে মাথা ঢেকে নেয়। তারপর দুজনে একসাথে নামাজ পড়তে শুরু করে।
কিছুক্ষণ আগেই নামাজ শেষ করছে দুজনে। মীরাত বিছানায় বসে আছে চুপচাপ। তবে তার দৃষ্টি আহিয়াদের দিকে। মূলত কি কাজ করছে তা দেখতে ব্যস্ত। আহিয়াদ মীরাতের সামনে বসে আছে। হাতে তার একটা ছোট বক্স।আহিয়াদ মীরাতকে উদ্দেশ্য করে বলল;
“ হাত এইদিকে দাও।”
মীরাত আহিয়াদের কথামতো হাত বাড়ায়। আহিয়াদ সেই বক্স থেকে আংটি বের করে মীরাতের হাতে পড়িয়ে দেয়। সোনার আংটি তার হাতে অনেক ভালো মানিয়েছে। ডিজাইনটাও অনেক সুন্দর। মীরাত হাতে জ্বলজ্বল করছে আংটির দিয়ে তাকিয়ে ওষ্ঠ প্রসারিত করে বলল;
“ অনেক সুন্দর হয়েছে। নিশ্চয়ই এটা আপনার পছন্দের? ”
আহিয়াদ কিছুটা অবাক হয়ে বলে ;
“ কীভাবে বুঝলে?”
মীরাত সরাসরি আহিয়াদের চোখে চোখ রাখে। মৃদু হেসে বলে ;
“ বুঝে গেলাম। ”
আহিয়াদ সরু চোখে তাকায়। মীরাত তখনও হাসছে। সে আংটি দেখে বুঝে ফেলেছিল এটা আহিয়াদ তার জন্য কিনেছে। আহিয়াদ বিছানার ওপরে থাকা বক্সটি হাতে নেয়। মীরাত ভ্রু কুঁচকায়। এই বক্সে আবার কি আছে? কৌতুহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করল ;
“ এটা কি? ”
আহিয়াদ কিছু না বলে হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। মীরাতের মাথা থেকে আঁচল নামিয়ে দেয়। মীরাত চমকে যায়। কিছুটা ভয়ও পায়। ওখান থেকে সরে যাবে এমন সময় ভেসে এলো স্নিগ্ধ শান্ত স্বর;
“ নড়াচড়া না করে চুপচাপ বসে থাকো। আমি যা করছি করতে দাও। ডোন্ট ডিস্টার্ব মি বউ।”
“বউ” শব্দটি শ্রবণ হতেই মীরাত চুপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। কিছুটা ভয় আর অদ্ভুত অনুভূতির মিশ্রণে সে কাবু। বুকের মাঝে ধকধক করছে। আহিয়াদ বক্স হতে হোয়াইট গোল্ডের একটা চেইন সাথে লকেট রয়েছে সেটি বের করল। লকেট হার্ট শেপের। তার মাঝে A লেখা। সে আস্তেধীরে সযত্নে মীরাতের গলায় পড়িয়ে দেয়। তারপর শান্ত কন্ঠে বলে ;
“আমার তরফ থেকে ছোট্ট একটা গিফট তোমার জন্য। আমায় যতদিন ভালোবাসবে ততদিন নিজের কাছে সযত্নে রেখে দিও। ”
মীরাত সেই লকেটে হাত রাখে। আহিয়াদের কথায় কিছু একটা ছিল। বুকে যেন নিরব ঝড় বয়ে গেল। সে এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকায় আহিয়াদের দিকে। আহিয়াদ বসেছে তার সামনে। অতি স্বাভাবিক আর শান্ত ভঙ্গিতে তার দুহাতে গাজরা পড়িয়ে দিচ্ছে।
মীরাত অশান্ত ভঙ্গিতে শুধালো;
“আপনি লাস্টের কথাটা ওমন ভাবে কেনো বললেন?”
আহিয়াদ গাজরা বাঁধা শেষ করে স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“ কীভাবে বলেছি?”
মীরাত বিষন্ন মনে বলল;
“ওইভাবে না বলে যদি বলতেন সারাজীবন ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে যত্নে রেখে দিতে তাহলে আমি স্বাভাবিক ভাবে নিতাম। আপনার বলা কথায় মনে হচ্ছে আমি হয়তো সময় দেখে কয়েকবছর ভালোবাসবো আপনাকে।তারপর দুজনে আলাদা হয়ে যাবো। ”
আহিয়াদ গলা খাদে নামিয়ে বলল;
“আমি জানি তুমি কখনও আমায় ছেড়ে যাবে না। তুমি বুঝতে ভুল করেছো। বলেছি যতদিন আমায় ভালোবাসবে ততদিন আগলে রেখো। তুমি আমায় সারাজীবন ভালোবাসলে আমার দেওয়া চিহ্নটাও সারাজীবন আগলে রাখবে। বুঝেছো বউজান। ”
মীরাত দুদিকে মাথা নাড়িয়ে ইশারা করে বুঝেছে। আহিয়াদ মজা করে বলে ;
“ রিটার্ন গিফট কই আমার? ”
মীরাত অবাক হয়ে বলল;
“ আমি তো জানি বর বউকে গিফট দেয়। ”
“আমি নিয়ম একটু চেঞ্জ করলাম। রিটার্ন গিফট দাও। ”
মীরাত পড়েছে ভীষণ বিপাকে। সে তো কোনো গিফট কিনেনি আহিয়াদের দিকে। মুখ গোমড়া করে ভাবতে লাগল কি দেওয়া যায়।তার চোখ পড়ল বিছানার ওপর থাকা দুটো গোলাপের ওপর।সে হাতে তুলে নিল তখনই।
মীরাত ফুল দুটো হাতে নিয়ে আহ্লাদিত হয়ে আহিয়াদের দিকে দিয়ে বলল;
“ আপনার গিফট। ”
আহিয়াদ দুষ্টুমিরস্বরে বলল;
“এমনভাবে নয়। গোলাপ দিলে কি বলতে হয় সেটা বলে দাও। ”
মীরাত মেকি রাগ দেখিয়ে বলল;
“বলব না। ”
“তোমার গিফট তুমিই রাখো তাহলে। ”
“আরে রাগ করছেন কেনো? আপনি বুঝছেন না কেনো আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে।”
“ আমার সামনে লজ্জা পেয়ে লাভ নেই। দ্রুত বলে ফেলো। আই কান্ট ওয়েট। ”
মীরাত দুবার শ্বাস টেনে নিলো। স্থির করল সে আজ বলবেই। কন্ঠনালী কাঁপছে ভীষণ। হাত, পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বুকের মাঝে মনে হচ্ছে ঢাক ঢোল পেটাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো যুদ্ধ করতে যাচ্ছে। ওষ্ঠ ভিজিয়ে নেয়। মুঠোবন্দি গোলাপ আহিয়াদের দিকে বাড়িয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করে দ্রুততার সহিত আওড়ায়;
“আই লাভ ইউ আহিয়াদ। আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি। আপনি কি আমার সারাজীবনের সুখ, দুঃখের সাথী হতে প্রস্তুত!”
আহিয়াদ মীরাতের হাত থেকে ফুল নিয়ে নেয়। সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে প্রতিত্তোর করে;
“আই লাভ ইউ টু বউজান। আমিও আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি। যেদিন কবুল বলে আপনাকে আপন করেছিলাম ঠিক সেদিন থেকে সারাজীবন আপনার পাশে থাকার ওয়াদায় নিজেকে আবদ্ধ করে নিয়েছিলাম। ”
মীরাত চোখ খুলে তাকায়। “আপনি ” সম্বোধন মীরাতকে মুগ্ধ করল। সে কখনও আহিয়াদের মুখে আপনি সম্বোধন শোনেনি।আহিয়াদ মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চাহনির তীক্ষ্ণতায় মীরাত আর তাকিয়ে থাকতে পারল না নজর ঘুরালো।
“ভালোবাসা কি আমার জানা নেই। তবে আমার কাছে ভালোবাসা হলো কোনো অচেনা মানবীর অশ্রুসিক্ত চোখের চাহনিতে হঠাৎ থমকে যাওয়া।”
আহিয়াদ কিছুটা মৌন রইল। তারপর আবারও বলল;
“ তোমার অশ্রুসিক্ত চোখের চাহনিতে এক মুহুর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। সেই চাহনি আজও ভুলতে পারিনি। চোখ বন্ধ করলেই সেই দৃশ্য চক্ষুপটে ভেসে ওঠে। ”
মীরাতের মাঝে অদ্ভুত দোলাচল দেখা গেল। সে অশান্ত ভঙ্গিতে তাকাল।আহিয়াদের আজও মনে পড়ে সেই প্রথম দেখার কথা। হঠাৎ দেখা, হঠাৎ বিয়ে অদ্ভুত অনুভূতি সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত নিয়তি। এই ভালোবাসা ও হঠাৎ করেই হয়ে গেছে। সে কি প্রথম দেখায় ভালোবেসেছিলো? নাহহ হয়তো অশ্রুসিক্ত নয়ন, মলিন মুখশ্রী, ভগ্নহৃদয় আর অজানা কষ্টে জর্জরিত মেয়েটাকে দেখে হঠাৎ চোখ থমকে গিয়েছিল। হয়তো ভালোলাগা নয়তো ভালোবাসা। এই দুই সমীকরণে কোথাও সে আঁটকে গিয়েছিল। তবে ভাবেনি নিয়তি মীরাতকে জীবনসঙ্গিনী রুপে সারাজীবনের জন্য তার জন্য ঠিক করে রেখেছে।
মীরাত অশান্ত ভঙ্গিতে শুধালো ;
“আগে কখনো আমায় বলেননি কথাগুলো। তবে আজ কেনো বলছেন?”
আহিয়াদ মীরাতের দৃষ্টি খেয়াল করে বলল ;
“ কারণ আজ রাতটা আমাদের জন্য স্পেশাল। কিছু অব্যক্ত কথা ব্যক্ত করলেও অব্যক্ত অনুভূতি অনেক। আজ অনেক ক্লান্ত তুমি। ঘুমিয়ে পড়ো আমি লাইট অফ করে দিচ্ছি। ”
মীরাত এহেন কথায় অবাক হলো। সরু চোখে তাকিয়ে থাকলো আহিয়াদের দিকে। আহিয়াদ চোখ দিয়ে ইশারা করল শুয়ে পড়ার জন্য। মীরাত আর কিছু বলে না। সে চুপচাপ একপাশে শুয়ে পড়ে। আহিয়াদ পাঞ্জাবি পাল্টে টিশার্ট আর টাউজার পরে আসে। রুমের লাইট অফ করে মীরাতের পাশে শুয়ে পড়ে। দুজনের চোখে ঘুম নেই। দুজনেই নিজেদের জগতে নানা ভাবনায় ব্যস্ত। মীরাত একটু পর পর নড়ছে। শাড়ি পড়ে ভালোভাবে ঘুমাতে পারছে না।
আহিয়াদ তা খেয়াল করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“ শাড়ি খুলে কম্ফোর্ট ড্রেস পড়ে এসো। ”
মীরাত নিচু স্বরে উত্তর দেয়;
“নাহ আমি ঠিক আছি। ”
আহিয়াদ বিরবির করে বলল ;
“ বুঝতেই পারছি কেমন ঠিক আছো। ”
মীরাত কিছু শুনতে না পেয়ে বলল;
“কিছু বললেন? ”
“নাহ। ঘুমিয়ে পড়ো।”
“আমার শীত লাগছে। কম্ফোর্টার টা দিন। ”
আহিয়াদ বিছানায় উঠে বসে। ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে বিছানা থেকে নেমে আলমারি থেকে বের করে নিয়ে এসে মীরাতের গায়ের ওপর দিয়ে দেয়। ফোনের ফ্ল্যাশ অফ করে সে নিজেও কম্ফোর্টার জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। রাত একটা বেজে গেছে। মীরাতের চোখে ঘুম নেই। উসখুস করছে। সে উঠে ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। আহিয়াদও ঘুমায় নি। সে পাশ ফিরল। জিজ্ঞেস করল ;
“ কি হয়েছে তোমার? ”
“ঘুম আসছে না।”
“কেনো?”
“ আপনি অর্ধেক কথা বলেন আর বাকী টুকু বলেন না তাই। ”
আহিয়াদ হুড়মুড়িয়ে উঠে আধশোয়া হয়ে বসল। কিছু বুঝতে না পেরে বলল;
“ কি বলতে চাইছো? ”
“ আপনি কি আমাকে ভালোবাসতেন? সত্যি বলবেন কিন্তু। ”
আহিয়াদ মীরাতের অগোচরে বাঁকা হাসে।সে মীরাতের হাত ধরে হঠাৎ টান দেয়। মীরাত হুমড়ি খেয়ে আহিয়াদের বুকে পড়ে। সে উঠতে যাবে আহিয়াদ দুহাতে আবদ্ধ করে নেয়। মীরাত থমকে যায় একদম।
আহিয়াদ ফিসফিসিয়ে বলে ;
“এবার বলবো?”
মীরাত চুপ করে থাকে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনলো। এর মাঝেই শোনা গেল আহিয়াদের কন্ঠস্বর।
“ হয়তো ভালোলাগা নয়তো ভালোবাসা ছিল। এই দুই সমীকরণে আঁটকে ছিলাম। তবে সমীকরণ সমাধান করে বুঝলাম ভালোলাগা থেকে প্রণয়ের সূচনা হয়। ”
মীরাত নিজেও আহিয়াদকে আলিঙ্গন করল। আজ তার সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই মানুষটাকেই তো সে চেয়েছিল। অবশেষে পেয়ে গেল। আহিয়াদ ওষ্ঠ ছোঁয়ায় মীরাতের কপালে। মীরাত শিউরে ওঠে। আহিয়াদের মনের অবাধ্য অনুভূতিরা আজ ভীষণ উন্মাদ। বুকের মাঝে অজানা অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছে। মন চাইছে ভালোবাসার মানুষটিকে প্রণয়ের রঙে রাঙিয়ে দিতে। সে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখেছে শুরু থেকেই। দুজনের মন আজ ভীষণ এলোমেলো। এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়।
কপোত কপোতী আজ নিজেদের নতুন জীবনের সূচনা করেছে। নানা বাধা পেরিয়ে মীরাত নামক মানবী অবশেষে তার ভালোবাসার মানুষকে পেয়েছে। যদিও তার জীবনে মানুষটির আগমন ঘটেছিল অনেক কষ্টের পরে। তবুও সেই কষ্ট ভুলে সঠিক মানুষকে ভালোবেসেছে। দুজনের জীবনের শুরু হোক সুন্দর ভাবে। আহিয়াদের অব্যক্ত প্রেমাসুখ অবশেষে ব্যক্ত করল।
[এই যে লোমান্টিক পার্ট। এরপর যে বলবে আহিয়াদ আনরোমান্টিক তাদের ঠুকুস করে পদ্মা নদীতে ফেলে দিব। রিয়েক্ট কমেন্ট না করলে সে একটা বুইড়া ব্যাঙ। ২৪৫০ + শব্দ অনেক বড় পর্ব দিয়েছি।]
চলবে…….