#অব্যক্ত প্রেমাসুখ❤️🔥
#আদ্রিতা নিশি
।৯।[ বিবাহ স্পেশাল]
[কপি করা নিষিদ্ধ ]
বিয়ে একটি সামাজিক এবং আইনি প্রতিষ্ঠান যা দুইজন ব্যক্তির মধ্যে পছন্দ, বিশ্বাস, ও পারস্পরিক দায়িত্বের ভিত্তিতে একটি সম্পর্ক গড়ে তোলে। এটি সাধারণত দুটি পরিবার বা সমাজের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের একটি উপায় হিসেবে দেখা হয়। বিয়ে বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্ম ও সমাজের মধ্যে বিভিন্ন রীতিনীতি ও নিয়ম অনুসারে পালিত হয়।
রাত বারোটা বেজে পঁচিশ মিনিট। লাল জামদানী পরে সোফায় বসে আছে মীরাত। মুখে হালকা কৃত্রিম প্রসাধনীর ছোঁয়া। হাত,গলা,কানে সোনার হালকা গহনা। মাথায় শাড়ির আঁচলে আবৃত।পাশেই বসে আছে আহিয়াদ পরনে তখনকার পরিহিত কালো শার্ট – প্যান্ট। তার ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক থাকলে মীরাতের মুখ থমথমে। হয়তো মনের বিরুদ্ধে গিয়ে রাজি হয়েছে। সামনে কাজী সাহেব বিবাহের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে ছোট পরিসরে হবে। বাহিরের কাউকে এই কারণে জানানো হয়নি। বাড়ির সকলে উপস্থিত থাকলেও জেনি উপস্থিত নেই। আরিশা জেনিকে ডাকতে রুমে গিয়ে দেখে জেনি তার মা – বাবার সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। সে এসে আহিয়াদকে কথাটা বলতেই আহিয়াদ জেনিকে বিয়ের কথাটা জানাতে আপাতত নিষেধ করেছে। কেনো নিষেধ করেছে জানার ইচ্ছা থাকলে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়ে উঠেনি আরিশার। আফিয়া বেগম একপাশে শাড়ির আঁচল গুজে দাঁড়িয়ে আছে। আজ খুশি হওয়ার কথা থাকলেও হতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে মেয়েটাকে জোর করে গছিয়ে দিচ্ছে আহিয়াদকে। সে জানে তার বান্ধবীর ছেলে আহিয়াদ। যদি সুরমা [ আহিয়াদের মা ] বিয়েতে অসন্তুষ্ট হয় তবে তার মেয়ে যে সুখে থাকবে না। ছেলেটা কি তার মা – বাবার সাথে বিয়ের কথা বলেছে? হয়তো না। মুন্সি সাহেব কাজি সাহেবের সাথে কথা বলছেন।
আহিয়াদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় মীরাতের দিকে। তার দৃষ্টি অতিশয় শান্ত। শান্ত চাহনিতে চেয়ে রইল সে নত মস্তকে বসে থাকা মীরাতের পাণে। মেয়েটি অনুভূতিশূন্য অবস্থায় রয়েছে তার অন্তরে বিষণ্ণ শূন্যতায় পরিপূর্ণ। চোখের দৃষ্টিতে কোনো উজ্জ্বলতা নেই।মুখাবয়বটা নিরুত্তাপ। হাসির রেখা, চিন্তার ছাপ অনুপস্থিত। হৃদয়ের গভীরে কোনো অনুভূতির ঝংকার আর অবশিষ্ট নেই।প্রতিটি ঘটনা প্রতিটি অনুভূতি তার থেকে খুব দূরে চলে গেছে। তার চলনে ও কথায় কোনো আগ্রহ বা উত্তেজনা নেই। মূর্তির মতো পাথর হয়ে গেছে।কেমন অনুভূতিহীন নির্জীব দেখাচ্ছে মীরাতকে।
আহিয়াদ নিরবতা ভেঙ্গে ধীর কন্ঠে বলে উঠলো – তোমার কি সম্মতি আছে বিয়েতে? যদি না থাকে বলতে পারো। আমি চাই না তোমার অসম্মতিতে বিয়েটা হোক।
মীরাত অনুভূতিহীনভাবে তাকায় আহিয়াদের দিকে। সুদর্শন যুবককে দেখে তার মাঝে প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হলো না। নিরস প্রাণহীন চোখ ভিজে উঠলো। কন্ঠনালী হতে যেনো কথা বেরোচ্ছে না। প্রেমের মোহনায় ডুবন্ত ফুলের ন্যায় তার অন্তর থেকে বিয়ের প্রস্তাব প্রতিধ্বনিত হলেও বিয়ে নামক শব্দটা তার কাছে কোনো কলঙ্ক মনে হচ্ছে ।
মীরাত অশ্রু আড়াল করে ভেজা কন্ঠে বললো – আমি রাজি বিয়েতে। আমায় কেউ জোর করেনি।
আহিয়াদ মীরাতের কথায় বুঝলো মুখে রাজি বললেও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানোর কার্যক্রম শুরু করতেই দুজন দৃষ্টি ফিরিয়ে সোজা হয়ে বসে। নতুন জীবনের পদার্পণের মাধ্যম হিসেবে দুজনে আইন কানুন মেনে রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে। প্রথমে আহিয়াদ স্বাক্ষর করে পরবর্তীতে মীরাত স্বাক্ষর করে।কিছুটা সময় পরেই কবুল বলার মাধ্যমে বিয়ে সম্পূর্ণ হয় দুজনের। মীরাত বিয়ের সময়ে বেশী সময় নেইনি কবুল বলতে। নির্জীব মানুষের ন্যায় তিনবার আওড়েছে শুধু। তখন শুধু চোখের কার্ণিশ বেয়ে নোনা জল গাল বেয়ে পরেছে। বাড়ির সকলে মীরাতের এমন প্রতিক্রিয়া দেখে বেশ অবাক হয়েছে। কারণ মীরাত মূর্তির ন্যায় শুধু সম্মতি প্রদান করেছে। বিয়ের সকল কার্যক্রম শেষ হতেই কাজি সাহেব মিষ্টিমুখ করে সম্মানি নিয়ে নিজ গন্তব্যে রওনা দেন। আহিয়াদ উঠে দাঁড়ায়। নিহাল এসে শুভকামনা জানায় প্রথমে। তারপর আবসার আর মুন্সি সাহেব আহিয়াদের সাথে কোলাকুলি করে অভিনন্দন জানায়। আফিয়া বেগম আর এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়ায় না। নিজের বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়। আগামীকাল থেকে মেয়েটা আর তার কাছে থাকবে না ভাবতেই কান্না কন্ঠ নালী ভেদ করে উগ্রে বাহিরে আসতে চাইছে। লিমা বেগম মীরাতের মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলেন।
আহিয়াদ নিজের নির্ধারিত রুমের দিকে রওনা দিলো। নব বিবাহিত স্ত্রীর দিকে ইচ্ছাকৃতভাবে তাকালো না আর কথাও বললো না। তার মস্তিষ্কে যেনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিয়ে নামক দায়িত্বটি। মীরাত চোখ উঁচিয়ে অপলক চেয়ে রইল মানবটির দিকে। বিস্মিত হয়েছে সে। অদ্ভুত লাগছে তার। কিছুদিন আগেও যে মানুষটি অচেনা ছিলো আজ সেই মানুষটি তার অর্ধাঙ্গ। ভাবতেই বক্ষ হীম শীতল হয়ে উঠলো। রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত হচ্ছে নাম না জানা শিহরণ।
★★
নিকষ কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের মাঝে উজ্জ্বল মালার ন্যায় চাঁদ দৃশ্যমান। কিছুক্ষণ আগেও আকাশটি মেঘে ছেয়ে ছিলো। আবহাওয়া ও শীতল। অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতে মেঘাচ্ছন্ন আকাশে চাদের উপস্তিতি অদ্ভুত।
আহিয়াদ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার আকাশের দিকে। কেমন উদাসীন দুশ্চিন্তাগ্রস্থ সেই চাহনি।বারবার একই কথা মনে আসছে। মীরাতকে কি কখনো মন থেকে সাদরে গ্রহণ করতে পারবে সে? নাকি দায়িত্বের চাদরে সবটা জরিয়ে যাবে। মীরাত কি শুধু তার দায়িত্ব হয়ে রইবে। সে তার জীবনে মীরাতকে স্বইচ্ছায় জরিয়েছে। পবিত্র সম্পর্কের বাঁধন দৃঢ় হয় এটা লোকমুখে প্রচলিত । সে আজ থেকে নতুন সম্পর্ক মানার পুরো চেষ্টা করবে। কিন্তু মীরাত কি সবকিছু মেনে নিতে পারবে?
দরজা খোলার আওয়াজে আহিয়াদের ধ্যান ভঙ্গ হয়। সে বেলকনি থেকে পা বাড়িয়ে রুমে আসে। সে রুমের মাঝে মীরাত, আরিশাকে দেখতে পায়। মীরাত অস্বস্তি আর সংকোচে আড়ষ্ট হয়ে আছে।
আহিয়াদ তীর্যক চাহনিতে সরাসরি বলে উঠে – এতো রাতে এখানে কি করছিস আরিশা?
আরিশা অবাক হওয়ার ভান করে বললো– তোমার বউকে তোমার কাছে দিতে এসেছি?
আহিয়াদ সরু চোখে তাকায়।মুখাবয়ব গম্ভীর হয়। আরিশা তা দেখে হেসে বলে – এমনি তো বউ দিবো না। আগে আমায় আর নিহাল ভাইয়াকে খুশি করো।
আরিশা হাত বাড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। মীরাত চুপচাপ কাহিনি দেখছে।
আহিয়াদ কথা বাড়ায় না। পকেট হতে মানিব্যাগ বের করে এক হাজার টাকার পনেরোটা নোট বের করে আরিশার হাতে ধরিয়ে দেয়। আরিশা টাকা পেয়ে খুশিতে গদগদ অবস্থা।
আরিশা গদগদ ভাব নিয়ে বললো – ধন্যবাদ ভাইয়া। আহ কি শান্তি টাকায়।
আহিয়াদ গম্ভীর কণ্ঠে বললো – বিয়ের কথাটা জেনি জেনো ঢাকায় যাওয়ার আগে জানতে না পারে। আমি ঢাকায় গিয়ে সকলের সামনে বিয়ের কথাটা জানাবো।
আরিশা ভদ্র মেয়ের মতো বললো – ঠিক আছে। আমি গেলাম তাহলে। ভাইয়া ভাবি নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইল আমার তরফ থেকে।
আরিশা রুম থেকে বেরিয়ে যায়।আহিয়াদ হাতে থাকা ঘড়ি ড্রেসিং টেবিলে রেখে ফোন আর ওয়ালেট তার পাশে রাখলো। সে কাবার্ড থেকে জামা কাপড় বের করে সরাসরি ওয়াসরুমে চলে গেলো। আহিয়াদের এমন ব্যবহারে মীরাত হতবুদ্ধির ন্যায় দেখলো শুধু। সে যে একটা জলজ্যান্ত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে দেখেও এমন ভাব করছে যেনো কেউ সামনে নেই। মীরাত ভাবতে ভাবতে বিছানার এককোণে গিয়ে বসলো। অচেনা মানবটি তার হাসবেন্ড ভাবতেই হাসফাস করে উঠলো সে। সে তো এই রুমে আসতে চায় নি। কিন্তু লিমা বেগম পাঠিয়েছেন। সে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রুমটা দেখতে লাগলো। তার চোখ আটকালো ডিভানের পাশে রাখা গিটারটায়।
আহিয়াদ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। উন্মুক্ত শরীরে এসে দাঁড়ায় আয়নার সামনে। ভেজা কৃষ্ণ বর্ণের চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছতে ব্যস্ত। মীরাত চোখ উঠিয়ে তাকায় আহিয়াদের দিকে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে যায়। লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নেই সে। মনে মনে বিরক্ত সে নিজের প্রতি। কেনো তাকাতে গেলো?
মীরাতের তাকানোর দৃশ্য আহিয়াদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। তার খেয়াল ছিলো না রুমে মীরাত আছে। সে তোয়ালে রেখে একটা টি শার্ট পরে নিলো দ্রুত।
আহিয়াদ এসে সামনে দাঁড়ায়। সে বললো– অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পরো। আগামীকাল দশটায় আমরা ঢাকায় রওনা দিবো।
মীরাত দ্বিধা নিয়ে তাকায় মানবটির দিকে। ভেজাচুলগুলো লেপ্টে আছে কপাল জুড়ে। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে পানির বিন্দু বিন্দু কণা জ্বলজ্বল করছে।সুঠাম দেহের অধিকারী মানবটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ঢোক গিলো। বক্ষে অজানা ভয় বিচরণ করতে লাগলো।
মীরাত কিছুটা সাহস সঞ্চার করে বললো – তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন।
আহিয়াদ কপালের মধ্যভাগে অবহেলায় পরে থাকা চুল হাতে ঠেলে বললো – কি প্রশ্ন।
মীরাত প্রশ্ন ছুড়ে দিলো – আপনি আমায় কেনো বিয়ে করেছেন?
আহিয়াদের কপাল কুঁচকে গেলো হঠাৎ এমন প্রশ্ন করায়। সে বললো– দায়িত্ব পালনের জন্য।
মীরাত যেনো হোঁচট খেলো এই কথায়। দায়িত্ব? বিয়ে করেছে দায়িত্ব পালনের জন্য।
মীরাতের মুখশ্রী অস্বাভাবিক হয়ে উঠলো।অবিশ্বাস্য তার চাহনি। সে নিভে যাওয়া কন্ঠে বললো– আপনি আমার অসহায়ত্বে করুণা দেখিয়েছেন। তাই তো বিয়ে করেছেন। তাই না?
আহিয়াদ ওষ্ঠ এলিয়ে হাসলো বিদ্রুপের হাসি । করুণা দেখিয়েছে কথাটা বড্ড বিদঘুটে শোনালো তার কাছে।
[ আজকের পর্ব কেমন হয়েছে সকলে জানাবেন। ]
চলবে…..