#অব্যক্ত প্রেমাসুখ🪶
#আদ্রিতা নিশি
।২০।
[কপি করা নিষিদ্ধ ❌]
ঘরজুড়ে নিঃশব্দতার আবহ বিরাজ করছে। সময়ের সাথে থমকে গেছে এই ছোট্ট কক্ষের চার দেয়ালের মধ্যে। ফাবিহার রুম এখন নিস্তব্ধতার আশ্রয়স্থল সকলের কাছে। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই।ফাবিহা এক কোণে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার সারা শরীর জুড়ে ভয় স্পষ্ট। হাত দুটো বুকে আঁকড়ে ধরে নিজেকে আরও অশান্ত করে তুলেছে।
মীরাত বিছানার কিনারে বসে আছে। তার দৃষ্টি মেঝের দিকে নিবদ্ধ, কিন্তু অশ্রুসিক্ত নয়নের কারণে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সব ঘোলাটে। তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে গভীর আতঙ্ক। অদৃশ্য ভয়ে তার কণ্ঠ শুকিয়ে এসেছে। মাথা তুলে তাকানোর সাহসও যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। চারপাশের নীরবতা তার মনের শূন্যতাকে আরও গভীর করে তুলছে।
আহিয়াদ সুরমা বেগমের সামনে দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে আত্মবিশ্বাস আর মুখে একরকম নির্লিপ্ততার ছাপ। মা-ছেলের দৃষ্টি কিছু মুহূর্তের জন্য মিলিত হয়। দুজনের মধ্যে কোথাও নীরব মনমালিন্য চলছে। সুরমা বেগমের দৃষ্টি কঠোর, তবে তাতে মায়াও লুকিয়ে আছে। তিনি নিরব ভঙ্গিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন।
“আজ কাল তোমায় বড্ড বেশী অচেনা লাগছে আহিয়াদ।কখনো তো তুমি এমন অদ্ভুত আচরণ করোনি তবে এখন কেন করছ?”
সুরমা বেগমের সরাসরি প্রশ্নে হেলদোল দেখা দিল না আহিয়াদের মাঝে। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ফাবিহা কিছুটা আমতা আমতা করে বলে উঠল ;
“আসলে মা তুমি যেমন ভাবছো তেমন কিছু নয় আসলে ভাই….
“একদম চুপ। তোমায় আমাদের মাঝে কথা বলার অনুমতি দেইনি আমি। ”
সুরমা বেগমের ধমকে ফাবিহা মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। আহিয়াদ শান্ত কন্ঠে বলে উঠল ;
“ মা আমি তোমায় এক্সপ্লেইন করছি বিষয়টা। ”
সুরমা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বলল;
“এক্সপ্লেইন করো মাই সান। এতোক্ষণ তো তোমার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছি।”
মীরাতের ভেজা চোখ ধীরে ধীরে উঠল আহিয়াদের দিকে। তার দৃষ্টিতে জমে থাকা ভয় আর অসহায়তার আভা ঘরের নিস্তব্ধতাকে আরও ভারী করে তুলল। সেই চোখের গভীরে ছিল অস্ফুট আর্তি, একান্ত নির্ভরতার আকুতি। আহিয়াদও ঠিক সেই মুহূর্তে মীরাতের দিকে তাকাল। তাদের দৃষ্টির সংযোগে কিছু একটার নিরব ভাষায় ছড়িয়ে পড়ল অসমাপ্ত কথোপকথনের প্রতিধ্বনি। মীরাতের চোখে ফুটে ওঠা আতঙ্কের ছবি আহিয়াদকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিল মেয়েটির মনের অবস্থা।কিন্তু আহিয়াদের মুখে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তার দৃষ্টিতে ছিল দৃঢ়তার অদ্ভেদ প্রাচীর। চোখ ফিরিয়ে সে সোজা তাকাল মায়ের দিকে। গভীর শ্বাস টেনে, নিজের ভিতর জমে থাকা অস্থিরতা আর উদ্বেগকে দমিয়ে রাখল নিজের মাঝে।
ঘরের নিস্তব্ধতায় আহিয়াদের নির্ভীকতা ঝড়ের মাঝে অনড় বৃক্ষ। আহিয়াদ তার চাহনি দিয়ে মীরাতকে বলতে চেয়েছে, “তোমার এই ভয়, এই শঙ্কা—সবকিছু সামলানোর দায়িত্ব আমার।”
“ আমি জানি তুমি আমায় খুব ভালোবাসো। এটাও জানি তুমি ছেলে হিসেবে আমায় অনেক ভালোভাবে বড় করেছো মা। আমি ছোট বেলা থেকে আজ পর্যন্ত তেমন কোনো কিছু গোপন করিনি। কিন্তু এই প্রথম একটা কথা গোপন করেছি। কথাটা গোপন করার অনেক রিজন ছিলো। তবে এই গোপনীয়তা দীর্ঘ হতো না। আগামীকাল সবাইকে জানিয়ে দিতাম। কিন্তু..”
সুরমা বেগম আতংকিত হয়ে বলে উঠলেন;
“ এসবের মাঝে এই কথা কেন বলছ? তুমি কোনো ক্রাইম করোনি তো? ”
আহিয়াদ গম্ভীর কণ্ঠে বললো ;
“ তেমন কিছু নয়। ”
“তবে?”
“আমি মীরাতকে বিয়ে করেছি।”
“তুমি আমার সাথে ফান করছো আহিয়াদ!”
সুরমা বেগম নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই বললো। চোখে মুখে অবিশ্বাসের ভাব। মনে হচ্ছে কথাটা বিশ্বাস করেনি। আহিয়াদ সিরিয়াস ভাব নিয়ে উত্তর দিলো;
“ ফান নয়। সত্যি বলছি। নানাজানের বাড়িতে আমার আর মীরাতের আকদ হয়েছে। আমরা এখন লিগ্যালি ম্যারেড কাপল।”
“তুমি এটা করতে পারোনা আহিয়াদ।তুমি কি ভুলে গেছ জেনি তোমার বাগদত্তা।এটা তুমি কি করলে?”
সুরমা বেগম অবিশ্বাসে চোখ বড় করে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার মুখে হতবাক হওয়ার ছাপ স্পষ্ট। নিজের কানে শোনা কথাটাও বিশ্বাস করতে পারছেন না। আহিয়াদ বিয়ে করেছে—এই সত্যটা তার মস্তিষ্কে বজ্রাঘাতের মতো আঘাত হানল। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার মনে। কীভাবে তিনি এখন জেনির পরিবারকে মুখ দেখাবেন? এতদিনের সম্পর্ক, এত পরিকল্পনা—সবকিছু মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
তার মাথার ভেতর জটিল চিন্তাগুলো এমনভাবে ঘূর্ণি তুলছে যে তিনি নিজের ভারসাম্যই হারিয়ে ফেললেন। দেহটা ঝুঁকে আসতে লাগল। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়বেন। এই দৃশ্য দেখে ফাবিহা দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। আহিয়াদও এক পা এগিয়ে ধরতে গেল, কিন্তু সুরমা বেগম কঠিন ভঙ্গিতে হাত উঠিয়ে তাকে থামিয়ে দিলেন।তার ঠোঁট কাঁপছে। গলা থেকে বেরিয়ে এল আক্ষেপে ভরা কণ্ঠস্বর;
“তুমি এটা ঠিক করোনি, আহিয়াদ। তুমি আমাদের এভাবে ঠকালে, জেনিকে ঠকালে? যদি জেনিকে এতটাই অপছন্দ ছিল, তাহলে এতদিন চুপ ছিলে কেন? কেন? এখন হঠাৎ গোপনে বিয়ে করে এনেছ? আর কী কী লুকিয়ে রেখেছ আমাদের থেকে? বলো তো, আহিয়াদ, আর কী লুকিয়েছ?”
সুরমা বেগমের গলায় অভিমান আর ক্ষোভ মিশে আছে। চোখের পানি আর ভেজা কন্ঠ তার কথাগুলোর ভারী ভাব আরও বাড়িয়ে তুলছে। ঘরের বাতাস হঠাৎ আরও ভারী হয়ে উঠল। আহিয়াদ তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল—চোখে দৃঢ়তা, কিন্তু মনের এক কোণে অপরাধবোধ লুকিয়ে আছে।
সুরমা বেগমের কথায় আহিয়াদ থমকে যায়।সে দু হাত নামিয়ে নেয়। উদগ্রীব হয়ে বলে উঠল;
“তুমি আমায় ভুল বুঝছো মা। একবার পুরো ঘটনা শোনো তারপর যা ইচ্ছা তাই বলো।”
“তোমার একটা কথাও শুনতে চাই না আমি। এখোনি তোমার বাবাকে বলছি। ”
“ এতো উত্তেজিত হলে শরীর খারাপ করবে। একটু শান্ত হও।”
“এতো আমায় নিয়ে চিন্তা? তাহলে বিয়ের আগে আমাকে একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করোনি?”
আহিয়াদের কথা বন্ধ হয়ে গেলো। আসলেই তো সে কাউকে কিছু বলেনি। ভুল তো তার হয়েছে। বিয়ের বিষয়টা আগেই জানানো উচিত ছিলো বলে তার মনে হচ্ছে।
মীরাত বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। নিভে যাওয়া কন্ঠে অনুতাপ নিয়ে বলে উঠে;
“আন্টি আসলে উনার কোনো দোষ নেই। সব কিছু আমার কারণে হয়েছে। ”
“আমি আর আমার ছেলে কথা বলছি। আমাদের মাঝে বাহিরের কাউকে কথা বলার রাইট আমি কাউকে দেইনি। ”
মীরাত সুরমা বেগমের কথাগুলো শুনে থমকে গেছে। তার হৃদয়ের ভেতর অদৃশ্য শূল বিঁধে গেলো।যা কাঁপিয়ে দিয়েছে তার পুরো অস্তিত্বকে। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু চুপচাপ গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে কোনো শব্দ ছাড়াই। তার মনের গহীনে ঘুরপাক খেতে লাগল একটি প্রশ্ন—সে কি সত্যিই “বাহিরের মেয়ে”? তার মাথার ভেতর ঘুরতে লাগল , “হ্যাঁ, আমি তো বাহিরের মেয়ে। এই বাড়িতে আমি অতিথি মাত্র।”তার শূন্য চোখে এক মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠল নিজের অবস্থান। বড়লোক বাড়ির ছেলের জীবনে সে কি আসলেই জোরপূর্বক ঢুকে পড়েছে?
ফাবিহার হাতে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা সুরমা বেগম হঠাৎই নিজেকে ছুটিয়ে নিলেন। ফাবিহার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। মীরাতের দিকে একবারও না তাকিয়ে, কঠিন, অনমনীয় ভঙ্গিতে দরজা পর্যন্ত পৌঁছালেন। কিন্তু বাইরে যাওয়ার ঠিক আগে, হালকা পেছন ফিরে ঘরের ভেতর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। অভিমানের চাপা স্বর নিয়ে বললেন;
“ফাবিহা, তোমার ভাই আর ওই মেয়েকে বলো, আমার সামনে যেন না আসে।”
কথার সমাপ্তি ঘটিয়ে গটগটিয়ে রুমের বাহিরে চলে গেলেন সুরমা বেগম। তার পিছু পিছু ফাবিহা ও ছুটলো।
মীরাত ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল, তার শরীর আর মনের ভার সহ্য করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। দুহাতে চুল খামচে ধরে হঠাৎই তার ভেতরের সব বাঁধ ভেঙে গেল। হু হু করে কেঁদে উঠল এক বুক বিষন্নতা আর ব্যথা উগড়ে দিয়ে। তার শ্বাস ভারী হয়ে আসছে। নিজের কান্নার মধ্যে সে বারবার ভাবতে লাগল—সবসময় এমনটা কেন হয় তার সাথে? কেন ভাগ্য তাকে এইভাবে পরীক্ষা নেয়?
আহিয়াদ এক মুহূর্তের জন্য নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিল।, কিন্তু মীরাতের এই ভেঙে পড়া চেহারা তার সহ্য হলো না। নিজের অস্থিরতা সামলে ধীরে ধীরে মীরাতের পাশে বসে পড়ল।। হাত বাড়িয়ে মীরাতের কাঁধে আলতোভাবে রাখল।
আহিয়াদের গলার গভীর থেকে উঠে এলো শান্ত স্বরে বলা কথা;
“প্লিজ, মীরাত, কান্না করো না। আমি জানি এটা খুব কঠিন সময় তোমার আর আমার জন্য। কিন্তু সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, আমি কথা দিচ্ছি। শুধু একটু সময় প্রয়োজন।”
“কিছু ঠিক হবে না। সবকিছু আবারও এলোমেলো হয়ে যাবে। ”
আহিয়াদ মীরাতের কন্দনরত কাতর কন্ঠ শুনে অতি শান্ত কন্ঠে প্রতিত্তোর করলো ;
“তুমি আমার ওপর ভরসা রাখো। আই প্রমিজ সব কিছু ঠিক করে দিবো।”
মীরাত অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালো আহিয়াদের দিকে। মনের মাঝে আকুলতা নিয়ে ভেজা কন্ঠে বললো;
“আন্টি যদি আমায় না মেনে নেয় তাহলে আমি কি করবো আহিয়াদ?আমার তো এখন আপনিই ভরসা। যদি আন্টি আপনায় বলে আমায় ডিভোর্স দিতে তখন আমার কি হবে?আমি কোথায় যাবো? দয়া করে আমায় ডিভোর্স দিবেন না। এটা আমার অনুরোধ। আমি আপনার কাছে একটু থাকার ঠাই চাই।এর থেকে বেশী কিছু চাই না। জানেন আমাদের গ্রামের মেয়ে মানুষ বলে বিয়ের পর নাকি মেয়েদের নিজের বাড়ি তার শশুড় বাড়ি। মায়ের বাড়ি মেয়েরা আত্নীয়ের ন্যায় হয়ে যায়। আপনি আমায় ছেড়ে দিলে আমার নিজ বলতে কিছুই থাকবে না। আর শুনুন, আমি আপনাকে হারাতে চাই না। বেশী কিছু চাইবো না শুধু এইটুকু চাইবো আপনি আমায় কখনো ছেড়ে যাবেন না।”
আহিয়াদ মীরাতের অশ্রুসিক্ত লোচনে তাকায়। অদ্ভুত দহনে পুড়ছে তার হৃদয়। মীরাতের কান্না সহ্য হচ্ছে না তার। এই অদেখা অনুভূতি জন্মেছে বক্ষে। সে মীরাতের দুহাত নিজ হাতের মুঠোবন্দী করে নিয়ে বললো;
“মনে রেখো মীরাতুল আযহা তুমি এখন থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমারই রইবে। তোমায় আজন্মকাল আমারই থাকতে হবে।”
[সবাই রেসপন্স করবেন দয়া করে। অনেকদিন গল্প দেওয়া হয়নি তাই পেজ ডাউন হয়ে গিয়েছে আর কেমন হয়েছে সকলে মতামত জানাবেন। অনেকদিন পর লেখা এলোমেলো হলে মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখবেন।]
চলবে………