অব্যক্ত_প্রিয়তমা,part_23
ফাতেমা_তুজ
” অনি ”
” হ্যাঁ আসিম ”
” থমকে গেলে কেন ? ”
” না কিছু না তো, চলো ”
আসিম অনিন্দিতার হাত ধরে আবারো এগিয়ে যায়। পেছন ঘুরে চারপাশে চোখ ঘোরায় অনিন্দিতা। ভেতর টা কেমন যেন করছে। এই ডাকের সঙ্গে অনেক বেশি পরিচিত ওহ। নির্ভীকের উপস্থিতি অনুভব করার শক্তি হারিয়েছে সে। বহু দিন হলো ছেলেটার ছবি ও দেখা হয় নি। চর্চা না থাকলে সময়ের সাথে সাথে মানুষ তাঁর গুন হারিয়ে ফেলে যে , অনিন্দিতা তাঁর উদাহরন। অথচ একটা জিনিস কিছু তেই মিলছে না। আজ এতো গুলো দিন হয়ে গেল নির্ভীক কে ভুলতে পারে নি সে। সময় মানুষ কে পরিবর্তন করে তবে অনিন্দিতার মাঝে কেন এই পরিবর্তন হলো না ?
সন্ধ্যার আজান পরে যায়। আসিম আর আগায় না। যাওয়া প্রয়োজন, তাই আবারো পেছনে মোর নেয়। অনিন্দিতার পাশাপাশি হেঁটে চলে গাড়ির দিকে। হঠাৎ করেই আসিম লক্ষ্য করে অনিন্দিতা গভীর চিন্তা মগ্ন। তাছাড়া আশে পাশে চোখ বুলাচ্ছে। যেন কাউ কে খুঁজছে। বিস্ময় নিয়ে আসিম বলে
” কি হয়েছে অনি ? ”
” না কিছু না। এমনি তেই ভাবছিলাম কতো টা দেরি হয়ে গেল। ”
” আরে কিচ্ছু হবে না। আমি আমার ককপিট দিয়ে মিনিটেই চলে যাবো। আসো আসো ”
অনিন্দিতা হাসে। আসিম কে দেখে মনেই হয় না একটা কোম্পানি তে সবার উপর ছুড়ি ঘোরায়। ছেলেটার মাঝে চঞ্চলতা প্রচুর। বলতেই হয় লাখে একটা।
গাড়ি থামতেই ছুটে আসে হীর। অনিন্দিতা কে জড়িয়ে বলে
” কেমন আছো আপু ? ”
” ভালো আছি। অনেক লেট করে ফেললাম তাই না ? আমার অরু মাম্মাম কোথায় রে ? ”
” ঘরেই আছে। ”
অনিন্দিতা চলে যায়। হীর বলে
” আরে আসিম ভাইয়া আসুন। আপনাকে এখন অতিথির মতো বরন করতে হবে নাকি ? ”
” আরে ধ্যাত কি যে বলো। আমি হলাম ঘরের লোক। আসলে হয়েছে কি অরুর জন্য গিফ্ট এনেছিলাম সেটা বাসায় ফেলে এসেছি। ”
” তাঁতে কি ? ”
” তেমন কিছুই না। ওর জন্য চকলেট তো নিয়ে আসি এখন। না হলে আমার খারাপ লাগবে। ”
” হায়রে , তাড়াতাড়ি আসবেন। একদম ই সময় নেই। ”
” আচ্ছা। ”
আসিম চলে যায়। চোখে মুখে আতঙ্ক। এক হাতে ড্রাইভ করে অন্য হাতে কল করে ইশরাক কে। কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আসিম বলে
” কাজ টা কি ঠিক হচ্ছে ডক্টর ইশরাক ? ”
” কি বলতে চাচ্ছো আসিম? ”
” না বোঝার ভান করবেন না। আমি শিশু বাচ্চা নই।”
” আসিম ! ”
” প্লিজ । এবার অন্তত নির্ভীক স্যার কে ফোন টা দিন। ”
” সেটা কি করে সম্ভব? ওহ তো কানাডা তে আছে। ”
” কামন ডক্টর ইশরাক। আমি কানে কালা নই। অনিন্দিতা একা নয় আমি ও নির্ভীক স্যারের কন্ঠ শুনেছি। ”
ওপাশ থেকে কথা বলে না ইশরাক। রগরগা কন্ঠে আসিম বলে
” লোকেশন ম্যাসেজ করুন আমি এখনি আসছি। ”
ইশরাক লোকেশন পাঠিয়ে দেয়। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে আসিম এগোয়। আজ একটা কিছু হবেই। এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না।
.
আকাশে যেন হাজার খানেক তারা। সেই তারার দিকে নির্লিপ্ত চেয়ে আছে নির্ভীক। আসিমের রাগ হচ্ছে। এই মুহুর্তে নির্ভীক কে পাহাড় থেকে ফেলার ইচ্ছে জেগেছে। তবে সে ইচ্ছে সম্ভব নয়। আকাশের দিকে তাকিয়েই নির্ভীক বলে
” কফি খাবে আসিম ? ”
” কফি ! ”
” হুম কফি। আশ্চর্য কেন হচ্ছো ? পড়া শোনার কি অবস্থা। ”
” নির্ভীক স্যার। আমি এই বিষয়ে কথা বলার জন্য আসি নি। প্লিজ একটু সিরিয়াস হোন। ”
” কি বলতে চাও আসিম ? নির্ভীক সিরিয়াস নয়। ”
” তেমন টা বলি নি আমি , ডক্টর ইশরাক। আপনি দেখেছেন অনিন্দিতার পরিবর্তন? ওহ এখন ভালো আছে। ”
রহস্য হাসে নির্ভীক। পাহাড়ের খাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে এগিয়ে আসে আসিমের দিকে। বরাবরের মতোই আসিমের কলার উঁচু করা। এই স্টাইল টা নির্ভীকের বেশ পছন্দ। তবু ও সে এগিয়ে আসে আসিমের দিকে। কলার ঠিক করে দিয়ে বলে
” জীবনে অনেক বড় হবে তুমি। তবে অতিরিক্ত কনফিডেন্স একদম ই ভালো নয়। ”
” আমার কনফিডেন্স নিয়ে এখনো সন্দেহ স্যার? আমি আবারো প্রমান করে দিবো আমি কনফিডেন্স কেন। ”
নির্ভীক উত্তর দেয় না। লাইটার বের করে একটা সিগারেট ধরায়। বিন্দু মাত্র অবাক হয় না আসিম। কখনো সিগারেট মুখে তুলে নি ছেলেটা। তবে আজ খাবে। নির্ভীকের সাথে তালে তাল মিলিয়ে তিন তিনটে সিগারেট শেষ করে ফেলে। নির্ভীক বলে
” তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে আসিম। ”
” হচ্ছে না। আমি ক্লিয়ার হতে চাই। ”
” কি ক্লিয়ার হতে চাও ? ”
” আপনি কানাডা থেকে এখানে কেন ? ”
” কিছু দিন পর এমনি তেই আসতে হতো। তাছাড়া রোজের শরীর টা ও ভালো নেই। বিডি তে একা আসা যাওয়া করা রিক্স হয়ে গেছে। তাই ওর সাথেই এসেছি। ”
” অনি কে ডাকলেন কেন ? ”
ভ্রু কুটি করে তাকায় নির্ভীক। আসিমের প্রশ্নের আগা মাথা বুঝতে পারে না। আসিম বলে
” আমরা যখন পাহাড়ের উপর উঠছিলাম তখন আপনার ডাক শুনেছি আমি। ”
” ওহ। ঠিক ই শুনেছো। আমি হঠাৎ অনিন্দিতা কে দেখে চমকে গিয়েছিলাম। নিজেকে লুকাবো কি করে , ঠিক বুঝতে পারি নি। ইশরাক আমাকে টেনে নিতেই আমি অনিন্দিতার নাম উচ্চারন করে ফেলি। আর কিছু ? ”
আসিম কথা বলে না। সিগারেট তুলে নিতেই হাত ধরে ফেলে নির্ভীক। বলে
” টিচার এর পাশে বসে তিনটে সিগারেট শেষ করেছো। এটা অনেক বেশি লজ্জাজনক বিষয়। আর খেও না কেমন ? ”
“এখনো বলবেন, আপনি অনিন্দিতা কে ভালোবাসেন না নির্ভীক স্যার? ”
” বহু বার একি প্রশ্ন করেছো আসিম। আমি উত্তর দিয়েছি। ভালোবাসি না বলেই আমি চলে গিয়েছিলাম। অনিন্দিতা কে কাছে ডাকার সাধ্য আমার নেই। তাই আমি চাই না আমার জন্য অনিন্দিতার কোনো ক্ষতি হোক। এবার তোমার যাওয়া প্রয়োজন। ”
আসিম উঠে চলে যায়। নির্ভীকের বলা কথা গুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ওভার কনফিডেন্স কে সত্যি কার অর্থে ব্যবহার করে দেখাবে আসিম।
” রোজ কে দেখে রাখিস। আমি যাচ্ছি, আর হ্যাঁ ভুলে যাস না ওহ প্রেগনেন্ট। ”
” নির্ভীক। আমাকে এখনো ক্ষমা করিস নি ? ”
” বলেছিনা না জীবন থাকতে তোকে কখনো ক্ষমা করবো না। আশা করি এখন তুই শুধরে গেছিস। জীবনে আর ভুল করিস না। সুখী হ। ”
অজানার পথে হাঁটে নির্ভীক। পেছন থেকে চিৎকার করে ইশরাক বলে
” আর যাই হই না কেন তোর মতো পাষান নই আমি। জীবনে সেক্ররিফাইজ টাই সব নয়। কিছু সময় প্রিয় মানুষ টা কে ও মূল্য দিতে হয়। এখনো সময় আছে নির্ভীক। তুই চাইলেই সব কিছু ঠিক হতে পারে। ”
আনমনেই হাসে নির্ভীক। পকেট থেকে ছোট ক জোড়া পুতুল বের করে তাকিয়ে থাকে।
সব কিছু ঠিক হয় না। ভালোবাসার কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। ঠিক তেমনি ভাবে অনিন্দিতার প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই ওর। কিন্তু যাঁদের সাথে এতো গুলো বসন্ত পেরিয়ে এসেছে। তাঁদের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। যাঁর মাশুল গুনে গুনে দিবে নির্ভীক ।
.
” আসিম এতো দেরি কেন করলে তুমি ? ”
” স্যরি অনি। আসলে রাতের পরিবেশ টা উপভোগ করছিলাম । ”
” ধ্যাত আসো তো। তোমার জন্য কেক কাঁটা হয় নি। ”
মৃদু হাসে আসিম। অনিন্দিতা বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। অরু কে কোলে নিয়ে কেক কাঁটিয়ে নেয়। সবাই বেশ হৈ হুল্লরে মেতে উঠে। চারুলতার মন ভালো নেই। অনিন্দিতা বলে
” কি হয়েছে আন্টি ? ”
” কি হয় নি বল তো অনি। নির্ভীক টা পরে আছে কানাডায়। এদিকে নিহাল টা ও আসে নি। কতো বার ফোন করলাম , বলে কি না কাজের চাপে বিজি। একা একা বিজনেস করে কি হবে আমি বুঝি না। দুটো ছেলেই আমাকে পাগল করে দিলো।”
” সেসব বাদ দাও এখন আসো ডিনার করবে। ”
” হুমম। ”
ডিনার করে বসার ঘরে আসর জমায় সকলে। হীর , পৃথিবী , অনিন্দিতা আর আসিম আসে ছাঁদে। যে যার মতো ব্যস্ত কথা বলায়। কোনো কিছু ই ভালো লাগে না আসিমের। নির্ভীক এখনো ওর কাছে রহস্য। কি আছে এর পেছনে ?
” আসিম এদিকে আসো। ”
” হুমমম ভাই আসছি। ”
” একা কেন দাঁড়িয়ে আছো ? ”
” এমনি তেই ভালো লাগছে না। আচ্ছা পৃথিবী ভাই আমি রেস্ট নেই। আপনারা গল্প করুন। ”
” সেকি আসিম চলে যাবে মানে ? ”
” অনি তোমরা গল্প করো। আসলে আমি একটু ক্লান্ত। ”
” আচ্ছা তাহলে যাও। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমায় ডেকো। ”
” ওকে ”
সকল কে বিদায় জানিয়ে চলে যায় আসিম। ফোন হাতে নিয়ে ভাবতে থাকে কি করা যায়। রোজ আর ইশরাকের সম্পর্ক টা এখনো ঠিক ঠাক বুঝতে পারে নি ওহ। সব কেমন যেন এলোমেলো।
বেডে বসে বসে চিন্তাগস্ত হয় আসিম। কিন্তু কিছুই মাথায় আসে না। ব্যগ্র হয়ে ফোন করে আসিম। ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠ কানে আসে
” অনিন্দিতা ঠিক আছে আসিম ? ”
” নির্ভীক স্যার ! ”
” কি হলো বলছো না কেন ? ”
” আপনি এখনো স্বীকার করবেন না ? ”
” কি স্বীকার করবো। আসিম এখন বলো এই মাঝ রাতে ফোন করেছো কেন ?
অনিন্দিতা ঠিক আছেন। ”
” আশ্চর্য হই আমি। এতো খোঁজ খবর নেওয়ার পর ও বলবেন যে অনির প্রতি কোনো অনুভূতি নেই ? ”
” হুম আছে। অবশ্যই আছে , অনিন্দিতা আমার কাছে একজন স্টুডেন্ট। অনিন্দিতা আমার কাছে একজন মানুষ। অনিন্দিতা আমার কাছে একজন প্রেমি। যে আমার জন্য পাগলামি করে। আর সেই দায়িত্ববোধ থেকেই ওনার খবর নেই আমি। ”
উচ্চস্বরে হেসে উঠে আসিম। ওপাশে থাকা নির্ভীক থত মতো খায়। বলে
” হাসছো কেন তুমি ? ”
” উফফস স্যরি স্যার। আসলে হয়েছি কি আমি কখনো আপানকে কনফিউজড হতে দেখি নি। তবে আজ অনুভব করলাম আপনি প্রচন্ড কনফিউজড। কথা দিলাম আমি আমার ওভার কনফিডেন্স দিয়ে সব খুঁজে নিবো। ”
টুট টুট শব্দ হতেই ফোন টা ছুঁড়ে ফেলে নির্ভীক। পাশে থাকা ওয়াইন এর বোতল থেকে ওয়াইন ঢালে। সিগারেট জ্বালিয়ে চলে আসে ব্যলকনিতে। শির শির বাতাসের সাথে ওয়ানে চুমুক দেয়। সাথে উড়িয়ে নেয় নিকোটিনের ধোঁয়া। চোখ থেকে নামে যায় বর্ষন। তাচ্ছিল্য হেসে এক নিমিষে ওয়াইন শেষ করে বলে
” মানুষ হলো পৃথিবীর সব থেকে অভাগা প্রানী। ”
চলবে