#অভিমানী_ঝরা_পাতা,part_6
#ফাতেমা_তুজ
প্রতি টা বিচ্ছেদ ই বাজে হয়। ঝরা আর রনির বিচ্ছেদ ও তদ্রূপ বাজে। নানান ছুতোর সাহায্যে সবাই কে ফাঁকি দিয়ে এসেছে শেষ বারের মতো প্রিয় মুখ টা দর্শনে। এই শেষ দর্শনের লোভ সামলাতে পারে নি ঝরা অথবা রনি। এসে থেকেই আবেগে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে মেয়ে টা। রনি অসহায়, হতবাক আর নিরুত্তর। চোখ দুটো স্থির নিবদ্ধ অদূরের নদীর তীরে। ইচ্ছে করছে নদীর বুকে ভেসে যেতে। তবে এ কার্য কোনো মতেই করবে না ও। মন মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে চলতে গিয়ে প্রচন্ড বেগ পেতে হচ্ছে ওকে।যাঁর দরুন বার বার পরিকল্পনার ব্যাঘাত ঘটছে।
ঝরা কেবলি কোমল কন্ঠে হাহা কার করে বলল
” কেমনে থাকবো আমি? ”
বুকের ভেতর টা কাঁচির সাহায্যে কেউ যেন ছিন্ন ভিন্ন করে যাচ্ছে। রনির চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো অবলীল ভাবে। সামান্য ঠান্ডা হাওয়াতেও যেন দাঁত শির শির করে উঠলো। ঠোঁট দুটো হালকা ফাঁক হয়ে আবার নিভে গেল। শরীর সামান্য নিশ্চল হয়ে পরেছে। হাতের কব্জি তে শক্তি নেই একটু। মনে হচ্ছে সব থেকে অসহায় প্রানী। রনির বুকে মাথা রেখে বেশ কিছু সময় কাঁদতে লাগলো ঝরা। এ পৃথিবীর উপর ভীষন অভিমান জমেছে। কেবলি প্রশ্ন জাগে কেন রনির সাথে বিচ্ছেদ ঘটবে। কেন সিয়াম কে বিয়ে করতে হবে। সব এতো টা মূল্যহীন!
” পালিয়ে যাবো রনি। ”
হাজার খানেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাঁটিয়ে মূল্যবান শব্দ টি উচ্চারণ করলো ঝরা। তবে রনি কোনো উত্তর করলো না। ঝরা আবার প্রশ্ন ছুড়লো
” পালিয়ে যাবে না রনি? ”
” আফসোস করবে তুমি। ”
” রনি! ”
” মনে আছে রিলেশনের শুরু তে কি বলেছিলে? পরিবার কে দুঃখ দিয়ে ভালো থাকা যায় না।
এতে নাকি আফসোস করতে হয়। পালিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করলে ও যেন নাকোচ করে দেই। ”
দু পা পিছিয়ে গেল মেয়েটি। বিস্ময় হয়ে কাঁটিয়ে দিলো কয়েক মুহূর্ত। চোখের জল যখন গালে লেপ্টে যাওয়ার উপক্রম ঠিক তখনি ঝরঝরে কেঁদে উঠলো। রনির শার্ট খামচে ধরে অবিরত বলতে লাগলো
” কেন, কেন, আমাকে সহ্য করতে হবে এ যন্ত্রনা। কেন আমাদের ভালোবাসা ঝরে যাবে ব্যথার সাগরে। আমি পারবো না থাকতে। প্লিজ রনি কিছু করো। ”
রনির চোখ দু খানা বিস্ময় ভরা। আকাশে তখন ও কিছু টা আলো বিদ্যমান। থেকে থেকে জোনাক পোকা রা ঝোপের কাছে উড়ে যাচ্ছে। অপরূপ সৌন্দর্যে হারিয়ে যায় রনি। এতো সুন্দর পৃথিবী! অধর কোনের হাসি রাঙা চাহনি ঝরার বুকে র/ক্তক্ষরণ করছে। ছেলেটা কি পাগল হয়ে গেল?
সূর্য ডুবে গিয়ে পশ্চিম আকাশ তখন লাল হয়ে আছে। ব্যাগে থাকা মুঠো ফোন বেজে চলছে। সে শব্দ কর্ণকুহর হতেই রনি ঘুরে তাকালো। চোখে মুখে সামান্য বিরক্তির ছাপ। ঝরার মাথায় হাত রেখে বলল
” ভাগ্যে আমাদের বিপরীতে। তুমিই তো বলেছিলে সব টা মেনে নিতে। ”
” মেনে নিবে সব? ”
” হুম নিতে হবে মেনে। আমরা অসহায়, বড় দের ভাষায় অসুস্থ কপোত কপোতী। ”
কথা গুলো বলার সময় রনির মুখ থেকে যেন ব্যথা ঝরছিলো। বাতাসে ভাসতে লাগলো সেই ব্যথার করুণ সুর। সামান্য আঁধার নামাতে কেমন বিদঘুটে আর অসহ্য শোনালো সে শব্দ। ঝরা ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল। রনির বুকে জাপটে পরে কিছু সময় কাঁদতে লাগলো। রনি ও কাঁদছে, বিচ্ছেদের মতো যন্ত্রনা কিছু নেই। মেয়েটার চশমা ভাঙার আশংকায় ছেড়ে দিলো রনি। ঝরার প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দেখে বলল
” গ্লাস ভেঙে যাবে। ”
” রসিকতা করছো? ”
” একদম ই না। বরাবর ই গ্লাস ভেঙে ফেলো তুমি। গত মাসে তিন টে গ্লাস ভেঙেছো খেয়াল আছে? ”
খেয়াল করলো ঝরা। মাস ভিত্তিক একটা করে চশমা ভেঙে ফেলে ওহ। এটা ওর বদ অভ্যাস বটে।তবে গত মাসে কোন খেয়ালে যেন তিন টে গ্লাস ভেঙেছে। হতাশা এসে ভর করলো ঝরা কে। রনি কিছু টা এগিয়ে এসে মেয়েটা কে জাপটে ধরলো। ছেলেটার বুকের উষ্ণতায় কোমল বিড়াল ছানার মতো নেতিয়ে রইলো। ঝরার চোখের পানি ছেলেটার বুকে এসে লাগছে। তাঁতে যেন আরো ভেঙে পরলো ছেলেটি। হাজারো মানুষের মাঝে পৃথিবীর সব থেকে অসহায় লাগছে নিজেকে। রনি অনুভব করতে পারে কয়েক টুকরো কালো মেঘ এসে ওকে বেঁধে নিচ্ছে খুব শক্ত করে। প্রচন্ড ব্যথায় চিৎকার করে আর্তনাদ করছে তবে সে শব্দ পৃথিবীর কোনো প্রানীই শুনতে পেল না। অগোচরে থেকে দুঃখ বিসর্জন দিতে হলো। এবার বিদায়ের পালা। চারপাশে কোনো প্রাকৃতিক আলো নেই। যা আছে তা সোডিয়ামের কৃত্রিম আলো। ঝরার মুঠো ফোন এখনো বেজে চলেছে। রনি চোখ মুছে ওর থেকে ফোন নিয়ে কল রিসিভ করলো।
” হ্যাঁ ঝরা, কোথায় আছিস তুই। ফোন ধরছিলি না কেন। দেখ বোন কোনো উল্টো পাল্টা চিন্তা করবি না। বাড়ি ফিরে আয়। কাল তোর হলুদ, ভুলে যাস না এটা আমাদের বাড়ির মানসম্মানের ব্যাপার। ”
” চিন্তা করবেন না আপু আপনার বোন বাসায় পৌছে যাবে। ”
” হ্যালো কে, ঝরা , ঝরা কোথায়? ”
” আমার পাশেই আছে। রাখছি আপু, ভালো থাকবেন। ”
যন্ত্র টি মুষ্টিবদ্ধ করে কয়েক বার শ্বাস নিলো রনি। চোখ টা লাল হয়ে আছে। এই চোখ থেকে যেন গরম লাভা বের হচ্ছে। ঝরার হাতে ফোন তুলে দিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল
” সোজা বাসায় যাবে। ”
” আমি তো বাসায় যেতে চাই না রনি। বাসায় যাওয়ার জন্য তো আসি নি। ”
” কথা বাড়িও না ঝরা পাতা। আর আজ থেকে আমাদের পথ আলাদা।”
” আমি যাবো না। ”
” যেতে হবে তোমায়। ”
” কেন যেতে হবে। এমন করছো কেন তুমি? ”
” বোঝার চেষ্টা করো ঝরা। তোমার আমার পথ দুর্গম। আমরা ভালো থাকবো না। ফিরে যাও তুমি, প্লিজ রেহাই দাও। ”
চশমার গ্লাস টা আবছা হয়ে গেছে। চোখের কার্নিশ বেয়ে নেমেছে অশ্রু ধারা। গরম নোনা জলের ছোঁয়া যেন তীর তীর করে শরীরে সুচের মতো লাগে। সারা শরীর জেগে উঠলো মুহূর্তেই। কোন রনি কে দেখছে সে? এ তো সম্পূর্ন আলাদা একজন। তবে একেই কি ভালোবেসে ছিলো ঝরা! ভুল মানুষের প্রেমে পরে নিজেকে সর্বহারা ভাবছে।
রনির চাহনি নিচু হয়ে গেল। অনেক টা এগিয়ে গেছে ঝরা। ছেলেটার বুক চিরে নেমে এলো দীর্ঘশ্বাস। ঝরার রাগ, অভিমান শতভাগ যুক্তি সম্মত।
.
দলে দলে মেয়েরা হলুদ রঙের শাড়ি পরেছে। মুখে ভারী মেকাপের ছোঁয়া। একেক জন যেন হলুদ কুমারী। হাসি ঠাট্টা তে মেতে উঠেছে পুরো বাড়ি। বেশ লাগছে সবাই কে। তবে ঝুমের মন খারাপ। হয়তো বোনের প্রতি মায়া হয়েছে। ঝুম এসে ঝরার পাশে বসলো। ঝরা শুধুই ঠোঁট দুটো প্রসারিত করলো। গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারলো না। গলা টা শুকনো লাগছে। পাশে থাকা জগ থেকে পানি ঢেলে নিয়ে কয়েক ঢোক পানি পান করলো। ঝুমের বার্তা টি কানে পৌছাতেই ঝরা বলল
” সব তো শেষ আপু। ঠিক ই বলেছিলে এক জন ভুল মানুষ কে ভালোবেসেছি আমি। ”
” আম স্যরি বোন। ”
” আরে তুমি স্যরি কেন বলছো? দোষ তো আমার। অপাত্রে কন্যা দান করেছি। সব কিছু চোখের সামনে হলে ও বুঝতে পারি নি সেটা। হয়তো এটাই আমার ভাগ্য। ”
ঝুম হেসে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। খুব সুন্দর লাগছে মেয়ে টা কে। চোখে থাকা গ্লাসের জন্য আরো বেশি মায়াবী দেখাচ্ছে।
একে একে হলুদ লাগাতে লাগলো সবাই। ঝরা নিষ্প্রাণ, বাক হীন যেন কলের পুতুল। ফটোগ্রাফার রা নানান ভঙ্গিমায় ছবি তুলে নিচ্ছে। ঝরার আগ্রহ নেই তেমন। শুধু হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলাচ্ছে। ভীরের মাঝে এক পুরুষালি হাতের স্পর্শ পেতেই চোখ দুটো কেঁপে উঠলো। বিচলিত হয়ে খুঁজলো মানুষ টি কে। তবে কোথাও নেই সেই মানুষ টি। ঝরার মন বলছে রনি এসেছে। আর এ স্পর্শ রনির ই ছিলো। তবে কি ঝরা কে নিয়ে যেতে এসেছে রনি? এক টা আশার আলো দেখতে পাচ্ছে মেয়ে টি। হয়তো সেই আলো তে পরিপূর্ণ হবে ঝরা। অথবা ঝরে যাবে ঝরা পাতা হয়ে।
চলবে