অভিমানী_ঝরা_পাতা,part_7 [ সমাপ্তি পার্ট ]

0
1182

#অভিমানী_ঝরা_পাতা,part_7 [ সমাপ্তি পার্ট ]
#ফাতেমা_তুজ

আকাশ টা বিতৃত্ব লাল। থেকে থেকে কালো আবরণ জমে আছে। বোধহয় মেঘ করেছে। একটু পর ই ঘুরুম ঘুরুম আওয়াজ তুলে গগন তাঁর ক্রন্দসী রূপ দেখাবে। মাথার উপর ফাইল তুলে দিয়ে হালকা পায়ে ছুটছে রনি। অফিসের মিটিং টা ভেস্তে যাবে নিশ্চিত। নতুন চাকরি, না জানি কি হয়। গাড়ি নেই শহরে। সবাই ঘরের ভেতর লেপ্টে আছে হয়তো। সমস্ত কিছু তোয়াক্কা করে এগিয়ে যাচ্ছে রনি। অফিসে পৌছাতে মিনিট পাঁচেক লেট হয়ে গেল। বস জানলে চাকরি যাবে। তবে ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো বস আসে নি এখনো। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কাজ করতে লাগলো। মাস্টার্স সম্পন্ন করার মাস চারেক পর ই এই চাকরি টা হয়ে যায়। কোনো রকম অনৈতিক পথ অবলম্বন করতে হয় নি ওকে। মেধা আর পরিশ্রমের ফল এই চাকরি টা। কম্পিউটারে চোখ রেখে কাজে মনোযোগী হলো রনি। দুই ঘন্টা পর ম্যানেজার এসে বললেন
” রনি, তোমার আর্টিকেল টা স্যার খুব পছন্দ করেছেন। সম্ভবত সামনের মাসেই তোমার চাকরি টা কনফার্ম করে দিবেন। ”

উত্তেজনায় উজ্জ্বল হলো চোখ। বসা থেকে উঠে গিয়ে ম্যানেজারের সাথে হাত মেলালো। এতো দ্রুত কনফার্ম হবে ধারনার বাইরে ছিলো। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে কাজে মনোযোগ দিলো। মনস্থির করলো এবার থেকে আরো বেশি পরিশ্রম করবে ওহ।

থালা ভর্তি মিষ্টি সাজিয়ে রেখেছেন হামিনা। এক সময় ছেলের প্রতি বিরক্ত হয়েছিলেন তিনি ও। সকলের সাথে যোগ দিয়ে রনি কে তাচ্ছিল্য করেছিলেন। তবে আজ অনুভব করতে পারেন তিনি ভুল ছিলেন। সত্যি বলতে মানসিক ভাবে ঠিক না থাকলে কোনো কাজ ই সঠিক হয় না। আর তখন কার রনি তো ছিলো উম্মাদ।সে দিন টার কথা এখনো মনে আছে হামিনার। কি বিভর্ষ সে দৃশ্য। গাঁয়ের প্রতি টা লোমকূপ সজাগ হয়ে যায়। নিজেকে কিভাবে ক্ষত বিক্ষত করেছিলো রনি। মা হয়ে ও তিনি কয়েক মুহূর্ত থমকে যান। ছেলে কে বাঁচানোর কথাই যেন ভুলে যান তিনি। ভাগ্যিস রনির বন্ধুরা ছিলো। না হলে আজ চার বছর হয়ে যেতো ছেলেটার মৃত্যু সংবাদের। রনি বুঝতে পারে মায়ের ব্যথা।
” সেসব ভেবো না তো। ভাবলেই কষ্ট পাবে। আমি তো ঠিক আছি এখন। ”

ছেলের পরিবর্তন ভালো লাগলো ওনার। বিষয় টা ধামাচাপা দিতে মিষ্টির থালা থেকে একটা মিষ্টি এগিয়ে দেন। রনির ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি। হামিনা কে জড়িয়ে ধরেই বলল
” তোমার হাতের মিষ্টি মানেই অমৃত। ”

” মায়ের হাতের জিনিস তো তাই। ”

” একদম। ”

রনি বেশ তৃপ্তি করে মিষ্টি মুখে পরলো। মিষ্টির স্বাদ ভালো। তবে খেতে ইচ্ছে করছে না ওর। তাই এক টা খেয়েই তাগাদা দিয়ে বলল
” গোসল করবো মা। রাতে এক টা পার্টি এটেন্ট করতে হবে। ”

” পার্টি, কোন পার্টি। ”

” ঐ যে আমাদের বস এর ভাগ্নের শো রুম ওপেন এর পার্টি। ”

” কিসের শো রুম? ”

” মোবাইল ফোন। ”

” ওহ তা সেখান থেকেই খেয়ে আসবি? ”

” পার্টি তে যেহেতু যাচ্ছি তো সেখান থেকেই খেয়ে আসবো। ”

হামিনা জামা কাপড় বের করে দিয়ে চলে গেলেন। রনি সাওয়ার নিতে গেল চট জলদি। বাইরে বেশ ঠান্ডা পরেছে। অথচ সকাল বেলাই কি গরম আর বৃষ্টি ছিলো। প্রকৃতি আজ কাল ক্ষনে ক্ষনে নানা রূপ দেখাচ্ছে।

তৃপ্তি সহকারে খাবার খাচ্ছেন ম্যানেজার রউফ। লোক টার মোটা ভুরি দেখে বেশ হাসি পেলো রনির। হাসি পাওয়ার ই কথা। এই যে অনুষ্ঠান শুরু হলো না অথচ রউফ বিরিয়ানির প্যাকেট হাতে তুলে নিয়েছেন।

কিছুক্ষনের মাঝেই সকলে শো রুমের দরজায় মিলিত হলো। মাইক হাতে নিয়ে নানান রকমের বক্তব্য প্রদান করা হচ্ছে। এক ঘেয়ামি লাগলো রনির। তাই কিছু টা দূরে এসে ফোনে নিমজ্জিত হলো। কোথা থেকে যেন একজন এসে পিঠ চাপরে দিলো। চোখে মুখে সামান্য হাসি। রনি প্রথমে চিনতে না পারলে ও পরে চিনতে পারলো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
” কেমন আছেন সিয়াম সাহেব? ”

” এই তো বেশ ভালো। তো আপনার কি অবস্থা? ”

” আল্লাহ যেমন রেখেছেন। ”

” সম্ভবত কয়েক মাস আগে মাস্টার্স সম্পূর্ন করেছেন। তা এখন কি চাকরি খুঁজছেন? ”

” না। অলরেডি আমি জব করছি। রহমান ইন্ডাস্ট্রির জুনিয়র অফিসার পদে। ”

” ওয়াও এটা তো খুব ভালো খবর। ”

উত্তর করলো না রনি। সিয়াম আরো কিছু কথা বললো। ছেলেটা মিশুক, আর বেশ ভালো ও বটে। তবে রনির কাছে সিয়াম কে কাঁটার মতোই লাগছে। কিছু টা যেন আন্দাজ করলো সিয়াম। তাই আর বেশি কথা বাড়ালো না। যাওয়ার পূর্বে বলল দু দিন পর ওর মেয়ের প্রথম জন্ম বার্ষিকী। রনি যেন আসে। চাপে পরে সম্মতি জানালো রনি।

আড়ালে এসে চোখের জল মুছে নিলো। প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে ওর। এতো কান্না পাচ্ছে যে ইচ্ছে হলো রাস্তায় গিয়ে শুয়ে পরতে। চিরতরে হারিয়ে যেতে এই পৃথিবীর বুকে।

দুদিন পর
ঘড়ির কাঁটা ঢং ঢং শব্দ তুলে জানান দিলো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বেশ আলসেমি তে ধরেছে রনি কে। হামিনা এসে কিছু ছবি হাতে তুলে দিলেন।
রনি বুঝতে পারলো কিসের ছবি। ছেলেটা কেবল ই মলিন হাসলো। হামিনা ছেলের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললেন
” দেখবি সব ভালো হবে বাবা। সময় তো থেমে থাকে না তাই না? লড়াই করতে হয়।”

” হ্যাঁ মা। এ পৃথিবী তে লড়াই না করলে বাঁচা যায় না। আর কিছু ক্ষেত্রে তো সব ছেড়ে দিতে ও হয়। দিন শেষে থাকে শূন্য। ”

কিছু বুঝতে পারলেন না হামিনা। তবে কথা বাড়ালেন না। ছেলেটা সম্মতি জানিয়েছে এটাই অনেক।

জন্মদিনের পার্টি তে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না রনির। তবে যেতেই হবে ওকে। কাবাড থেকে নতুন শার্ট বের করে গাঁয়ে মোড়ালো। প্রথম মাইনের টাকায় কেনা শার্ট এটা। মায়াবী হাতে হাত বুলালো তে লাগলো বুকে। রনির মনে পরে একদিন তাঁর বাবা বলেছিলেন রোজগার এতো সহজ নয়। দুটো মানুষের খরচ কত হয় তাঁর হিসেব ওর মাথায় আছে কি না। রনি সেদিন নিরুত্তর ছিলো। তবে আজ অনুভব হলো টাকার মায়া বড় মায়া।

সিয়ামের মেয়ের জন্য বেশ সুন্দর ডল কিনে নিলো রনি। বাচ্চা টি কে ফেসবুকে দেখেছিলো। মায়ের সাথে হাস্য উজ্জল মুখে তাকিয়ে। কি সুন্দর ফুটফুটে চাহনি। বুক টা ভরে উঠলো যেন।

সিয়াম অতিথী এটেন্ট করছে। রনি কে দেখে তৃপ্ত হাসলো। ভেবেছিলো হয়তো আসবে না। একজন লোক কে গেস্ট সামলাতে বলে রনির হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। চার দিকে জমকালো আয়োজন। রনি হাসার চেষ্টা করছে। তবে হাসি টা মুখে মানাচ্ছে না ঠিক।
এক টা বেঞ্চ এ বসলো দুজনে। মাটি তে জুতো দিয়ে আঁকি বুকি করছে রনি। সিয়াম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঝরার প্রসঙ্গ টেনে নিলো। হঠাৎ এমন কথা বলবে তা বুঝতে পারে নি রনি।
সিয়ামের দৃষ্টি তে বিনয়। রনি চোখের পানি আড়াল করে বলল
” আমি পারবো না। ”

” দেখুন মিস্টার রনি, আপনার অতিরিক্ত ভোলা ভালা মুখ টার পেছনে লুকিয়ে আছে বাজে একটা মুখ। ”

” হয়তো। ”

” হয়তো না। শত ভাগ সত্য। লুকিয়ে থেকে কোনো লাভ নেই। আমি ঝরা কে সব টা বলেছি। ”

ঝাপসা চোখে তাকালো রনি। সিয়াম কে বেশ সিরিয়াস মনে হলো। রনির আফসোস হচ্ছে, ইস সিয়ামের মতো শক্ত মনের হলে বেশ ভালো হতো।

রনির ঘাড়ে হাত রাখলো সিয়াম। কতো টা নিষ্ঠুর এই মানব। নিজ হাতে হ,ত্যা করেছে নিজের ভালোবাসা। তবে বলা বাহুল্য যে রনি অনেকাংশে ছিলো নিরুপায়।

” সত্যিই সব টা বলেছেন ঝরা পাতা কে? স্যরি আই মিন ঝরা কে। ”

” ইটস ওকে। হ্যাঁ বলেছি সব টা। ”

সিয়ামের সহজ উত্তরে ভাঙচুর হলো রনির ভেতর। কেবলি চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলো। সিয়ামের হাতের খোঁচায় চোখ মেলে তাকালো। চশমা চোখে মেয়ে টি এগিয়ে আসছে এই দিকেই।মৃদু সমীরণে খোলা চুল গুলো উড়ছে। হাতে বছর খানেক এর ফুটফুটে বাচ্চা টা। সিয়াম এগিয়ে গেল। ঝরার থেকে বাচ্চা টি কে তুলে নিয়ে অন্য পথে এগোলো। ঝরা এগোচ্ছ যতো রনির বুক তঁতো মোচর দিয়ে উঠছে।

এই মেয়েটার দিকে অধিক সময় তাকাতে পারে না রনি। ঝরা কাছে তো আসলো তবে কথা বললো না। রনির পাশে এক টুকরো কাগজ রেখে চলে গেল। রনি কাগজ টা তুলে পড়তে লাগলো।

” ভালোবাসলে এমন করে বাসতে হয় যাতে বিচ্ছেদ হলে ও অপর ব্যক্তির মনে ঘৃনা তৈরি না হয়। তবে তুমি ঠিক উল্টো। ভালো তো বাসলে তবে ঘৃনা তৈরি করে দিলে। আমি আমার পরিবার কে সব থেকে বেশি ঘৃনা করি। কারন আমার ভালোবাসা কে মেনে নেয় নি তাঁরা। তবে সিয়ামের থেকে সব টা জানার পর তোমাকে ঘৃনা করি আমি। নিজের ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস ছিলো না?
নিজের জন্য করুণা হয় আমার। কাকে ভালোবেসে ছিলাম আমি? যে আমার হাত টা এভাবে ছেড়ে দিলো তা ও অবিশ্বাসের খেলায়।খুব অন্যায় হয়ে যেতো সেদিন সুযোগ টা গ্রহন করলে? উহু তেমন কিছু হতো না। বেঁচে যেতো আমাদের ভালোবাসা। তবে তুমি সেটা হতে দিলে না। মহান হতে হলো তোমায়।পরিবারের সম্মান তোমার কাছে বেশি গুরুত্ব হলো। অথচ একটি মেয়ের জীবন টা ময়লার মতো ঝেরে দিলে। চাই না এমন ভালোবাসা। ঘৃনা করি আমি। ”

সামনে তাকালো রনি। এক পাশে ছল ছল চোখে তাকিয়ে আছে ঝরা। শরীর টা কাঁপছে বোধহয়। রনি এক সেকেন্ড অবস্থান করলো না। ছুটে এলো বাইরে। ঝিলের ধারে গিয়ে লম্বা লম্বা দম ফেললো। বুক টা জ্বলে যাচ্ছে ওর। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেছে। এখনো দু চোখে ভাসে সেই জ্বলন্ত দিন।

নিজের সাথে দ্বন্দ্ব করে হলুদের দিন রনি গিয়েছিলো ঝরা কে নিজের কাছে ফিরিয়ে নিতে। তবে সব টা বুঝতে পেরে যায় ঝুম। মেয়েটা রনি কে একটু ও সহ্য করতে পারে না এটা জানতো রনি। তবে কেন সহ্য করতে পারে না এটা জানতো না। সেদিন রনির হাত ধরে সবার থেকে আড়ালে নিয়ে আসে ওহ।
চিৎকার করে নিজের জীবনের আর্তনাদ শোনায় রনি কে। লজ্জায় মাথা নুইয়ে যাচ্ছিলো ছেলেটার। ওর ভাই এমন টা করেছে ভাবতে ও পারছিলো না। ঝুম তখন প্রতিশোধের আগুন মাথায় নিয়ে। সব টাই জানতো ওর পরিবার। রনির ইমোশনে আঘাত করে ঝুম। বলে ঝরা কে নিয়ে পালিয়ে গেলে সবার সম্মুখে ঘটনা প্রচার হবে। আর তখন রনির পরিবারের প্রতি ও ঝরার ঘৃনা তৈরি হবে। নিচু হয়ে যাবে সবাই। রনি তখন বুঝতে পারছিলো না কি করবে। সব কেমন ঝাপসা লাগছিলো। উপায় ছিলো না একদম ই। ঝরা কে নিয়ে পালিয়ে গেলে ও লাভ নেই। ঝুম আঙুল তুলে দেখালো ওর চাকরি নেই, খাওয়াবে কি। সব টা তখন মাথায় এসে বসলো। মেনে নিলো নিজের ভাগ্য। বুকে পাথর চেপে ঝরা কে রেখে এসেছিলো সিয়ামের হাতে।

ডুকরে কেঁদে উঠলো রনি। পকেটে হাজার টাকার বেশ অনেক গুলো নোট। টাকা গুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে মুচরে ধরলো। টাকার কি মূল্য, যে ভালোবাসা কে হারিয়ে দেয় এভাবে।

ফোন টা বাজতেই সচকিত হলো রনি। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সিয়াম বলল পার্টি তে আসতে। রনি আসতে চাইলো না। তবে ঝরার কন্ঠ স্বর পেয়ে পার্টি তে আসলো।

অনুষ্ঠান হলো। সবাই বেশ আনন্দিত। রনি অসহায় মুখে তাকিয়ে। কিছুক্ষন পর ঝরা কাছে এলো। বেশ অনেক টা দূরুত্ব বজায় রেখে একটা বক্স বাড়িয়ে দিলো। প্রশ্ন বোধক দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইলো। ঝরা বলল
” খুলে দেখার অনুরোধ রইলো। ভালো থাকবেন, সম্ভব হলে আর কখনো আমার সামনে আসবেন না। ”

মেয়েটার কটাক্ষ করা বার্তা গুলো রনির অন্তকর্নে ঝড় তুলে দিলো। ঝরার দেওয়া উপহার টা খুলে দেখলো রনি। কিছুই নেই তাঁতে। খালি প্যাকেট একদম। বেশ অনেক ক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাচ্ছিল্য হাসলো রনি। হাসি টা একান্তই নিজের। ঝরার অভিমান করার শতভাগ যুক্তি রয়েছে। তবে এভাবে অপমান করার অর্থ এই মাত্র বুঝতে পারলো। উপাহরের খালি প্যাকেট দিয়ে ঝরা আঙুল তুলে বুঝিয়ে দিলো “তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে।” কি নিষ্ঠুর সেই অভিমানী বাক্য!

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here