অমানিশা❤️,পর্ব-১০,১১

0
1092

অমানিশা❤️,পর্ব-১০,১১
লেখিকা_মালিহা খান❤️
পর্ব-১০

গোসল সেড়ে খাবার টেবিলে এলো আরশাদ। ভেজা চুল না মুছে গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে রাখা তার চিরকালের অভ্যাস। আজও নিয়ম লঙ্ঘন হয়নি।
মুনতাহা তখন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে কি যেনো খাচ্ছে। সাবিনা বেগম একটু আগে ঘরে গিয়েছেন। সকাল ঠি ক দশটার পর গোসল করেন তিনি।
আরশাদ এসে বসেছে টের পেয়েও সে মাথা তুলেনি। চামচ দিয়ে খুটখাট করে কাটছে আর মুখে তুলছে, চিবাচ্ছে, আবার কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। আরশাদ বিরক্ত করলোনা। নিশব্দে নিজের প্লেটটা টেনে নিয়ে খাবারে মনোনিবেশ করলো। মেয়েটা খায়ও চড়ুই পাখির মতোন। একটু একটু করে। অল্প অল্প করে।
গুমরে মরা নিরবতায় কাটলো অনেকক্ষণ। আরশাদের খাওয়া শেষের দিকে। মুনতাহা তখনো বাটির জিনিসটাই খেয়ে চলেছে একমনে। আরশাদ কপাল কুঁচকালো। একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করতেই বুঝলো, মেয়েটা বার বার ছোট্ট ছোট্ট হাই তুলছে, ডানহাতে চোখ কচলাচ্ছে।
ঘাড় বাকিয়ে ঘড়ির দেখলো আরশাদ। দশটা দশ। মুনতাহা এসেছে প্রায় অনেকক্ষণ। ঘুম পাচ্ছে তবু বসে আছে কেনো? আস্তে করে ডাকলো,

—“মুনতাহা?”

মুনতাহা মুখ তুলে তাকালো এতক্ষণে। ঠোঁটজুড়ে মিষ্টির রস। বাটির ভিতর আধখাওয়া সাদা মিষ্টি। চোখের ঘুম লুকোনোর নিষ্ফল প্রয়াস। আরশাদ নিমত্তের মতো সবটা মুখস্থ করলো। মেয়েটা খুব সাধারণ। আহামরি কিছু নয়। অনারম্বরেই ভীষণ আড়ম্বর!
অত:পর অতীক্ষ্ন মৃদু স্বরে বললো,

—“আপনাকে আম্মা ডেকে এনেছে?”

মুনতাহা উপরনিচে মাথা নাড়ায়। আরশাদ আবার প্রশ্ন করে,”আব্বুকে বলে এসেছেন?”
এবার আর ইশারায় অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে না পেরে মুখ খুললো মুনতাহা। ঠোঁটে লেগে থাকা রস বড্ড আঠালো। কিছুক্ষণ মুখবন্ধ থাকলেই আঠায় আঠায় দু’ঠোট লেগে যায়। মুনতাহা বারকয়েক জিভ দিয়ে চেঁটেপুটে উওর দিলো,” আব্বু-ই তো দিয়ে গেলো।”

—“আংকেল বাসায় নেই?”

মুনতাহা আবার মাথা নাড়ালো। আরশাদ বুঝলো,”মাহতাব সাহেব বাসায় নেই, মেয়েটার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে, মা হয়তো কোনো কাজে ডেকেছিলো কিন্তু রান্নার চক্করে বেমালুম ভুলে গেছে যে মুনতাহা এখনো টেবিলেই অপেক্ষা করছে, আর মেয়েটা কোনো কাজ না পেয়ে আধঘন্টা যাবত একটুকরো মিষ্টি নিয়ে খুটখাট করছে।”
দীর্ঘ ভাবনা শেষে প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়লো আরশাদ।
মা কে ডাকলো হাল্কা উচ্চস্বরে। আনতারা হম্বিতম্বি করে আসলেন। আরশাদের বলতে হলোনা। মুনতাহাকে দেখে তিনি নিজেই হায়হায় করে উঠলেন,

—“ওহ মা, তুমি তো বসে আছো। দেখেছো, আমার মনেই নেই। তুমি ডাক দিবেনা? পাগল মেয়ে। এমনে বসে থাকে চুপচাপ?”

মুনতাহা হাসলো নাকি না বুঝলোনা আরশাদ। তবে উঠে দাড়িয়ে মায়ের উদ্দেশ্য বললো,

—“কিজন্য ডেকেছো আম্মা?”

আনতারা মিষ্টি করে হাসলেন। আরশাদ অবাক হলো। মায়ের এই অকৃত্রিম হাসিটা দেখেনা অনেকদিন।
একবছর না? হ্যাঁ, প্রায় একবছর-ই তো। বাবা চলে গেছেন গোটা একটা বছর হয়ে যাবে কিছুদিন পর।
আনতারা মিষ্টি হাসি বজায় রেখেই বললো,

—“গয়না গুলো নিয়ে আসলাম না কাল? ওকে মানায় নাকি দেখি। এসো মুনতাহা। আমার ঘরে এসো মা।”

মুনতাহা উঠে দাড়ালো। আরশাদ একবার তাকালো তার দিকে। বিড়বিড় করলো,”ওকে সবতেই মানাবে আম্মা।”
অত:পর ঠোটের কোঁণ প্রসারিত করে মনে মনে তোলপাড় করে মনের ভেতরেই বাক্য আঁওড়ালো,”তাছাড়া, চাঁদের আবার অলঙ্কার লাগে নাকি? তার অঙ্গে অঙ্গে তো এমনিতেই অপার্থিব সৌন্দর্যের অগাধ- অহর্নিশ বিচরণ।”

আনতারা আলমারি ঘেটে লালরঙা গয়নার বাক্স বের করলেন। একটা নয়, দুটো নয়। পরপর কয়েকটা। মুনতাহার সেদিকে খেয়াল নেই। গোল গোল চোখদুটো যেয়ে আটকেছে জানলার গ্রিল গলিয়ে সামনের বাসার জানলার উপরের কার্নিশে বসে থাকা দুটো জালালি কবুতরের দিকে। কবুতর দু’টোকে সে চিনে। আব্বুকে দিয়ে গমের দানা আনিয়ে রাখে। যখন ছাদে যায় হাতের করে নিয়ে যায়। ছড়িয়ে দিতেই কি সুন্দর খায়!

দূর্বল মনস্বিতার সুঁতো ছিঁড়ে গেলো আনতারার ডাকে। তিনি বাক্স খুলতে খুলতে বলছেন,”তাড়াহুড়োয় মন মতো বানাতে পারিনি। দোকানের ডিজাইন থেকেই নিয়ে এসেছি। দেখি পড়তো মা।” তার হাতে গলার হাড়।
মুনতাহা বাধ্য মেয়েটির মতো মাথা ঝুঁকিয়ে দিলো। আনতারা পরালেন। ঘাড়ের চুল নিজেই ঠিক করে দিলেন। এতেই ক্ষ্যান্ত হলেন না। হাতের বালা- চুড়ি, কালের দুল, নাকের টানা নথটাও ধরে দেখলেন। মুনতাহা হকচকিয়ে বললো,”বিয়ে হলে এগুলো সব পরে থাকতে হবে আন্টি?”

আনতারা হেসে ফেললেন। ছেলে আসলেই কাল বাদে পরশু বিয়ে করছে, খুশি মনে ধরছেনা। ঢেউখেলানো হাসি নিয়েই বললেন,” আরে নাহ, পাগল মেয়ে। এই ভারি ভারি জিনিস সবসময় পরে থাকতে কে বলেছে? এসব তো আমি শখ করে নিয়েন আসলাম। পছন্দ হয়নি?”

—“না হয়েছে, খুব সুন্দর হয়েছে।”

আনতারা হাসলেন। মুনতাহা তখন আবারো বাইরে তাকিয়েছে। আনতারা এই প্রথম বোধহয় দেখলেন কোনো মেয়ের গহনার প্রতি অনিহা। দামী দামী গহনার থেকে তার বোধহয় পাশের বাসার জানলায় রোদপোহানো ছাইরঙা কবুতর দুটিই ভীষণ প্রিয়!

দুপুরের দিকে বেরোলো মুনতাহা। আনতারা জোরজবরদস্তি খাবার খাইয়েই ছেড়েছে। এই ফ্ল্যাট থেকে ওই ফ্ল্যাট। আরশাদ তাও ভেতরে ঢোকা পর্যন্ত দিতে এসেছে।
মুনতাহা ঢুকলো। দরজা আটকাবে নাকি না ভাবলো কিছুক্ষণ। সিদ্ধান্তে পৌছে যেতেই তার ভাবনায় গুঁড়েবালি ঝেড়ে দিয়ে আরশাদ দরজার পাশের দেয়ালে একহাত রেখে পরিষ্কার গলায় বললো,

—“বিয়ে কবে জানেন তো? আংকেল বলেছেনা?”

মুনতাহা মোমের পুতুলটির মতো মাথা নাড়ালো। মানে, সে জানে।
আরশাদ মনে মনে শোকপ্রকাশ করলো কিছুক্ষণ। মেয়েটা কথা কম বলে। অথচ এই অবুঝকে কে বোঝাবে, ওই মিনমিনে কন্ঠস্বর তার কত প্রিয়। আর বোঝানো হলোনা।
আরশাদ বোঝাপড়া বাদ দিয়ে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলো,”কবে? বলুন।”

মুনতাহার ছোট্ট, সংক্ষিপ্ত উওর,”পরশুদিন।”

আরশাদ মুচকি হাসলো। যাক, বলেছে কিছু। একটু ঝুঁকে চোখে চোখ রেখে বললো,

—“আম্মাকে নিয়ে মার্কেটে যাবো একটুপর। বিয়ের দিন কি পরবেন বলুন।”

এবার চিন্তাগ্রস্থ লাগলো মুনতাহাকে। একটু এলোমেলো, জ্ঞানশূন্য লাগলো। যেনো তাকে এ ধরণীর সবচেয়ে জটিল, দুর্বোধ্য, নিষ্করুণ প্রশ্নটি করা হয়েছে। উওর সাথেসাথেই এলোনা। আরশাদকে একাধারে চেয়ে থাকতে দেখে মুনতাহা শেষমেষ আমতাআমতা করলো,”আপনি নিয়ে এসেন কিছু একটা।”

প্রতিদিনকার মতোন সেদিনটাও ভীষণ সাধারণ। এক্কেবারেই গতানুগতিক। কোনো বিশেষত্ব নেই। নিত্যদিনের রুটিনমাফিক সকাল হয়েছে, বেলা গড়াতেই বিশাল দৈত্যাকার সূর্য উঠেছে, আবার গোধুলীলগ্নে তা পাড়ি জমাচ্ছে জগত আন্ধার করে।
মাহতাব সাহেব বাসায় ঢুকে খানিকটা অবাক হলেন। মুনতাহা কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। হ্যাঁ, মেয়েটার ছোটবেলা থেকে বালিশে মাথা রাখলেই ঘুমিয়ে পড়ার মতোন স্বভাব। বড্ড ঘুমকাতুরে। হিসেব করে রাখলে ঠিক দেখা যেতো জীবনের অর্ধেক সময় সে ঘুমিয়েই কাটিয়েছে।
কিন্তু তবু, আজ তো বিয়ে পড়ানো হবে। মেয়ে জানেও। তাও ঘুমাচ্ছে কেনো? মাহতাব সাহেব সমীকরণ মেলাতে পারলেন না।
তার পিছে আরশাদ। হাতে মিষ্টির প্যাকেটের সাথে আরো কিছু খাবারপত্র। দু’একজন পরিচিত আসবে। এছাড়া আর কোনো হট্টগোল নয়। ঘরের মানুষ নিয়েই শুধু বিয়েটা পড়ানো হবে।
মুনতাহাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকালো সে। মাহতাব সাহেব বুঝতে পারলেন। হাল্কা কেঁশে নিজ থেকেই বললেন,”চিন্তা করোনা, ও মাঝেমধ্যেই এখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়ে। উঠে যাবে একটু পর। কাজি আসতে তো এখনো দেরি আছে।”
আরশাদ সম্মতিসূচক হাসলো। প্যাকেটগুলো টেবিলে রাখলো। মাহতাব সাহেব কি করতে জানি নিজের ঘরে গেলেন। আরশাদ একধ্যানে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো মুনতাহার দিকে। গায়ের কাঁথাটা পা থেকে সরে গেছে। মেয়েটা এমন জড়োসড়ো হয়ে আছে কেনো?
না না করেও ঘরে ঢুকলো সে। আম্মা আসবে একটু পর। সাজিয়ে টাজিয়ে দিবে একটু। পায়ের কাঁথাটা ঠিক করতেই ভ্রু কুঁচকালো আরশাদ। তাড়াহুড়ো করে যেয়ে দাড়ালো মুনতাহার মাথার কাছে। একটুক্ষণ কিছু একটা পরখ করতেই সব যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো মূহুর্তেই। রুদ্ধশ্বাসে চিৎকার করে ডাকলো সে,”আংকেল? আংকেল এদিক আসেন।”

চলবে

#অমানিশা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১১

জ্বরে গা পুঁড়ে যাচ্ছে মুনতাহার। চামড়ার পরতে পরতে আগুন লেগেছে যেনো। ভয়াবহ উত্তাপে ক্রমাগত ঝলসাচ্ছে তুলতুলে নরম শরীর। তড়িঘড়ি করে গাল- কপাল হাতরালো আরশাদ। ঠোঁট অবধি টানা কাঁথার ভিতরে হাত গলিয়ে গলায় ছোঁয়ালো। আল্লাহ! এমন জ্বর? এত জ্বর?
নাম ধরে ডাকলো। মুনতাহা? মুনতাহা? একবার নয়, বারবার, বেশ ক’বার। তবে সাড়া পাওয়া গেলো না। নাহ্, অচেতন নয় মেয়েটা। জ্ঞান আছে। উওর দিতে পারছেনা শুধু। চোখের পাতা কাঁপছে। তাকাতে চাইছে তো, পারছেনা শুধু। গায়ের কাঁথা সরিয়ে দিলো আরশাদ। দু’টো কাঁথা? এতক্ষণে খেয়াল হলো ঘরের ফ্যান চলছেনা। তারমানে জ্বরটা অনেকক্ষণ আগেই এসেছে। মেয়েটা জ্বর নিয়েই শুয়েছে। মাহতাব সাহেব ছুটে এলেন। মুনতাহা ঝাপসা ঝাপসা তাকালো। আরশাদের দিকে চেয়ে কি যেনো বিরবির করলো। আরশাদ ঠোঁটের কাছে কান নিয়ে শোনার চেষ্টা করলো। বোধগম্য হলোনা, খুব অষ্পষ্ট। মুনতাহা বিড়বিড় করেই চলেছে। আরশাদ কপালের উপর হাত রাখলো। মাহতাব সাহেবের দিকে চেয়ে শঙ্কিত কন্ঠে বললো,”ওর তো অনেক জ্বর আংকেল।

মাহতাব সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। থমথমে হয়ে বললেন,”জ্বর? জ্বর মানে? দুপুরেই তো ভালো দেখে গেলাম। মুন?” বলতে বলতেই এগিয়ে গেলেন তিনি। মুনতাহা আবার চোখ বুজেছে ততক্ষণে। মাহতাব সাহেব মুখে হাত ছোঁয়াতেই আৎকে উঠলেন,”হায় আল্লাহ! আম্মা? এত জ্বর কখন উঠলো?”
বাবার আদুরে সংস্পর্শ পেতেই কুঁকড়ে গেলো মুনতাহা। কোনরকমে জড়িয়ে জড়িয়ে ডাকলো,”আ.. আব্বু..আব্বু তুমি..।”কথা সম্পূর্ণ হলোনা।
আরশাদ হাঁফ ছেড়ে বললো,”আংকেল, জ্বরটা মাপা দরকার।”
মাহতাব সাহেব মাথা নাড়ালেন। দ্রুত পাশের ড্রয়ার থেকে জিনিসপত্র এলোমেলো করে থার্মোমিটার বের করলেন।
জ্বর মাপলেন। মুনতাহা কেঁশে উঠলো হঠাৎই। থার্মোমিটারটা পড়ে গেলো জিহ্বার নিচ থেকে। মাহতাব সাহেব ধরে ফেললেন। মুনতাহা কাঁশতে কাশতেই শুধালো,”পা.. পানি খাবো আব্বু।”
আরশাদ একটু এগিয়ে গেলো। মাহতাব সাহেব নিজ থেকেই একটু সরে দাড়ালেন। মুনতাহার কাশি থামেনা। আরশাদ দু’হাতে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বললো,
—“দেখি, উঠতে হবে মুনতাহা।”

শরীরে বল নেই। আরশাদ তুলে বসালো। পিঠের পিছে বালিশ দিয়েও বাহু জড়িয়ে ধরে রাখলো। মাহতাব সাহেব পানি ঠেকিয়ে ধরলেন ঠোঁটের কাছে। মুনতাহা অল্পএকটু খেলো। ঠিকঠাক খেতেও পারলোনা। থুতনি বেয়েই গড়িয়ে গেলো অনেকটা। আরশাদ স্বযত্নে মুছে দিলো হাত দিয়ে। মুনতাহা বুকের পাশটায় মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। কি গরম কপালটা। মাহতাব সাহেব অবিলম্বে জলপট্টি নিয়ে আসলেন। আরশাদ তখনো ধরে রেখেছে তাকে। মুনতাহা নিষ্প্রভ, নিশ্চল, গুঁটিয়ে আছে। মাহতাব সাহেব কিছু বললেন না। আরশাদ উঠতে চাইলো। মাহতাব সাহেব থামিয়ে বললেন,” থাক, ধরে রাখো। একা বসতে পারবে না। পড়ে যাবে।”
আরশাদ দিরুক্তি করলোনা। মাহতাব সাহেব রুমাল ভিজিয়ে কপালে দিলেন। পানি গড়িয়ে গড়িয়ে বুকের শার্ট ভিজলো।
ফোন বের করলো আরশাদ। মাকে জানানো দরকার।

ঘন্টা পেরোলো। মুনতাহার জ্বর কমেনা। উল্টো বাড়ছে। বাটির পানি পর্যন্ত গরম হয়ে যাচ্ছে বারবার। কপাল থেকে কাপড় সরিয়ে নেয়ার একটুপরই যেই না সেই। মাহতাব সাহেব ভেবে পেলেননা এত জ্বর উঠলো কি করে? দুপুরেই তো ভালো রেখে গেলেন।
এখনো আরশাদের বুকের পাশেই লেপ্টে আছে মুনতাহা। আনতারা পাতলা সুতির ওড়না ভিজিয়ে ঘাড়ে দিয়ে রেখেছে। যদি জ্বর কমে। আরশাদের শার্ট ভিজে একাকার।
বাটির পানি আবার গরম হয়ে গেছে। মাহতাব সাহেব বদলে আনতে গেলেন।
মুনতাহা মুখ উঁচিয়ে আরশাদকে বললো,”কাজি আসবে না? মেহমানরা চলে এসেছে?”আরশাদ তাকালো। ধীরগলায় বললো,”রাখেন আপনার বিয়ে। এত জ্বর, একটাবার ফোন করতে পারলেন না?”

মুনতাহা চোখ নামিয়ে নিলো,

—“ফোন তো নিতে পারিনি। ওইযে ফোন। উঠতেই পারলামনা। এত জ্বর এসে গেলো হঠাৎ করে। আমি ভেবেছি কমে যাবে।”

আরশাদ দেখলো ফোনটা টেবিলের উপর রাখা। বিছানা থেকে দুরত্ব অনেকটা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কপালের কাপড়টা উল্টে দিয়ে বললো,”থাক, উঠেছে উঠেছে। আপনি এখন চুপ করে চোখটা বন্ধ করে রাখেন। একটু পর কমে যাবে।”
মাহতাব সাহেব পানির বাটি নিয়ে এলেন। কপালের কাপড় পাল্টে দিলেন। আরশাদ ঘড়ি দেখলো। সাতটা দশ। সাড়ে সাতটার দিকে কাজি চলে আসবে। হাঁফ ছেড়ে পরিষ্কার গলায় বললো,”সবাইকে মানা করে দিন আংকেল। কাজিকে আসতে মানা করুন। ও সুস্থ হোক। পরে ওসব হবে।”
মুনতাহা বাঁধা দিলো,”নাহ, আমি পারবো।”
আরশাদ মৃদু স্বরে ধমকে উঠলো,
—“কি পারবেন? বসতে পারছেন না ঠিকমতো। আবার বলছেন পারবেন। আংকেল, আপনি মানা করে দিনতো।”
মুনতাহা হাঁসফাঁস করে বললো,
—“আব্বু না, শুধু শুধু খারাপ ভাববে সবাই। আমি ঠিক আছি। তুমি কাউকে মানা করবেনা।”

আরশাদ ধমকালো আবার। মুনতাহা নিভলোনা। গোঙাতে গোঙাতে অসহায় কন্ঠে বললো,”আপনি-ই না বললেন সেদিন, আমি শুধু কবুল বললেই হবে। আমি কবুল বলতে পারবোতো।”
আরশাদ জবাব দিতে গেলো। মাহতাব সাহেব থামিয়ে দিলেন,
—“আরশাদ থাক, ও কথা শুনবেনা। জেদ করবে। বিয়েটা হোক শুধু। কবুল বললেই তো হলো।”

আধঘন্টার মধ্য কাজি এলো। মুনতাহার জ্বর তখন তুঙ্গে। তবু দমেনা সে। বাবার অসম্মান হোক কোনোক্রমেই চায়না। আজ বিয়ে না হলে মানুষ উল্টোপাল্টা বলবেই সে জানে।
মাথায় পানি ঢালা হয়েছে একটু আগে। চুল ভেজা। মাথার পিছে আরশাদের বুক। মুনতাহা কাঁপতে কাঁপতেই ‘কবুল’ বললো। আরশাদ হাত ধরে ধরে সাইন করালো। নিজেও করলো। মেয়েটার এতো জেদ। বিয়েটা হয়ে গেলো।
কাজি সাহেব বেরিয়ে যেতেই ডুঁকরে উঠলো মুনতাহা। কেমন যেনো করলো। এতক্ষনের জোর করে চেপে রাখা যন্ত্রনাটা যেনো বেরিয়ে এলো হঠাৎই। আরশাদ অস্থির কন্ঠে বললো,”কি হয়েছে?”
মুনতাহা কেঁদে ফেললো। করুণ অনুনয়ের বললো,

—“আমাকে একটু শক্ত করে ধরবেন? খুব খারাপ লাগছে।”

ভোরের প্রথম আলো ঘরে আসলে, তবেই চোখের পাতা এক করলো মুনতাহা। সারাটারাত জ্বরের ঘোরে গোঙাতে থাকা কন্ঠটা একটুখানি আরাম কুঁড়োলো। আনতারা ঘুমিয়ে পড়েছে বিছানায় হেলান দিয়ে। মুনতাহা আরশাদের বুকে। আরশাদ সজাগ নাকি না বোঝা গেলো না তবে চোখ বন্ধ। দু’হাত ব্যস্ত মুনতাহাকে ধরে রাখতে। আগলে রাখতে। মাহতাব সাহেব নম্র চোখে তাকালেন। তার অনুপস্থিতিতেও মেয়ে অযত্নে থাকবে না। এবার নিশ্চিন্ত। সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ালেন তিনি। একবার কপালে হাত রেখে জ্বর মাপলেন। একটু কম। ঘরের পর্দা টেনে নিলেন। বাতি নিভিয়ে দিলেন। চোখে আলো পড়লে মুনতাহা ঘুমোতে পারে না। সেই ছোটবেলার অভ্যাস।
ঘরের বাতি নিভে যেতেই চোখ মেললো আরশাদ। মাহতাব সাহেবকে দরজা আটকে বেরিয়ে যেতে দেখলো খুব নিশব্দে। ভোরের আবছা নীল আলো পাতলা পর্দা ফুড়ে ঘরভর্তি করছে। মুনতাহা তার বাহুডোরে। আরশাদ অন্ধকারেই গালে হাত রাখলো। নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,”সুস্থ হন চাঁদ, আমার যে এখনো জ্যোৎস্না দেখা বাকি।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here