অমানিশা❤️,পর্ব-১৭,১৮

0
1200

অমানিশা❤️,পর্ব-১৭,১৮
লেখিকা_মালিহা খান❤️
পর্ব-১৭

আজানের সুর ভেসে এলো। ফজর ওয়াক্ত। নতুন ভোর। নতুন প্রত্যুষ।
মুনতাহা তার আদরের শক্ত বুকের বা’পাশটায় এলোমেলো হাত বুলিয়ে আস্তে করে ডাকল,”আব্বু নামাজ পরবা না?”
আনতারা মুখে আচঁল চাপা দিলেন। মুনতাহা তাকাল একবার। চোখদুটো শুকনো। অনুভূতির খড়া লেগেছে। নিরব আর্তনাদরা হাহাকারে ফাঁটছে।
আনতারা দেখতে পারলেন না। মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলেন।
মুনতাহা কাঁদলোনা। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চোখ ফিরিয়ে মাথাটা পুনরায় এলিয়ে দিলো বাবার বুকে। বুকটা ঠান্ডা। বরফের মতো। এতো ঠান্ডা কেনো? শীত পড়েছে নাকি?
মুনতাহা ধীরপায়ে উঠে ফ্যান বন্ধ করে এলো। আবারো পূর্বের মতন বুকে মাথা পেতে ছোট্ট করে চুমু খেলো মাঝখানটায়। আনতারা ফের ডুঁকরে উঠলেন। মেয়েটা কম করে হলেও হাজারখানেক চুমু খেয়েছে।
মুনতাহা আদর করে বলল,”এ্যাই আব্বু? তোমার ঘুম তো এতো গাঢ় না। উঠো।”
মাহতাব সাহেব উঠলেন না। লাশ কি আর আবদার রাখতে পারে?
মুনতাহা আবার বলল,”তুমি না বলো নামাজ না পরলে আল্লাহ রাগ করে? উঠো না আব্বু। ওয়াক্ত পেরিয়ে যাচ্ছে। পরে কাজা হয়ে যাবে।”
আনতারা নির্বাক চেয়ে রইলেন। সাবিনা বেগম এককোঁণায় বসে চোখের জল মুছলেন গোপনে। মেয়েটার এবার কাঁদা দরকার। অনেকক্ষণ হলো চুপ করে আছে।
আজান শেষে মৃত্যু ঘোষনা হলো। একটি শোক সংবাদ, একটি শোক সংবাদ ধ্বনিতে চারপাশ নিঝুম ভোর আলোড়িত হতেই ঘরে প্রবেশ করলো আরশাদ। মসজিদে গিয়েছিলো। জানাজার কথা বলে এসেছে।
মুনতাহা মাথা তুলে মনোযোগ দিয়ে মাইকিং শুনছে। রক্তলাল নিষ্প্রাণ চোখদুটিতে আকাশছোঁয়া অবিশ্বাস। মাইকিং শেষ হলো। মুনতাহা আবার কান পাতলো বুকে। এই ঘোষনায় তার কিচ্ছু যায় আসে না। সে তো বাবার বুকেই আছে। এইতো বাবা। একটুপরেই উঠে যাবে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলবে,”আহা! আম্মা? এত কাঁদে নাকি? আব্বু একটু ঘুমিয়েইছিলাম শুধু।”
আরশাদ ধীরপায়ে এগুলো। পদচারণে শব্দ নেই। আনতারার সাথে চোখাচোখি হলো একবার।
মুনতাহাকে সরানো যাচ্ছেনা কিছুতেই। বাবার বুক থেকে কিছুতেই সরবে না সে। আরশাদের সাথে একচোট চিল্লাচিল্লি করেছে। শেষমেষ তাকে না সরিয়েই তখন বেরিয়ে গিয়েছিলো আরশাদ।

আরশাদ কাছে গেলেও মুনতাহা মুখ তুলে তাকায়না।
আরশাদ মৃত চোখে দেখে সে পাশে দাড়ানো মাত্র মুনতাহা বুকের শার্ট মুচরে ধরেছে। কি করবে এই মেয়েকে নিয়ে? দিশেহারা লাগলো।

এ্যাম্বুলেন্স এসেছিলো। আরশাদ মানা করে দিলো যখন, মুনতাহা কান্না থামিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ছিলো। মিনমিন করে বলছিল,”মানা করলেন কেনো?”
আরশাদ উওর দেয়নি।
সেই যে কান্না থামিয়েছে মুনতাহা এখন অবধি আর কাঁদেনি। একফোঁটা জল গড়ায়নি গাল বেয়ে।
লাশ বেশিক্ষণ রাখতে হয়না। দাফন করতে হবে। আরশাদ গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

ঘরভর্তি মানুষ কিলবিল করছে। মৃত পিতার লাশ আঁকড়ে কন্যার নিশ্চুপ নিরিবিলি শুয়ে থাকায় জল উপচেছে প্রতিটা চোখে। মুনতাহার চোখ বন্ধ। আনতারা ধীরগলায় ডাকল,”মা, উঠতে হবেতো।”

পাশ থেকে কে যেনো বলছে,”লাশ শক্ত হয়া যাইতাছে। গোসল আর কহন করাইবেন।”

মুনতাহা বুক থেকে মাথা তুললো। ক্ষিপ্ত চোখে তাকাল। সেকেন্ডের ব্যবধানে বাড়ি কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল,”যান এখান থেকে। যান বলছি। মা, যেতে বলেন এদের। কেন এসেছে? বের হন।”
আনতারা পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করলেন। তাড়াহুড়ো করে ফোন করলেন আরশাদকে। আরশাদ রিসিভ করেই ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
—“এইতো আসছি আম্মা, আসছি। মুনতাহা চিৎকার করলো মাত্র?”

ভোরের বাতাসে হেমলকের বিষ। মুনতাহার ফোঁলা চোখে ধোঁয়াটে অভিলাষ। বাবা চোখ মেলবে। অবশ্যই মেলবে। মেলতেই হবে যে।
আরশাদ ঢুকল। কবর খোড়া শেষ। কবরস্থান কাছাকাছিও নয়। বেশ দূরে। গোসল করিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সকাল হয়েই গেছে। এতক্ষণ লাশ রাখা উচিত না।
মুনতাহা কেমন করে যেনো তাকায়। আরশাদের বুকটা মোচর দিয়ে উঠে। পারে না সে মৃত শরীরটায় জান দিয়ে দেয়। কিন্ত হায়! সে অপারগ! চরম অধম!
মুনতাহা চেয়েই আছে। কিছু কি বলতে চাচ্ছে মেয়েটা? আরশাদ বুঝতে পারেনা চোখের ভাষা। খুব এলোমেলো লাগে শব্দ গুলো, কথাগুলো। খুব অনর্থক আবদার।
কাছে যায়। হাঁটু ভেঙে ঝুঁকে মুনতাহারমাথার পাশে হাত রেখে বলে,”আপনি যত দেরি করবেন, আংকেলের কষ্ট ততোই বাড়বে।”

—“আমার কাছে থাকতে আব্বুর কিসের কষ্ট?”

আরশাদ উওর দেয়না। চেয়ে থাকে। মুনতাহা থরথর করে কেঁদে ফেলে। ঠোঁট কাঁপে। চোখে উপচে উঠে দলা পাকানো কান্না। বাবার ধরে রাখা হাতটা ছুটে যায়। মুনতাহা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আরশাদকে। ঘরভর্তি মানুষ আরশাদ বাঁধা দেয়না। বারণ করেনা। সরায়না। মুনতাহা হেঁচকি তুলে কাঁদে। শ্বাস আটকে চোখের পানি ফেলে। বুকের শার্ট খামছে ঝাঁকি দিয়ে বলে,”আপনি কেনো কিছু করলেন না? কেনো করলেন না? বলুন। কেনো করলেন না?”
আরশাদ পূর্বের মতোই নিশ্চুপ। উওর নেই। বড়ই অভাব মুখ ফোঁটা জবাবের। কি করবে সে? মুনতাহার কান্নাগুলো আগুনের লাভার মতো বুকে ক্ষত সৃষ্টি করে।
মুনতাহা হাহাকার করতে করতেই শরীর ছেড়ে দেয়। নি:স্ব-র ন্যায় ফ্লোরে বসে পড়ে। আরশাদও বসে যায় হাঁটু গেড়ে। মুনতাহা মাথা ঠেকায় তার বুকেই। সাদা শাড়ি পরিহিত বিক্ষিপ্ত দেহ। তার ঝলমলে চাঁদের আজ পুরোটাই অমানিশা।
আরশাদ চোখের ইশারা করে। ড্রইংরুমের কিছু লোক এগিয়ে আসে দ্রুত। মাহতাব সাহেবকে নিয়ে যাওয়া হয়। আরশাদ দেখে মাহতাব সাহেবের ডান হাতটা মুঠো হয়েই শক্ত হয়ে গেছে। মুনতাহা যেভাবে ধরেছিলো এতক্ষণ, ঠি ক সেভাবেই। আঙুলগুলো নিচের দিকে বাঁকানো। তালুর থেকে হাল্কা ফাঁক। শুধু আরেকটা হাতের অভাব সেই বন্ধনীতে। শেষ সময়েও বাবা তার মেয়ের হাতই ধরে রেখেছিলো।

গোসল শেষ হলো। একতলায় গোসল করানো হয়েছে। আরশাদ ওখানেই। মুনতাহা উপরে। বুঝিয়ে রেখে এসেছে। লাশ মোড়ানো হলো কাফনে। আরশাদ শেষবারের মতো দেখে নিল মুখটা। মানুষটা তাকে প্রচন্ড ভরসা করেছিলো। এত আদরের মেয়েকে সারাজীবনের জন্য তাকে দিয়ে দেয়ার আগে একবারও আপত্তি করেনি। আরশাদ হাতের পিঠে চোখ মুছে। মুখ ঢেকে দিল। ধুপধাপ পায়ের শব্দ। আরশাদ চকিতে পিছে ফিরে। মুনতাহা নেমে এসেছে। সফেদরঙা আচঁল ছুটে গেছে কাঁধ থেকে। নিচের দিকটা আছরাচ্ছে পায়ের কাছে।
চরম অবহেলায় ধুলো মাখা হচ্ছে মুক্ল কাপড়।
অথচ গতরাতে এ জা’গায়েই পরিপাটি হয়ে দাড়িয়ে ছিল মেয়েটা। বাবাকে দেখবে এগারো দিন পর। কি বাঁধভাঙা খুশি ছিলো চোখদুটিতে।
আর সকাল না পেরোতেই তার এহেন এলোমেলো আবেশ। চোখে সেই বাবাকেই শেষ বিদায় জানানোর আঁকুতি। পৃথিবী বড়ই অদ্ভুত! নিয়ম গুলো বড়ই দূর্বোধ্য
আরশাদ এগিয়ে গেলো। একপলক আশেপাশে দেখে আঁচলে ভাঁজ দিয়ে তুলে দিলো কাঁধে। গালে হাত রেখে বলল,”কি হয়েছে?”

—“আব্বুকে দেখবো।” মুনতাহার ছোট্ট উওর।

আরশাদ ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল একবার। ছেলেমানুষে ভর্তি লাশের আশপাশ।
মুনতাহার মুখটা চুপসে গেলো নিমিষেই । উনি উওর দিচ্ছেননা কেনো? বাবাকে কি আর দেখাও যাবেনা? উনি কি মানা করে দিবে? মুনতাহা অনুনয় করে উঠল,”একটু দেখি? আর দেখবেনাতো।”
আরশাদ বুঝলো তার আশঙ্কা। সবাইকে বাইরে যেতে বলে জায়গা খালি করলো। আনতারা উপরের সিঁড়িতে দাড়িয়ে ছিলেন। মনে প্রশ্ন, মেয়েটার কে তারা আদৌ সামলাতে পারবে তো?
জায়গা খালি হলে সামনে থেকে সরে দাড়ালো আরশাদ। অঘোষিত অনুমতি পেয়েই ছুট লাগালো মুনতাহা।
তারপর? তারপর সেখান জুড়ে শুধুই হাহাকার, হাহাকার আর হাহাকার এবং হাহাকার। আরশাদ পাশেই দাড়িয়ে থাকে। মুনতাহা গলা ফাটিয়ে কাঁদলেও সে বিন্দুমাত্র বাঁধা দেয়না। মেয়েটার কাঁদা দরকার। সে ঠাঁই দাড়িয়ে রয়। কানে ভেসে আসে,”এটাই যেনো ওর শেষ কান্না হয়।”

মুনতাহা শান্ত হয়না। কাঁদতে কাঁদতে কেমন ঘোরে চলে যায়। চোখ বন্ধ অথচ মেয়েটা কাঁদছেই। নি:শ্বাস আটকে আসছে যেনো। আনতারা ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,”বাবা, অসুস্থ হয়ে যাবে। এমনেই গায়ে জ্বর উঠেছে।”
আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পাশে বসে মাথাটা সরায় লাশের বুক থেকে। হাত দুটো ধরে করে ছুটিয়ে নেয় কাফনের কাপড় থেকে। মুনতাহা বিরবির করছে,”আব্বু খুব নিষ্ঠুর হয়ে গেছে জানেন? আমি এত কাঁদলাম। এত ডাকলাম। তবু উঠলোনা।”কন্ঠে স্পষ্ট তীব্র অভিমান।
আরশাদ দু’হাতে উঠিয়ে দাড় করালো তাকে। মুনতাহা তখনও বিলাপ বকেই যাচ্ছে,”আব্বু নিষ্ঠুর হয়ে গেছে। খুব নিষ্ঠুর। আমার আব্বু এতো নিষ্ঠুর ছিলোনা।”

ঘরে তখন রাঙা সূর্যের আলো। একহাতে গাল চেপে হা করিয়ে আরেকহাতে হাই ডোজের ঘুমের ওষুধটা মুখে তুলে দিলো আরশাদ। মুনতাহা দূর্বল হাতে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে। আরশাদ একহাতে তার হাতদুটো আটকে আরেকহাতে পানি খাইয়ে দিলো। মেয়েটা শান্ত হবেনা নয়তো। তার যেতে হবে। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণের ব্যবধানেই ঘুমিয়ে পড়লো মুনতাহা। আরশাদ বুক থেকে সরিয়ে বালিশে শুইয়ে দিলো। গায়ে চাদর টেনে দিয়ে আনতারাকে বলল,”আপাতত ঘুমিয়ে থাক আম্মা। এ ঘরে কাউকে আসতে দিওনা।”
আনতারা মাথা নাড়ালেন। আরশাদ বেরিয়ে গেলো শক্তপায়ে।

—“আংকেল স্ট্রোক করেছিলেন। খুব সম্ভবত নিজের ব্যাবসাবিষয়ক কারণে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি। ড্রয়ারে রাখা কাগজপত্রগুলো দেখে আপাতত এতটুকুই বুঝেছি। ব্যাংকের অনেকগুলো রিসিট আছে সেখানে। এ কয়দিনে মোটা অংকের টাকা তুলেছেন বেশ কবার। লস হয়েছিল ব্যাবসায়। সেগুলো ঘিরেই বোধহয় খুব বেশি দুশ্চিন্তা করেছেন। তাছাড়া উনার প্রেশারও আন্ডার কন্ট্রোল ছিলোনা। অতিরিক্ত প্রেশার উঠেই মাঝরাতে স্ট্রোক করেছেন। আর মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণেই..”

এটুকু বলো থামলো আরশাদ। কন্ঠস্বরে মনে হলো কিছু একটা থামিয়ে দিয়েছে তাকে।
তার ঘরের দরজা খোলা। মুনতাহা ঘুমাচ্ছে তখনো। দুপুর গড়িয়ে বিকাল নেমেছে। মেয়েটার ঘুম ভাঙেনি। বেহুশের মতো ঘুমাচ্ছে। আরশাদ সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ালো। মেয়েটার জন্য হলেও বাকি কথাটা সে কখনোই সামনে আসতে দিবে না।

চলবে

#অমানিশা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৮

ব্যস্ত পথের কিনার ঘেঁষে রাধাচূড়ার মোহনিয়া হাসি। মাথায় ফোঁটা লাল মুকুটে দূর্নিবার সৌন্দর্যের অহং। শেষ দুপুরের সোনারঙা রোদপাটিতে কয়েকজোড়া ক্লান্ত কাঠশালিক চোখ বুজে বিশ্রাম নিচ্ছে, মাঝেমধ্য আবার ঘাড় বাকিয়ে ঠোঁট ঠুকরে ঠুকরে চুলকে নিচ্ছে ডানা-কাঁধপিঠ।
উশৃঙ্খল হর্ণের শব্দ, বাসের ধোঁয়ায় জটালো পরিবেশ। হরহামেশার শহরের রাস্তাভর্তি থোকা থোকা যানযটের মাঝেই ভীড়হীন ফার্মেসির সামনে বাইক থামালো প্রাপ্তবয়স্ক এক দীর্ঘদেহী যুবক। গায়ের আকাশীরঙা ভেজা শার্ট দেখে সূর্য বোধহয় মায়া করেই তার উপর রোদ লাগালোনা। রাধাচূড়া বোধহয় প্রেমে পরেই একটু দুলিয়ে দিলো তার ডালপালা। একটু ঠান্ডা বাতাসে শান্তি মেলাতে চাইলো যুবকের দেহে। অথচ বোকা রাধাচূড়া জানেই না,’যার ভেতরে উথালপাতাল তার বাহিরে শান্তি মেলানোর চেষ্টা বৃথা বই কিছুনা।’
দীর্ঘক্ষণ বাইকের হ্যান্ডেল চাপা ঘর্মাক্ত লালাভ হাতে হেলমেটের কাঁচ উঠালো যুবক। কাঁচের উপর সহসাই ছাপ বসে গেলো আঙুলের ঘামের। ফার্মেসীতে বসে থাকা পন্চাশোর্ধ ব্যক্তিটাকে বলতে হলোনা, যুবককে দেখামাত্র একপাতা নির্দিষ্ট ওষুধ বের করে বাদামী রঙা প্যাকেটে ঢোকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।
যুবক হেলমেট খুলেছে ততক্ষণে। রাধাচূড়া প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে তার গতি বাড়িয়েছে। সাঁই সাঁই করে দুলছে পাতাভর্তি ডালপালা। যুবক ক্লান্তিহীন অবসাদ চোখে তাকাল। কনুইয়ের কাছে কপালের ঘাম মুছে, পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে করতে আওয়াজ বাড়িয়ে বলল,

—“দু’পাতা দিন চাচা, কালরাতে এগারোটার দিকে ঘুরে গিয়েছি। আপনি তো আগেই দোকান বন্ধ করে নিরুদ্দেশ।”

উওর এলো,
—“অতো রাইতে কি আর দোকান খোলা রাখা যায় বাজান? ওষুধ তো গোনাই আছিলো। তুমি তো দুইদিনের ডা বাড়াইয়া নাও। তাও শ্যাষ হইলো ক্যম্নে?”

ঘর্মাক্ত যুবক হাসে। হাসির ফাঁকে ঢাকার চেষ্টা করে মনের মলিনতা। ঢাকা পরে কিনা জানেনা তবে চাচা আর সংলাপ বাড়ায়না। কথামতো আরেক পাতা ওষুধ প্যাকেটে ভরে স্ট্যাপলার মারে সশব্দে।
যুবক মানিব্যাগ মেলেছে। সূর্য তখন তেরছাভাবে আলো ফেলেছে মানিব্যাগের এককোঁণে। যেখানটায় প্লাস্টিকের আবরণের ভেতর দেখা যাচ্ছে এক যুবতীর সাদা কালো ছবি। নাহ্, কোনো হাস্সোজ্জ্বল চেহারা নয়। বরং গাছের ফাঁকে আটকে যাওয়া ওড়নার আচঁল ধরে বিরক্তিতে ভরা মুখটাই অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেখানে। একপাশে ঝুলছে তার লম্বা বেণি। ছবিটা ঝাপসা। ক্যামেরাটা কেঁপে গেছিলো। পাশের টং দোকানভর্তি মানুষ ছিলো যে। কেউ দেখে ফেললে!
যুবক স্মিত হাসে। হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল বুলায় পার্সপোর্ট সাইজের সাদাকালো ছবিটার উপর। ঠোঁটের হাসি অজান্তেই গাঢ় হয়। কোঁণ ছড়িয়ে যায় গোপনে। শহরের প্রেমহীন রাস্তার ধারে দাড়িয়ে এক ভয়ংকর প্রেমিকের মনে নাড়াচাড়া দিয়ে ওঠা পবিত্র প্রেমকে সম্মান জানিয়েই বোধহয় একটা তাজা রাধাচূড়া ডাল ছুটে যায়। নিজ ইচ্ছায় জীবন বিসর্জন দিয়ে টুপ করে পড়ে রংহীন ছবিটার উপর। যুবক অবাক হয়। ভাবনায় ভাটা পড়ে। চিবুক উচিয়ে মাথার উপর তাকায় সে। লালফুলগুলো হাসছে যেনো। আহা!
আচ্ছা, মুনতাহা ঠি ক কতদিন হাসেনা?

—“ভাই, আপামনি রে দিয়েন।”

ডাকে ধ্যান ভাঙল। দ্রুত মানিব্যাগ ভাঁজ করে ফেলল যুবক। রাধাচূড়াটা অযত্নে পড়ে গেলো ধূলোমাখা রাস্তায়।
একটা ছোকরা ছেলে। বয়স দশ-এগারো। শ্যামলা চেহারা। হাতের বাদামী কাগজের প্যাকেটের উপর আরেকটা সিভিটের পাতা ধরা। বোঝা যাচ্ছে সেটাই তার আপামনিকে দেয়ার কথা বলছে ছেলেটি। আরশাদ মুচকি হাসে। ছেলেটার কোকড়ানো চুলে আদুরে হাত বুলায়। মানিব্যাগটা হাল্কা খুলে আঙুলের চিমটিতে টাকা বের করতে করতে বলে,
—“বাসায় আসিস না কেনো? আপামনি তো রোজই বলে তোর কথা।”

ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে হাসে। আহ্লাদে আটখানা হয়ে যায় চোখের কালো মনি। আরশাদ হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিতেই দোকানের ভেতরে থেকে চাচা ভরাট গলায় বলে,
—“ওটার টাকা দেয়া লাগবেনা।”

আরশাদ জোর করেনা। লাভ হবেনা। শুধু ওষুধের দাম মিটিয়ে প্যাকেটটা পকেটে ভরে নেয়। রাধাচূড়া তখনো দুলছে। প্রেমে সে কুপোকাত। হেলমেটটা পরতে পরতেই বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। ঘুমকাতুরে মুনতাহা এখন ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুমোয়না। চোখের নিচে দু’ইন্চি কালির পরত বসে গেছে। ঘুমের ওষুধে সারারাত বুঁদ করে রাখলেও ওষুধের সময় কেটে গেলেই আবার সেই নিদ্রাহীনতা।
একসময় মেয়েটা বেলা অবেলা ঘুমাতো। অফিস থেকে ফিরে তার এলোমেলো ঘুম দেখাই ছিলো আরশাদের একমাত্র ভালোলাগার কর্ম। অথচ.. অথচ এখন?
আরশাদ আকাশের দিকে চাইলো। সাদা শুভ্র মেঘে একফোঁটা গলিত স্বর্ণের সূর্য।
প্রথম প্রথম মুনতাহা ওষুধ খেতেই চাইতোনা। ডাক্তার বলেছিলো এমন না ঘুমিয়ে থাকলে শরীর আরো খারাপ হবে। তবু সে জোর করতোনা। কিন্তু…কিন্তু মেয়েটা যখন সারারাত পাশে শুয়ে মৃতের মতো দু’চোখ মেলে ঘরভর্তি অন্ধকারে চেয়ে থাকতো, মাঝেমধ্য উঠে বসে,”আব্বু এসেছে”, “আব্বু এসেছে” বলে হাঁসফাঁস করতো, তখন আর পারতোনা আরশাদ। দু’গাল চেপে ওষুধ মুখে দিয়ে দিতো। মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়তো। তারপর ধীরে ধীরে, একটাসময় মুনতাহা নিজেই হা করতো। একটা ওষুধ খাইয়ে পানির গ্লাস নামিয়ে রাখলে বলতো,”আরেকটা দিন, আমার ঘুম আসেনা।”
আরশাদ ওষুধের পাতা ড্রয়েরে রেখে ড্রয়ের তালা দিয়ে রাখে। চাবিটা নিয়ে আসে সঙ্গে। মেয়েটা একবার ঘুমের জন্য একসাথে দুটো ওষুধ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। সে কি দৌড়দৌড়ি!

হেলমেটের বেল্ট লাগিয়ে বাইক স্টার্ট দেয় আরশাদ। ধোঁয়াটে বাতাস ছেড়ে চাকা ঘুরলো।
সেই চাকার নিচেই লাল রাধাচূড়াটাকে পিষ্ট করে বাইক ছুটালো আরশাদ।
মোড়ের বাঁক ঘুরে আরেকটা দোকানের সামনে থামলো বাইক। আরশাদ নেমে দাড়াল। কিছুক্ষণের পর্যবেক্ষণে ঠোঁট ফুঁড়ে বেরোলো,
—“একজোড়া নিবো। ওই ঝুঁটিওয়ালা গুলো। কতো পড়বে?”

কাঁচা হলুদের আচঁলে গাঢ় কমলা ফুলের বাগান। পিঠে এঁকেবেঁকে লুটিয়ে পড়েছে দীর্ঘ ঢিলে বেণি। রাঙা
রোদ সরাসরি পরেছে গলার কাছে। চিকচিক করছে স্বর্ণের চেইন। ব্যালকনির ফ্লোরে পা ভাঁজ করে গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে এক রুপবতী দু:খিনী। সারারাত নির্ঘুম ছটফটানোর ফলাফল হিসেবে ব্যাথায় এখন মাথার খুলি ফেঁটে চৌচির।

কলিংবেল বাজলোনা, তবে দরজা খোলার খুটখাট শব্দে ঘাড় ঘোরালেন আনতারা। ছেলের মুখ দেখার আগে নজরে এলো তার হাতে ধরা বড় একটি খাঁচা। ভেতরে দুটো সাদা পায়রা কৌতুহলী চোখে এদিক ওদিক দেখছে। আরশাদ খাঁচাটা নামিয়ে রাখলো মাটিতে রাখলো। দরজা আটকে পায়ের জুতো খুললো। আনতারা
কবুতর দুটির দৃষ্টির ন্যায় কৌতুহলী কন্ঠে ই বললেন,
—“কবুতর এনেছিস কেনো?”

আরশাদ মুচকি হাসে। অকপটে বলে,”ওর কবুতর খুব পছন্দ আম্মা। একবার কিনে দিবো বলেছিলাম। সেজন্যই আরকি..”

—“ভালোই করেছিস। এদের সাথে একটু ব্যস্ত থাকলেও হয়।” আনতারার কন্ঠে ক্ষীণ আশা। আরশাদ হাসে শুধুই। খাঁচাটা তুলে নিয়ে বলে,
—“কই ও? ঘরেই? দুপুরে খায়নি তাইনা? তুমি একটু খাবারটা বেড়ে দাও আম্মা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিবো। আসলে সারারাত ঘুমোয়নি তো। খেতেও তো ভাল্লাগে না।”

কথায় আছে,”আজ মরলে কাল দুদিন।” মৃত মানুষকে নাকি কেউ মনে রাখেনা। একসময় সবাই ভুলে যায়।
অথচ আজ আড়াইমাস পেরিয়ে গেলো মুনতাহা অসুস্থ। মাহতাব সাহেবের মৃত্যুর পরে মেয়েটা সেই যে অসুস্থ হলো। খাবারের প্রতি অনিহা বেড়ে গেলো, চুপচাপ মেয়েটা যেনো এবার বোবাই হয়ে গেলো, একমনে কি যেনো ভাবতো বসে বসে, ঘুমাতে পারতোনা রাতে। শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হলো। সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে নিয়ে গেলো। উনি বললেন, বাবাকে ভুলতে পারেনা। বাবার আকস্মিক মৃত্যু ভুলতে পারেনা। ব্রেনে এফেক্ট করে। যে করেই হোক, বাবাকে ভুলে থাকতে হবে।
কতদিন গিয়েছে এমন, সারারাত বুঝিয়ে বুঝিয়ে রেখে ভোরবেলা উঠেই তাকে নিয়ে কবরস্থানে ছুটেছে আরশাদ। মুনতাহা যেয়ে চুপচাপ বসে থেকেছে ঘন্টার পর ঘন্টা।
আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার। জীবনটা তার দীর্ঘশ্বাসেই আটকে গেছে যেনো। কবুতরগুলো উড়ছে, লাফাচ্ছে খাঁচা ভরে।

মুনতাহার চোখ বোজা। আরশাদ অবাক হয়। বিস্ময় নিয়ে দেখে। মেয়েটা ঘুমিয়ে পরেছে? সত্যি নাকি মিথ্যে? ভ্রম নাকি কল্পনা?
খাঁচাটা নামিয়ে রাখে নিশব্দে। দু’কদম এগোতেই চোখ মেলে মুনতাহা। হঠাৎ পাওয়া মুক্তো-ঝিনুকটা যেনো সেখানেই হারিয়ে যায়। আরশাদ তবু হাসে। বলে,”ওহ, জেগে আছেন? আমি ভাবলাম ঘুমিয়ে পরেছেন।”
মুনতাহা পলক ঝাপটানোর চেষ্টা করে। আরশাদ হাঁটুগেড়ে বসলো। বহুদিনের অভ্যাসবশত কপালের চুল কানে গুঁজে দিয়ে বলল,”দুপুরে খাননি কেনো? চলুন খাবেন।”

মুনতাহা হেলানো শরীর সোজা করে। দূর্বল হাতে চোখ কচলে ক্ষীণ কন্ঠে বলে,”আপনি ওষুধ এনেছেন?”

—“এনেছি। কিন্তু কিছু একটু খেয়ে তারপর খেতে হবে। ঘুমোলে আপনি মাঝরাতের আগে উঠবেননা মুনতাহা।”

মুনতাহা মাথা নাড়ায়। পিছে কিছু একটা চোখে পড়তেই দৃষ্টি পরিষ্কার করার চেষ্টা করে। আরশাদ তার চোখ অনুসরণ করেই বলে,

—“আপনার পায়রা। পছন্দ হয়েছে?”

মুনতাহা উওর দেয়না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে খাঁচার দিকে। চোখে কি একটু খুশি দেখা যায়? একটু আনন্দ উচ্ছাস দেখা যায়? আরশাদ বুঝে না।

ভাতের ছোট্ট লোকমাটা মুখে নিয়েই বাঁধ সাধলো মুনতাহা। কপাল কুঁচকে চরম অনিহায় বলল,”আর না।”
আরশাদ প্লেট নামিয়ে রাখলো। বিষাদ চোখে দেখলো, পাতে তখনো অর্ধেকের মতো ভাত পরে আছে।
মুনতাহা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে রেখেছে। আরশাদ বা’হাতে টেবিলের উপর থেকে ওষুধটা তুলে খাইয়ে দিয়ে বলল,”ঘুমান। চোখ লাল হয়ে আছে কেনো? মাথা ব্যাথা কমেনি?”

মুনতাহা দু’পাশে মাথা নাড়ায়। অর্থ্যাৎ,”কমেনি।”
ছোট্ট মস্তিষ্কে হাই পাওয়ারের ওষুধ কাজ করে তাড়াতাড়ি। নিমিষেই ঘুম ধরে যায় চোখে।
মুনতাহা ঘুমিয়ে পড়ে। মাথাটা পাশে হেলে পরতেই আরশাদ এলোপাথারি ঠোঁট ছোঁয়ায় তার মলিন চাঁদমুখে। বারান্দা থেকে পায়রাদুটোর ডাক শোনা যাচ্ছে। বাকবাকুম বাকবাকুম।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here