অমানিশা❤️,পর্ব-২১(সমাপ্তিপাতা)

0
3166

অমানিশা❤️,পর্ব-২১(সমাপ্তিপাতা)
লেখিকা_মালিহা খান❤️

সন্ধ্যার পর হঠাৎই সাবিনা বেগম মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। রাতের খাবারের জন্য বেরোতে নিচ্ছিলেন, ঘরের দরজা পেরিয়ে একটু এগোতেই মাথার যন্ত্রনা তীক্ষ্ন সুঁচের মতো বিঁধলো যেনো।
আনতারা চিৎকার করে দৌড়ে এলেন। মেঝেতে বসে মা তুল্য শাশুড়ির মাথা কোলে তুলে নিলেন। অভিসঙ্কিত উচুকন্ঠে ছেলেকে ডাকলেন,”আরশাদ? আরশাদ এদিকে আয় জলদি। আম্মা? ও আম্মা, কি হলো?”
মুনতাহা রান্নাঘরে ছিলো, আনতারার বিকট চিৎকারে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো সেও। সাবিনা বেগমকে অচেতন পড়ে থাকতো দেখে ছোট্ট মন ঘাবড়ে গেলো মূহুর্তেই।
আরশাদ আসলো। কয়েকমূহুর্ত স্তব্দ চেয়ে থেকে দ্বিগবিদিক দিশেহারা মাকে কোনরকমে সাহস দিয়ে দাদিকে পাঁজকোলা করে ঘরে নিয়ে গেলো। বিছানায় শুঁইয়ে মুখে পানি ছিঁটালো। তবু জ্ঞান ফিরলোনা। আনতারা হু হু করে কেঁদে উঠলেন। মাথায় হাত বুলাতে যেয়ে টের পেলেন, তালু প্রচন্ড গরম হয়ে আছে। আরশাদকে বলতেই সে ব্যস্ত গলায় বলল,”প্রেশার আর ডায়বেটিস টা মাপেন তো মুনতাহা। আমি ডাক্তারকে ফোন করছি।”
মুনতাহা উঠে গেলো, মেশিন এনে প্রেশার মাপলো। হাই-প্রেশার। ডায়বেটিস বেড়ে গেছে। আনতারা ঠান্ডা পানিতে গামছা ভিজিয়ে এনে ঘাড় গলা মুছে দিলেন। আরশাদ ফোন নিয়ে ঘরের বাইরে গিয়েছে। মিনিটের মাথায় ফিরলো যখন, সাবিনা বেগমের জ্ঞান ফিরলো তখনই। আনতারা যেনো রক্ষে পেলেন। শুকনো কলিজায় যেনো পানি মিলল সামান্য। শাশুড়ির কপালে হাত রেখে ধরা গলায় বললেন,”আম্মা? আম্মা খারাপ লাগে?”
মুনতাহা বা’হাত কোলে নিয়ে ধরে রেখেছে শক্ত করে। একটু আগে ভালো মানুষটাকে শুইয়ে দিয়ে গেলো। মাথা টি পে দিলো। ঘুম পাড়িয়ে তবেই ঘর থেকে বেরোলো। অথচ ঘন্টা দেড়েক না পেরোতেই মানুষটা এমন অসুস্থ হয়ে পড়লো?
সাবিনা বেগম মলিনচোখে চাইলেন। মুখে বলতে পারলেন না কিছু, তবে আস্তে আস্তে ডানহাতটা উঠিয়ে আনতারার হাত আঁকড়ে ধরলেন। মেয়েটা পাগলের মতো করে তার জন্য।
আরশাদ যেয়ে দু’হাতে ধরে উঠালো দাদিকে। মুনতাহা পিঠের পিছে বালিশ দিলে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো। শরীর কেমন অবশ হয়ে গেছে। ভার ছেড়ে দিয়েছে। তবু জ্ঞান থাক।
আনতারা মগের পানিতে আবার গামছা ভিজিয়ে ঘাড়ে দিয়ে রাখলেন। একহাতে জড়িয়ে ধরে রাখলেন শক্ত করে। নয়তো হেলে পরে যাবেন। মুনতাহা আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,”পানি খাবেন দাদু?”
সাবিনা বেগম পূর্বের ন্যায় মলিন চোখেই চাইলেন। উওর দিতে পারলেন না।
মুনতাহা সম্মতি ভেবে বেডসাইড টেবিলে রাখা জগের দিকে হাত বাড়াতেই আরশাদ খপ করে তার হাত ধরে ফেললো। মুনতাহা প্রশ্ন চোখে তাকাতেই অন্যদিকে চেয়ে কন্ঠ ব্যস্ত করে বলল,”একটু…একটু আসেন তো দেখি।”
সাবিনা বেগম চোখ বুজে রেখেছেন।
মুনতাহা পাল্টা প্রশ্ন করার সুযোগও পেলো না, আরশাদ তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে গেলো। মুনতাহা বিস্মিত কন্ঠে বলল,”কি হয়েছে? নিয়ে আসলেন কেনো?”
আরশাদ একবার ফোনের দিকে তাকাল। কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলল,

—“আপনার কবুতরগুলো ঘরে উড়োউড়ি করছে মুনতাহা। ওদের কে খাঁচায় ঢুকিয়ে আসেন। ঘরে ফ্যান ছাড়া।”

মুনতাহার চোখদুটো অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেলো যেনো। বিস্ময় লুকোনোর চেষ্টা না করেই বলল,”দাদু অসুস্থ, আমি এখন কবুতর ঢুকাবো?”

—“ডাক্তার আসছে তো। আপনি যান, যেটা বলেছি সেটা করেন।”আরশাদের কন্ঠে আদেশ।

বোকা মুনতাহা বুঝলোনা কিছুই। কিছুক্ষণ গোলমেলে চেয়ে কবুতর ঢোকানোর জন্য চলে যেতেই স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো আরশাদ। ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটুক।


সাবিনা বেগম ঘুমোচ্ছেন। ডাক্তার সফিক বাসায় এসেছে অনেকক্ষণ। বয়স্ক লোক। আরশাদের পরিচিত। দেখেশুনে ওষুধ দেয়ায় প্রেশার নেমেছে কিছুক্ষণ আগেই। ঘুমের ইনজেকশনের প্রভাবে শান্তি ঘুমোচ্ছেন এখন।
আনতারা ক্লান্ত গলায় বললেন,”কি হয়েছে আম্মার? হঠাৎ এমন মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন কেনো? আগে তো কখনো এমন হয়নি।”
সফিক দ্বিধাগ্রস্ত চোখে আরশাদের দিকে তাকালেন। চোখের দৃষ্টিতেই বোধহয় আরশাদ বুঝলো উনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন। মৃদুকন্ঠে বলল,”বলুন আংকেল, সমস্যা নেই।”

—“উনার মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে। এটা হলো স্ট্রোকের মতো কিছু উপসর্গ যা কয়েক মিনিটব্যাপী থাকে এবং তৎপরপরবর্তীতে শরীরের কোনো স্হায়ী দূর্বলতা দেখা যায় না। কিন্তু চিকিৎসা না নিলে মাইল্ড স্ট্রোকের রোগীরা তিন মাসের মধ্য মেজর স্ট্রোকের আক্রান্ত হতে পারে।
আপাতত টেস্ট ছাড়া তো কিছু বলতে পারছিনা। সিটি স্ক্যান বা এম আর আই করে দেখতে হবে এটা ইস্কেমিক স্ট্রোক না হেমোরেজিক স্ট্রোক। তারপর সে অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট চলবে।”

বলে থামলেন সফিক। মুনতাহা আরশাদের পাশে দাড়িয়ে আছে। একপলক দুজনকে দেখে আবার বলতে শুরু করলেন,
—“উনাকে স্ট্রেস নিতে দিবে না, চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। আর যেহেতু উনি ঝুঁকিতে আছেন তাই একটু বেশি কেয়ারফুল তো থাকতেই হবে।
হঠাৎ স্ট্রোক করলে যেমন না জেনে কিছু খাওয়াতে হয়না। কোন ধরণের স্ট্রোক না জেনে ওষুধ খাওয়ানো
ঠিক না। ক্ষতি হতে পারে। খাবার এমনকি পানিও খাওয়ানো উচিত নয়। শ্বাসনালিতে গিয়ে রোগীর অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে। তাছাড়া..”

আরশাদের বুকটা ধক করে উঠলো। শরীরের শিরায় শিরায় বয়ে গেলো খরধার ত্রাস। এতদিন যাবত যেই কথাটা সে নিজের ভেতর চেপে রেখেছে তা এভাবে প্রকাশ পেয়ে গেলো? পাশ ফিরে মুনতাহার দিকে তাকানোর সাহস হলোনা। কেটে গেলো দু’তিনসেকেন্ড। মেয়েটাকি কথাটা খেয়াল করেনি তবে? আরশাদের মনের ক্ষীণ আশাকে অদৃশ্য ছুড়িকাঘাতে হত্যা করে মুনতাহা থেমে থেমে বলল,

—“ক..কি..খাওয়াতে…হয়না?”

আরশাদ চোখ বোজল। হাতের মুঠ শক্ত হয়ে গেলো। কেনো? কেনো? এতগুলো মাস পর মেয়েটা স্বাভাবিক হয়েছে। হাসছে, কথা বলছে, ছুটোছুটি করছে। কি দরকার তাকে আবার দুমড়েমুচড়ে ধুলিস্যাৎ করে দেয়ার? কি দরকার তাকে দোষের সাগরে ঝলসে দেয়ার?বুকের ধুকপুকানি আরো বাড়িয়ে মুনতাহা ফের জিজ্ঞেস করলো,

—“কি খাওয়াতে হয়না?”

শফিক চেয়ে ছিলেন। মেয়েটাকে তিনি প্রথমবার দেখছেন না। আগেও বেশ ক’বার সাক্ষাত ঘটেছে তাদের।
আরশাদের বিয়ের বিষয়টা তিনি জানতেন না। সেবার যে দুটো মাত্রাতিরিক্ত হাই ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়ে এই মেয়েটার মৃতপ্রায় অবস্থা হলো, আরশাদ ছেলেটা রাতের বেলা নি:সহায় হয়ে তাকেই ফোন করেছিলো। পাগলের মতো অচেতন মেয়েটাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো। তার ছটফটে অনুরোধে তিনি সেই রাতের বেলাই ইমারজেন্সিতে ছুটে গিয়েছিলেন।
যেয়ে যখন দেখলেন, পেশেন্ট একটা অল্পবয়সী মেয়ে, অনেকটা অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করেছিলেন,”ও কে আরশাদ?”
আরশাদ থরথর কন্ঠে বলেছিলো,”আমার বউ, ও আমার বউ আংকেল। রাতে ঘুম হয়না দেখে না বুঝে দুটো ওষুধ খেয়েছে। এখন আর চোখ খুলছেনা। ও এমনিতেও একটু দূর্বল তো। একটু তাড়াতাড়ি দেখুননা আংকেল।”
উনি অবাকই হয়েছিলেন। আরশাদ যথেষ্ট ব্যাক্তিসম্পন্ন মানুষ। বউকে নিয়ে তার এহেন আহাজারিতে কোথায় যেনো একটু নড়ে উঠেছিলেন তিনিও।

মুনতাহা এখনো চেয়ে আছে উওরের আশায়। শফিক মৃদু হেসে বললেন,

—“কিছুই খাওয়ানো উচিত নয় মা। অনেকসময় খাবার, পানি এগুলো খাদ্যনালিতে না গিয়ে শ্বাসনালিতে চলে যেতে পারে তো। উল্টোপাল্টা ওষুধ দিলেও…”

আরশাদ মাঝপথেই উঠে দাড়ালো। যা হবার হয়েছে। এতদিন সামলেছেনা? এবারও সামলে নেবে। বললো,”আসুন আংকেল, আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। রাত হয়ে গেছে।”

শফিক বুঝলেন না। একবার চেয়ে দেখলেন মুনতাহা মেয়েটা কেমন থমকে দাড়িয়ে আছে। আরশাদই বা হঠাৎ এভাবে উঠে দাড়ালো কেনো? আরশাদ আবার তাড়া দিলে আর ঘাটলেন না তিনি। উঠে দাড়ালেন।
আরশাদ একবার মুনতাহার দিকে চাইলো। মেয়েটা কি যেনো ভাবছে। নীরস চোখে পলক ফেলছে আর কি যেনো ভাবছে ফ্যাল ফ্যাল করে। বুকটা ছিঁড়ে গেলো আরশাদের। কি করবে সে?
শফিক চলে গেলেন। আরশাদ নামিয়ে দিয়ে ফিরে এলো। দরজা আটকাতে আটকাতে ভাবলো, তাকে বুঝাতে হবে। যেভাবেই হোক মেয়েটাকে তার বুঝাতেই হবে। সিদ্ধান্তের দোরগোড়ায় যখন সে হাজিরা দিচ্ছিলো তখনই পেছন থেকে কাতর কন্ঠস্বর শোনা গেলো,

—“আপনি জানতেন তাইনা?”

হাত থেমে যায়। বুকের স্পন্দন বিরতি নিয়ে চলে। আরশাদ চোখ বুজে শ্বাস নেয়। পেছনে ঘুরে দেখে মুনতাহা ঠায় দাড়িয়ে আছে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,”কি জানতাম?”

মুনতাহা ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকে। মৃত গলায় বলে,”আব্বুকে আমি পানি খাইয়েছিলাম।”

আরশাদ কাছাকাছি যেতেও পারলোনা তার আগেই মুনতাহা গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো,”আপনি জানতেন, আপনি জানতেন আব্বুকে আমি মেরে ফেলেছি। এই যে এই হাত দিয়ে…আমি জানি আপনি জানতেন।” মুনতাহা ধপ করে বসে পড়লো। তার চিৎকারে তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে ছুটে এলেন আনতারা। আরশাদ তখন মেঝেতে বসে মুনতাহাকে বুকে টেনেছে জলদি। শক্ত করে ধরে বারবার করে বলছে,”আপনি কিছু করেননি মুনতাহা। আপনি জানতেন না।”
মুনতাহা মানেনা। অবোধ মন কথা শোনেনা। আরশাদের বুক খামছে ধরে একই বুলি আওড়ে যায়,”আব্বুকে আমি মেরেছি। আমি মেরে ফেলেছি। আমি নিজহাতে আব্বুকে মেরে ফেললাম? এজন্যই আব্বু শ্বাস নিতে পারছিলোনা, তাইনা? আমি কেনো পানি খাওয়ালাম? কেনো খাওয়ালাম বলেননা?”
আরশাদ উওর দিতে পারেনা। মাকে ইশারায় দাদুর ঘরের দরজা ভিড়িয়ে দিতে বলে। আনতারা বুঝতে পারেনা কি হচ্ছে। মুনতাহার শ্বাস আটকে যায় গলায়। শ্বাস নিতে পারেনা।
আরশাদ রুদ্ধ গলায় বলে,”আম্মা পানি দাও। পানি দাও আম্মা।”
আনতারা দৌড়ে পানি নিয়ে আসেন। আরশাদ একহাতে জড়িয়ে ধরে অপরহাতে খাইয়ে দেয়। মুনতাহা পাগলের মতো করে। মুখ থেকে পানি পড়ে শাড়ি ভিজে যায়।
আরশাদ হাত দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়।

সেদিন রাতে মুনতাহা যখন তাকে ফোন করে ডাকলো। সে যাওয়ার পরপরই বুঝেছিলো মাহতাব সাহেব নিশ্বাস নিতে পারছিলেন না। তবে তার জানা মতে ব্রেইন স্ট্রোকে নিশ্বাসের সমস্যা হবার কথা না। বারবার শ্বাসটান উঠছিলো। মুনতাহা বুক জাপটে মাথা গুঁজে রেখেছিলো বিধায় বুঝতে পারেনি বাবার হাঁসফাঁস। মাহতাব সাহেব মাথার যন্ত্রনায় পিছে দিকে হাত ঠেস দিয়ে ঝুঁকে ছিলেন। সে অবস্থায়ই হয়তো পানি খাইয়েছিলো মুনতাহা।
আরশাদ তো দেখেনি তাই বুঝেওনি কেনো তিনি নিশ্বাস নিতে পারছেন না। বুঝলে হয়তো কিছু একটা করতে পারতো।
যখন তিনি চোখ বুজে ফেলে তার কিছুক্ষণ পর আরশাদ দেখে বেডসাইড টেবিলে আধখাওয়া পানির গ্লাস। মুনতাহা সেদিন কাঁদতে কাঁদতেই বলেছিলো, বাবা শেষবার তার হাতেই পানি খেয়েছে। আরশাদ কিছু বলেনি।
পরে খোঁজ করে, ফোনে দেখে, ডাক্তারের কাছেও গিয়েছিলো সেদিন বিকেলেই। জানতে পারে ওসময় খাবার- পানি খাওয়ানো উচিত নয়। সেই থেকে সে চেপে রেখেছে কথাটা। ওইযে মেয়েটা নিজেকে দোষী ভাববে। প্রাণপ্রিয় বাবার মৃত্যুতে কোথাও না কোথাও সে দায়ী। কথাটা জানলে মেয়েটা কি করবে? ভাঙাচোরা মুনতাহাকে সামলাতেই এতো পুড়তে হয়েছে, গুড়িয়ে যাওয়া মুনতাহাকে সামলানোর সাহস তখন আর করে উঠতে পারেনি আরশাদ।

মুনতাহা দু’হাতে মাথা চেপে ধরে। চিৎকার করে বিরতীহীন। আরশাদ বলতেই থাকে,

—“মুনতাহা আপনি জানতেন না। আপনি না জেনে খাইয়েছেন। তাছাড়া আংকেলের বেশ মেজর স্ট্রোক হয়েছিলো। উনি এমনিতেও..আপনার জন্য হয়নি কিচ্ছু। আপনি পানি না খাওয়ালেও উনি হয়তোবা বাঁচতেননা মুনতাহা। বোঝার চেষ্টা করেন।”

—“আপনি মিথ্যা বলছেন।”

—“আমি মিথ্যা বলছিনা।”

মুনতাহা একই কথা বলতে থাকে। বোঝেনা, বুঝ বুঝতে চায়না। তার হাহাকারে কলিজায় শাণিত শূল বিঁধে আরশাদের।
একপর্যায়ে ক্রুদ্ধ, নিরুপায় আরশাদ খেঁই হারিয়ে ফেলে। পাগলপ্রায় প্রেয়সীকে থামাতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সজোরে থাপ্পড় বসায় মুনতাহার নরম গালে। ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। তুলতুলে গালে পাঁচআঙ্গুলের ছাপ বসে যায়। মুনতাহা চুপ হয়ে যায়। ঠোঁটের রক্ত গড়িয়ে পড়ে। আনতারা হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে আসেন। আরশাদের কাছ থেকে মুনতাহাকে ছাড়িয়ে নিয়ে রণকন্ঠে গর্জে উঠেন,”তোর সাহস কেমনে হয় ওর গায়ে হাত তোলার?”

মুনতাহা চুপ হয়ে গেছে। চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে, ঠোঁট দিয়ে রক্ত। গালের আঙুলের ছাপে নির্মমতা। আরশাদ হাত মুঠো করে ফেলে। উঠে দাড়িয়ে বলে,”ওকে বলো আর একবারও যেনো নিজেকে দোষারোপ না করে।” বলে হনহন করে ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দেয় সে।
আনতারা কথাবার্তায়ই বুঝেছেন কি হয়েছে। মুনতাহা একমনে মেঝের দিকে চেয়ে আছে। ছোট্ট মস্তিষ্কে জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে হাজারো ভাবনা, অনুশোচনা, অভিযোগ, হতভম্বতা।
আনতারা নিজের ঘরে নিয়ে যান মেয়েটাকে। বিছানায় বসিয়ে ঠোঁটের রক্ত মুছিয়ে দেন। এলোমেলো চুল ঠি ক করে দেন। ভেজা শাড়ি বদলে দেন।
মেয়েটা মূর্তির মতো বসে থাকে। সাড়াশব্দ করেনা। একটু আগেই কত হাসলো তার সাথে।
আনতারা কপালে চুমু খেয়ে বললেন,”আজকে আমার কাছেই থাকো আম্মু। ওর কাছে যাওয়া লাগবেনা।”
মুনতাহা উওর দেয়না। একবার চেয়ে মাথা কাত করে সম্মতি জানায়।
_________________

তখন গভীর রাত। ঘড়ির কাঁটা দুটো ছুঁইছুঁই। আধখাওয়া সিগারেটের বাদামীরঙা ফিল্টার ফাঁকা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে ঘরে আসে আরশাদ। বিনিদ্র শূন্য বিছানা। মুনতাহা আম্মার কাছে। রাতের খাবারের সময়ও আনতারা তার সাথে কথা বলেনি। মুনতাহার খাবার ঘরে নিয়ে গিয়েছে। খাইয়ে দিয়েছে হয়তো।
আরশাদ কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থাকে। তারপর উঠে যায়। দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। আনতারার দরজা আটকানো। আরশাদ দু’সেকেন্ড দাড়িয়ে থেকে আঙ্গুলের টোঁকা দেয়। ডাকে,”আম্মা? আম্মা জেগে আছো?”
ভেতর থেকে আনতারার নির্ঘুম কন্ঠ ভেসে আসে,”কি সমস্যা?”

—“আসবো আম্মা?”

আনতারা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। দরজা আটকানো। আরশাদ খোলেনি এখনো। বলে,”আয়।”
আরশাদ ভেতরে ঢোকে। চোখ রক্তবর্ণ। সিগারেটের ঝাঁঝে ঠোঁটজোড়া পুড়ে গেছে যেনো।
মুনতাহা চুপটি করে ঘুমাচ্ছে। একহাতে আনতারাকে ধরে আদুরে কন্যার মতোন গুঁটিয়ে আছে। ঘরের সবুজ বাতিতে কি সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে! আরশাদ দু’কদম এগোয়। আনতারা কাঠ গলায় বলেন,

—“কি বলতে এসেছিস, বলে চলে যা।”

—“ওকে নিয়ে যাই আম্মা। তুমি ঘুমাও।”

—“ও আমার কাছেই ঘুমাবে। আর কোন কথা না থাকলে যা।”

—“আম্মা?”

—“তুই ওকে মেরেই ফেলবি আরশাদ।”আনতারার স্পষ্ট উওর।

আরশাদ চমকে উঠে। কথাটা সহ্য হয়না কেমন। উঁচু জোরালো কন্ঠে বলে,”আম্মা? ও কেমন করছিলো? আমি কিভাবে দেখবো এসব? তুমি..”

—“আস্তে কথা বল! ঘুমাচ্ছে!” আনতারার কাঠগলায় চাপা কন্ঠস্বর।

আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কপাল চেপে দাড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মুনতাহা নড়েচড়ে আরো গুটিয়ে শোয়। আনতারা মাথায় হাত বুলিয়ে দেন বারবার। মাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আরশাদই অধৈর্য হয়ে বলে,”আম্মা আমি নিয়ে যাই। কিছু করবোনা। তোমার মনে হয় আমি আবার মারবো ওকে?”

আনতারা কয়েকসেকেন্ড একাধারে চেয়ে থাকেন ছেলের দিকে। মুনতাহাকে ধরে রাখা হাতটা সরিয়ে অন্যদিকে তাকান। নিরব সম্মতিতে স্বস্তি মিলে আরশাদের। ঘুমন্ত মুনতাহাকে পাঁজকোলা করে তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে।

মুনতাহার ঘুম ভাঙে ভোরের দিকে। সদ্য ঘুম ঘুম চোখেও বুঝতে অসুবিধে হয়না কার উদোম বুকে মিশে আছে সে। চিরচেনা গায়ের ঘ্রান, চিরচেনা স্পর্শ, সাথে কিছু বিভৎস্য স্বৃতি। মুনতাহা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে। আরশাদ ঘুমোয়নি সারারাত। আধঘুম, আধ জাগরণের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছিলো।
মুনতাহা নড়াচড়ার চেষ্টা করতেই তন্দ্রা কেটে গেলো তার। ঘরে বাতি নেই। তবে জানালা দিয়ে আসা ভোরের আলোতে অষ্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সব।
মুনতাহা বুঝলো আরশাদ জেগে আছে। কথা বলতে যেয়েও চুপ করে গেলো। আরশাদ কোমড় থেকে হাত উঠিয়ে গালে রাখলো। বলল,

—“ঘুম হয়েছে?”

মুনতাহা উওর দিলোনা। নিষ্প্রভ হয়ে রইলো। আরশাদ বালিশের পাশে হাত রেখে মুখ বরাবর ঝুঁকলো। গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। নরম চুমুতে গাঢ় চড়ের দাগ মিটানোর চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ। মুনতাহা প্রতিক্রিয়া দেখালোনা। শুধু ধারালো নখ বাহুতে গেঁথে দিলো ধীরগতিতে।
আরশাদ মাথায় চুমু খেলো। বলল,”আর পাগলোমো করবেন না। আল্লাহ যেভাবে আংকেলের মৃত্যু লিখে রেখেছিলেন সেভাবেই হয়েছে। নিজেকে দোষারোপ করে কি হবে? আমি একটুপর অফিসে চলে যাবো। তারপর আর কান্নাকাটি করবেন না। ঠিকাছে?”

মুনতাহা হরহামেশার মতো মাথা কাত করেনা। তবে মিনমিন করে বলে,”আমাকে একটু আব্বুর কাছে নিয়ে যাবেন?”

আরশাদ কোমল চোখে তাকায়। এই প্রশ্নটা যে আগে কতবার করতো মেয়েটা। কবরস্থানে নিয়ে যেতে বলতো। রাতবিরাতে বললে সে বলতো, সকালে নিয়ে যাবে।
আজ বলল,
—“অফিস থেকে ফিরেই নিয়ে যাবো। ঠিকাছে?”

মুনতাহা চেয়ে থাকে শুধু। দিরুক্তি করেনা।

________________

তখন দুপুর। রোদে উজ্জ্বল বারান্দা। মুনতাহা পায়রাদুটো উড়িয়ে দিলো। উড়োনোর আগে দুজনের মাথায় দুটো চুমু খেলো। উড়িয়ে লাভ নেই। এরা আবার চলে আসবে। চড়ুইয়ের বাসাটা ফাঁকা। মা পাখিটা সকালে চলে যায়। মাঝে মাঝে এসে ডিমগুলো দেখে যায়। কি চিন্তা! বাবাও এমন চিন্তা করতো। কাজে যেয়ে বারবার তাকে ফোন দিতো।
মুনতাহা ঘরে যায়। কানে কোথ্থেকে যেনো ‘আম্মা’ ডাক ভেসে আসে। ‘আম্মা’,’আম্মা’,’আম্মা’। এইতো বাবার কন্ঠ। স্পষ্ট বাবার কন্ঠ। কোথায় বাবা? মুনতাহা এদিক ওদিক তাকায়। বাবাকে পায়না। পাবে কি করে? সে তো মেরে ফেলেছে। এই যে এই হাত দিয়ে পানি খাইয়েছে। বাবাকে মেরে ফেলেছে।
মুনতাহা আলমারি খোলে। নির্দিষ্ট একটা শাড়ি বের করে। মুচকি হেসে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে এলো যখন, কি সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে! স্বয়ং শুভ্রমেঘরাণী যেনো।
মুনতাহা আয়না দেখেনা। ওই মুখ তার দেখতে ইচ্ছে করেনা। ঘেন্না লাগে। খুনি একটা।
বেডসাইড টেবিলটা আজকাল খোলা থাকে। আরশাদ আগে তালা দিয়ে যেতো, এখন আর দেয়না। মুনতাহা ধীরপায়ে এগোয়। ড্রয়ের খোলে। দুটো ভরা ঘুমের ওষুধের পাতা। গ্লাসে পানি ঢালে মুনতাহা। জ্ঞাণ শুন্য মস্তিষ্ক কাজ করেনা। একটার পর একটা ওষুধ খালি হতে থাকে। শূন্যপাতা বালিশের পাশে রেখে ধপ করে বিছানায় বলে পড়ে মুনতাহা। কাঁথা মেলে নেয়। আরামের ঘুম দিবে। মাথা ঘোরায়। ঘোলা চোখেই দেখে ড্রয়েরে আরেকটা জিনিস আছে। ধারালো একটা ছুঁড়ি। কি চকচক করছে। মুনতাহা হাতে তুলে নেয়। ড্রয়ের আটকে দেয়। বালিশে মাথা পেতে গায়ে কাঁথা টানে। ছুঁড়িটায় চেয়ে থাকে নির্নিমেষ। মিনিটের ব্যবধানে কব্জি গড়িয়ে টুপ টুপ করে ঝরে লাল লহু। ছুড়িটা পড়ে থাকে কোলের কাছে। মুনতাহা শান্তির ঘুম দেয়।

______________
অপরাহ্ন গড়িয়ে সায়াহ্ন নামছে। শহরজুড়ে রাঙা রোদের নিরুত্তাপ প্রলেপ উত্তরোত্তর মলিন হচ্ছে।
পশ্চিমাকাশের বক্ষে সুনিদ্রায় শায়িত হচ্ছে ক্রুদ্ধ উষাপতি।
ক্লান্ত দেহে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছে দীর্ঘদেহী পুরুষ। বা’হাতের মুঠোয় জায়গা পেয়েছে দু’আটি তাজা মেহেদীপাতা। পায়ের গতি অতিমন্থর। তৃতীয়তলায় এসে থামলো অবসাদ পা জোড়া। হাত উঠিয়ে দরজার পাশের কলিংবেল বাজালো অলসগতিতে। চকচকে দরজার ঠিক অপরপাশে একটা ধুলোমলিন দরজা। আরশাদ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে একবার। এ জা’গাটায় ইতো চাঁদটার সাথে দেখা হয়েছিলো। সেই প্রথমবার।
মুনতাহার সেই ঘুম ঘুম চোখজোড়া ভেসে উঠে প্রেমিক চক্ষুদর্পণে। হাসে সে। কেউ একজন দরজা খুলতে আসছে। শব্দ শোনা যাচ্ছে। আম্মা মনেহয়। মুনতাহা হলে পায়ের শব্দ শোনা যেত না। মেয়েটা দৌড়োদৌড়ি করে কম। খুব কম।
আনতারা দরজা খুললেন। দৃষ্টি বিনিময় হলো। মায়ের চোখে অব্যক্ত চাপা রাগ। আরশাদ চোখ নামিয়ে নিলো। আনতারা সরে দাড়ালেন। আরশাদ নিরবে ঢুকলো। আনতারা দরজা আটকে দিলেন নিশব্দে।
যাবার জন্য পা বাড়াতেই আরশাদ হাল্কা গলায় ডাকলো,”আম্মা?”
আনতারা দাড়িয়ে গেলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে ছোট্ট করে বললেন,”কি?”
আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হাতটা বাড়িয়ে বলে,”পাতাগুলো রেখে দাও।”
আনতারা শান্তচোখে দেখে। মুনতাহার জন্য এনেছে বুঝতে পেরেছেন। তবু রাগ কমলোনা। পাতাগুলো নিয়ে আবার পা বাড়াতেই আরশাদ ফের ডাকে,”আম্মা?” কন্ঠে কাতরতা, অসহায়ত্ব, আবদার। আনতারা দাঁতে দাঁত চেপে তাকালেন। আরশাদ কয়েকসেকেন্ড বিমূর্ত চেয়ে থেকে বলল,”কথা বলছোনা কেনো আম্মা? তুমি দেখছিলে না ও কিভাবে নিজেকে দোষারোপ করছিলো? আমি কি করতাম? বলো?”
আনতারা হতভম্ব কন্ঠে বলল,
—“তাই বলে তুই গায়ে হাত তুলবি আরশাদ?”

—“ও থামছিলো আম্মা?”

—“ঠোঁটের দিয়ে রক্ত বেরিয়ে গেছে মেয়েটার। দুপুরে খায়নি। ঠোঁট ফুলে গেছে। এরজন্য মানুষটা তোর কাছে মেয়েকে তুলে দিয়ে গিয়েছে? মারার জন্য?”আনতারা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। আরশাদ দু’কদম এগিয়ে এলো। মায়ের গালে হাত রেখে মাথায় পাশে চুমু খেলো। ধীরকন্ঠে বলল,”আর হবেনা আম্মা। শান্ত হও।”
আনতারা কেঁদে উঠলেন। আরশাদ হাসলো। নরম গলায় বলল,”কই ও? দাদুর কাছে?”

—“ঘুমোচ্ছে দেখে এলাম।”

আরশাদ জুতো খুলতে খুলতে বলল,”কখন ঘুমিয়েছে?”

—“দুপুরের পরপরই। খেতে ডাকলাম। ওপাশ ফিরে শুয়েছে। উঠলোনা। আর ডাকিনি। একটু আগেও দেখলাম ওভাবেই গায়ে কাঁথামুড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।”

—“কাঁথামুড়িয়ে? ওর তো গরম লাগে। জ্বর এসেছে?”

আনতারা চিন্তিত কন্ঠে বললেন,”তা তো দেখিনি।”

—“আচ্ছা ঠিকাছে, আমি দেখছি আম্মা। তুমি খাবার দাও। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। ওকে নিয়ে আবার বেরোতে হবে একটু পর।”

—“কোথায় যাবি?”

—“কবরস্থানে, সকালে বলছিলো। বলেছিলাম এসে নিয়ে যাবো।”

—“ওহ।”

—“দাদু ঠিক আছে?”

—“হ্যাঁ, আম্মাও ঘুমাচ্ছেন। দুপুরে ভালোভাবেই খেয়েছে। ঠি ক আছে।

—“ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে এসেছি। কাল সন্ধ্যায় নিয়ে যাবো।”

আরশাদ ঘরের দরজা খুলল। আনতারা মেহেদিপাতাগুলো ডাইনিং টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললেন,”ভাত খায়নি, ওকে ডেকে দিস। একসাথে খেয়ে নিবে।”

মুনতাহা ঘুম। গলা পর্যন্ত কাঁথা টানা। পা ভাঁজ করে গুটিয়ে ঘুমোচ্ছে। শীত করছে নাকি মেয়েটার? ঘরের আলোও জ্বালানো।
অফিসের ব্যাগটা সোফার উপর রাখে আরশাদ। রেগুলেটর ঘুরিয়ে ফ্যানের গতি কমিয়ে কাছে যায়।
ঠোঁটের কোঁণটা সত্যিই ফুলে গেছে। সকালেও এতো ফোলা ছিলনা। রক্ত মুছিয়ে দিয়েছিলো। তবু একটু একটু জমাট বেঁধে লাল হয়ে আছে।
আরশাদ ঝুঁকে গেলো। কপালে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে গালে কপালে হাত ছুঁইয়ে জ্বর মাপলো। নাহ্, জ্বর আসেনি। এমনেই হয়তো শীত করছে। গা ঠান্ডা হয়ে আছে।
ফুঁলে ওঠা ঠোঁটের কোঁণে ছোট্ট করে চুমু খেলো সে। আদুরে গলায় ডাকলো,”মুনতাহা? চাঁদ, উঠেন।”
মুনতাহার সাড়াশব্দ পাওয়া গেলোনা। আরো দু’বার ডেকে আরশাদ সোজা হয়ে দাড়ালো। গভীর ঘুম হয়তো। কাল এতো কাঁদলো, শরীর খুব খারাপ লাগছে হয়তোবা।
তখন আর ডাকলোনা। আরেকটু ঘুমোক। তার ফ্রেশ হতেতো সময় লাগবে, ততক্ষণ পর্যন্ত নাহয় ঘুমিয়ে থাক।
গোসল সেড়ে বেরোলো যখন মুনতাহা তখনও একইভাবে শুয়ে আছে। খটকা লাগলো। মেয়েটাতো কখনই একাধারে শুয়ে থাকেনা। দু’মিনিট পরপর এপাশ ওপাশ ফিরে খালি। গায়ের কাঁথা এলোমেলো হয়ে যায়। সে বারবার ঠিক করে দিলেও কাজ হয়না। আজ এমন বুঁদ হয়ে ঘুমোচ্ছে কেনো? ওষুধ তো খায়না আর।
তবে?
আরশাদ এগিয়ে যায়। গালে হাত রেখে ডাকে,”চাঁদ? মুনতাহা? আংকেলের কাছে যাবেন বললেন? রাত হয়ে গেছে, উঠেন। দেরি হয়ে যাবে। খাবারও খাননি আপনি। মুনতাহা?”
ভেজা চুলের পানি টপটপ করে পড়ে ঘুমন্ত চোখের পাপড়িতে। মুনতাহা তবু সাড়াশব্দ করেনা। চোখ পিটপিট করেনা। আরশাদ কয়েকসেকেন্ড স্তব্দ চেয়ে থাকে। চোখে ভর করে অবিশ্বাস। তীব্র অবিশ্বাস। মনে বাজে ভীত দামামা। কন্ঠস্বর পাল্টে যায়। আরশাদ অধৈর্য হয়ে পড়ে,”মুনতাহা কি হলো?”
হাঁটু ভাঁজ করে তুলে বিছানায় রাখে সে। বালিশের পাশে হাত রেখে আরো কাছে ঝুঁকতেই টের পায় হাতে কি যেনো বাঁজছে। এলোমেলো হাতরালে সহজেই হাতে চলে আসে ঘুমের ওষুধের খালি পাতাগুলো। আরশাদ বিশ্বাস করেনা। গলার কাঁথা একটু সরাতেই নজরে আসে মেয়েটা সাদা শাড়ি পরে আছে। সেই সফেদ জামদানিটা। মাহতাব সাহেব মারা যাবার আগে যেটা উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন। মেয়েটা পরতোনা এটা। কক্ষণো পরতোনা। আলমারিতে ভাঁজ করে তুলে রেখেছিলো।
গায়ের কাঁথা সরিয়ে দেয় আরশাদ। চোখজোড়া যেনো দেখতে ভুলে যায়। হৃদস্পন্দন যেনো স্পন্দিত হওয়া ভুলে যায়। আঁখিপল্লব যেনো পলক ঝাপটাতে ভুলে যায়। রক্তে ভরে গেছে চাদর। ডানহাতের কব্জির রক্ত ফুরিয়ে গেছে যেনো। আরশাদ পাগলের মত হাতটা মুঠোয় তুলে নেয়। এ হাতই না কাল চুমুতে ভরিয়ে দিলো!
ছুরিটা পড়ে আছে কোলের কাছে। কাল যে চড়ুইয়ের বাসার জন্য আনলো, মেয়েটা আর রেখে আসেনি। ঘরেই ছিলো। সকালে ড্রেসিং টেবিলের উপর দেখে ড্রয়ের ঢুকিয়ে রেখেছিলো সে।
আরশাদ বিশ্বাস করেনা। সবতেই যেনো অবিশ্বাসের মরীচিকা। হাতে চুমু খেয়ে ডাকে,

—“এ্যাই চাঁদ? চাঁদ উঠেন। উঠেননারে বাবা। উঠেন বলছি? এই মেয়ে কথা শোনোননা কেনো? আপনার সাহস তো কম না। ধমকাচ্ছিনা? চাঁদ? আমি কিন্তু আবার গায়ে হাত তুলবো। আবার মারবো কিন্তু। চাঁদ? উঠেন চাঁদ। আহা উঠেননা! হয়েছেতো।”

আরশাদ চিৎকার করেনি। পাগলের মতো ডেকেছে শুধু। আনতারা তার ওমন ডাক শুনেই ছুটে আসেন। রক্তাক্ত হাত ধরে রাখা আরশাদকে দেখে মূহুর্তেই বুঝে যান কি হয়েছে। আরশাদ একপলক মায়ের দিকে তাকায়। অভিযোগ করে বলে,

—“ও আমাকে ভালোবাসেনি আম্মা। ও আমাকে ভালোবাসেনি।”

________________
জানো পৃথিবী?
তোমার মতো আমার আকাশেও না একটা দারুন জোছনা এসেছিলো। তার একছটা আলোতেই আমার পৃথিবী ঝলমলিয়ে উঠতো। তার লজ্জামাখা হাসিতেই আমার বুক দাপিয়ে প্রেম বইতো। তার মিনমিনে কন্ঠ আমাকে মদ্যপ করে তুলতো। কিন্ত জানো কি! সেই জোছনাময়ী চাঁদটা ছিলো খুব নিষ্ঠুর। বড্ড স্বার্থপর। আমার ভালোবাসা সে বুঝতে পারতোনা। চোখের গভীরতা সে মাপতে পারতোনা। বুকের প্রেম সে টেরই পেতোনা।
এতসব বোঝাপড়ায় আমি যখন ডুবকি তুলছিলাম, মাঝখান দিয়ে চাঁদটা করলো কি জানো?
আমার জোছনা ভরা গোছানো ঘরটাকে মুচড়ে মুচড়ে প্রণয়ের ধংস্বস্তুপ করে দিয়ে চলে গেলো। আমার সবটুকু প্রেম নিয়ে, আমার থেকেই দূরে চলে গেলো। আমাকে নি:স্ব করে, ভেঙেচূড়ে বিধস্ত করে সে যেনো শান্তি কুঁড়োলো খুব। আমার চাঁদটা এতো অবুঝ কেনো হলো পৃথিবী?

পৃথিবী নিরুত্তর চেয়ে থাকে। তার থালাভর্তি জোছনা সহ্য হয়না অমানিশায় ঘেরা একাকী প্রেমিকের।
আরশাদ ঘরে ঢুকে। সিগারেটের ধরিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে। চোখ বুজে আপনমনে আওড়ায়,
জানেন চাঁদ? চোখ ভাঙা ঘুমে আমি আজও পাশ হাতরিয়ে খুঁজি। আপনাকে পাইনা যখন, তখন ঘুমমাথায় কি ভাবি জানেন? আপনি হয়তো আমার বুক থেকে সরে বা’পাশটায় ফিরে শুয়েছেন। আপনারতো খুব গরম লাগে। অথচ, আমার অর্ধঅচেতন মন বুঝেই না আমি যে আজ দু’বছর যাবত একাই ঘুমোই।
আচ্ছা চাঁদ, আপনি সবসময় আমার থেকে দূরে যেতে চাইতেন কেনো? আমার বুকে থাকতে কি আপনার খুব খারাপ লাগতো?
জানেন চাঁদ? আমার অগোছালো ঘর না এখন সারাটাদিন অগোছালোই থেকে যায়। দু’মিনিট পরপর কেউ গুছিয়ে দেয় না। ভাবছেন আমাদের ঘরকে আমার ঘর বলছি কেনো? আমার ঘরই বলি চাঁদ। আপনি তো কখনো ঘরটাকে নিজের ভাবেনইনি। ভাবলে এমন অগোছালো রেখে চলে যেতে পারতেন?
আচ্ছা, আপনার আমাকে মনে পড়ে চাঁদ? মনে পড়ে এই পৃথিবীতে আপনাকে এখনো একজন পাগলের মতো ভালোবাসে?
হা হা! কিসব বলছি তাইনা? আপনিতো স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছেন। মনে পড়বে কেনো?
চাঁদ? আপনি না খুব ভীতু ছিলেন? তবে নিজের হাতে ছুরি চালানোর সময় ভয় লাগেনি? একটুও ভয় লাগেনি? ভয় কেনো লাগলোনা চাঁদ? আপনি এতো সাহসী কেনো হলেন চাঁদ? আমার চাঁদ তো ভীতুই ভালো ছিল।
চাঁদ? আপনি যে আপনাকে এতো কিছু বলি? আপনি শুনতে পান চাঁদ? আমি না সত্যি পাগল হয়ে গেছি চাঁদ। আপনি কিকরে শুনবেন!

আরশাদ একাই হাসে! একাই কাঁদে! একাই অভিযোগের ঝুলি খুলে বসে! পাশাণ চাঁদ শোনেনা! জবাব দেয়না। অন্ধকারজুড়ে অভিযোগী প্রশ্নরা ঘুরপাক খায়।
বিদীর্ণ মন সাদা বিষাক্ত ধোঁয়ায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়। নাভিশ্বাস উঠে যায় গলায়। তবু অভিযোগ থামেনা,

“আপনার কাছে আমি এখনো একবুক ভালোবাসা পাই চাঁদ। আপনার কাছে আমি এখনো একসমুদ্র প্রেম পাই চাঁদ। আপনার কাছে আমি এখনো এক আকাশ জোৎস্না পাই চাঁদ। আপনার কাছে আমি গোটা আপনিটাকেও পাই চাঁদ।”

সিগারেটের প্যাকেট ফাঁকা হয়ে যায়। আরশাদ হেসে ফেলে,”আপনার কাছে আমি তিনশত বিশ টাকা পাই চাঁদ। এক সন্ধ্যায় আপনাকে দেখতে গিয়ে আমার পুরো টাকাটা জলে গিয়েছিলো।”

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here