অমানিশা❤️,পর্ব-৪,৫

0
1038

অমানিশা❤️,পর্ব-৪,৫
লেখিকা_মালিহা খান❤️
পর্ব-৪

রাস্তার ধারে একটা কালো কুকুর ভিজছে। ভিজছে বলাটা ভূল, মূলত সে ভিজতে বাধ্য হচ্ছে। ঝুমঝুমে বৃষ্টিতে
মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়নি কোথাও। আরশাদ রিকশা ভাঁড়া মিটাচ্ছিলো। মুনতাহা তখনো তার বাহুর শার্ট টেনে ধরে রয়েছে। অবশ্য সারারাস্তায় ছাড়েওনি। একভাবে ধরেই রেখেছে তখন থেকে।
বাদামী চামড়ায় মানিব্যাগটা পকেটে ঢোকালো আরশাদ। এদিক ওদিক তাকিয়ে মুনতাহাকে নিয়ে গেটের দিকে এগোতে এগোতে বললো,”আপনিতো আমাকে রক্তাক্ত করে ফেললেন মুনতাহা।”

মুনতাহা কপাল কুচকালো। বললো,
—“মানে?”

আরশাদ একঝলক হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“শার্টটা দেখলে যে কেও বলবে আমাকে বুঝিমাত্র গুলি করা হয়েছে। রক্ত মেখে একাকার।”

আরশাদের দৃষ্টি অণুসরণ করে তাকালো মুনতাহা। আৎকে উঠলো মূহুর্তেই। হকচকিয়ে শার্টের হাতা ছেড়ে দিলো। বিহ্বল চোখে চেয়ে বললো,”সরি, আ…আমি বুঝিনি।”

—“আহা! ঠি ক আছে। আপনি ধরুন। আমি এমনেই বললাম।” হাসলো আরশাদ।

মুনতাহা ধরলোনা। অপরাধীর মতোন চোখ নামিয়ে ঈষৎ লজ্জিত কন্ঠে বললো,” আপনি…গরম পানি দিয়ে ধুলেই আলতার রং উঠে যাবে।”

আরশাদ নরম গলায় বললো,
—“আচ্ছা ঠি কাছে, আসুন সাবধানে। আংকেল বোধহয় ফিরেননি এখনো।”

ভেতরে ঢুকে দরজা ধরে কয়েকসেকেন্ড দাড়িয়ে রইলো মুনতাহা। মাথাটা হাল্কা বের করে ঠোঁট সরু করে
তু তু জাতীয় আওয়াজ করতেই রাস্তার ধার থেকে একপ্রকার দৌড়ে কাছে চলে এলো কালো কুকুরটা। মুনতাহা ঢোকার জন্য একটু সরে দাড়াতেই চটপট ঢুকে পড়লো কাকভেজা গায়ে। কৃতজ্ঞতার সহিত লেজ নাড়াতে লাগলো অনবরত। প্রায় সাথেসাথেই দারোয়ান আংকেল কোথ্থেকে যেনো উদয় হলেন। কুকুরটাকে বের করার জন্য দ্রুতগতিতে পা বাড়াতেই মুনতাহা শক্ত চোখে চেয়ে কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো,
—“ওকে বের করবেন না আংকেল, বৃষ্টি কমলে ও নিজেই চলে যাবে।”

দারোয়ান থেমে গেলো। মুনতাহা বাড়িওয়ালার মেয়ে। উনিশ- বিশ হলে তার চাকরি চলে যাবে ভেবে মৃদুকন্ঠে সম্মতি দিলো সে,”আইচ্ছা, আপামনি।”

আরশাদ নিশব্দে হাসলো। চাঁদের তেজ দেখে খানিকটা প্রশংসাও করলো মনে মনে।
মহাবিপত্তির সমাপ্তি ঘটাতে না ঘটতেই বাঁধলো আরেক বিপত্তি।
গেটে চকচকে তালা ঝুলছে। মুনতাহা বেকুবের মতো চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আরশাদ তার কেবল ফোনধরা ফাঁকা হাতদুটোর দিকে চেয়ে বারকয়েক খুকখুক করে পরিষ্কার গলায় বললো,”আপনার কাছে চাবি নেই?”

মুনতাহা ঘাড় বাকিয়ে তাকালো। দৃষ্টি বিনিময় হলো। দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে বললো,”আমি তো চাবি নেইনা সাথে। আব্বুর কাছেই থাকে সবসময়।… মনে ছিলোনা।” কন্ঠের ভার ছেড়ে দিলো সে।
নিচের ঠোঁটের লিপস্টিক উঠে গেছে। লালের ফাঁকে ফাঁকে গোলাপি রং বেরিয়ে এসেছে। বামকোণের দিকে ছড়িয়ে গেছে কিছুটা।
আরশাদ বিচলিত ভঙ্গিতে চোখ নামালো। এমন হ্যাংলো স্বভাব তার নয়। কখনোই নয়। আজীবন নিজেকে সংযমী উপাধিই দিয়ে এসেছে।
বারকয়েক ঢোক গিলে বললো সে,”আপনি এই ফ্ল্যাটে বসুন কিছুক্ষণ। আংকেল আসলে চলে যেয়েন।” কন্ঠ এলোমেলো শোনালো নিজের কাছেই। পকেট হাতরে চাবি বের করলো আরশাদ। মুনতাহা কি যেনো ভেবে চুপচাপ এগিয়ে এলো। আরশাদ সন্ধানী গলায় বললো,
—“আপত্তি করলেন না যে? বিশ্বাস করেছেন তাহলে আমাকে?”

—“আব্বুতো বললো বিশ্বাস করতে।”মুনতাহার সহজসরল উওর।

আরশাদ একটু চুপ থেকে বললো,
—“আব্বু না বললে করতেন না?”

মুনতাহা একঝাঁক দোটানা নিয়ে উওর দিলো,”কি জানি।”

সাবিনা বেগমকে হাভাতের মতো চেয়ে থাকতে থেকে খানিকটা ইততস্তবোধ করলো মুনতাহা। আরশাদের পাশ ঘেঁষে গেলো দাড়ালো। আরশাদ জুতোর ফিতা খুলছিলো। মুনতাহা চাপা কন্ঠে বললো,”আপনি বলুন আমি কে। উনি কি না কি ভাবছেন…”
আরশাদের মাও বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে। মুনতাহাকে একনজর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে সে বলল,
—“তুই এমনে ভিজেছিস কেনো বাবা? ও কে ?”

আরশাদ সহজ গলায় উওর দিলো,
—“মাহতাব আংকেলের মেয়ে, মুনতাহা। আংকেল ঝড়ে আটকা পড়েছেন তাই ভার্সিটি থেকে নিয়ে আসতে বললেন। ঝড়বৃষ্টির মধ্য, রাত হয়ে গেছে। চিন্তা করছিলেন খুব। তাই নিয়ে আসলাম। উনার কাছে ফ্ল্যাটের চাবি নেই। আংকেল আসা পর্যন্ত এখানেই থাকুক।”

আরশাদের মা হাসলেন এবার। একটা বিনীত আদুরে ভাব চলে এলো কন্ঠে,
—“ওহ, বসো বসো। বসো মা। দাড়িয়ে আছো কেনো?”

মুনতাহা তীব্র সংকোচ নিয়ে আরশাদের দিকে তাকালো। যেনো তাকে ছাড়া এক পা বাড়াতেও লজ্জা, ভীতি, দ্বিধা।
আরশাদ আশ্বস্ত করে বললো,
—“বসুন মুনতাহা, আমার আম্মা আর ইনি আমার দাদু। ভয় পেয়েননা।”

_____________
মাহতাব সাহেব ফিরলেন সাড়ে দশটার দিকে। উদ্ভ্রান্তের মতো অবস্থা তার। কি একটা জ্যাম রাস্তায়। গাড়ি পাওয়া যাচ্ছেনা। ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝরাস্তায় মনে পড়েছে মেয়ের কাছে চাবি নেই। আরশাদকে ফোনও দিতে পারেননি।
সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে পরপর কয়েকবার ব্যস্ত হাতে কলিংবেল চাপলেন তিনি। দরজা খুললো আরশাদই।

সাবিনা বেগম বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন নিজের ঘরে। সবুজ রংয়ের হাল্কা বাতি জ্বালানো। মুনতাহা ঘুমাচ্ছে তার পাশেই। পা দুটো ভাঁজ করা। গালের নিচে হাত দেয়া। কাঁচের চুড়িগুলো হাতে নেই। কেউ একজন যত্ন করে খুলে রেখেছে। ঠোঁটের রং মুছিয়ে দিয়েছে। চুলগুলো আলগা হাতে বেঁধে দিয়েছে। ঘুমের ঘোরে যাতে পড়ে না যায় সেজন্য পাশে একটা কোলবালিশও রেখে দিয়েছে।
মাহতাব সাহেব দরজার কাছে দাড়িয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। মলিন কন্ঠে বললেন,
—“ঘুমিয়ে পড়েছেতো।”

আরশাদ উওর দিলো,
—“একটু আগেই ঘুমিয়েছে আংকেল। আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে বারবার ঝিমিয়ে পড়ছিলো। আম্মা জোর করে ভাত খাইয়ে দিলো একটু। তারপর দাদুর সাথেই বসে ছিলো। ঘন্টাখানেক আগে দেখি ঘুমাচ্ছে। তাই আর ডাকিনি।”

চলবে
অমানিশা❤️
লেখিকা_মালিহা খান❤️
পর্ব-৫

মুনতাহার ঘুম ভাঙলো বাবার আদুরে ডাকে। বাইরে তখন সকাল। চমৎকার রোদ উঠেছে। কয়েক ছ’টা রশ্নি এসে খেলাধুলো করছে মেলে রাখা নরম তালুর উপর। মুনতাহা নড়েচড়ে আবার ঘুমালো। মাহতাব সাহেব একটু ঝুঁকে কপালে হাত রাখলেন। নাহ, জ্বর আসেনি তো।
এলো চুলে আঙ্গুল দিয়ে অনর্থক আঁচরে দিতে দিতে আবারো ডাকলেন তিনি,”মুন? আম্মু উঠো। সকাল হয়ে গেছে মা। বাসায় যাবে না? মুন?”
মুনতাহা এবার পিটপিট করলো। সদ্য ঘুম ভাঙা আধবোজা চোখে তেমন কিছু স্পষ্ট হলোনা। তবে ছোট্ট একটা হাই তুলে, ভালো করে চোখ মেলে বাবার চেহারাটা দেখামাত্রই যেনো সচল হয়ে উঠলো ঘুম ঘুম নিশ্চল মস্তিষ্ক।
তড়িঘড়ি উঠতে উঠতে হন্তদন্ত কন্ঠে বুলি ছাড়লো সে,
—“আব্বু তুমি..কখন আসলে? আমি তো অপেক্ষা করছিলাম। তারপর…”

—“এখানেই ঘুমিয়ে পরেছিলি আম্মা। রাত হয়ে গেছিলো তাই আর নিয়ে যাইনি।”

মুনতাহা এদিক ওদিক তাকাল। ঘরে কেউ নেই। সে একা।

—“নিয়ে যাওনি কেনো? তুমি আমাকে ডাক দাওনি কেনো? আমি সারারাত এখানে ছিলাম? আব্বু আমি…”কন্ঠস্বর ধীরে ধীরে কেমন অস্থির হয়ে উঠলো। কেমন রুদ্ধশ্বাসে, আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে উঠলো কাজলে মাখামাখি হওয়া লম্বা আঁখিপল্লবে ঢেকে থাকা ভীষণ কালো চোখ দুটি। মাহতাব সাহেব মমতামাখানো হাতে তার দু’গালে হাত রাখলেন। গাঢ় কন্ঠে বললেন,

—“কিছু হয়নি মা, আব্বু আছিনা? কিচ্ছু হয়নি। তুই শুধু ঘুমিয়েইছিলি। আ.. আমি রাতে এখানেই ছিলাম মা। তোর সাথেই ছিলাম। এইযে সোফা… সোফায় শুয়েছি। তুই ঘুমিয়ে পড়েছিলে তো। ক্লান্ত ছিলি। তাই ডাকিনি।”

মুনতাহা চুপ হয়ে গেলো। আরেকবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,”সকাল হয়ে গেছে আব্বু।”

—“হ্যাঁ, সকাল হয়ে গেছে। বাসায় যাবো আমরা। ঠি কাছে? উঠে পড়। এক্ষুনি যাবো।”

মুনতাহা গা থেকে কাঁথা সরালো। আরশাদ ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। ঘরের দরজা অর্ধেক খোলা বিধায় আলুথালু শাড়ি জড়ানো মুনতাহাকে দেখতে অসুবিধা হলোনা। গায়ে স্যান্ডো গেন্জি। ফুলে ফেঁপে উঠা বাহু, চওড়া কাঁধ। রোমশ বুকের একটুআধটু উঁকি দিচ্ছে গেন্জির ভেতর দিয়েই।
মাহতাব সাহেব বেরিয়ে এলেন। জানা সত্ত্বেও নিমীলিত গলায় প্রশ্ন করলো সে,
—“উঠেছে আংকেল?”
মাহতাব সাহেব সৌজন্য হেসে বললেন,
—“উঠেছে বাবা, আসলে ওর ঘুম একটু গাঢ় তো। তাই তখন উঠেনি। তুমি বোধহয় আস্তে ডেকেছো।”

আরশাদের মা চায়ের কাপ রাখতে রাখতে বললেন,
—“আপনার মেয়েটা খুব লক্ষি ভাই। শান্ত, চুপচাপ। আমি কাল বললাম ‘কি খাবে?’ সে কিছুতেই মুখ খুললোনা। খালি বলে ‘কিচ্ছু খাবেনা।’ তা কি হয় বলেন? পরে কত্ত জোর করে অল্পএকটু ভাত খাইয়েছি।”

—“আপনি অতো করেছেন এই বেশি আপা।”

মাহতাব সাহেব দাড়িয়ে আছে দেখে আরশাদ নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। পাশের চেয়ারটা টেনে দিয়ে বললো,”আংকেল বসেন। নাস্তা করে যাবেন।”

উনি না না করে উঠলেন। মুনতাহা বেরিয়েছে। একবার চোখে চোখ পড়লো। আরশাদই প্রথমে সরিয়ে নিলো। মুনতাহা তখনো চেয়ে আছে। ঘনঘন পলক ফেলছে। কি যেনো দেখলো মনেহয়। তারপর মাথা নামিয়ে গুটিশুটি হয়ে মাহতাব সাহেবের পাশ ঘেঁষে দাড়ালো।

প্রায় সপ্তাহখানেক পরের কথা। দিনটা মঙ্গলবার। সন্ধ্যার দিকে রান্নাঘরে ছিলো মুনতাহা। গায়ের আকাশী রঙা কামিজ। গাঢ় সবুজ ওড়নাটা বিশেষ ভঙ্গিমায় কোমড়ে দু’প্যাঁচ দেয়া। চুলের আধখোলা হাতখোঁপা ঘাড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে।
কলিংবেল বাজলো। মাহতাব সাহেব যেয়ে দরজা খুললেন। এতদিন বাদে আরশাদকে দেখে খানিকটা অবাক হলেন ঠিক। তবে পরমূহুর্তেই হেসে বললেন,”তোমাকে দেখিনা যে?

আরশাদ সাথেসাথেই উওর দিলো,
—“একটু ব্যস্ত ছিলাম আংকেল। এইতো গতকাল রাতে খুলনা থেকে ফিরলাম। সকালে আবার অফিস চলে গেলাম। আর দেখা হলোনা। আপনি…”

মাহতাব সাহেব মাঝেই বললেন,
—“আচ্ছা এসো। ভেতরে এসো। তারপর কথা বলা যাবে।”

আরশাদ না করলোনা। যেন সে প্রস্তুতই ছিলো। সোফায় বসে হাতের ফোনটা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখতে রাখতেই মুনতাহাকে নজরে এলো। মেয়েটা উল্টোদিকে ফিরে খুন্তি নাড়ছে একমনে। এদিকের কোনো হুঁশ নেই। তাকে একবার ফিরেও দেখেনি বোধহয়। আর সে নাকি, তাকে এভাবে বেমালুম ভুলে বসে থাকা এই রমণীকে একমূহুর্ত দেখার জন্য মৃতপ্রায় হয়ে কাতরাচ্ছিলো একয়দিন? শুধুমাত্র একে দেখার জন্য দশদিনের কাজ চারদিনে করে ফিরে এসেছে? হায়, নারীমন! কি পাষাণ, তবু আকাঙ্ক্ষিত।
ততক্ষনে খোঁপা খুলে পিঠ ভর্তি ছড়িয়ে পড়েছে কালো চুল। মাহতাব সাহেব মুখোমুখি বসলেন। গলা বাড়িয়ে ডাকলেন একবার,
—“মুন? আম্মা, চা টা দিয়ে যা।”

মুনতাহা না ফিরেই উওর দিলো,”দিচ্ছি আব্বু।”

চিনির কৌটো নেয়ার জন্য ঘুরলো একবার। তখনই নজরে এলো আরশাদকে। আজ গায়ে সাদা শার্ট নেই। একটা কালো হাফহাতা গেন্জি। মুখ নাড়িয়ে, হাত নাড়িয়ে কি সুন্দর করে কী কী যেনো বোঝাচ্ছে। অন্যরকম লাগলো দেখতে।
চিনির কৌটো থেকে কয়েক চামচ কাপে দিলো সে। গুঁড়ো দুধ দিলো। চা ঢাললো। চামচ নেড়ে গোলাতে গোলাতেই পাশের চুলোয় বসানো পানি তৃতীয়বারের মতোন টগবগ করে ফুটতে শুরু করেছে। খাবার পানি। অনেকক্ষণ আগে বসিয়েছে। শুকিয়ে কমেও গেছে খানিকটা। চুলোর আঁচ সর্বোচ্চ মাত্রায়। দাউ দাউ করে জ্বলছে হলুদ অনল।
কাপ দুটো ট্রে তে তুলে পাশ থেকে পাতিল ধরার মোটাকাপড় দুটো হাতে নিলো মুনতাহা। জলদি জলদি করতে যেয়ে চুলো না নিভিয়েই ধরতে গেলো ভারি গরম পাতিল। তুলে ফেলেছে একটু তক্ষুনি হাতে জলন্ত আগুন শিখা ছুঁয়ে গেলো। হাতদুটো আর ধরে রাখতে পারলোনা। ছেড়ে দিলো পাতিল। সদ্য নামানো পানিগুলো ঝর্ণার বেগে পায়ের উপর পড়ে যেতেই গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো মুনতাহা। কন্ঠনালি ঝাঁঝড়া করে ডাকলো,”আব্বু….”
স্টিলের পাতিলা টা বিদঘুটে একটা ঝনঝনে শব্দ তুলে মেঝেতে আছরে পড়লো। পা দুটো ঝলসে গেলো যেনো।
মাহতাব সাহেব ছুটে আসতে আসতেই ফ্লোরে বসে পড়েছে মুনতাহা। রান্নাঘরে একটা ভ্যাপসা, ম্যাজম্যাজে, দমবন্ধ পরিবেশ। মাহতাব সাহেবের মুখমন্ডল রক্তশূন্য হয়ে গেলো মুহুর্তেই। মুনতাহা চিৎকার করছে পাগলের মতো। ঘরটা কেমন যন্ত্রনাময় হয়ে উঠেছে। আরশাদ সময় নষ্ট করলোনা বিন্দুমাত্র। দ্রুতপায়ে এগিয়ে মুনতাহাকে পাঁজকোলা করে কোলে তুলে নিতে নিতে জোরপূর্বক স্বাভাবিক করে রাখা কন্ঠে বললো,

—“কাঁদেনা। কিচ্ছু হয়নি। আংকেল ওয়াশরুম কোনদিকে?”

মাহতাব সাহেব শ্বাস চেপে রাখলেন কোনমতে। কাঁপা কাঁপা পায়ে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলেন। আরশাদ এদিক ওদিক না তাকিয়েই ভেতরে ঢুকলো। ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে একহাঁটু গেড়ে বসে পড়লো ফ্লোরেই। মুনতাহাকে ঠেস দিয়ে বসালো বুকের সাথে। পাজামা উপরে তুলে দিলো খানিকটা। রুপোলি নুপুরগুলো খুলে রাখলো অতি সাবধানে। ফর্সা পাজোড়া ভীষণ লাল হয়ে গেছে। অতিরিক্ত গরম পানি পড়ায় চামড়া পড়ে গেছে।
তরতর করে ঠান্ডা পানি পুড়ে যাওয়া পায়ের উপর পড়তেই দাপরে উঠলো মুনতাহা। গলাকাঁটা মুরগীর মতো ছটফট করে উঠলো অসহ্য যন্ত্রনায়। খামছে খামছে বুক গলা ছিঁড়ে ফেললো যেনো। আরশাদ নিশ্চুপ। নখের আঘাতে গলার পাশ দিয়ে চটচটে রক্ত বের হচ্ছে। মুনতাহা তবু থামছেনা। বুকে মাথা গুঁজে হৃদয় কাঁপানো আর্তনাদ করেই যাচ্ছে।
মাহতাব সাহেব কষ্টের মাঝেও খুব করে হাসতে চাইলেন। চেয়ে চেয়ে দেখলেন, তার মেয়ে এই প্রথম অন্যকাউকে আঁকড়ে ধরেছে। খুব ভরসায়।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here