অমানিশা❤️,পর্ব-৮,৯

0
1070

অমানিশা❤️,পর্ব-৮,৯
লেখিকা_মালিহা খান❤️
পর্ব-৮

দেয়ালের সময় নির্দেশক যন্ত্রটা ইংরেজি টুয়েলভ্ সংখ্যার ঘর অতিক্রম করলো কিছুক্ষণ আগে। এখন বারোটা দশ।
পায়ের ব্যান্ডেজটায় আলগা একটা গিঁট বেঁধে, কোল থেকে উঁচু বালিশের উপর তুলে দিয়ে ক্লান্ত শ্বাস ছাড়লো আরশাদ।
মেয়েটা একমূহুর্ত স্হির নেই। একবার এপাশে ফিরছে তো আরেকবার ওপাশে ফিরছে। এতদিন শুনেছে, মেয়েমানুষ শান্তশিষ্ট হয়ে ঘুমায়। অথচ এই মেয়ে অবিকল চড়ুই পাখির মতো করছে।
আরশাদের মা আনতারা ছেলের দিকে চেয়ে রয়েছেন অনেকক্ষণ যাবত। মুনতাহা দু’তিনবার লাথি মেরেছে ঘুমের ঘোরে। ছেলে কিচ্ছু বলেনি। আস্তেধীরে একমনে গজ পেঁচিয়ে দিচ্ছিলো। কি অনড় মনোযোগ! যেনো একটু চাপ দিলে, মেয়েটা একটু ব্যাথা পেলেই অনর্থ হয়ে যাবে।
মা কে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে মৃদু হাসলো আরশাদ। বললো,”কি দেখছো আম্মা?”
তিনি মুচকি হাসলেন। উওর দিলেননা। মুনতাহা আবার পাশ ফিরলো। হাতটা যেয়ে পড়লো উনার কোলের মধ্যে, হাতের উপর। আনতারা স্বস্নেহে আঁকড়ে ধরলেন। চুলোর জলন্ত আগুনের আঁচ প্রথমে হাতেই লেগেছিলো। সেখানটায় হাল্কা লাল। মায়া লাগে দেখলে। তিনি তাকিয়ে ছিলেন হাতের দিকে, আরশাদ ডাকলো,”আম্মা?”
এমনেই তার গলা প্রচন্ড ভারি। পরিষ্কার ভাবে ডাকলে যে কেউ চমকে উঠে। আনতারা তাকালেন। আরশাদ তার মুঠোয় ধরে রাখা হাতের দিকে ইশারা করে বললো,

—“তুমি শখ করে যেই আংটিটা বানিয়ে রেখেছিলো সেটা এই আঙুলে হবেনা?”

আনতারা চমকালেন আবার চমকালেন না। মাঝামাঝি ধরণের একটা হতভম্ব চাহনী স্পষ্ট হলো চোখে। বছরকয়েক আগে তিনি একটা সোনার আংটি বানিয়ে এনেছিলেন। অনেকটা শখ করেই। বলেছিলেন, ছেলের বিয়ের সময় পূত্রবধুকে পড়িয়ে দিবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। আংটিটা এখনো বাক্সের ভেতর নতুন-ই পড়ে আছে।

আরশাদ আবার প্রশ্ন করলো,”হবে আম্মা? নাকি ছোট করে কাটিয়ে আনতে হবে? হাত তো চিকন।”

আনতারা হেসে ফেললেন এবার। সুপ্ত সম্মতিতে বারদুয়েক মুনতাহার অনামিকায় বৃদ্ধাঙ্গুল বুলিয়ে পরখ করে বললেন,
—“হয়ে যাবে। কিন্তু..”

আরশাদ ভ্রু উঁচালো। সাথেসাথেই বললো,
—“কিন্তু কি?”

হাসি নিভলো। আনতারা নিষ্প্রভ কন্ঠে বললেন,
—“কিভাবে বাবা?”

আরশাদ প্রশ্নাত্বক দৃষ্টিতে চাইলো। হতভম্ব কন্ঠে বললো,
—“কিভাবে মানে? তোমার ছেলে পছন্দ করেছে আম্মা। তোমার নিশ্চয়ই আপত্তি থাকার কথা না?”

আনতারা মাথা নাড়ালেন দ্রুত,
—“আরে না, আমার আপত্তি থাকবে কেনো? আমি ওর বাবার কথা বলছিলাম।”

আরশাদ উঠে দাড়ালো। বিছানায় রাখা ফোনটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বললো,

—“সেসব আমি দেখে নিবো আম্মা। আসি তাহলে। দাদু একা বাসায়। তুমি ওকে দেখে রেখো রাতে। শুভ রাত্রি।”

মুনতাহার ঘুম ভাঙলো দেরি করে। বাইরে রোদ উঠেছে। সাদা মেঝে ভর্তি করে আল্পনার মতো ছড়িয়ে আছে হলদে রশ্নি। পাখির কিচিরমিচির শব্দ। কাকের বিদঘুটে ডাক। তোড়জোড় করে সকাল হওয়ার জানান দিচ্ছে সময় সচেতন প্রকৃতি।
ভালোভাবে চোখ মেলতেই খানিকটা হকচকিয়ে গেলো সে। এক মহিলার বুকে মাথা গুঁজে রেখেছে। জাপটে ধরে রেখেছে। মহিলার হাত তার চুলের পিছে। কেমন যেনো লাগলো। একটা অচেনা মহিলা তার সাথে কেনো শুয়ে আছে? পিঠ থেকে দ্রুত হাত সরিয়ে নিয়ে বুক থেকে মাথা সরালো মুনতাহা। আনতারা জেগে গেলেন। খুব হাল্কা ঘুম তার। মুনতাহা তার চেহারা দেখতেই আরো একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কোনোকিছু বুঝতে না পেরে শূন্যকন্ঠে বললো,

—“আন্টি আপনি..” কথা শেষ না করেই এদিক ওদিক তাকালো সে। না, এটাতো তারই রুম। পায়ের দিকে চোখ গেলো। আলগা করে করা ব্যান্ডেজ খুলে কাছেই পড়ে আছে। সদ্য পোড়া বিভৎস্য পাজোড়া দেখে ভয় পেয়ে গেলো মুনতাহা। চাদর খামছে ধরলো দু’হাতে। মুখ দিয়ে অষ্ফুস্ট স্বরে বেরোলো,”আব্বু..”
আনতারা মায়াভরা চোখে তাকালেন। নিজ থেকেই মুনতাহার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে নরম কন্ঠে বললেন,
—“দেখোনা মা। ভয়ের কিছু নেই। ক’দিন পরই ঠি ক হয়ে যাবে।

মুনতাহা কাঁদো কাঁদো অসহায় স্বরে ডাকলো,
—“আব্বু কোথায়?”

আনতারা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মাহতাব সাহেবকে ডাক দিতেই হুড়মুড় করে ছুটে আসলেন তিনি। বাবাকে দেখে তবেই শান্তি হলো মেয়ের। অস্বস্তি কেটে গেলো। তার গোল গোল নরম চোখের চাহনী সহজেই বুঝতে পারলেন মাহতাব সাহেব। এগিয়ে আসতেই আনতারা সরে দাড়ালেন। মাহতাব সাহেব দু’গালে হাত রাখলেন। মাথায় ছোট্ট চুমু খেয়ে বললেন,

—“এইতো আব্বু আছি। পায়ে এখনো ব্যাথা হচ্ছে আম্মা?”

মুনতাহা একবার পায়ের দিকে তাকালো। সাথেসাথেই চোখ বুজে ফেললো বাচ্চাদের মত। পা দুটো জ্বলছে। ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই জ্বলছে। ভীষণ জ্বলছে। বাবার কাছে তার সহজ সীকারোক্তি,”পা খুব জ্বলছে আব্বু।”
মাহতাব সাহেবের ভেতরটা কেঁদে উঠলো। যন্ত্রনায় হৃদপিন্ডে সূল বিঁধলো কয়েক’শ। তাড়াহুড়ো করে ঠান্ডা পানিতে কাপড় ভিজিয়ে আনলেন তিনি। পায়ে মুছিয়ে দিলে জ্বালাপোড়া একটু হলেও কমবে।

তখন সন্ধ্যা।
মাহতাব সাহেব বসে ছিলেন মুনতাহার সাথে। মেয়ে তার বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে রেখেছে। ঘুমাচ্ছেনা তবু চোখ বোজা। তিনি মাথায় হাত বুলাচ্ছেন অনবরত। আরশাদরা আসবে একটু পরে। আরশাদ জানিয়েছে সকালেই। অফিসে যাবার আগে একবার মেয়েটাকে দেখে গিয়েছিলো। তখনই বলেছে, সন্ধ্যার দিকে অফিস থেকে ফিরেই তার মাকে নিয়ে এসে আংটি পরিয়ে যাবে মুনকে। তার অসম্মতি নেই বরং যত দ্রুত সম্ভব ততোই ভালো। মুন জানেনা। বলবে বলবে করেও বলতে পারেননি। চোয়াল ভারি হয়ে আসে খালি। মেয়েদের কেনো বিয়ে দিতে হয়?
কলিংবেল বাজলো। মুনতাহা মাথা উঠিয়ে নিলো আস্তে করে।

আনতারা আরশাদ আর সাবিনা বেগমকে একসাথে ঘরে দেখেই খানিকটা গোলমেলে হয়ে গেলো মুনতাহা।
ভাবলো, অসুস্থ বলে তাকে দেখতে এসেছে হয়তো।
কিন্তু মাথাটা ঘুরে উঠলো তখনই যখন কিছুক্ষণ পরে আরশাদের মা সামনে বসে বাক্স থেকে আংটি বের করে বললেন,”দাও মা, হাত দাও।”

মুনতাহা কিছু বুঝে উঠতে পারলোনা। হাতদুটো জড়োসড়ো করে গুটিয়ে নিলো দ্রুত। কেমন কেনো লাগলো। জ্ঞাতশূন্য চোখে বাবার দিকে চাইলো সে। আরশাদ আস্তে করে বললো,”আংকেল? বলেননি ওকে?”
মাহতাব সাহেব ঝুঁকে গেলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন,
—“মুন আম্মু হাত বাড়িয়ে দে। দেখ, তুই বড়ো হয়েছিসনা? আব্বুর কথাতো মানে তাইনা? শোন মা, আব্বু আর ক’দিন থাকবে বল?”

এতটুকু শুনতেই থরথর করে কেঁদে দিলো মুনতাহা। চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেলো। চেহারা রক্তলাল হয়ে গেলো মূহুর্তেই। মুখের চোয়াল অসম্ভব ভারি হয়ে উঠলো। দু’হাতে বাবার পেট জড়িয়ে ধরে ভীত কন্ঠে বললো সে,
—“আব্বু, এসব কেনো বলছো?” তারপর একটু থেমে সজোরে হেঁচকি তুলে বললো,”তুমি আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে?”

মাহতাব সাহেব দু’হাতে মাথা টা বুকের সাথে চেপে রেখেই ধরা গলায় বললেন,
—“আহা! আম্মা কাঁদেনা। উনারা শুধু আংটি পরিয়ে যাবেন। বিয়ে পরে মা। তুই হাত বাড়িয়ে দে। আব্বুর কথা শুনবিনা?”

মুনতাহা চোখভর্তি পানি নিয়ে গুটিগুটি করে একবার আরশাদের দিকে তাকালো। হাতদুটো তখনো শক্ত করে গুটিয়ে রেখেছে।
আরশাদ পাশ থেকে ধীরকন্ঠে বললো,”আংকেল থাক আজকে, আপনি বুঝিয়ে বলেন পরে। বাচ্চা মানুষ, অসুস্থ এমনিই। কান্নাকাটি করলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে।”

মাহতাব সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আদুরে কন্ঠে বললেন,”আম্মা, এমন করেনা মা। আমি বলছিনা হাত বাড়াতে? ভয় কেনো? আব্বু বলছিনা? হাত দাও মা। উনি বড় না? অসম্মান হচ্ছে কিন্তু।”
মুনতাহা চোখ নিচে নামিয়ে নিলো। হাত বাড়িয়ে দিলো ধীরগতিতে। আনতারা মুচকি হেসে আংটি পরালেন তার অনামিকা আঙ্গুলে।

চলবে

#অমানিশা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৯

মুনতাহার কান্না থামেনা। আনতারা নিজের গলা থেকে চেইন খুলে পরিয়ে দিয়ে গেছেন। মেয়েটা তখন ঘাড়ের চুলগুলোও সরায়নি। আনতারা উপায়ন্তর না পেয়ে উপর দিয়েই হুক আটকে দিয়েছেন। ঘরে আপাতত কেউ নেই। শুধু আরশাদ বসে আছে কাছে। সে একা কথা বলবে। মাহতাব সাহেব আপত্তি করেননি, একটু আগেই বাইরে থেকে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেছেন।
মুনতাহার মাথা নোয়ানো। গাল বেয়ে থুতনির কাছে জমা হচ্ছে চোখের পানি। সেখান থেকে কিছু ফোঁটা টুপটাপ পড়ছে কবজির উপর। আর কিছু চিবুক ধরে গড়াচ্ছে গহনে…আরশাদ দেখলোনা আর। পাশে বিছিয়ে থাকা ওড়নার আচঁল মুঠোয় টেনে হাতের কব্জিতে জমা হওয়া কান্নার ফোঁটাগুলো মুছে দিলো। ঠান্ডা গলায় ডাকলো,”মুনতাহা?”

মুনতাহা তাকালোনা। উল্টো দু’বার দমকে দমকে উঠলো। আরো কয়েকটা ফোঁটা জল মূহুর্তেই জমা হলো কব্জিতে। আরশাদ এবার আর ওড়না টানলোনা। নিজের হাত দিয়েই মুছে দিলো। অত:পর ফের বললো,

—“মুনতাহা ডেকেছি না? তাকান আমার দিকে।” সেই গম্ভীর স্বর। গমগমে কন্ঠ। মুনতাহা পিটপিট করে তাকালো একবার। পরমূহুর্তেই চোখ নামিয়ে মিহি কন্ঠে বললো,”বলেন।”
আরশাদ একবার ভাবলো আবার তাকাতে বলবে আবার কি যেনো ভেবে জোর করলোনা। বললো,

—“আপনার মন খারাপ কেনো? কাঁদছেন কেনো?”

মুনতাহা চাপা স্বভাবের নয়। কিছু মনে থাকলে সে সরলমনে বলে দেয়। সামনের মানুষটা কি ভাবল জানেনা, তার বলার সে বলে দেয়। আরশাদের প্রশ্নেও ব্যাতিক্রম হলোনা। সে ভনিতা ছাড়াই পাল্টা প্রশ্ন করলো,
—“আপনি আমাকে বিয়ে করবেন কেনো?”

আরশাদ হাসলো। নিজের বা’হাতটা উঠিয়ে আলতো করে রাখলো মুনতাহার মাথার উপর। বায়দু’য়েক বুলিয়ে পূর্বের চেয়েও নরম গলায় বললো,
—“আমি বিয়ে করবো বলে কাঁদছেন? আপনি রাজি নন বিয়েতে?”

তার একটুকু আহ্লাদ পেয়েই যেনো জলন্ত মোমের মতো গলে গেলো মুনতাহা। কান্নার গতিক বাড়িয়ে হু হু করে অভিযোগ করলো,”আমি আব্বুর কাছে থাকবো। আপনি কেনো বিয়ে করে নিয়ে যাবেন?”

আরশাদ আবারো হেসে ফেললো ভেতরে ভেতরে। মেয়েটা শরীরে বড় হলেও বাবার বর্ণণাতীত আহ্লাদ- আদর তাকে এতটুকুই বানিয়ে রেখেছে। তার প্রমাণ এইযে..এমন বেহিসেবী কান্না, এলোমেলো কথা, লাল টকটকে
নাকের ডগা, ফুলে ওঠা ঠোঁট। আহা! ঘাড় বাকিয়ে পলক ঝাপটালো আরশাদ। ভাবনা থেকে বেরিরে গিয়েছে সে। ঠি ক কি যেনো ভাবছিলো? সবকিছু যেয়ে ওই মুখেই আটকে যায় কেনো?
দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই মনে পড়লো মুনতাহার প্রশ্ন। ঘাড় সোজা করে আবার তাকালো। বললো,

—“বিয়ে করে নিয়ে যাবো কে বললো?”

মুনতাহার কান্না তখন একটু হলেও থেমেছে। নাক টেনে বললো,
—“বিয়ে হলে তো সবাই চলে যায়। এটা বলতে হয় নাকি?”

আরশাদ তার কপালের দায়সারা চুলগুলো আঙুল দিয়ে গুছিয়ে দিলো। বললো,
—“তো কি হয়েছে? আপনি থাকবেন। এখানেই থাকবেন। আব্বুর কাছেই থাকবেন। শুধু ক’টাদিন পর আমার একটুখানি অধিকার থাকবে আপনার উপর।”

মুনতাহা ঠোঁট উল্টালো।

—“আপনি অধিকার দিয়ে কি করবেন?”

আরশাদ মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিলো। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো একমনে। মুনতাহার কান্না তখন পুরোপুরি থেমে গেছে। অর্থ্যাৎ, আরশাদের কথা সে বিশ্বাস করেছে। আরশাদ একবার তাকালো। চোখে চোখ পড়লো। অকস্মাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াবী চোখদুটো দেখে নিয়ে বা’হাতের তালুটা মেলে দিলো সে। আঙ্গুলের হাতছানির ইশারায় হাত দিতে বললো। মুনতাহা কি যেনো ভেবে চুপচাপ হাত রাখলো আরশাদের হাতের উপর। আরশাদ নরম স্পর্শে চারআঙ্গুলের ডগা ধরে বৃদ্ধাঙ্গুল ছোঁয়ালো অনামিকায়। সময় নিয়ে বললো,

—“দেখুন মুনতাহা, আপনার বাবা অধিকার ছাড়া আপনার দিকে তাকাতেও মানা করেছেন। সেটা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। বুঝতে পেরেছেন?”

মুনতাহা কিন্চিৎ ঠোট নাড়িয়ে বললো,

—“আমাকে দেখার কি আছে?”

আরশাদ চোখ তখন তার চোখেই। কন্ঠে শক্তপোক্ত ভাব,”আপনি জানেন কি আছে।”

মুনতাহা দিরুক্তি করলোনা। লজ্জা পেলো নাকি জানেনা তবে গালদুটো লাল হয়ে উঠলো ভীষণ। চোখদুটো আর উঠলোইনা। আরশাদ বললো,

—“আপনি অহেতুক একটা কারণে কাঁদছিলেন। আর কাঁদবেননা। ঠিকাছে?”

—“আপনি সত্যি নিয়ে যাবেন না তো?”

আরশাদ সাথেসাথেই উত্তর দিলোনা। খানিকবাদে নির্বিকার কন্ঠে বললো,

—“আচ্ছা, আপনি কি লক্ষ্য করেছেন আপনি আমার প্রত্যেকটা কথার উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করছেন? আপনি এতো প্রশ্ন করেন কেনো মুনতাহা?”

মুনতাহা বোকাকন্ঠে বললো,”প্রশ্ন করলে কি হয়েছে?”

আরশাদ হেসে ফেললো এবার,”আপনি আবার প্রশ্ন করছেন।”

মুনতাহা চুপ করে গেলো। আরশাদ পকেটে কি যেনো হাতরালো। রুপালি দু’টো নুপুর বেরিয়ে এলো। ধরে রাখা হাতটা উল্টো করে মুঠোয় নুপুর দুটো গুঁজে দিলো সে। মুঠো বন্ধ করে বললো,”আপনার নুপুর, কাল না বলেই খুলে নিয়েছিলাম। পা ঠিক হয়ে গেলে আবার পরে নিয়েন। কেমন?”

মুনতাহা মাথা কাত করে নিরবে সম্মতি দিলো। অর্থাৎ,”আচ্ছা।”
আরশাদ উঠে দাড়ালো পাশ থেকে। ‘একটু দেখি’ বলে নিজের হাতটা মেলে দিলো আবার। মুনতাহা সংকোচ করলোনা। নির্দ্বিধায় হাত রাখলো। আরশাদ হাল্কা ভাবে ধরলো, সেকেন্ডে আঙুলের আংটিটা খুলে নিয়ে নিজে পরিয়ে দিলো। মুনতাহা হাভাতের মতো চেয়ে আছে। মাত্রই না উনার মা পরিয়ে দিলো আবার খুলে নিজে পরানোর কি হলো?
আরশাদ মৃদু হাসলো। হাতটা নামিয়ে কোলের উপর রেখে মুখ বরাবর ঝুঁকে বললো,
—“আপনি শুধু কবুল বলবেন। আর কিচ্ছু করতে হবেনা। ঠিকাছে?”

মুনতাহা এবারো মাথা কাত করে সম্মতি দিলো। অর্থ্যাৎ,”আচ্ছা”।

সেদিনের পর দিন দুই পেরিয়ে গেছে। শনিবারের কুঁড়ে সকাল। অফিস ছুটি। বিছানার মাঝখান জুড়ে উপুর হয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে আরশাদ। দীর্ঘদেহী পিঠ অনাবৃত। খালি গা। খয়েরী রংয়ের টি- শার্টটা শোভা পাচ্ছে বালিশের পাশে। মুনতাহা বেখেয়ালি ধরণে চায়ে চুমুক দিলো। সাথেসাথেই ঠোঁটটা পুড়ে গেলো যেনো। সাবিনা বেগম তাড়াহুড়ো করে কাপ নামিয়ে দিলেন,”আরে বউ, জামাই তো তোমারই হইবো। একটু খেয়াল করে খাও। দু’দিন আগে পা পুড়ছে এখন আবার ঠোঁট পুড়াইতেছো। আর তোমারে দেইখা দেইখা আমার নাতিটাও পুড়তাছে।”

মুনতাহা লাজুক ভঙ্গিতে দৃষ্টি নামালো। এই দু’দিনে তিন চারবার দেখা হয়েছে উনার সাথে। প্রত্যেকবারই তিনি তাকে ‘বউ’ বলে সম্মোধন করেছেন। সবার সামনেই। কেউ কিছু বলেনা। আর এদিকে সে বেদম লজ্জায় পড়ে যায়। সাবিনা বেগম ঠান্ডা পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। ফিসফিসিয়ে বললেন,
—“আমার নাতিরে খুব পসোন্দ হয়?”

মুনতাহা বিষম খেয়ে তাকালো। আনতারা পাশেই সোফা গুছাচ্ছিলেন। ফিসফিসিয়ে বললেও কথাগুলো ঠিকই কানে গেলো তার। মুনতাহাকে বিষম খেতে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি,

—“আম্মা আপনি একটু লাগাম টানেন মুখে। আমার সাথে করেন করেন, এখন এই মেয়েটাকেও পেয়েছেন।”

—“আচ্ছা, আমাকে কি ব্যাটা ব্যাটা লাগে? আমিতো তোমাগো মতো মাইয়া মানুষ। আমার কাছে এতো লজ্জা কিসের?”

আনতারা হাল ছাড়লেন। মুনতাহা মাথা নিচু করে খাবার চিবোচ্ছে। সাবিনা বেগম আদর করে বললেন,

—“ওইদিন এমনে কানলা মাইয়া, আমি তো ভাবছি তোমারে জোর জবরদস্তি আংটি পরাইতেছে। নাতিটা আমার আবার খুব জেদি। একলা কথা বললানা? আমি তো ভাবছি, ঘর থেকে বাইর হইলে দেখুম তোমারে চড়ায়া লাল কইরা ফেলছে। এমনেই তো কাইন্দা কাইন্দা লাল হয়ে গেছিলা।”

আরশাদ ঘুমের মাঝেই সোজা হয়ে শুয়েছে। মুনতাহা অল্পএকটু তাকালো। কপালে হাত ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে লোকটা। উদোম রোমশ বুক! হাতের পেশিগুলো কি অসম্ভব ফুলে ফেঁপে আছে! চট করেই চোখ পড়লো সাবিনা বেগমের দিকে। তিনি হাসছেন। মুনতাহা হুড়মুড় করে প্লেটের দিকে তাকালো। সাবিনা বেগম হো হো করে হাসলেন,

—“আরে দেখো দেখো, তোমারই তো বুক। তুমিই তো মাথা রাখবা কয়দিন পর।”

মুনতাহা মিইয়ে গেলো সেকেন্ডেই। আর একবারো তাকালোনা ঘুমন্ত পুরুষটির দিকে।

আনতারা আবার চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন,
—“উফ আম্মা! চুপ করেন।”

আনতারা সোফা ঝেড়ে কি যেনো করতে গেলেন আরশাদের ঘরে। ড্রয়ের খুলে কি সব বের করলেন। খুটখাট শব্দে নড়েচড়ে উঠলো আরশাদ। চোখ মেলে ঘাড় বাঁকাতেই নজর গেলো ডাইনিং টেবিলে বসা জলপাই রংয়ের থ্রিপিস পরণে সাদামাটা মেয়েটার দিকে। মাথা ঝুঁকিয়ে খাচ্ছে। একপাশের চুলে মুখ দেখা দায়। পায়ের দিকে তাকালো। ব্যান্ডেজ করা। কিন্তু হাঁটতে পারে। ঘা শুকাচ্ছে।
আরশাদ উঠে বসলো। আনতারা পিছে ঘোরার আগেই ঘুম থেকে ওঠা ভাঙা গলায় ডাকলো,

—“মুনতাহা? আপনি এই পা নিয়ে এমন টইটই করছেন কেনো? আংকেল নেই বাসায় তাইনা?”

মুনতাহা তাকালো। তার ঠোঁটের কোঁণে এখনো দুধ চা লেগে আছে। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছে নিয়ে বললো,

—টইটই করছি কোথায়? আমি একটু আগেই এসেছি।”

আরশাদ প্রত্যুওর করলোনা। একবার শক্তশীতল চাহনী নিক্ষেপ করে পাশ থেকে টি-শার্ট নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে আপনমনেই কিড়মিড় করলো,”একটু আগেই এসেছি? হাহ্। আমি স্পষ্ট দেখলাম, আপনি বিগত একঘন্টা যাবত বারবার বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন মুনতাহা। একটু ঘুমাতে দিলেন না, পাষাণ মেয়ে। আবার বলছেন, আমি একটু আগেই এসেছি?”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here