#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||
২৪.
“হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে, হ্যাপি বার্থডে, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।”
সবাই সম্মিলিত ভাবে তূর্যকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো। অরুণিকা তূর্যের কাছে এসে বলল,
“রকস্টার আজ তোমার জন্মদিন?”
তূর্য হেসে বলল, “হ্যাঁ, টুইংকেল।”
তাহমিদ একটা বক্স টেবিলের উপর রেখে বলল,
“তোর বার্থডে কেক।”
তূর্য কেকটা দেখে বলল, “তুই বানিয়েছিস?”
“হ্যাঁ।”
তূর্য ছবি উঠিয়ে নিয়ে বলল,
“দেখতে অসাধারণ লাগছে। এবার খেতে কেমন লাগে সেটাই দেখার বিষয়।”
সবাই একসাথেই তূর্যকে কেক খাওয়ালো। তাহমিদ কেকের জন্য ভালোই প্রশংসা পেলো। খাওয়া-দাওয়ার পর সেই উপহারটি দেওয়ার সময় এলো, যেটির জন্য আজ এতো আয়োজন করা হয়েছে।
আরাফ অরুণিকাকে কোলে নিয়ে বলল,
“উপহারটা তুমিই দাও।”
তূর্য যদিও বুঝতে পেরেছে তবুও সে উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল। এবার আহনাফ অরুণিকার হাতে গিটারটি দিলো। অরুণিকা সেটা নিয়েই বলল,
“এতো বড় গিফট! এখানে কি আছে?”
আরাফ বলল,
“তুমি আগে তোমার রকস্টারকে দাও। সে-ই খুলে দেখুক কি আছে এতে!”
অরুণিকা সেই বক্সটি আঁকড়ে ধরে বলল,
“অনেক ভারী।”
তূর্য নিয়ে বলল,
“হয়েছে, হয়েছে। টুইংকেল স্পর্শ করে দিয়েছে এতেই হবে। নয়তো আমি পাওয়ার আগেই হাত থেকে ফেলে আমার শখের উপহার ভেঙে ফেলবে।”
শতাব্দী গালে হাত দিয়ে বলল,
“গায়ক সাহেব, তুমি বুঝে ফেলেছ নাকি!”
তূর্য কলার নাচিয়ে বলল,
“উপহার দাতা কারা?”
শতাব্দী পাঁচজনের দিকে ইশারা করে বলল, “এরা।”
“এরা কারা?”
“তোমার বন্ধু।”
“তো, আমি বুঝি আমার বন্ধুদের চিনবো না?”
তূর্য বক্স খুলে গিটারটা বের করে পাঁচ জনের উদ্দেশ্যে বলল,
“আমার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপহার হলো, আমি তোদের মতো বন্ধু পেয়েছি। আর আমার একটা টুইংকেলও আছে।”
অরুণিকা গিটারটি নিয়ে বলল,
“এটা দিয়ে কি করে?”
তূর্য অরুণিকাকে কোলে বসিয়ে বলল,
“এটা গান গাওয়ার সময় ব্যবহার করে। এমনিতেও করা যায়। এটাতে শব্দ তুললে গান শুনতে আরো ভালো লাগে।”
অরুণিকা ফ্যালফ্যাল করে তূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমন বলল,
“তোর কঠিন কথাগুলো ও বুঝবে না। তুই বরং শুনিয়েই বুঝিয়ে দে।”
এরপর সবাই তূর্যকে ঘিরে বসলো। অরুণিকা তূর্যের কোলে বসেছে। তূর্য গিটারে সুর তুলে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা গিটারের শব্দ শুনে হেসে তূর্যের দিকে তাকালো।
“আমি তোমাকেই বলে দেবো,
কি যে একা দীর্ঘ রাত
আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে।
.
আমি তোমাকেই বলে দেবো,
সেই ভুলে ভরা গল্প
কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়।
.
ছুঁয়ে কান্নার রঙ,
ছুঁয়ে জোছনার ছায়া
ছুঁয়ে কান্নার রঙ
ছুঁয়ে জোছনার ছায়া।”
অরুণিকা তূর্যকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি ওই গানটা গাও। যেটা আমাকে শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়েছিলে। ওই গানটা।”
তূর্য মুচকি হেসে গিটারে সুর তুললো।
“তুমি নরম ফুলের গান,
তুমি গরম ভাতের ভাপ,
তুমি অভিমানের চুপ,
তুমি কান্না জমা মোম।
.
আমি তোমার ছায়ায় ছায়ায় থাকি মা
আমি তোমার চোখের তারায় বাঁচি মা,
আমি তোমার মায়ায় মায়ায় থাকি মা
আমি তোমায় হাওয়ায় আবার ডাকি মা,
আমি তোমায় ভালোবাসায় মুড়ে, রাখি মা।”
শতাব্দী কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“গায়ক সাহেব, তোমার কন্ঠে জাদু আছে। আমি তো তোমার প্রেমেই পড়ে যাচ্ছি।”
তূর্য শব্দ করে হাসলো। শতাব্দী বলল,
“হাসছো কেন?”
“আমার প্রেম করতে আপত্তি নেই, তবে বিয়ে আমি করছি না।”
“বিয়ে করবে না কেন?”
“রকস্টারদের বিয়ে করলে মানায় না।”
“দেখা যাবে, তুমিই সবার আগে বিয়ে করে বউ ঘরে তুলেছ।”
“আমার তো মনে হয় বিয়েটা সবার আগে ইভানেরই হবে।”
“কিভাবে বুঝলে?”
“দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছি।”
“এতো ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছো কেন? কিছু আছে নাকি?”
ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এখনো কলেজ পাশ করি নি। কি আবোলতাবোল বলছিস তুই?”
ইভানের কথায় তূর্য আর শতাব্দী চুপ হয়ে গেলো।
আজ স্কুল ছুটি তাই সবাই বাসায় আছে। আর আজই অরুণিকা তার পুতুলের বিয়ে দেবে। শতাব্দী হচ্ছে পুতুলের বড় বোন, ইভান পুতুলের বড় ভাই। ইমনকে বানিয়েছে ঘটক। আরাফ হচ্ছে পুতুলের মা, আর তূর্য বাবা। তাহমিদ আর আহনাফ এসেছে পুতুলের বিয়েতে নাচ-গান করতে। ডুমুর আর বাঁধন পুতুলের শ্বশুড়-শাশুড়ি।
সবাইকে এক একটা পরিচয় দেওয়ার পর শতাব্দী অরুণিকাকে জিজ্ঞেস করলো,
“ছোট সখী, তাহলে তুমি কি হবে?”
অরুণিকা হেসে বলল,
“আমি সবাইকে সাজিয়ে দেবো। রান্না দেখবো। তাহমিদের মতো রান্না করে সবাইকে খাওয়াবো।”
আরাফ হাত তালি দিয়ে বলল, “বাহ, বেশ, বেশ।”
তূর্য বলল, “খেতে পারবো তো?”
অরুণিকা বলল, “হুম অনেক মজা হবে।”
তাহমিদ বলল, “কি কি রাঁধছো?”
“এখন বলবো না। যখন খাবে, তখন বলবো। এখন আগে সাজিয়ে দেবো।”
অরুণিকা একটা উড়না শতাব্দীর মাথায় পরিয়ে দিয়ে কাঁচা হাতে তাকে সাজিয়ে দিলো। অরুণিকা সাজিয়ে দেওয়ার পর বলল,
“দেখো, কতো সুন্দর লাগছে।”
শতাব্দীকে দেখে তূর্য বলল,
“আমার মেয়ের এ কি হাল হলো।”
আহনাফ তূর্যকে গুঁতো দিয়ে বলল,
“বাহ, অরু। তুমি তো খুব সুন্দর করে সাজিয়েছো।”
অরুণিকা মিষ্টি হাসি দিলো। শতাব্দী মুখ ছোট করে বসে রইলো। অরুণিকা ইভানের সামনে এসে বলল,
“তোমাকে সাজতে হবে না। ভাইরা বোনের বিয়েতে সাজে না।”
ইভান হাঁ করে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। শতাব্দী হেসে বলল,
“ভাইরা বোনের বিয়েতে শুধু কাজ দেখে।”
এরপর পাশে থাকা একটা বাটি ইভানের মাথার উপর দিয়ে শতাব্দী বলল,
“মনে করো এখানে ফুল আছে। আর তুমি ফুল নিয়ে ঘর সাজাচ্ছো।”
ইভান বাটিটা সরিয়ে চোখ ছোট করে শতাব্দীর দিকে তাকালো। এবার ইমনের নাকের নিচে কাজল দিয়ে গোঁফ এঁকে অরুণিকা বলল,
“তুমি হচ্ছো ঘটক। তুমি বিয়ে দেবে।”
ইমন বলল, “ঘটক না, কাজি।”
শতাব্দী ইমনের কাছে এসে বলল,
“ভাবলাম ঘটক সাহেবকে বলবো, একটা ছেলে দেখতে। এখন যেহেতু কাজি হয়ে গেছেন, তাহলে একেবারে বোনের বিয়ের পাশাপাশি আমার বিয়েটাও করিয়ে দিন, কাজি সাহেব।”
ইমন কাজল দিয়ে আঁকা গোঁফের উপর হাত বুলিয়ে বলল,
“তোমার যা চেহারা, কয়েকশ বছরেও সু পাত্র জুটবে কিনা সন্দেহ।”
তূর্য রাগী কন্ঠে বললো,
“এই কাজি, তুই আমার মেয়েকে এভাবে অপমান করতে পারিস না। আমি তোর গোঁফগুলো একেবারে!”
“একেবারে কি? এই গোঁফ সহজে কাটা যাবে না। অরুণিকা এই গোঁফ লাগিয়েছে।”
“আমি তো কাটবো না। একেবারে পুরো মুখে গোঁফ লাগিয়ে দেবো।”
অরুণিকা তূর্যকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি হচ্ছো পুতুলের বাবা। তুমি কম কথা বলবে। চুপ থাকবে। নয়তো বরের বাবা রাগ করবে।”
অরুণিকার কথা শুনে সবাই অবাক। আরাফ জিজ্ঞেস করলো,
“তোমাকে এসব কে বলেছে?”
“আলেয়া খালা বলেছে। সিনথিয়া আপুর বিয়ের সময় আংকেল চুপ করে বসে ছিলো। এমনিতেই কতো বকবক করে। আলেয়া খালা বলেছে, মেয়ের বাবা-মার চুপ থাকতে হয়।”
ইমন হেসে বলল,
“অরুণিকা হবে ভবিষ্যৎ পরিবার কল্যান মন্ত্রী।”
এবার অরুণিকা আরাফকে সাজিয়ে দিলো। তূর্য আরাফের হাত ধরে বলল,
“আমার বউকে দারুণ লাগছে। চলো ঘরে যাই।”
আরাফ হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“যা তো। সর।”
এবার তাহমিদ আর আহনাফকেও সাজিয়ে দিলো। আহনাফকে সাজানোর সময় অরুণিকা তার ঠোঁটে লাল লিপস্টিক লাগিয়ে দিচ্ছিল। আহনাফ বলল,
“অরু, আর লাগিয়ে দিও না। কি করছো? একেবারে খাইয়ে দেবে নাকি?”
অরুণিকা হাত ঝেড়ে বলল,
“এখন শেষ।”
আহনাফ বিরক্তির সুরে বলল,
“মেয়েরা এমন আস্তরণ লাগিয়ে কিভাবে চলাফেরা করে। আমার তো মনে হচ্ছে মুখে ভারী কিছু লাগিয়েছি।”
শতাব্দী মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“মেয়েরা সব পারে, বুঝলে?”
“এতো বুঝতে হবে না। এই অরু, তাড়াতাড়ি বিয়ে শেষ করো।”
অরুণিকা বলল,
“তোমরা নাচ-গান করো।”
আহনাফ বলল,।”আমি নাচবো?”
“তোমাকে নাচ-গান করার জন্যই তো বিয়েতে এনেছি।”
এবার অরুণিকার চাপাচাপিতে তাহমিদ আর আহনাফ কোমড় দুলিয়ে নাচতে লাগলো। তাদের দেখাদেখি ইমন আর তূর্যও যোগ দিলো। শুধু আরাফ আর ইভান বসে বসে তাদের দেখছে। অরুণিকার পুতুলের বিয়ে খেলা শেষ করে শতাব্দী বাসায় চলে যাওয়ার জন্য বের হলো। শতাব্দীকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য তাহমিদও বেরিয়ে এলো। শতাব্দী মুচকি হেসে বললো,
“আজকের খেলায় অনেক মজা পেয়েছি।”
“হুম।”
শতাব্দী বিদায় দিয়ে চলে যেতে নিবে তখনই তাহমিদ পকেট থেকে একটা ছোট বক্স বের করে বলল,
“এটা তোমার জন্য।”
শতাব্দী বক্সটি নিয়ে বলল, “আমার জন্য?”
“হুম।”
“কি আছে এখানে?”
“বাসায় গিয়ে দেখো।”
শতাব্দী মুচকি হাসি ফেরত দিয়ে বাসায় চলে এলো। বাসায় এসে সে তাড়াতাড়ি বক্সটা খুলে দেখলো এক জোড়া নুপূর। সে নুপূরগুলো হাতে নিয়ে দেখলো বক্সে ছোট একটা চিরকুটও ভাঁজ করা আছে। সে তাড়াতাড়ি সেটি খুলে পড়তে লাগলো।
তাহমিদ লিখেছে,
“অরুণিকার কাছে শুনেছি তোমার নাকি নুপূর পরতে খুব ভালো লাগে। ওর জন্য কিনতে গিয়েছিলাম। ভাবলাম, তোমার জন্যও নিয়ে ফেলি।”
শতাব্দী মুচকি হেসে নুপূরগুলো হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করলো। একটা মিষ্টি অনুভূতি এখন তার ভেতরটা নাড়িয়ে দিচ্ছে। এই অনুভূতির কোনো নাম নেই। শুধু সে এতোটুকু জানে, আজ তার ভীষণ ভালো লাগছে।
চলবে-