#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৫||
২৮.
ইমনকে দেখেই মাওশিয়াত তার সামনে ভ্রূ কুঁচকে দাঁড়ালো। মাওশিয়াত বুকে হাত গুঁজে বলল,
“আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না তুমি খেলায় নাম দিয়েছ।”
ইমন হেসে বলল,
“বিশ্বাস না হওয়ার কি আছে?”
“আমার মনে হয় না তুমি ফুটবল খেলতে পারো।”
“মনে না হওয়ার কারণ কি?”
“তোমাকে দেখে মনে হয় না।”
আহনাফ ইমনের কাঁধে হাত রেখে মাওশিয়াতকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মানুষের দক্ষতা তার চেহারার মধ্যে থাকে না। এই দক্ষতা বোঝার জন্য উদার মন দরকার। আর তোমার মন-মানসিকতা একটুখানি। তাই তোমার হয়তো মনে হয় না।”
মাওশিয়াত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমন আহনাফের কথা কাটিয়ে দেওয়ার জন্য বলল,
“আরেহ আহনাফ, সবসময় মজা করিস কেন?”
আহনাফ বাঁকা চোখে মাওশিয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে কিন্তু ইমন ভালো করেই চিনে। আমি সবসময় সিরিয়াস কথা বলি। মজা করার মতো মন-মানসিকতা আমার নেই।”
কথাটি বলে আহনাফ চলে গেলো। ইমন আহনাফের পিছু পিছু এসে বলল,
“তুই মাওশিয়াতকে এভাবে অপমান করেছিস কেন?”
আহনাফ ইমনের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
“তোর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে নাকি? ওকে আমি অপমান করেছি? বোকা ছেলে, ও তোকে অপমান করছিল। আমি শুধু ওকে ওর মানসিকতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।”
ইমন চুপ করে রইলো। আহনাফ বলল,
“মনে হচ্ছে তুই মাওশিয়াতের ব্যাপারে খুবই সেনসিটিভ। প্লিজ ইমন, আমি চাই না তুই মানসিকভাবে কষ্টে থাক। ও তোকে নিয়ে ওভাবে চিন্তা করছে না। করবেও না।”
“কেন করবে না?”
“বয়স কত হয়েছে তোর?”
“খুব শীঘ্রই ষোলো শেষ হবে।”
“ষোলো বছর খুবই কম, ইমন। আর কিইবা আছে আমাদের? না আছে পরিচয়, না আছে নাম। এমন অবস্থায় আছি, যেখানে নিজের বংশ পরিচয় দিলেই বিপদ। সেখানে তুই প্রেম করবি? তাও আবার মাওশিয়াতের সাথে? ও এই দেশের। আর আমরা ভিনদেশি। ওর পরিবার এটা মেনে নেবে না, তারপর একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এতো ঝামেলা নিতে পারবি?”
“ভালোবাসায় সব সম্ভব।”
“তুই যেই অনুভূতিকে ভালোবাসা ভাবছিস, সেটা আসলে ভালোবাসা না।”
“যদি সত্যিই ভালোবাসা হয়? আমার তো মাওশিয়াতকে অনেক ভালো লাগে।”
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আশা করি বাইরের কারো জন্যই আমাদের ছ’জনের মধ্যে কোনো ঝামেলা হবে না।”
কথাটি বলেই আহনাফ চলে গেলো। ইমন পেছন ফিরে মাওশিয়াতের দিকে তাকালো। মাওশিয়াত তার বান্ধবীর সাথে গল্প করছে। ইমন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক মিনিট, দুই মিনিট, এভাবে অনেক সময় পার হয়ে গেলো। মাওশিয়াতও তার কথা শেষ করে ক্লাসে ঢুকে গেলো। কিন্তু তার চোখ একবারও ইমনের দিকে গেলো না। তাহলে কি আনমনেও মাওশিয়াতের দৃষ্টি ইমনকে খোঁজার চেষ্টা করে না? তাহলে এই বন্ধুত্বও কি মাওশিয়াতের কাছে মূল্যহীন?
ক্লাস রুমের সামনে খালি বারান্দায় ইমন দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার বাবাকে খুব মনে পড়ছে। বাবা আর মা ইভানের চেয়ে তাকে একটু বেশিই ভালোবাসতো। কারণ সে বয়সে ছোট ছিল। সে কখনোই কোনো অপূর্ণতায় ছিল না। কিন্তু আজ সে যা চাইছে, তা সহজে পাচ্ছে না। এই না পাওয়ার যন্ত্রণা তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই কালো রাতটির কথা। যদি সেদিন সেও বাবা-মার সাথে অনেক দূরে হারিয়ে যেতো? হয়তো তখন তাকে এতো আক্ষেপ করতে হতো না।
ইভানের কন্ঠে ইমনের ঘোর কাটলো। ইভানের পেছনে তাহমিদ, তূর্য, আরাফ আর আহনাফ দাঁড়িয়ে আছে। ইভান ইমনের দুই কাঁধে তার দুই হাত রেখে বলল,
“আমি জানি তোর এই সুযোগটা দরকার ছিল। তুই তো খেলতে চাস। এখন তোর স্বপ্ন পূরণের ছোট একটা পথ খুলে গেছে।”
তাহমিদ বলল,
“যারা মনে করে তোর মধ্যে কোনো ট্যালেন্ট নেই, তাদের দেখিয়ে দিতে হবে, ইমন কে!”
তূর্য ইমনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“শুধু পড়াশুনা করলেই সম্মানিত হওয়া যায় না। যারা সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকে, তারাই ক্লাসে প্রথম হয়। আর যারা নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য সংগ্রাম করতে থাকে, তারা জীবনে প্রথম হয়।”
আরাফ বলল,
“ইমন, এখন প্র্যাক্টিসে যা।”
আহনাফ ইশারায় ইমনকে শুভেচ্ছা দিলো। ইমনও মুচকি হেসে চলে গেলো। এরপর এক সপ্তাহ কেটে গেলো। এক সপ্তাহ পর একাদশ শ্রেণির দুটি গ্রুপের মধ্যে ফুটবল খেলা হলো। সেই খেলায় ইমনদের দল জয়ী হলো। এভাবে দুই দিনের ব্যবধানে চারটি ম্যাচ হলো। চারটি ম্যাচে দুটি দল বাছাই করা হলো। এই দুটি দলের মধ্যেই এবার শেষ ম্যাচ হবে। যেই দল জিতবে, তাদের জন্য একটা সুযোগ থাকবে। তারা যদি ভালো খেলা প্রদর্শন করতে পারে, তাহলে তাদের অন্য স্কুলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিয়ে যাওয়া হবে।
শেষ ম্যাচের দিনই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। এদিকে বাছাই পর্বে তূর্যের নাম এসেছে। এখন স্কুলের পাঁচজন বাছাইকৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে গানের প্রতিযোগিতা হবে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিন অরুণিকা আর শতাব্দীও আরাফদের স্কুলে গেলো। অরুণিকা আজ সাদা ফ্রক পরে অনুষ্ঠান দেখতে এসেছে। শতাব্দী নিজ হাতে অরুণিকাকে সাজিয়ে দিয়েছে। তাহমিদ অরুণিকার সাজ দেখে শতাব্দীকে বলল,
“একদম পুতুল বানিয়ে দিয়েছ!”
“ও তো পুতুলই।”
আরাফ অরুণিকার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।”
অরুণিকা ফ্রক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে বলল,
“আমাকে কি পুতুলের মতো লাগছে?”
“হ্যাঁ, একদম পুতুল লাগছে।”
অরুণিকা মুখে হাত দিয়ে হাসলো। আহনাফ দূর থেকে সেই হাসি দেখে মুচকি হেসে ইভানকে বলল,
“আমাদের অরু বড় হয়ে যাচ্ছে, দেখ।”
ইভান অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, সামনে ওর ছয় বছর পূর্ণ হবে। কিভাবে যে দুইটা বছর কেটে গেছে!”
এবার তূর্য তার গিটার নিয়ে মঞ্চে উঠলো। অরুণিকা হাততালি দিয়ে বলল,
“দেখো, রকস্টার।”
তূর্য অরুণিকার দিকে তাকিয়ে কন্ঠে গান ধরলো,
“খোলা চোখখানা করো বন্ধ,
বাতাসের ঠাণ্ডা গন্ধ
বয়ে বেড়ায় ঘরেরও বাহিরে,
আসো ছোট্ট একটা গান করি,
যাতে ঘুম পাড়ানি মাসি এসে পাশে বসে
হাতখানা দিবে কপাল ভরে
ভয় নেই, আছি আমি পাশে
হাতখানা ধরে আছি হেসে
কোলেতে আমার মাথা তোমার।
.
অন্ধকার রাত, নিশ্চুপ সব
জোনাকির দল আজও জেগে আছে
তারা হয়তো অপেক্ষায় তোমার ঘুমের
হাতে রেখে হাত দেখে ঘড়ি
বসে অপেক্ষা করি
কবে হবে কাল, ফুটবে সকাল
.
আয়, ঘুম চুম্বন দে তার সারা কপালে
যাতে ঘুম আসে সব নিশ্চুপ হয়ে যায়
আয়, চাঁদমামা কাছে আয়
যাতে অন্ধকার না হয়
আলোমাখা কপালেতে টিপ টা দে
যাতে কিছু আলোকিত হয়
সে যাতে ভয় না পায়
.
পরি আয়, তার দুই হাত ধরে
নিয়ে যা স্বপ্নের খেলাঘরে
যেথা মিলবে তার সুখের ঠিকানায়
তারাদল ছুটে আয় এইখানে
তার ঘুমখানা যাতে না ভাঙে তাই
নিয়ে যা তাকে স্বর্গের বিছানায়
যদি দেখো সেথা আমায়
বসে গান তোমায় শোনাই
তুমি মিষ্টি এক চুমু খেয়ো মোর গালে।
.
অন্ধকার রাত, নিশ্চুপ সব
জোনাকির দল আজো জেগে আছে
তারা হয়তো অপেক্ষায় তোমার ঘুমের
হাতে রেখে হাত দেখে ঘড়ি
বসে অপেক্ষা করি
কবে হবে কাল, ফুটবে সকাল
.
আয়, ঘুম চুম্বন দে তার সারা কপালে
যাতে ঘুম আসে সব নিশ্চুপ হয়ে যায়
আয়, চাঁদমামা কাছে আয়
যাতে অন্ধকার না হয়
আলোমাখা কপালেতে টিপ টা দে
যাতে কিছু আলোকিত হয়।”
তূর্য গান গেয়ে মঞ্চ থেকে নেমে অরুণিকার গাল টেনে দিয়ে বলল,
“এই টুইংকেল, তোমাকে তো আজ পরীর মতো লাগছে।”
অরুণিকা তূর্যের গিটার ধরে বলল,
“আমাকে এটা দেবে?”
তূর্য গিটারটা সরিয়ে বলল,
“না, এটা ছোটরা ধরে না।”
শতাব্দী হেসে বললো,
“বাহ গায়ক সাহেব, একটু আগে তুমি তোমার টুইংকেলের দিকে তাকিয়ে গান করছিলে, আর এখন গিটারটাই ধরতে দিচ্ছো না! এ আবার কেমন ভালোবাসা।”
তূর্য ভ্রূ নাচিয়ে বলল,
“তুমি আমার ভালোবাসা বুঝবে না। আমার ভালোবাসা সবার চেয়ে ভিন্ন। এই ভালোবাসা দেখা যায় না।”
কথাটি বলতে বলতেই তূর্য হেসে দিলো।
শতাব্দী বলল, “হাসছো কেন?”
তূর্য ইশারায় আরাফ আর আহনাফকে দেখিয়ে দিয়ে বলল,
“পাশের দুইটা রেগে যাচ্ছে বোধহয়।”
আরাফ ইশারায় অরুণিকাকে দেখিয়ে দিলো। তূর্য অরুণিকার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছে। তূর্য অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আরেহ, আমার পিচ্ছি টুইংকেলকে আমি কত্তো ভালোবাসি, একদম ইমন, ইভান, আরাফ, আহনাফ, তাহমিদকে যেমন ভালোবাসি, ঠিক তেমনি। কিন্তু আমার গিটারের চেয়ে বেশি না। সরি টুইংকেল।”
অরুণিকা গিটারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি টুন-ঝুনকে বেশি ভালোবাসি। শতু আপুকেও ভালোবাসি।”
“আমাদের ভালোবাসো না?”
“হ্যাঁ, সবাইকে ভালোবাসি। তোমরা সবাই ভালো। কিন্তু ওই ছেলেটা পঁচা।”
অরুণিকা ইভানকে দেখিয়ে দিয়ে কথাটি বলল। ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“হ্যাঁ, আমি পড়তে বসাই তাই পঁচা হয়ে গেলাম। এখন বাকিরাও পড়াক। তারপর সবাইকে কতো ভালোবাসে, দেখবো।”
এরপর পুরষ্কার বিতরনী পর্বে তূর্য গানের জন্য প্রথম পুরষ্কার পেলো। ক্রেস্ট নিয়ে মঞ্চ থেকে নামার সময় তাদের শ্রেণি শিক্ষক তাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গেলো। তিনি তূর্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তোমার কন্ঠে অসম্ভব মায়া। তোমার জন্য একটা ভালো খবর আছে।”
“কি খবর স্যার?”
“আমাদের অতিথি মিস্টার সুমন রায় তোমার গান পছন্দ করেছেন। তিনি তোমাকে উনার সাথে যোগাযোগ করতে বলেছেন।”
স্যার একটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“হয়তো তুমি মিডিয়ায় কাজ করার সুযোগ পাবে। কারণ মিস্টার সুমন রায় মিডিয়ার সাথেই জড়িত।”
তূর্যের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। সে আবার মনে করার চেষ্টা করলো, সে কি গান গেয়েছিল! গানটা কি সে এতো ভালো গেয়েছে, যার জন্য তার মিডিয়ায় কাজ করার সুযোগ হয়ে যাবে?
অন্যদিকে ইমনের দল জয়ী হয়েছে। তাদের বার্ষিক পরীক্ষার পর আবার অনুশীলন করতে হবে। এবার ভালো খেলতে পারলে সে পুরষ্কার হিসেবে টাকা পাবে। এদিকে খেলা শেষ হওয়ার পর পুরষ্কার নিয়ে সে যখন বন্ধুদের কাছে আসছিল, তখনই মাওশিয়াত তার সামনে এসে দাঁড়ালো।
ইমন ক্রেস্ট দেখিয়ে বলল,
“আমি ভালো খেলি, এখন প্রমাণ পেয়েছো?”
“হ্যাঁ, ভালোই খেলেছ হয়তো। তবে আমি ফুটবল খেলা বুঝি না। সবাই তোমার অনেক প্রশংসা করছে, তাই বুঝলাম ভালো খেলেছ। তবে এসব খেলাধুলা করে তুমি বেশিদূর এগুতে পারবে না। আসল উন্নতি তো ভালো রেজাল্ট আসলেই হয়।”
ইমন মুচকি হাসলো। মনে মনে বলল,
“তোমার মনে জায়গা নেওয়ার জন্য আমি এখন থেকে খুব পড়বো। ভালো রেজাল্ট করবো। তখন হয়তো তুমি আমায় খুব পছন্দ করবে।”
চলবে-