অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-১৭||

0
1367

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৭||

৩১.
তাহমিদ আজ স্কুলে যায় নি। কাল রাতে সে অনেকগুলো সিঙ্গারা ও সমুচা বানিয়েছিলো। ভাবছে সেগুলো আজ বিক্রি করতে পারলে অনেক টাকা হাতে আসবে। এমনিতেই আগামী সপ্তাহে অরুণিকাকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। তারপর ওর স্কুলের ড্রেস, জুতো, নতুন বইসহ আরো অনেক কিছুই কিনতে হবে। তাই এখন হাতে টাকা থাকা বেশি জরুরি।

তাহমিদ একটা বড় হাঁড়ির ভেতর সব ভাজা সিঙ্গারা আর সমুচা রাখলো। এবার রিক্সা নিয়ে চলে এলো একটা স্কুলের সামনে। সেখানে দাঁড়িয়ে সে স্কুলের টিফিন ছুটিতে তার হাতে বানানো সিঙ্গারা আর সমুচা বিক্রি করতে লাগলো।

হঠাৎ একটা মেয়ে এসে বলল,
“এই সমুচা ওয়ালা দাম কতো সমুচার?”

মেয়েটির সম্বোধন তাহমিদের পছন্দ হলো না, যদিও সে অনেক বার ফেরিওয়ালা, দোকানদার, মিষ্টিওয়ালা এসব নামেই সম্বোধিত হয়েছিল।

তাহমিদ তবুও ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে বলল, “আট টাকা।”

মেয়েটি ক্ষ্যাপা কন্ঠে বললো,
“একটা সমুচার দাম আট টাকা? অসম্ভব! তিন টাকা দিয়ে দাও।”

তাহমিদ অবাক কন্ঠে বললো,
“তিন টাকার সময় কি এখন আর আছে? এই একটা সমুচা বানাতেই আমার অনেক পরিশ্রম হয়েছে। আট টাকা তো আমি বেশি চাই নি।”

মেয়েটি বাঁকা চোখে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার সাথে বাড়াবাড়ি করবি? তুই রাস্তার দোকানদার আমাকে শেখাবি টাকা বেশি হয়েছে কিনা?”

মেয়েটি তাহমিদকে ধাক্কা দিতেই তাহমিদ মাটিতে পড়ে গেলো। তাহমিদ মাটি থেকে উঠে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
“আমি তো আপনার সাথে বেয়াদবি করছি না। তাহলে আপনি আমাকে এভাবে ধাক্কা দিলেন কেন?”

মেয়েটি বুকে হাত গুঁজে বলল,
“দিলাম ধাক্কা! কি করবি তুই? বল কি করবি? আমাকে মারবি? তোর মতো রাস্তার ছেলে আমার গায়ে হাত তোলার সাহস পাবে? একবার মেরেই দেখ, এমন মার খাওয়াবো, বাবার নাম ভুলে যাবি।”

“আটটা টাকার জন্য এতো নোংরা ব্যবহার না করলেই হতো।”

তাহমিদ একটা সমুচা মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার তিনটাকা লাগবে না। আপনি বরং টাকা ছাড়াই খেয়ে যান। আমার সমস্যা হবে না। আমার বাবা-মা আমাকে আট টাকার জন্য কারো গায়ে হাত তোলা শেখায় নি। তাই আমাকে আমার বাবার নাম ভুলতে হবে না। আমি তাদের নাম সারাজীবন মাথায় রাখবো।”

মেয়েটি ক্ষুব্ধ হয়ে তাহমিদের গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো। তখনই শতাব্দী স্কুলের গেইট দিয়ে বের হলো। বের হয়ে দেখলো তার ক্লাসমেট তুতুল তাহমিদকে চড় মেরেছে। এদিকে তাহমিদ গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুতুল তাহমিদকে বলল,
“তোর মতো ছেলে আমার জুতোর ধুলো পাওয়ারও যোগ্য নয়, আর তুই আমার উপর কথা বলছিস?”

শতাব্দী তাহমিদের কাছে এসে তুতুলকে বলল,
“তুতুল, তুমি ওকে চড় মারলে কেন?”

“কারণ ও একটা চোর। তিন টাকার সমুচা আট টাকা দিয়ে বিক্রি করছে।”

শতাব্দী রাগী কন্ঠে বললো,
“চোর ও না। চোর তুমি।”

“আমি চোর? আমি কি চুরি করেছি?”

“অন্যের পরিশ্রমের টাকা দিতে চাইছো না, এটাকেই তো চুরি বলে। এদিকে কাল তো মেলা থেকে কয়েক হাজার টাকার কেনাকাটা করেছো, তাও আবার নতুন প্রেমিকের টাকায়। তো তোমার প্রেমিক কি তোমাকে আটটা টাকাও হাতে দিয়ে যায় নি? নাকি তোমার বাবা-মা তোমাকে তিনটাকা ধরিয়ে দিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছে?”

তুতুল আর কিছু বললো না। সে হনহন করে চলে গেলো। শতাব্দী এবার তাহমিদের দিকে তাকালো। তাহমিদের চোখেমুখে মলিনতা। তবুও সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিদের সেই অসহায় মুখটি দেখেই শতাব্দীর মায়া লাগলো। সে তাহমিদের হাঁড়িটা নিয়ে স্কুলের ভেতর চলে গেলো। তাহমিদও তার পেছন পেছন গিয়ে বলল,
“কি করছো শতাব্দী?”

শতাব্দী তাহমিদের দিকে তাকিয়ে ইশারায় তাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে বললো। এবার শতাব্দী কোথা থেকে একটা ছোট ঘন্টা নিয়ে এলো। তারপর স্কুলের গেইটের সামনে সেই ঘন্টা বাজিয়ে আওয়াজ করে বলতে লাগলো,
“খেতে চাও কি সিঙ্গারা, বাড়াতে চাও শক্তি? তাহলে চলে আসো মিষ্টিবাবুর ছোট্ট দোকানে। সাথে আছে সমুচা। মুখে দিলে যেন লেগে থাকবে তারই স্বাদ, মিষ্টি বাবুর হাতে জাদু, টক-ঝাল-মিষ্টি কোথাও নেই খাত। আসো আসো। খেতে আসো।”

স্কুলের মেয়ে সমুচা বিক্রি করছে এটাই যেন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসাহ বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ক্লাসের কয়েকজন শিক্ষক এসে সমুচা কিনে নিলো। গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন অভিভাবকও কিনে নিলেন, শিক্ষার্থীরা তো ভীড় লাগিয়ে দিয়েছে। হাঁড়িতে আর একটাও অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু এখনো ভীড় কমে নি। এদিকে তাহমিদ শতাব্দীর দিকে শুধু তাকিয়ে আছে। শতাব্দী পুরো টাকা আর খালি হাঁড়ি তাহমিদকে দিয়ে বলল,
“মিষ্টিমশাই সব ক’টা বিক্রি হয়ে গেছে।”

তাহমিদ মুচকি হেসে বললো,
“ধন্যবাদ শতাব্দী।”

“ধন্যবাদ দিলে হবে না।”

“কি চাও তুমি?”

“আমি সময় চাই মিষ্টি মশাই। আমার জন্য কি তোমার কাছে সময় হবে?”

“হ্যাঁ, কেন হবে না? অবশ্যই হবে।”

শতাব্দী তাহমিদের হাত ধরে বলল,
“তাহলে চলো আমার সাথে।”

শতাব্দী তাহমিদকে নিয়ে একটা খালি উদ্যানে ঢুকলো। যার চারপাশে সবুজ ঘাস। উদ্যানের শেষে একটা পুকুর। আর তার সাথে লাগানো একটা বটবৃক্ষ। শতাব্দী একপাশে তার স্কুল ব্যাগ আর তাহমিদের হাঁড়ি আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখলো। এরপর তাহমিদের হাত ধরে চলে গেলো পুকুরের পাশে। বটবৃক্ষের মোটা শেকড়ের মধ্যে দু’জনই বসে পড়লো। আর স্থির দৃষ্টিতে পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে রইলো।

তাহমিদ হঠাৎ বলল,
“আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায় আমরা নিজেরাও জানি না। কিন্তু অরুণিকার জন্য আমি সব সহ্য করতে প্রস্তুত।”

শতাব্দী তাহমিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অরুণিকাকে খুব ভালোবাসো তাই না?”

“হ্যাঁ। আমার কোনো বোন ছিল না। ও আমার আপন বোন না। আমি চাইলেও ওকে বোন বলতে পারবো না। সম্পর্কের কিছু দেয়াল আছে, সেটা আজীবন থেকে যাবে। কিন্তু আমি কি অনুভব করি, এটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।”

“তুমি কি অনুভব করো, আমায় বলবে?”

“কাকে নিয়ে?”

“অরুণিকাকে নিয়ে!”

“বোনের মতোই। ও আমার কাছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আগেও একসাথে ছিলাম। দেশে একই এলাকায় আমাদের বাড়ি ছিল। বিকেলে ও ওর বয়সী বাচ্চাদের সাথে খেলতে বের হতো। আর আমি ওকে দেখতাম। মাঝে মাঝে চোখেও পড়তো না। আমি কখনোই ভাবি নি ও আমার কাছে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাবে। একই সাথে থাকতে থাকতে ওর প্রতি মায়া জমে গেছে।”

দু’জনই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। হঠাৎ শতাব্দী বললো,
“আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি?”

“হুম, করো।”

“কাউকে বারবার দেখার ইচ্ছে, কারো সাথে কথা বলতে চাওয়া, বেশি সময় কাটাতে চাওয়া, এসবের কি কোনো নাম আছে? এসবের কারণ কি!”

তাহমিদ শতাব্দীর দিকে তাকালো। ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার মধ্যে কি এসব চলছে নাকি!”

শতাব্দী হেসে বলল, “অনেকটাই।”

তাহমিদ গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কে সে?”

“আছে কেউ। তুমি চিনবে না।”

তাহমিদ চুপ করে রইলো। তার ভেতর থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো।

শতাব্দী আবার বলল,
“আরেহ আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”

তাহমিদ বলল,
“আমার তো এমন কখনো হয় নি, তাই আমি বুঝতে পারছি না। তবে কাউকে ভালো লাগলেই এমন অনুভূত হয়।”

“তাহলে কি আমি তাকে পছন্দ করি?”

তাহমিদ বলল,
“তোমার এসবের বয়স হয় নি।”

শতাব্দী তাহমিদকে হালকা ধাক্কা দিলো। তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। শতাব্দী শব্দ করে হাসলো। তাহমিদও মাথা নামিয়ে মুচকি হাসলো। শতাব্দী তার গালে হাত দিয়ে বলল,
“অনেক লেগেছে, তাই না?”

তাহমিদ হাত সরিয়ে দিলো। শতাব্দী বলল,
“তুমি কি জানো, তোমার হাসি খুব সুন্দর!.ছেলেরা এতো সুন্দর করে হাসতে পারে!”

তাহমিদ এবার শব্দ করে হাসলো। আর বলল,
“চলো বাসায় যাই।”

“হুম, হুম লজ্জা পাচ্ছো, তাই না? এখন মেয়েদের মতো লম্বা চুল থাকলে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলতে চলো বাসায় যাই, আমার লজ্জা করছে। তারপর লজ্জায় মুখ হাত দিয়ে ঢেকে দিতে।”

তাহমিদ উঠে দাঁড়ালো। আর শতাব্দীকেও টেনে তুললো। এরপর বুকে হাত গুঁজে বলল,
“তোমার প্রশংসা শুনে আমি লজ্জা পাই না। আমি মনোবল পাই। এখন যে বললে আমার হাসি সুন্দর, ভাবছি এখন থেকে দাঁত বের করে হেসে নাস্তা বিক্রি করবো৷ দেখবে সবাই পইপই করে ছুটে আসবে, আর আমার নাস্তা কিনে নেবে। মেয়েদের দেখে আরো বেশি হাসবো।”

শতাব্দী তাহমিদের বাহুতে একটা ঘুষি দিয়ে বলল,
“তুমি মিষ্টি মশাই থেকে দিন দিন দুষ্টুমশাই হয়ে যাচ্ছো। এখন বাড়ি চলো। আর রাতে মাছ ভাজা করলে আমাকে ডেকো। আমি দেখেছি গায়ক সাহেব মাছ কিনে এনেছে। আমি রাতে তোমাদের সাথে খাবো।”

তাহমিদ আর শতাব্দী গল্প করতে করতে তাদের গন্তব্যে যেতে লাগলো। শতাব্দীর কাঁধে ব্যাগ, হাতে তাহমিদের আনা হাঁড়ি। আর তাহমিদের হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ। তারা ঘাসের উপর হাঁটছে। মৃদু বাতাস ঘাসে আলোড়ন ছড়াচ্ছে। সেই আলোড়নে আলোকিত হয়ে আছে দুটি মানুষ ও তাদের অনুভূতি।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here