অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-২৩||

0
1281

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৩||

৪০.
অরুণিকা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে বলল,
“আমি বাসায় যাবো। আমাকে যেতে দিন।”

ছেলেটি অট্টহাসি দিয়ে বলল,
“যদি যেতে না দেই কি করবে?”

বাঁধন পেছন থেকে এসে অরুণিকার সামনে দাঁড়ালো। অরুণিকা বাঁধনের দিকে তাকিয়ে রইলো। বাঁধন অপরিচিত ছেলেটিকে বলল,
“ভাইয়া, এই মেয়ের জন্য আহনাফ ভাই আর তাহমিদ ভাই সেদিন আমাকে মেরেছিল। ওর জন্য বাবা-মা আমাকে মেরেছে। এখনো বাবা আমাকে ওই বিষয় নিয়ে বকা দেয়। স্কুলে পাশ করি নি, তাই বাবা পুরো মহল্লার সামনে আমাকে পিটিয়েছে। আর বলেছে আমার মগজে নাকি সব নোংরামি, তাই পরীক্ষার ফল খারাপ এসেছে। এর আগে কখনোই বাবা আমাকে বকে নি। ওর জন্য আমি মার খেয়েছি। ভাইয়া, এই মেয়েকে একটা শাস্তি দাও। এতো মাস আমি সুযোগ পাচ্ছিলাম না। আজ সুযোগ হয়েছে।”

আগন্তুক ছেলেটি সাড়ে এগারো বছরের ছেলে বাঁধনের মুখে এমন কথা শুনে অবাকই হলো। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি ছেলেদের উদ্দেশ্য করে বলল,
“বাঁধন বড় হলে ওকে আমাদের গ্রুপে নেবো। এর দ্বারাই চাঁদাবাজি সম্ভব।”

বাঁধন হেসে বলল,
“ভাইয়া আমি যাই এখন। ওর বেনামি পরিচালকগুলো আসার খবর পেলে তোমাকে জানিয়ে দেবো।”

মহল্লার বাইরে থেকেই অরুণিকাকে টেনে নিয়ে গেলো আশিস। আশিস পাশের এলাকায় থাকে। সারাদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে চাঁদাবাজি করবে, আর স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের উত্যক্ত করে সময় পার করবে। রাতে জুয়া খেলবে বা মাতাল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকবে। আশিস অরুণিকাকে নিয়ে যাওয়ার সময় মাওশিয়াত রিকশা থেকে নামলো। মাওশিয়াত অরুণিকাকে আশিসের সাথে দেখে দৌঁড়ে এলো। ক্ষুব্ধ কন্ঠে আশিসকে বলল,
“এই ছেলে, ওকে ছাড়ো৷ কি করছো তুমি?”

আশিস কলার উঠিয়ে মাওশিয়াতের মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“তুমি কে? রাস্তা ছাড়ো। নয়তো তোমাকেও তুলে নিয়ে যাবো।”

পাশের ছেলেটি বলল,
“আশিস ভাই, শেষ কথাটা ফেলে না দেওয়ায় ভালো।”

মাওশিয়াত রাগী কন্ঠে বললো,
“আগে হাত লাগিয়ে দেখাও। তারপর বুঝিয়ে দেবো আমি কি জিনিস।”

ছেলেটি মজার ছলে মাওশিয়াতের গায়ে হাত লাগাতেই মাওশিয়াত ছেলেটির গালে চড় লাগিয়ে দিলো। আশিস ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল,
“এই মেয়েকে ধর।”

মাওশিয়াত আশিসের নাক বরাবর ঘুষি মারতেই আশিস নাক ধরে দূরে সরে দাঁড়ালো। বাকি ছেলেগুলো মাওশিয়াতকে ধরতে এলেই, সে কয়েকটা ঘুষি দিয়ে তাদের মাটিতে ফেলে দিলো। অরুণিকা হাঁ হয়ে মাওশিয়াতকে দেখছে। আশেপাশে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। শতাব্দী স্কুল থেকে ফিরে মাওশিয়াতকে মারপিট কর‍তে দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। অরুণিকা শতাব্দীর কাছে দৌঁড়ে এসে বলল,
“শতু আপু, মাওশিয়াত আপু ওদের মারছে। তুমিও মারো।”

শতাব্দী অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“কিন্তু মারছে কেন?”

“ছেলেগুলো বাঁধনের কথায় আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছিল।”

শতাব্দী রাগী দৃষ্টিতে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে তার ব্যাগ দিয়েই ছেলেগুলোকে পেছন থেকে মারতে লাগলো। তাদের মধ্যে একটা ছেলে শতাব্দীর চুল ধরে তাকে মাটিতে ফেলে দিলো। আর তখনই শতাব্দী উঠে দাঁড়ালো। এরপর চেঁচিয়ে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের উদ্দেশ্য করে বললো,
“ইশ, এই গুলো মানুষ নাকি উল্লুক। এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে এদের গণ ধোলাইয়ের জন্য এগিয়ে আসুন। একটা মেয়ে মারছে, আর আপনারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন? নির্লজ্জ কোথাকার।”

লোকগুলো শতাব্দীর কথা শুনে এগিয়ে আসতে যাবে তখনই আশিস পালিয়ে গেলো। আশিসকে পালাতে দেখে বাকিরাও পালালো। এরপর অরুণিকা আর শতাব্দী মাওশিয়াতের কাছে এলো। অরুণিকা বলল,
“আপু, তুমি ওদের কিভাবে মেরেছো? তোমার এতো শক্তি? তোমার কাছে কি পাওয়ার আছে?”

মাওশিয়াত হেসে বলল,
“আমি তোমার বয়স থেকেই জুডো শিখেছি।”

“জুডো কি?”

“তুমি যেমন ছবি আঁকার জন্য ড্রয়িং ক্লাসে যাও। শতাব্দী যেমন নাচ শেখার জন্য নৃত্যের ক্লাস করে, তেমনি এমন বদমাশ ছেলেদের মারার জন্য আমি জুডো শিখেছি।”

শতাব্দী অবাক হয়ে বলল,
“মাওশিয়াত দিদি, তুমি আসলেই জিনিয়াস। ইমন তোমার কথা বলেছিলো।”

মাওশিয়াত বলল,
“কি বলেছিল ইমন?”

“বলেছে তুমি দেখতে যেমন সুন্দরী, পড়াশুনায়ও অনেক ভালো। আর তোমার কথাবার্তা শুনলে শুনতেই ইচ্ছে করবে। আর এখন দেখছি তুমি মারামারিও করতে জানো।”

মাওশিয়াত অরুণিকার হাত ধরে তাকে বাসায় নিয়ে এলো। এরপর তিনজন একসাথে মেঝেতে বসলো। মাওশিয়াত অরুণিকাকে জিজ্ঞেস করলো,
“ইমন কোথায়?”

“ও তো অনেক দেরীতে বাসায় আসে।”

“ইভান!”

“ইভান তো অনেকদিন বাসায় আসে না। জানো আপু, ইভান আর ইমন আঁড়ি নিয়েছে। ওরা এখন আর কথা বলে না।”

“আরাফ আর তাহমিদ কোথায়?”

শতাব্দী বলল,
“তাহমিদ তো এই সময় রেস্টুরেন্টে থাকে। ওখানে কাজ নিয়েছে তো। আর আরাফ হয়তো টিউশন করাতে গেছে।”

অরুণিকা বলল,
“সবাই সন্ধ্যায় বাসায় আসে। কেউ কেউ রাতে।”

মাওশিয়াত অরুণিকার গালে হাত রেখে বলল,
“আর তুমি বাসায় একা থাকো?”

“হ্যাঁ। অন্ধকার হওয়ার আগেই তাহমিদ চলে আসে। আমার তো অন্ধকারে ভয় লাগে। আর এর আগে আমি বাসায় এসে টিভি দেখি।”

মাওশিয়াত ইভানকে ফোন করে বলল,
“আজ তোমাদের অবহেলার জন্য অরুণিকা অনেক বড় একটা বিপদে পড়তে যাচ্ছিলো। ভাগ্যিস ইমনের সাথে দেখা করার জন্য এখানে এসেছিলাম। ওকে একা রেখে তোমরা কোথায় থাকো?”

ইভান ফোন রেখেই টিউশন থেকে বেরিয়ে পড়লো। বাকিদেরও মেসেজ করে জানালো। সবাই কাজ ফেলেই বাসায় চলে এলো। আহনাফ সেই মুহূর্তে যতির সাথে ছিল। তাই সেও আহনাফের সাথে বাসায় চলে এলো। বাসায় এসে সব শোনার পর আরাফ অরুণিকার দুই হাত ধরে বলল,
“এগুলো ক’দিন ধরে হচ্ছে?”

অরুণিকা বলল,
“অনেকদিন। মুরাদ আর ওর বন্ধুরা আমাকে অনেকদিন ধরেই বিরক্ত করছিলো। কিন্তু এই ছেলেটা আজই এসেছে।”

ইভান রাগী কন্ঠে বলল,
“তাহলে এতোদিন আমাদের বলো নি কেন?”

অরুণিকা মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মাওশিয়াত রাগী কন্ঠে বললো,
“ওকে বকছো কেন? তোমাদের তো ওর যত্ন নেওয়ারও যোগ্যতা নেই। এতোদিন ভেবে এসেছি তাহমিদ ওর আপন ভাই। কিন্তু এখন শতাব্দী থেকে জানলাম তোমরা কেউই ওর ভাই না।”

যতি কথাটি শুনে অবাক হলো। যতি বলল,
“অরুণিকা তোমাদের আপন বোন না? আহনাফ, তাহলে তুমি আমাকে মিথ্যে কেন বলেছো?”

ইমন বলল,
“আমরা এসব কথা কাউকে জানায় নি। মহল্লার কেউই জানে না। শুধু শতাব্দীরা, আর চাচা-চাচীরা জানে।”

“শতাব্দী, জানলে আমিও জানতে পারতাম। আমি তো আহনাফের গার্লফ্রেন্ড। আহনাফ আমার কাছ থেকে এতো বড় সত্য লুকিয়েছে কেন?”

আহনাফ রাগী কন্ঠে বলল,
“আল্লাহর ওয়াস্তে তুমি চুপ থাকো। আমার মাথা খেও না। এই মুহূর্তে তোমার এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় আমার কাছে নেই।”

তূর্য হাঁটু গেড়ে অরুণিকার সামনে বসে বলল,
“টুইংকেল, তুমি আমাদের বলো নি কেন?”

অরুণিকা একবার আরাফের দিকে তাকালো, আরেকবার তূর্যের দিকে। তারপর বলল,
“তুমি আর আরাফ আগে আমার সাথে গল্প করতে, তাই না?”

তূর্য মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”

“এখন তো করো না। বাসায়ও থাকো না। যখন আসো, তখন আমি ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে স্কুলে চলে যাই, আর সময় পাই না৷ আমি তো বাসায় একাই থাকি। তোমরা বাসায় আসলেও আমার কথা শুনো না। আমি কিভাবে বলবো?”

আরাফ একপাশে বসে রইলো। তার এই মুহূর্তে নিজের উপর রাগ হচ্ছে। কলেজ ছুটির পর সে দুই ঘন্টা সময় পায়। কিন্তু সে তখন সায়ন্তনীর দোকানে সময় কাটিয়ে আসে। সেই মুহূর্তে চাইলে সে বাসায় এসে অরুণিকার সাথে সময় কাটাতে পারতো।

আহনাফ অরুণিকার গালে হাত রেখে বলল,
“আমি তোমাকে আর এক সেকেন্ডও একা থাকতে দিবো না। ক্লাস শেষে বাসায় চলে আসবো।”

যতি কথাটি শুনে মনে মনে ক্ষেপে গেলো। নিজের মনেই বলল,
“অরুণিকা আহনাফের আপন বোন নয়৷ তবুও ও সারাদিন অরুণিকার কথা বলবে। তাহলে আহনাফ কি অরুণিকাকে নিয়ে অন্য চিন্তা করে? আমার এদের আলাদা করতেই হবে। নয়তো আহনাফ যদি ওর সাথে থাকতে থাকতে ওকে ভালোবেসে ফেলে? মনের উপর তো কারো জোর নেই। বাকিদের এমন অনুভূতি সৃষ্টি হলে কোনো সমস্যা নেই৷ কিন্তু আহনাফ তো আমার বয়ফ্রেন্ড। আমি এই অরুণিকাকেই এদের থেকে আলাদা করে দেবো। ও এই বাসায় আহনাফের সাথে কখনোই থাকতে পারবে না।”

এদিকে যতিকে বাসায় পৌঁছে না দিয়ে আহনাফ বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। যতি মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও সে প্রকাশ করলো না। বাকিরা মাওশিয়াতকে ধন্যবাদ দিলো। মাওশিয়াত ইমনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ইমন, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভালো হতো যদি আমাকে বাসায় দিয়ে আসতে।”

ইমন ইভানের দিকে তাকালো। ইভান চুপচাপ অন্যদিকে সরে দাঁড়ালো। ইমন বলল,
“আমি মাত্র বাসায় এসেছি। এখন একটু বিশ্রাম নিতে হবে।”

বাকিরা ইমনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমন আরাফকে বলল,
“আরাফ, ওকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে আসতে পারবি?”

আরাফ মাওশিয়াতকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। মাওশিয়াত যাওয়ার আগে একবার ইমন আরেকবার ইভানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“আমার জন্য তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে, তাই আমিই এই ঝামেলা দূর করবো। তুমি অনেক ভালো, ইমন। দেরীতে হলেও আমি বুঝেছি, মাঝে মাঝে যারা আমাদের ভালোবাসে, আমাদের যত্ন নেয়, তাদেরই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এক পাক্ষিক ভালোবাসা কষ্টের হলেও এখানে কোনো শান্তি নেই। ইভানকে ভালোবেসে আমি শান্তি পাই নি। যতোটা শান্তি তোমাকে নিয়ে ভেবে পাচ্ছি, ইমন।”

এদিকে তূর্য বাসা থেকে বেরিয়ে আহনাফকে ফোন করলো। আহনাফ বলল,
“আমি মুরাদকেও ছাড়বো না। ওই আশিসকেও ছাড়বো না।”

তূর্য বলল,
“তুই একা না। আমিও ছাড়বো না। কোথায় আছিস বল। আজই ওদের উচিত শিক্ষা দেবো।”

আহনাফ আর তূর্য দু’জন মিলে প্রথমে মুরাদ ও তার সঙ্গীদের মারলো। তারপর আশিসকে মারতে গেলো। আশিসের সঙ্গপাঙ্গও ইচ্ছে মতো আহনাফ আর তূর্যকে পিটিয়েছে। কেউ কাউকে ছাড়ে নি৷ রাত দশটায় মার খেয়ে একেবারে মুখ ফুলিয়ে বাসায় এলো তূর্য আর আহনাফ। বাকিরা তাদের দেখে অবাক হলো। আহনাফ বলল,
“এই মার কিছুই না। এগুলো অরুর দিকে খেয়াল না রাখার শাস্তি। কিন্তু আশিস আর মুরাদ ওই দুইটা এক সপ্তাহ আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না।”

তাহমিদ বলল,
“আশিসের কথা বাদ দিলাম। কিন্তু মুরাদের বাবা-মা যদি মামলা করে দেয়?”

তূর্য বলল,
“করুক মামলা। জেল হবে আর কি। শাস্তি পাবো, সমস্যা নেই। ওদের মেরেই এখন শান্তি লাগছে। মারতে না পারলে আজ রাতে ঘুমাতে পারতাম না। কাল সকালে ওই বাঁধনকে ধরতে হবে। ও তো এখন বাসা থেকেই পালিয়েছে।”

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here