#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৬||
৪৩.
নতুন বাসায় আসার পর থেকেই সবারই ভালো সময় যাচ্ছে। তাহমিদের বেতন বেড়েছে। তূর্যের শেষ গানটি ভাইরাল হয়ে গেছে। এখন ইউটিউবে তার গানগুলোতে ভালোই ভিউ হচ্ছে। সে এবার নিজের লেখা গানেও সুর দিতে যাচ্ছে। নতুন গানটি নিয়ে কাজ করা পুরোপুরি সম্পূর্ণ হলে সে একটা ছুটি নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। এদিকে আরাফ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে। পাশাপাশি অনেকগুলো ছাত্র-ছাত্রীকে সে একসাথে পড়াচ্ছে। ইভান এবং আহনাফ দু’জনই পড়াশুনার পাশাপাশি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে। আর ইমন বিভিন্ন ক্লাবে ফুটবল খেলে মোটামুটি আয় করতে পারছে। অরুণিকাও পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছে। তাদের ভালোই সময় কাটছে।
এদিকে তিন রুমের এই বাসায় পানির ট্যাংক থাকায় এখন আর তাদের পানি ধরার জন্যও ছুটোছুটি করতে হয় না। রান্নাঘরের পাশেই ড্রয়িংরুম। সেখানেই আরাফ আর ইভান মেঝেতে বিছানা করে থাকে। বাকি তিনরুমের একটি অরুণিকার। বাকি দুইটির একটিতে তূর্য আর ইমন, অন্যটিতে আহনাফ আর তাহমিদ থাকছে। তারা সিদ্ধান্ত নিলো, যেই কয়েক বছর তারা কলকাতায় থাকবে, এই বাসাটি আর পরিবর্তন করবে না। তাই তারা ঘরের জন্য আসবাবপত্র কেনার চিন্তাভাবনাও করলো। এখন তাদের একটি বড় ডায়নিং টেবিল, আর সাতটা চেয়ার প্রয়োজন। সেখানেই তারা বসে পড়াশুনাও করবে আবার খাওয়া-দাওয়ার কাজও সারবে। রান্নাঘরের জিনিসপত্র আগের বাসা থেকেই নিয়ে এসেছে। তবে এখন দুইটা আলমারি, আরেকটা ফ্রিজ কেনা প্রয়োজন। এতোদিন আলমারির পরিবর্তে বড় বড় ড্রামেই তারা কাপড় রেখেছিল। যেখানে কাপড়ের ভাঁজ একদমই ঠিক থাকতো না। তাই আলমারি অবশ্যই কিনতে হবে। এরপর বই রাখার জন্য একটা বুকসেল্ফ, আর অরুণিকার জন্য ছোট একটা খাট কেনার তালিকা করলো। এগুলো একটি একটি করে তারা প্রতিমাসে কিনবে।
এসবের তালিকা তৈরি করে বাজারের তালিকা করতে বসলো তূর্য। তখনই বেল বেজে উঠলো। ইমন দরজা খুলতেই শতাব্দী আর মাওশিয়াতকে দেখে অবাক হলো। ইমন মাওশিয়াতকে বলল,
“তুমি এতো সকাল সকাল?”
মাওশিয়াত কোনো উত্তর দিলো না। তারা দু’জনই বাসায় ঢুকলো। মাওশিয়াত পুরো ঘর ঘুরে ঘুরে দেখছে। আর শতাব্দী অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার ছোট সখীকে দেখতে এসেছি। কেমন আছো সখী?”
অরুণিকাও শতাব্দীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি ভালো আছি। আপু, জানো আমি তোমাকে অনেক মিস করি।”
“আমিও। জানিস তুই চলে আসার পর থেকে মহল্লায় ভূত নেমে এসেছে।”
“কি বলো? সত্যি?”
“হ্যাঁ। কেউ কারো সাথে কথা বলে না। সবাইকে কেমন স্বার্থপর মনে হয়। তাই এখানে এসেছি। এখানে তো আর ভালোবাসার অভাব নেই।”
তাহমিদ নাস্তা বানিয়ে মেঝেতে রাখলো। শতাব্দীকে দেখে সে চমকে উঠলো। শতাব্দী তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“অনেকদিন পর দেখা হলো।”
তাহমিদ মুচকি হাসলো। শতাব্দী এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“মিস শতাব্দী আসায় আমি খুব খুশি হয়েছি।”
তাহমিদ তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য বলল,
“বাণীতে তাহমিদ হোসেন।”
মাওশিয়াত বলল, “বাসাটা খুব সুন্দর।”
ইমন ততোক্ষণে নিজের ঘরে চলে গেছে। মাওশিয়াত এদিক-ওদিক তাকিয়ে ইমনকে খুঁজতে লাগলো। ইমনকে না দেখে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আরাফ ছাড়া কেউই মাওশিয়াতের সাথে এতোটা কথা বলে না। কারণ তার জন্য ইমন আর ইভানের মধ্যে এখনো সব কিছু পুরোপুরি স্বাভাবিক হয় নি। ইভান তার দিক থেকে অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু ইমনই ভাইয়ের সাথে কথা বলতে আগ্রহ দেখায় না। তাই ইভান একপ্রকার মানসিক অশান্তিতে ভুগছে। মাওশিয়াতকে দেখে সেও একপাশে সরে দাঁড়ালো।
সবাই শতাব্দীর সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলছে। মাওশিয়াত একপাশে চুপচাপ বসে আছে। ইমনকে নাস্তা করার জন্য ডাকা হলো। সে তাহমিদের পাশে বসে গেলো। একবারো মাওশিয়াতের দিকে তাকালো না। মাওশিয়াতের খুবই খারাপ লাগলো। যাদের বাসায় এসেছে, তাদের কেউই তার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নয়৷ শতাব্দী নিজের ঘরের মতোই সবাইকে খাবার প্লেটে তুলে দিতে লাগলো। মাওশিয়াতকে দিতে যাবে তখনই সে বলল,
“আমি খাবো না। আসলে বাবা আর মা বলেছিল একবার অরুণিকাকে দেখে আসতে। তাই এলাম। আমি চলে যাচ্ছি।”
কথাগুলো বলার সময় মাওশিয়াতের গলা কাঁপছিলো। ইমন তার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। মাওশিয়াত উঠতে যাবে, তখনই অরুণিকা তার হাত ধরে বলল,
“আপু, চলে যাচ্ছো কেন?”
মাওশিয়াত অরুণিকার থুতনি ধরে বলল,
“পরে আবার আসবো।”
আরাফ মাওশিয়াতকে আটকাতে যাবে তখনই আহনাফ তার হাত ধরে ফেললো। আরাফ ইশারায় বলল তাকে আটকাতে। আহনাফ ফিসফিস করে বলল,
“ওকে দেখে ইভান আর ইমন অনেক অপ্রস্তুত হয়ে গেছে৷ এখন ওর জন্য দুই ভাইয়ের মধ্যে আর ঝামেলা না হলেই ভালো। ওকে যেতে দেওয়া উচিত। কমনসেন্স থাকলে আর আসবে না।”
আরাফ বলল,
“অরুকে ফিরিয়ে আনার জন্য ওর বাবা আমাদের অনেক সাহায্য করেছিল।”
“হ্যাঁ, জানি। তাই ওর বাবাকে আমরা সম্মান করবো। ওকে নয়।”
শতাব্দী খাওয়া-দাওয়ার পর তাহমিদকে সাহায্য করার জন্য রান্নাঘর ঘুছিয়ে দিতে গেলো। তাহমিদ বারবার শতাব্দীকে চলে যেতে বলছিল। কিন্তু শতাব্দী কোনো ভাবেই শুনছে না। দু’জনই একপ্রকার ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিলো। শতাব্দীর মেজাজ খারাপ হতেই সে হাতে লেগে থাকা ফেনাগুলো তাহমিদের গালে লাগিয়ে রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে বেরুনোর সময় ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেলো। তাহমিদ সেখানে দাঁড়িয়ে শব্দ করে হাসতে লাগলো। তাহমিদকে হাসতে দেখে শতাব্দী বলল,
“তোমার জন্য আমি নিচে পড়ে গেছি, আর তুমি হাসছ?”
তাহমিদের হাসি বন্ধই হচ্ছে না। শব্দ শুনে বাকিরাও রান্নাঘরে এলো। দেখলো শতাব্দী মেঝেতে বসে আছে। তূর্য ওকে টেনে তুললো। তাহমিদ এবার নিজের হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো। তবে আপন মনে এখনো সে হাসছে। শতাব্দী তাহমিদের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে হঠাৎ কি ভেবে বাঁকা হাসি দিলো। তূর্যকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“গায়ক সাহেব, তোমাদের মিষ্টিমশাইয়ের বিছানাটা কোথায়?”
তাহমিদ কথাটি শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকালো। শতাব্দীর বাঁকা হাসি দেখে সে বুঝে ফেললো শতাব্দী কি করতে চাইছে। তাহমিদ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, না প্লিজ। এমন করো না। তূর্য, ওকে রুম দেখিয়ে দিস না।”
কিন্তু কে শুনে কার কথা। তূর্য শতাব্দীকে টেনে এনে বিছানাটা দেখিয়ে দিলো। তাহমিদ হাতে থাকা ফেনাগুলো পানি দিয়ে পরিষ্কার করে রান্নাঘর থেকে বেরুনোর আগেই শতাব্দী ধপ করে তাহমিদের বিছানায় শুয়ে পড়লো। তার পা দুটি উপরে উঠিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে রইলো। তাহমিদ ঘরে এসে শতাব্দীর কান্ড দেখে দাঁতে দাঁত চেপে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। শতাব্দী বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে নিচে নেমে পড়লো। তারপর তাহমিদের সামনে এসে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“মিষ্টিমশাই তোমার বিছানাটা তো নোংরা হয়ে গেছে। আমার পায়ে কতো ময়লা ছিল, জানো। মহল্লায় খালি পায়ে হেঁটে পায়ে জুতো লাগিয়ে একেবারে এই বাসায় এসেছি।”
তাহমিদ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে রাখলো। শতাব্দী তার হাত তাহমিদের মুখের সামনে নাড়াতে নাড়াতে বলল,
“আচ্ছা, যাচ্ছি আমি। টা টা।”
তাহমিদ তূর্যের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তূর্য দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে তাহমিদের সামনে থেকে চলে আসলো।
বিকেলে আহনাফ নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে ফোন চালাচ্ছিল। বাসায় তখন অরুণিকা ছাড়া কেউই ছিল না। অরুণিকা টিভি বন্ধ করে এদিক-ওদিক উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলো বাসায় কেউ আছে কি না। আহনাফ আর তাহমিদের রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো, আহনাফ বিছানায় শুয়ে আছে। সে আহনাফের সামনে এসে দাঁড়ালো। আহনাফ একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার ফোনে মনোযোগ দিলো। অরুণিকা বলল,
“তুমি আমাকে গেইম খেলতে দেবে?”
আহনাফ আঁড়চোখে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেবো না।”
অরুণিকা মলিন মুখে চলে যেতে নেবে তখনই আহনাফ তার হাত ধরে তাকে পাশে বসালো আর বলল,
“কি গেইম খেলবে?”
অরুণিকা খুশি হয়ে বললো,
“ওই যে ইমন খেলে, একটা ছেলে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে, ওইটা খেলবো।”
আহনাফ প্লে স্টোর থেকে গেইমটি নামিয়ে অরুণিকার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিল। অরুণিকাও মনোযোগ দিয়ে খেলতে লাগলো। আহনাফ এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। মুহূর্তেই অতীতের স্মৃতিগুলো তার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো।
অরুণিকা যেদিন জন্মেছিল তখন তাকে দেখতে মায়ের হাত ধরে সে হাসপাতালে গিয়েছিল। মেয়ে হয়েছে শুনে দাদা-দাদী অনেক খুশি হয়েছিল৷ কারণ তাদের কোনো মেয়ে ছিল না। আর তাদের প্রথম চার জনই নাতি ছিল। তাই অরুণিকার জন্ম পুরো পরিবারেই খুশির বন্যা বয়ে আনে। আরাফ তখন থেকেই বাচ্চাদের খুব পছন্দ করতো৷ অরুণিকাকে যখন প্রথম তার কোলে দেওয়া হয়েছিল, আরাফের ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে উঠেছিল। আরাফ আহনাফকে বলল,
“আহনাফ, দেখ। বাবুটা আমার কোলে এসে চুপ করে ঘুমিয়ে আছে।”
আহনাফ বলল,
“তুই খুব বোরিং মানুষ তাই ওর তোকে দেখেই ঘুম পেয়েছে।”
আরাফ আহনাফের কথা শুনে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর সে অরুণিকাকে হাসপাতালের বেডে শুইয়ে দিয়ে তার ছোট ছোট আঙ্গুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিলো। চাচী পেছন থেকে এসে আহনাফকে বলল,
“আহু, তুই নিবি না বাবুকে?”
আহনাফ দূরে সরে বলল,
“না না ও পিসু করে দিবে।”
আহনাফের কথা শুনে সবাই হাসতে লাগলো। এসব মনে পড়তেই আহনাফ আনমনে হেসে উঠলো। আহনাফকে হাসতে দেখে অরুণিকা তার দিকে তাকালো। আহনাফ তার হাতের আঙ্গুলে হাত বুলিয়ে বলল,
“অনেক বড় হয়ে যাচ্ছো।”
অরুণিকা বলল,
“তুমি এই জন্য হাসছো, আমি বড় হয়ে যাচ্ছি তাই?”
আহনাফ মুচকি হেসে মাথা নাড়লো। বলল,
“পুরোনো কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তাই হাসি পেয়েছে।”
মুহূর্তেই আহনাফের বুকটা কাঁপতে লাগলো। সেই মুহূর্তের সবার হাসিমাখা মুখটা তার আবার দেখতে ইচ্ছে করছে। সে বিছানা ছেড়ে উঠে টেবিলের ড্রয়ারে রাখা ছবির এলবামটি বের করলো। এলবামের শুরুতেই একটা ছবি আছে। আহনাফের চৌদ্দতম জন্মদিনে সবাই একই ফ্রেমে দাঁড়িয়ে এ ছবি উঠিয়েছিল। এই ছবিটি তার ফোনে ছিল। সে ছবিটি ফোন থেকে বের করেছে। ছবি বাঁধানোর সময় পায় নি, তাই এখনো ছবিটি এলবামে রয়ে গেছে। অরুণিকা এলবাম বের করতে দেখে তার দিকে দৌঁড়ে এলো। বলল,
“দেখি দেখি, আমাকে দেখি। আমি কোথায়?”
আহনাফ চাচার কোলে অরুণিকাকে দেখিয়ে বলল,
“এই তো তুমি।”
অরুণিকাকে জুবাইয়ের চৌধুরীকে দেখিয়ে বলল,
“এটা আমার বাবা।”
আহনাফের চোখ ছলছল করে উঠল। সে অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাবো না, অরু। তুমি আমার সাথে, মানে আমাদের সাথে, থাকবে তো সারাজীবন? আমাদের ফেলে চলে যাবে না তো!”
“আমি কেন চলে যাবো, বলো তো!”
আহনাফ বিড়বিড় করে বলল, “বিয়ে হলে!”
অরুণিকা আহনাফের কথা শুনতে পেলো না। সে বলল,
“আমি তোমাদের ফেলে যাবো না।”
আহনাফ মনে মনে বলল,
“এখন তো বলছো থাকবে, কিন্তু বড় হলে যদি তুমি থাকতে না চাও, অরু? এই মায়া তো একপাক্ষিক। তোমারও কি সেই মায়া থাকবে? তোমার কাউকে ভালো লাগতেই পারে। তখন? আগের কথা কি মনে রাখবে তুমি? যেই বাবাকে ছাড়া তুমি খাওয়া-দাওয়া করতে না, যেই মাকে ছাড়া তোমার ঘুম আসতো না, তাদের তো ভুলিয়েই দিয়েছি আমরা। অন্য কেউ এসে তখন যদি আমাদেরই ভুলিয়ে দেয়?”
অরুণিকা এলবাম থেকে চোখ উঠিয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কাঁদছো কেন?”
আহনাফ শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে নিলো। অরুণিকা কিছু একটা ভেবে বলল,
“ফোনাপুর জন্য? ও তো তোমাকে আর ফোন দেয় না।”
আহনাফের যতির কথা মনে পড়তেই রাগ উঠে গেল। সে ধমকের সুরে বলল,
“চুপ। যাও পড়তে বসো। সারাদিন টিভি, ফোন, নয়তো অন্য কিছু। যাও, পড়তে বসো।”
অরুণিকা এক ধমকে ভয় পেয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“এখন তো পড়ার সময় না।”
আহনাফ আরো জোরে ধমক দিয়ে বলল,
“তাও এখন পড়তে বসবে। যাও।”
অরুণিকা দৌঁড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। আহনাফ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। হঠাৎ তার চুক্তিনামার কথা মনে পড়ে গেলো। চোখে ভেসে উঠলো, সেই কাগজটি যেটিতে তার স্বাক্ষরের পাশে অরুণিকার কাঁচা হাতের স্বাক্ষর আছে। সে বিছানায় মাথা ফেলে দিয়ে চলন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো। আর মনে মনে বলল,
“অরু, আমার মনে অনেক প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর তুমি বড় হলেই আমাকে দিতে পারবে। এই উত্তর যতোদিন আমার কাছে আসবে না, আমি ততদিন মানসিক শান্তি পাবো না। কিন্তু সময় যতো বাড়ছে আমি ততোই দুর্বল হয়ে পড়ছি। আমি চাই না আমার এই দুর্বলতা তোমার জীবনে কোনো বাঁধা ফেলুক। আমি চাই, আমাদের অরু সুখে থাকুক। অতীতের সেই ভয়ংকর রাতের কথা যাতে কখনোই অরুর মনে করতে না হয়।”
এদিকে আরাফ সায়ন্তনীর পাশে বসে রইলো। সায়ন্তনী বলল, “কি ভাবছো?”
আরাফ বলল,
“কই! কিছু তো ভাবছি না।”
“আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি?”
“হুম করো।”
“ইমন কি এখনো মাওশিয়াতকে পছন্দ করে?”
আরাফ প্রশ্নটি শুনে সায়ন্তনীর দিকে তাকালো। সায়ন্তনী বলল,
“আমার আসলে ইমনকে জিজ্ঞেস করার মত সাহস নেই। ও যদি কিছু মনে করে।”
আরাফ বলল,
“ইমনের ব্যাপারে আমার চেয়ে ভালো তো সে নিজেই বলতে পারবে। তুমি ইমন কে জিজ্ঞেস করতে পারো। ও কিছুই মনে করবে না।”
“তোমাকে একটা কথা বলার ছিল!”
“হুম, বলো!”
“আমার না, ইমনকে ভালো লাগে।”
আরাফ এই কথা শুনে অবাক হলো না। সে আগে থেকেই জানতো সায়ন্তনী ইমনকে পছন্দ করে। কারণ তার হাবভাব দেখলেই বোঝা যেতো। সায়ন্তনী বাকিদের তুলনায় ইমনের ব্যাপারেই বেশি সচেতন ছিল। ইমনের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তার আলাদা সচেতনতা আছে, যা আরাফ লক্ষ্য করেছিল। চায়ে চিনি কম হলে ইমনের হাবভাব দেখে সায়ন্তনী চিনির পট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। অন্যদের ব্যাপারে এত উদ্বিগ্নতা সে কখনো লক্ষ্য করেনি।
সায়ন্তনী বলল, “তুমি কিছু বলবে না?”
আরাফ বলল,
“এখানে আমার বলার কি আছে? তোমার ভালো লাগতেই পারে।”
সায়ন্তনী মাথা নিচু করে মলিন মুখে বললো,
“ইয়ে মানে, আমি তো সাধারণ পরিবারের মেয়ে। চায়ের দোকান চালিয়ে আমাদের সংসার চলে। আমার বাবা নেই। একটা সময় মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতো। ভাই পড়াশোনার পাশাপাশি কারখানায় কাজ করে। আমার তো কোন যোগ্যতা নেই। স্কুল পর্যন্তই পড়েছি। বাকিটা হয়তো আর সম্ভবও না।”
আরাফ চুপ করে রইল। সায়ন্তনীর কোন যোগ্যতা আছে কি নেই তা সে কখনো ভেবে দেখেনি। হুট করেই তার ভালো লেগে গিয়েছিল মেয়েটিকে। ইমনেরও কি তার মতো সায়ন্তনীকে ভালো লাগতে পারে? এই প্রশ্নের জবাব আরাফ দিতে পারবে না। তাই সে আর কিছুই বলল না। শুধু সায়ন্তনীর দিকে তাকিয়ে রইল।
চলবে-