অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-২৭||

0
1312

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৭||

৪৪.
রহমত চাচার সাথে ফোনালাপ করে গভীর চিন্তায় পড়ে গেলো ইভান। ইভানকে চিন্তিত দেখে আহনাফ তার কাঁধে হাত রেখে তার পাশে বসলো। ইভান আহনাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল, তারপর বলল,
“রহমত চাচা ফোন দিয়েছেন।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আজকে চার মাস হয়ে গেছে, উনি কোনো টাকা পাঠান নি। এখন ফোন করে অজুহাত দেখানো ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।”

“উনি অজুহাত দেওয়ার জন্য ফোন করেন নি।”

“তো, কেন ফোন দিয়েছেন?”

“এসব বাদ দে। আগে বল, জুবাইয়ের আংকেল সেই রাতে একটা কাগজ দিয়েছিল, মনে আছে?”

“কোন কাগজ?”

“যেই কাগজে সব তথ্য ছিল। উনি সেদিন দিয়েছিল কাগজটা। কোথায় সেটা?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। কিন্তু পাঁচ বছর আগের কাগজ তুই এখন খুঁজছিস?”

“কাগজটা কি তুই খুলে দেখিস নি? আরাফ, তাহমিদ কেউই দেখে নি?”

“আমি তো দেখি নি। বাকিদের জিজ্ঞেস করে দেখ।”

ইভান চেয়ার ছেড়ে উঠে সবাইকে ডাকলো। একই প্রশ্ন বাকিদেরও করলো৷ কিন্তু কারোই সেই কাগজটির কথা মনে ছিল না। তখন তূর্য কিছু একটা ভেবে বলল,
“আমার মনে পড়েছে। আংকেল কাগজটা আহনাফের হাতে দিয়েছিল। আহনাফ তুই কাগজটা কোথায় রেখেছিস?”

আহনাফ ভেবে বলল,
“পকেটেই রেখেছিলাম। কিন্তু এরপর তো আর বের করা হয় নি।”

আরাফ বলল,
“আমি তো সেই কাগজটির কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছি। চাচ্চু বলেছিলেন, ওখানে কিছু তথ্য আছে।”

আহনাফ মলিন মুখে বললো,
“প্যান্টের পকেটে ছিল। সিলেট যাওয়ার পর প্যান্টটা ধুয়ে ফেলেছিলাম। তারপর কলকাতায় আসার পর থেকে আর সেই প্যান্ট পরা হয় নি৷ আমি ড্রামেই রেখে দিয়েছিলাম হয়তো।”

তাহমিদ বলল,
“আর আমি সেই ড্রামে থাকা সব পুরোনো কাপড় বিক্রি করে দিয়েছি।”

সবাই তাহমিদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। তাহমিদ আবার বলল,
“সেই মাসে ঘর চালানোর মতো কোনো টাকাই ছিল না। অরুণিকা অনেকদিন ধরে মাংস খেতে চাইছিল। মাংস কেনার জন্যই আমি জামাগুলো বিক্রি করে দিয়েছিলাম। আর আমি তোদের জিজ্ঞেসও করেছিলাম। তোরাই বলেছিস এসবের প্রয়োজন নেই। আর জামাগুলো অনেক ছোটও হয়ে গিয়েছিল।”

ইমন মলিন মুখে বলল,
“তাহলে কি আমরা নিজেদের ভুলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি হারিয়ে ফেলেছি?”

আরাফ এবার ইভানকে জিজ্ঞেস করলো,
“ইভান, তুই হঠাৎ কাগজটির কথা বলছিস কেন?”

ইভান বলল,
“পাঁচ বছর আগে আমবাগানে দাঁড়িয়ে রহমত চাচা বলেছিলেন, আমাদের বাড়ির কয়েকজন দারোয়ান, মৈত্রী গ্রুপের কিছু সদস্য, পরিচিত কিছু মানুষ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। তারপর সিলেটে যাওয়ার পর বলেছিলেন, অরুণিকার মামা আর আমাদের শত্রুপক্ষ মির্জা গ্রুপ এর সাথে জড়িত আছে। আজ বলছে, বাস্কার গ্রুপের মালিক রিয়াজুর রহমানও জড়িত আছেন।”

ইমন বলল,
“উনি কি আমাদের পাগল করে ফেলবেন নাকি?”

“এখানে আমাদেরই কিছু একটা বুঝতে ভুল হচ্ছে। এমনিতেই মির্জা গ্রুপ সেই সময় থেকেই আমাদের শত্রুপক্ষই ছিল। এর আগেও কয়েকবার তাদের সাথে অনেক ঝামেলা হয়েছিল। আমাদেরই কোম্পানির একজন মহিলা কর্মচারীকে অপহরণ করে ফেলেছিল। তাই মির্জা গ্রুপের উপর আমার শুরু থেকেই সন্দেহ আছে।”

আহনাফ বলল,
“রিয়াজুর রহমান তো আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন।”

তূর্য বলল,
“আমাদের বাড়িতেও এসেছিল। উনার সাথে বাবার অনেক ভালো বন্ধুত্ব ছিল।”

ইভান বলল,
“আর মৈত্রী গ্রুপের কাউকেই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে না। কারণ গ্রুপের সবাই আমাদের পরিবার থেকেই ছিল। আর সবাইকেই খুন করে ফেলা হয়েছে।”

আরাফ বলল,
“গ্রুপের দুইটা অংশ ছিল। প্রথম অংশটার দায়িত্ব জুবাইয়ের চাচ্চুর হাতে ছিল, দ্বিতীয় অংশটা ইমতিয়াজ আংকেলের হাতে ছিল।”

ইমন বলল,
“হ্যাঁ, বাবা দেখেশুনেই সব কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন। আমি বাবার সাথে অনেক বার অফিসে গিয়েছিলাম। সবাই অনেক মিশুক ছিল। আমার তো কাউকেই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে না।”

ইভান বলল,
“আমার কথা তোরা কেউই ধরতে পারিস নি।”

সবাই ইভানের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। ইভান বলল,
“রহমত চাচা অনেক কিছুই জানেন, যা আমরা জানি না। উনি আমাদের সেদিন বাঁচিয়েছেন, অথচ অনেক কিছুই লুকাতে চাইছেন৷ আমি বুঝতে পারছি না, উনি আসলে কি কর‍তে চান। আর কাগজটার ব্যাপারে উনিই আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন। উনি আমার কথা শুনেই বুঝেছেন, আমরা সেই কাগজ পাই নি। আমার কাগজটার কথা ফোন রাখার পর মনে পড়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে আমি একটা বিষয় খেয়াল করেছি।”

আরাফ বলল,
“কি বিষয়!”

“প্রথমত উনি কিভাবে জানলেন, আমাদের একটা কাগজ দেওয়া হয়েছিল? আর আরেকটা বিষয় খেয়াল করলাম, আমরা কাগজটা পাই নি জানার পর উনার কন্ঠে একটা স্বস্তি ছিল। আর এই স্বস্তির জন্যই আমার এখন রহমত চাচাকে সন্দেহ হচ্ছে।”

তূর্য বলল,
“তুই কি বোঝাতে চাইছিস, ইভান? উনিই এসবে জড়িত ছিল? কিন্তু উনিই তো আমাদের বাঁচিয়েছেন!”

“এটাই তো আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আমরা একটা গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেছি। আরেকটা ব্যাপার আমি খেয়াল করলাম।”

“কি!”

“অরুণিকা আর ইমনের ব্যাপারেই উনার যতো মাথা ব্যথা। যতোবার ফোন দেয় অরুণিকার বয়স জিজ্ঞেস করেন। আর ইমন কি করছে এসব জানতে চান। বাকিদের কথা আলাদা ভাবে জিজ্ঞেস করেন না। কিন্তু কেন?”

ইমন ভাব নিয়ে বলল,
“আমরা বয়সে ছোট তাই হয়তো!”

“মোটেও না। এখানেও কিছু একটা আছে। যা আমি বুঝতে পারছি না।”

“এখন কি আমরা খুনিদের খুঁজে পাবো না?”

“অবশ্যই পাবো। কিন্তু পাঁচ বছর আগে যদি এতোটুকু বুদ্ধি থাকতো, পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে অনেক কিছুই আন্দাজ করতে পারতাম। আমাদের কি বিশ্বাস করার মতো কেউই নেই? আমাদের আত্মীয়-স্বজন সবাই তো আর সেদিন খুন হয় নি। অনেকেই তো ছিল বাইরে। তারাও কি এখনো বেঁচে আছে?”

তাহমিদ বলল,
“কাদের কথা বলছিস?”

“আরাফ, আহনাফ, অরুণিকা আর তোর নানার পরিবারের অনেকেই আছে। তূর্যের দাদার ভাইয়ের পরিবার আছে। ওরাও তো আত্মীয়! আমাদের না হয় নানার বাড়ির সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না। তোদের তো আছে।”

তূর্য বলল,
“ওদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। একদিন বিয়ের দাওয়ার দিতেই বাবার একজন চাচাতো ভাই এসেছিলেন। ওরা তিন ভাই ছিল। তার মধ্যে একজন অনেক আগেই মারা গিয়েছিল। বাকি দুইজনের মধ্যে যার বিয়ের দাওয়াত দেওয়ার জন্য তারা এসেছিল, সেও মারা গিয়েছে। ছোটটাকে আমরা কখনোই দেখি নি। উনি বাইরের দেশে থাকতেন।”

আহনাফ বলল,
“আমার নানার পরিবারে মায়ের একজন ফুফুই আছেন। আর তার ছেলে। ওদের সাথেও বিয়ের পর মা আর তেমন যোগাযোগ রাখে নি। রাখলেও আমি হয়তো জানি না। বাসায় তো কখনো আসতে দেখি নি। আর আমাদের পরিবারের কারোই তো বিয়ে হয় নি। একটা অনুষ্ঠান বা দাওয়াত পড়লে বোঝা যেতো কতো আত্মীয় আছে।”

আরাফ বলল,
“মায়ের মৃত্যুর পর নানুর পরিবারের কেউই আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখে নি। ওরা সবাই দাদু আর বাবাকে মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে করতো। কারণ মা ঘরের বড় বউ ছিলো। তাই নিষেধ করার পরও অনেক কাজ করতো। আমার জন্মের সময় মা অনেক দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন। এখানে দাদু আর বাবার কোনো দোষ ছিল না। এরপর ওরা আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু বাবা আমাকে যেতে দেয় নি।”

এবার তাহমিদ বলল,
“আমার নানুর পরিবারের তো অনেকেই আছে। আমাদের তো প্রায়ই যাওয়া আসা হতো। কিন্তু হঠাৎ একদিন মায়ের সাথে মামার একটা ঝামেলা হয়। এরপর আর যাওয়া হয় নি৷”

ইভান জিজ্ঞেস করলো, “কি ঝামেলা?”

“জানি না। আমাকে তো জানানো হয় নি। আমি ওদের কথাবার্তা শুনে এতোটুকু বুঝেছি ঝামেলা একটা হয়েছে।”

“তাহলে তোর মামাও জড়িত থাকতে পারে।”

তাহমিদ রাগী কন্ঠে বললো,
“ইভান, কি বলছিস এসব? ওরা মানুষ খুন করার মতো হিংস্র নয়।”

সন্দেহের তালিকায় অনেকেই আছে। কিন্তু কারণগুলো মানুষের জীবন নেওয়ার মতো নয়। কারো জীবন কেঁড়ে নেওয়া এতোটা সহজ বিষয় না। হাসিমুখে কারা পিঠে ছুরি চালিয়ে দিতে পারে, তা বোঝা অনেক কঠিন।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here